লগইন করুন
১৭- نفي الشريك عن الله تعالى
১৭- আল্লাহ তাআলার কোন শরীক নেই:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿وَقُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَلَمْ يَكُن لَّهُ شَرِيكٌ فِي الْمُلْكِ وَلَمْ يَكُن لَّهُ وَلِيٌّ مِّنَ الذُّلِّ وَكَبِّرْهُ تَكْبِيرًا﴾
‘‘আর বলো, সেই আল্লাহর প্রশংসা, যিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেন নি৷[1] তাঁর সার্বভৌমত্বে কোনো অংশীদার নেই। তিনি দুর্দশাগ্রস্ত হন না, যে কারণে তাঁর কোনো সাহায্যকারীর প্রয়োজন হতে পারে। তাঁর যথাযথ বড়ত্বব বর্ণনা করো’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ১১১) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
﴿يُسَبِّحُ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾
‘‘আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে তার সবই আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করছে৷ একচ্ছত্র সাম্রাজ্য তাঁরই এবং তাঁরই জন্য সকল প্রশংসা। তিনিই সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান’’। (সূরা তাগাবুনঃ ১) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
﴿تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَىٰ عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَلَمْ يَكُن لَّهُ شَرِيكٌ فِي الْمُلْكِ وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيرًا﴾
‘‘বরকতময় তিনি, যিনি তারঁ বান্দার উপর ফুরকান নাযিল করেছেন, যাতে তিনি বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হতে পারেন। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব তাঁরই। তিনি কাউকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন নি। সার্বভৌম ক্ষমতায় তাঁর কোন শরীক নেই এবং তিনি প্রত্যেক জিনিষ সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তার একটি তাকদীর নির্ধারণ করে দিয়েছেন’’। (সূরা ফুরকানঃ ১-২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
﴿مَا اتَّخَذَ اللَّهُ مِن وَلَدٍ وَمَا كَانَ مَعَهُ مِنْ إِلَٰهٍ إِذًا لَّذَهَبَ كُلُّ إِلَٰهٍ بِمَا خَلَقَ وَلَعَلَا بَعْضُهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يَصِفُونَ عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾
‘‘আল্লাহ কোন সন্তান গ্রহণ করেন নি এবং তাঁর সাথে অন্য কোন মাবুদও নেই৷ আল্লাহর সাথে যদি আর কোন মাবুদ থাকতো তাহলে প্রত্যেক মাবুদ নিজের সৃষ্টি নিয়ে আলাদা হয়ে যেতো এবং একজন অন্যজনের উপর চড়াও হতো৷ এরা যেসব কথা তৈরী করে তা থেকে আল্লাহ পাক-পবিত্র৷ প্রকাশ্য ও গুপ্ত সবকিছুই তিনি জানেন৷ এরা আল্লাহর জন্য যে শরীক নির্ধারণ করে, তিনি তার অনেক উর্ধ্বে’’। (সূরা মুমিনুনঃ ৯১-৯২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
﴿فَلَا تَضْرِبُوا لِلَّهِ الْأَمْثَالَ إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ﴾
‘‘কাজেই আল্লাহর জন্য দৃষ্টান্ত পেশ করোনা। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানোনা’’। (সূরা নাহালঃ ৭৪) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেন,
﴿قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالإثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنزلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لا تَعْلَمُونَ﴾
‘‘তুমি বলে দাওঃ আমার প্রতিপালক কেবল প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন এবং হারাম করেছেন গুনাহ্, অন্যায় বাড়াবাড়ি, আল্লাহর সাথে এমন বস্ত্তকে অংশীদার করা, যার কোন দলীল-প্রমাণ তিনি অবতীর্ণ করেন নি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা বলা তোমাদের উপর হারাম করেছেন, যা তোমরা জানো না’’। (সূরা আরাফঃ ৩৩)
ব্যাখ্যাঃ وَقُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ বলোঃ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্যঃ প্রশংসাকে হামদ বলা হয়। الحمد এর মধ্যে যেই أل রয়েছে উহা ইস্তেগরাকের জন্য। অর্থাৎ এ কথা বুঝানোর জন্য যে, সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য।[2]
الَّذِي لَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا যিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেননিঃ অর্থাৎ তাঁর কোন সন্তান নেই। যেমন ধারণা করে থাকে ইহুদী, খৃষ্টান এবং আরবের কতিপয় মুশরিক। তাঁর বাদশাহীতে কোন শরীক নেই। অর্থাৎ তাঁর রাজত্বে ও প্রভুত্বে অংশীদার নেই। যেমন ধারণা করে থাকে অগ্নিপূজক এবং তাদের অনুরূপ সম্প্রদায়। তারা একাধিক মাবুদে বিশ্বাসী।
وَلَمْ يَكُن لَّهُ وَلِيٌّ مِّنَ الذُّلِّ তিনি তাঁর বাদশাহী পরিচালনায় এমন অক্ষম নন যে, তাঁর কোন সাহায্যকারীর প্রয়োজন হয়ঃ অর্থাৎ তিনি এমন দুর্বল নন, যাতে তার কোন সাহায্যকারী কিংবা কোন মন্ত্রী অথবা কোন পরামর্শদাতার দরকার হয়। সুতরাং তিনি কারো সাথে বন্ধুত্ব রচনা করেন নি এবং কারো সাহায্যও গ্রহণ করেন নি।
وَكَبِّرْهُ تَكْبِيرًا আর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করো, চূড়ান্ত পর্যায়ের শ্রেষ্ঠত্বঃ যালেমরা যা বলে, তা থেকে আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ব ঘোষণা করো।
يُسَبِّحُ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ‘‘আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে তার সবই আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করছেঃ আল্লাহর আসমান ও যমীনে যত মাখলুক রয়েছে, তারা সকলেই সব দোষ-ত্রুটি হতে আল্লাহর তাসবীহ বা পবিত্রতা বর্ণনা করছে।[3] রাজত্ব একমাত্র তাঁরই, সকল প্রশংসাও তাঁর জন্য। এ দু’টিতে অন্য কারো কোন অংশ নেই। তাঁর বান্দারা পৃথিবীর রাজত্বের যেই অংশ লাভ করে থাকে, তা আল্লাহ তাআলা তাদেরকে দান করেন বলেই লাভ করে থাকে। তা মূলতঃ আল্লাহর রাজত্বেরই অংশবিশেষ। তিনি সবকিছুর উপরই ক্ষমতাবান। কোন কিছুই তাঁকে অক্ষম করতে পারেনা।
تبارك الذي نزل الفرقان على عبده বড়ই বরকত সম্পন্ন তিনি, যিনি তারঁ বান্দার উপর ফুরকান নাযিল করেছেনঃ [4] تبارك শব্দটি فعل ماضي (অতীতকালের অর্থবোধক ক্রিয়া)। এটি البركة থেকে গৃহীত। কল্যাণের প্রাচুর্য, বৃদ্ধি, সুদৃঢ় ও স্থায়ী হওয়াকে البركة (বরকত) বলা হয়। تبارك শব্দটি শুধু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং শুধু অতীত কালের শব্দ দ্বারাই ব্যবহৃত হয়।
এখানে কুরআনকে ফুরকান হিসাবে নামকরণ করা হয়েছে[5]। কেননা তা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করে দেয়। এখানে বান্দা বলতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদ্দেশ্য। আল্লাহর বান্দা হওয়া একটি প্রশংসনীয় বিশেষণ। কেননা আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাকে নিজের দিকে ইযাফত (সম্বধিত) করেছেন। এটি হচ্ছে তাঁর উপর কুরআন অবতীর্ণ করার সাথে সাথে সম্মান ও মর্যাদার সম্বন্ধ। যাতে করে তিনি সমস্ত জিন-ইনসানের জন্য সতর্ককারী হতে পারেন। এটি হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম বৈশিষ্ট। نذيرا শব্দটি الإنذار ক্রিয়ামূল থেকেمنذر অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। ভয়ের কারণগুলো সম্পর্কে জানিয়ে দেয়াকে إنذار বলা হয়। ليكون (যাতে তিনি হতে পারেন), -এইবাক্যটি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ফুরকান অবতীর্ণ করার কারণ। অর্থাৎ যাতে করে আল্লাহ তাআলা তাঁকে বিশ্বজনীন রেসালাতের মাধ্যমে সম্মানিত করতে পারেন।
অতঃপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর নিজের সত্তাকে চারটি গুণের মাধ্যমে গুণান্বিত করেছেন। (১) তিনি পৃথিবী ও আকাশের রাজত্বের মালিক। তিনি একাই আসমান-যমীনের সকল বিষয়ের মালিক এবং এতদুভোয়ের সবকিছু পরিচালনাকারী। (২) তিনি কাউকে সন্তান হিসাবে গ্রহণ করেন নি। যেমন ইহুদী, খৃষ্টান এবং আরবের মুশরেকরা ধারণা করতো। আল্লাহ যেহেতু স্বয়ং সম্পূর্ণ অমূখাপেক্ষী এবং সমস্ত মাখলুক তাঁর প্রতি মুখাপেক্ষী। কারো প্রতি তাঁর প্রয়োজন নেই বলেই তিনি কাউকে সন্তান হিসাবে গ্রহণ করেন নি। (৩) তাঁর রাজত্বে কোন শরীক নেই। এতে মূর্তিপূজক, অগ্নিপূজক এবং তাদের অনুরূপ আরো অনেক মুশরেক সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ করা হয়েছে। (৪) তিনি প্রত্যেক জিনিষ সৃষ্টি করেছেন এবং যত মাখলুক রয়েছে, তার সবগুলোই তিনি সৃষ্টি করেছেন। বান্দাদের কর্মগুলোও এর অন্তর্ভূক্ত। বান্দাদের কর্মগুলো আল্লাহর সৃষ্টি। বান্দারা তা সম্পাদন ও বাস্তবায়ন করে।[6] অতঃপর তার জন্য একটি তাকদীর নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি প্রত্যেক সৃষ্টির জন্য বয়স নির্ধারণ করেছেন এবং তার রিযিক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সে সৌভাগ্যবান হবে? না হতভাগ্য হবে? তাও তিনি অবগত আছেন। তিনি প্রত্যেক বস্ত্তকে যথাযথভাবেই প্রস্ত্তত করেছেন।
ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ আল্লাহ তাআলা এখানে তাঁর নিজের সত্তাকে সন্তান গ্রহণ করা থেকে পবিত্র করেছেন এবং তাঁর কোন শরীক নেই বলেও ঘোষণা করেছেন। অতঃপর তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনিই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেক বস্ত্তর তাকদীর সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা ব্যতীত সব বস্ত্তই তাঁর সৃষ্টি এবং তাঁর প্রতিপালনাধীন। তিনিই প্রত্যেক বস্ত্তর স্রষ্টা, প্রত্যেক বস্ত্তর প্রভু, সবকিছুর মালিক এবং সকলের মাবুদ। প্রত্যেক বস্ত্তই তাঁর ক্ষমতাধীন, তাঁরই পরিচালনাধীন, তাঁরই বশীভূত এবং তাঁরই তাকদীরের অধীনস্ত।
مَا اتَّخَذَ اللَّهُ مِن وَلَدٍ وَمَا كَانَ مَعَهُ مِنْ إِلَٰهٍ আল্লাহ কাউকে নিজের সন্তানে পরিণত করেননি এবং তাঁর সাথে অন্য কোন মাবুদও নেইঃ এই আয়াতেও আল্লাহ তাআলা নিজের সত্তাকে সন্তান থেকে পবিত্র করেছেন। তাঁর রাজত্বে, পরিচালনায় এবং তাঁর এবাদতে কোন শরীক হওয়াকেও সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছেন। আল্লাহর সন্তান থাকার ধারণাকে এবং শরীক নির্ধারণ করার বিষয়কে জোরালোভাবে অস্বীকার করার জন্য উপরোক্ত আয়াতের দুই জায়গায় من হরফে জার ব্যবহার করা হয়েছে।
إِذًا لَّذَهَبَ كُلُّ إِلَٰهٍ بِمَا خَلَقَ আল্লাহর সাথে যদি অন্য কোন মাবুদ থাকতো তাহলে প্রত্যেক মাবুদ নিজের সৃষ্টি নিয়ে আলাদা হয়ে যেতোঃ আয়াতের প্রথমাংশে বলা হয়েছে আল্লাহর কোন সন্তান নেই এবং তাঁর এবাদতে কোন শরীক নেই। এটি হচ্ছে তার পক্ষে একটি বিরাট দলীল। অর্থাৎ যদি ধরে নেওয়া হয় যে, একাধিক মাবুদ রয়েছে, তাহলে প্রত্যেক মাবুদই নিজ নিজ সৃষ্টি নিয়ে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো এবং দলাদলি ও ভাগাভাগির কারণে সৃষ্টিজগতের শান্তি-শৃংখলা নষ্ট হয়ে যেতো। বাস্তবে আমরা দেখছি যে, সৃষ্টিজগত পূর্ণ শৃঙ্খলার সাথেই রয়েছে এবং সুনিয়ন্ত্রিতভাবেই চলছে। তাতে একাধিক মাবুদ দেখা যায়নি এবং মাবুদদের দলাদলিও সৃষ্টি হয়নি।
بَعْضُهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ وَلَعَلَا এবং একজন অন্যজনের উপর চড়াও হতোঃ অর্থাৎ আল্লাহর সাথে যদি আরেকজন মাবুদ থাকতো, তাহলে তাদের প্রত্যেকেই অন্যের বিরোধীতা করতো। ফলে দুনিয়ার রাজা-বাদশাহদের মতই একজন অন্যজনের উপর জয়লাভ করতো। ফলে যে পরাজিত এবং দুর্বল প্রমাণিত হতো, সে ইলাহ (মাবুদ) হওয়ার যোগ্যতা হারাতো। সুতরাং যখন সমপর্যায়ের একাধিক মাবুদ থাকার বিষয়টি বাতিল সাব্যস্ত হলো, তখন সাব্যস্ত হয়ে গেল যে, মাবুদ মাত্র এক। তিনিই হচ্ছেন আল্লাহ। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। এই জন্যই আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃسُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يَصِفُونَ এরা যেসব কথা তৈরী করে তা থেকে আল্লাহ তাআলা পাক-পবিত্র। অর্থাৎ তারা আল্লাহ তাআলার জন্য যেই শরীক ও সন্তান নির্ধারণ করে থাকে, তা থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পবিত্র।
عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ প্রকাশ্য ও গোপন সবকিছুই তিনি জানেনঃ অর্থাৎ যেসব বিষয় বান্দাদের অদৃশ্য এবং বান্দারা যা জানেনা, কেবল তিনিই তা জানেন। বান্দারা যা দেখে ও জানে, তিনি তাও জানেন। সুতরাং আল্লাহ ব্যতীত অন্যরা যদিও তাদের সামনে দৃশ্যমান বস্ত্তগুলো সম্পর্কে জানতে পারে, কিন্তু তারা গায়েবের খবর জানেনা। সুতরাং এরা আল্লাহর জন্য যে শরীক নির্ধারণ করে, তিনি তার অনেক উর্ধ্বে।
فَلَا تَضْرِبُوا لِلَّهِ الْأَمْثَالَ إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ কাজেই আল্লাহর জন্য দৃষ্টান্ত পেশ করোনাঃ আল্লাহ তাআলা এখানে তাঁর জন্য উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত পেশ করতে নিষেধ করেছেন। এক অবস্থাকে অন্য অবস্থার সাথে তুলনা করার নাম ضرب المثل তথা উপমা পেশ করা। আরবের মুশরেকরা বলতোঃ আমরা শুধু এক আল্লাহর এবাদত করবো, এর প্রতি আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। সুতরাং আল্লাহর এবং আমাদের মাঝে মাধ্যম স্থাপন করার প্রয়োজন রয়েছে। তাই তারা বহু সংখ্যক মূর্তি এবং অন্যান্য বস্ত্তকে আল্লাহ এবং তাদের মাঝে মধ্যস্থতাকারী বানাতো। আল্লাহ তাআলাকে দুনিয়ার রাজা-বাদশাহদের সাথে তুলনা করেই তারা এই কাজ করতো। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এই কাজ করতে নিষেধ করেছেন। কেননা আল্লাহর সদৃশ কেউ নেই। সুতরাং আল্লাহর জন্য উপমা পেশ করা চলেনা এবং তাঁর সাথে কোন সৃষ্টির তুলনাও চলেনা। কেননা আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের সম্পর্কে ভাল করেই জানেন যে, তাঁর অনুরূপ সত্তা আর কেউ নেই। আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র সত্তা সম্পর্কে যা জানেন, তোমরা তা জানোনা। সুতরাং তোমাদের এই কাজ তথা আল্লাহর জন্য দৃষ্টান্ত এবং উপমা পেশ করা তোমাদের ভ্রান্ত ধারণা এবং বাতিল কল্পনা ব্যতীত অন্য কিছু নয়। সেই সাথে মূর্তিগুলোকে আল্লাহর সাথে তুলনা করা এবং সেগুলোর এবাদত করার ভয়াবহ ও মন্দ পরিণাম সম্পর্কেও তোমরা অবগত নও।
قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالإثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ বলোঃ আমার প্রতিপালক কেবল প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন এবং হারাম করেছেন গুনাহ্ এবং অন্যায় বাড়াবাড়িঃ এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে। এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কুরআন আল্লাহ তাআলার কালাম এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পক্ষ হতে মুবাল্লিগ (দাঈ ও প্রচারক)। إنما এটি সীমিত কারক অব্যয়। حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ‘‘আমার প্রতিপালক অশ্লীল কাজসমূহ হারাম করেছেন। অর্থাৎ অশ্লীল বিষয়সমূহকে হারাম হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। الفواحش শব্দটি فاحشة-এর বহুবচন। যেই পাপাচার অত্যন্ত নিকৃষ্ট, তাকে ফাহেশা বলা হয়।
مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যঃ অর্থাৎ ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্যে যেই অপরাধ করা হয় এবং যা গোপনে করা হয় এই উভয় প্রকার গুনাহ্কেই আল্লাহ তাআলা হারাম করেছেন। والإثم (পাপাচার) প্রত্যেক এমন অপরাধকে إثم বলা হয়, যাতে গুনাহ রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেনঃ শুধু মদ পান করাকে إثم বলা হয়।
وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ অন্যায় বাড়াবাড়িঃ অর্থাৎ সীমাহীন যুলুম করা এবং মানুষের উপর অত্যাচার করা তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে।
وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنزلْ بِهِ سُلْطَانًا আল্লাহর সাথে এমন বস্ত্তকে অংশীদার করা হারাম করেছেন, যার কোন দলীল-প্রমাণ তিনি অবতীর্ণ করেন নিঃ অর্থাৎ আল্লাহর এবাদতে তোমরা কোন শরীক সাব্যস্ত করোনা। অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর সাথে এমন কিছুকে শরীক করোনা, যার কোন প্রমাণ আল্লাহ তাআলা অবতীর্ণ করেন নি।[7] আয়াতের এই অংশ থেকেই শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া দলীল গ্রহণ করেছেন।
وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لا تَعْلَمُون আল্লাহর সম্পর্কে এমন কথা বলা তোমাদের উপর হারাম করেছেন, যা তোমরা জানোনাঃ আল্লাহর ব্যাপারে বানোয়াট ও মিথ্যা কথা বলা। যেমন আল্লাহর সন্তান আছে বলে দাবী করা কিংবা অনুরূপ এমন বিষয়ে কথা বলা, যে সম্পর্কে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই। অনুরূপ আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই মুশরেকরা নিজেদের পক্ষ হতে অনেক বস্ত্তকে হালাল করে এবং বহু জিনিষকে হারাম করে আল্লাহর দিকে সম্বধিত করতো এবং বলতো আল্লাহ এগুলো হালাল করেছেন কিংবা এগুলোকে তিনি হারাম করেছেন।উপরোক্ত আয়াতে কারীমা হতে প্রমাণ মিলে যে, তাতে আল্লাহ তাআলার শরীক হওয়াকে অস্বীকার করা হয়েছে এবং একমাত্র তাঁর জন্যই পরিপূর্ণ গুণাবলী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাঁর পবিত্র সত্তার জন্য সন্তান ও সদৃশ থাকার দাবী খন্ডন করা হয়েছে। সমস্ত মাখলুকই এ জাতিয় দোষ-ত্রুটি হতে আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে। অনুরূপ উপরোক্ত আয়াতগুলো শির্ক করাকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দিয়েছে। মূর্খতা ও কল্পনার উপর ভিত্তি করেই শির্কের সূচনা হয়েছে। আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলার কোন সদৃশ ও সমকক্ষ নেই। (আল্লাহই অধিক জানেন)
[2] - সকল নেয়ামত যেহেতু একমাত্র আল্লাহর পক্ষ হতে, তাই সকল প্রকার প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য হওয়া আবশ্যক। حمد (হামদ) শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে প্রশংসা করা। এটি ذم (নিন্দা)এর বিপরীত। হামদ এবং شكر পরস্পর সমার্থবোধক হলেও হামদ شكر -এর চেয়ে অধিকতর ব্যাপক অর্থ প্রদান করে। শোকর সাধারণত নেয়ামত ও অনুগ্রহের বিনিময়েই হয়ে থাকে। কিন্তু হামদএর জন্য তা শর্ত নয়। অর্থাৎ হামদ হচ্ছে নেয়ামত প্রদানকারীর সৌন্দর্য বর্ণনা করা। তা নেয়ামতের বিনিময়ে হোক বা নেয়ামত ছাড়াই হোক। অর্থাৎ সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর নেয়ামত এত ব্যাপক যে, তা গণনা করে শেষ করা যাবেনা। সুতরাং প্রত্যেকবার حمد (প্রশংসা) করার পূর্বে যে আল্লাহর নেয়ামত পেতে হবে, এমনটি নয়। বরং আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির প্রতি যে নেয়ামত সর্বদা প্রসারিত করে রেখেছেন, তার জন্য সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রশংসা করাকে পরিভাষায় হামদ বলা হয়। আর নির্দিষ্ট কোন নেয়ামত প্রাপ্ত হয়ে যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়, তাকে পরিভাষায় شكر বলা হয়। কেউ কেউ حمدএর সংজ্ঞায় বলেনঃ هو الثناء باللسان على الجميل الاختياري অর্থাৎ জবানের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় কৃত সৌন্দর্যের উপর কারো প্রশংসা বর্ণনা করাকে হামদ বলা হয়। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃفالحمد إخبار عن محاسن المحمود مع حبه وإجلاله وتعظيمه ভালবাসা ও সম্মানের সাথে প্রশংসিত সত্তার (আল্লাহ তাআলার) সৌন্দর্য বর্ণনা করাকে হামদ বলা হয়। হামদ ও শোকরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, (১) শোকর শুধু নেয়ামতের বিনিময়েই হয়ে থাকে, কিন্তু হামদের জন্য নেয়ামত শর্ত নয়। নেয়ামত ছাড়াও তা হতে পারে। (২) হামদ শুধু জবানের কথার মাধ্যমেই হয়, কিন্তু শোকর জবান, হাত, অন্তর এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমেও হয়। (আল্লাহই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)
[3] - আল্লামা ডঃ সালেহ আল ফাওযান বলেনঃ সকল মাখলুকই স্বীয় জবান দ্বারাই তাসবীহ পাঠ করে। তিনি আরো বলেনঃ যারা বলে বাকশক্তিহীন মাখলুক স্বীয় অবস্থার মাধ্যমে আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করে, তাদের কথা বাতিল; বরং তারাও জবান দ্বারাই তাসবীহ পাঠ করে। আল্লাহ তাআলা তাদের তাসবীহ পাঠের ধরণ সম্পর্কে জানেন। কিন্তু আমরা জানিনা। মূলতঃ তারা প্রকৃতভাবেই তাসবীহ পাঠ করে। যেমন পাথরের তাসবীহ পাঠ, খাদ্যের তাসবীহ পাঠ ইত্যাদি। সাহাবীগণ বলেনঃ আমরা খাদ্যের তাসবীহ শুনতাম। অথচ উহাকে খাওয়া হচ্ছে।
[4] - এই আয়াত থেকেও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তাআলা উপরে। কেননা নাযিল উপর থেকেই হয়ে থাকে। এ থেকে আরো প্রমাণিত হয় যে, কুরআন আল্লাহর কালাম; মাখলুক নয়। কারণ তা আল্লাহর পক্ষ হতে নাযিল হয়েছে।
[5] - এখানে কুরআনকে ফুরকান বলা হয়েছে। এ ছাড়াও কুরআনের আরো অনেক নাম রয়েছে। যেমন কিতাব, যিকির, রূহ, নূর, হুদা ইত্যাদি। যে জিনিষের নাম হয় অধিক তার সম্মান ও মর্যাদাও হয় অধিক।
[6] - সুতরাং তাদের কাজগুলো যেহেতু তারাই বাস্তবায়ন করে, তাই ভাল কাজ করলে তাদেরকে ভাল পুরস্কার দেয়া হবে আর খারাপ কাজ করলে শাস্তিও তারাই পাবে।
[7] - মুশরেকদের হাতে কোন দলীল নেই। তারা শুধু পূর্ব পুরুষদের অন্ধ অনুসরণ করেই শির্ক করে থাকে। ইবরাহীম (আঃ) যখন তাঁর পিতাকে এবং তাঁর স্বগোত্রীয় লোকদেরকে বললেনঃ مَا هَٰذِهِ التَّمَاثِيلُ الَّتِي أَنتُمْ لَهَا عَاكِفُونَ ‘‘তোমরা যে মূর্তিগুলোর এবাদত করছ, এগুলো কী? (সূরা আম্বীয়াঃ ৫২) অর্থাৎ এগুলোর এবাদতের পক্ষে কোন দলীল আছে কি? এগুলো কি তোমাদের কোন উপকার করতে পারে? তার জাতির লোকেরা জবাবে বলেছিল, وَجَدْنَا آبَاءَنَا لَهَا عَابِدِينَ ‘‘আমাদের বাপ-দাদাদেরকে আমরা এদের এবাদাতরত অবস্থায় পেয়েছি’’৷