শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া ১৬- আল্লাহ তাআলার জন্য নাম সাব্যস্ত করা এবং কেউ তাঁর সদৃশ হওয়া অস্বীকার করা ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী]
আল্লাহ তাআলার জন্য নাম সাব্যস্ত করা এবং কেউ তাঁর সদৃশ হওয়া অস্বীকার করা

১৬- إثبات الاسم لله ونفي المثل عنه

১৬- আল্লাহ তাআলার জন্য নাম সাব্যস্ত করা এবং কেউ তাঁর সদৃশ হওয়া অস্বীকার করা:

আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿تَبَارَكَ اسْمُ رَبِّكَ ذِي الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ﴾

‘‘তোমার রবের নাম বরকত সম্পন্ন, যিনি বড়ত্ব ও সম্মানের অধিকারী’’। (সূরা আর্ রাহমানঃ ৭৮) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,

﴿رَّبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا فَاعْبُدْهُ وَاصْطَبِرْ لِعِبَادَتِهِ هَلْ تَعْلَمُ لَهُ سَمِيًّا﴾

‘‘তিনি আসমান ও যমীন এবং এ দুয়ের মাঝখানের সবকিছুর রব৷ কাজেই তুমি তার এবাদত করো এবং তার এবাদতের উপর অবিচল থাকো৷ তোমার জানা মতে তাঁর সমকক্ষ কোন সত্তা আছে কি? (সূরা মারইয়ামঃ ৬৫) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ﴿وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ﴾ ‘‘এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই’’। (সূরা ইখলাসঃ ৪) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَّكُمْ فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ﴾

‘‘হে লোক সকল! এবাদত করো তোমাদের রবের, যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্বে যারা অতিক্রান্ত হয়েছে তাদের সকলকে সৃষ্টি করেছেন, এতেই তোমরা মুত্তাকী হওয়ার আশা করতে পারো৷ তিনিই তোমাদের জন্য যমীনকে বিছানা স্বরূপ বানিয়েছেন, আসমানকে ছাদ স্বরূপ বানিয়েছেন, উপর থেকে পানি বর্ষণ করেছেন এবং তার সাহায্যে সব রকমের ফল-ফলাদি উৎপন্ন করে তোমাদের আহার যুগিয়েছেন। অতএব জেনে-বুঝে তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক ও সমকক্ষ নির্ধারণ করোনা’’। (সূরা বাকারাঃ ২২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,

﴿وَمِنَ النَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ اللَّهِ أَندَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِّلَّهِ﴾

‘‘মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে আল্লাহর অংশীদার বা সমতুল্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে ভালবাসার মতই তাদেরকে ভালবাসে। অথচ ঈমানদাররা সবচেয়ে বেশী আল্লাহকেই ভালোবাসে’’। (সূরা বাকারাঃ ১৬৫)


ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ তাআলা বলেনঃ تَبَارَكَ اسْمُ رَبِّكَ‘‘তোমার রবের নাম বরকত সম্পন্ন। البركة শব্দের আভিধানিক অর্থ বড় হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি। আর কারো জন্য বরকতের দুআ করাকে تبريك বলা হয়। সেই হিসাবে تَبَارَكَ اسْمُ رَبِّكَ অর্থ হলো, তোমার রবের মর্যাদা মহান ও সমুন্নত হয়েছে। تبارك শব্দটি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য ব্যবহৃত হয়না।[1] যেই আয়াতগুলোতে আল্লাহর জন্য চেহারা সাব্যস্ত করা হয়েছে, সেগুলোর ব্যাখ্যার সাথেذُو الْجَلَالِ والإكرام এর ব্যাখ্যা পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে।[2]

فَاعْبُدْهُ وَاصْطَبِرْ لِعِبَادَتِهِ কাজেই তুমি তার এবাদত করো এবং তার এবাদতের উপর অবিচল থাকোঃ অর্থাৎ এককভাবে তাঁর এবাদত করো। তাঁর এবাদতের সাথে অন্য কারো এবাদত করোনা। العبادة শব্দের আভিধানিক অর্থ নত ও বিনয়ী হওয়া। আর শরীয়তের পরিভাষায়العبادة اسم جامع لما يحبه الله ويرضاه من الأعمال والأقوال الظاهرة والباطة অর্থাৎ মানুষের এমনসব প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য কথা ও কাজের নাম এবাদত, যেগুলোকে আল্লাহ তাআলা ভালবাসেন এবং পছন্দ করেন।[3]

وَاصْطَبِرْ لِعِبَادَتِهِ তার এবাদতের উপর অবিচল থাকোঃ অর্থাৎ তাঁর এবাদতের উপর সুদৃঢ় থাকো, সবসময় উহা সম্পাদন করতে থাকো এবং এবাদতের পথে যেসব কষ্ট আসে, তাতে ধৈর্য ধারণ করো।

هَلْ تَعْلَمُ لَهُ سَمِيًّا তোমার জানা মতে তাঁর সমকক্ষ কোন সত্তা আছে কি? এটি হচ্ছে ইস্তেফহামে ইনকারী (অস্বীকার প্রশ্নবোধক প্রশ্নের) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার এমন কোন সদৃশ ও সমক্ষক নেই, যে তাঁর এবাদতে শরীক হতে পারে।

وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَد এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেইঃ আরবদের ভাষায় সমতুল্য বস্ত্তকে الكفء বলা হয়। অর্থাৎ সৃষ্টিজগতে আল্লাহ তাআলার কোন সমতুল্য, সমকক্ষ, সদৃশ এবং শরীক নেই।

فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ অতএব জেনে-বুঝে তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক ও সমকক্ষ নির্ধারণ করো নাঃ الند শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে অনুরূপ, সদৃশ ও সমতুল্য। অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর জন্য এমনসব সমকক্ষ ও সমতুল্য নির্ধারণ করোনা, যাদেরকে তোমরা আল্লাহর এবাদতের মধ্যে শরীক করবে এবং ভালবাসা ও সম্মানের ক্ষেত্রে তাদেরকেও আল্লাহ তাআলার সমান করে ফেলবে। বিশেষ করে যখন তোমরা জানতে পারলে যে, একমাত্র আল্লাহই তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তী সকল মানুষের সৃষ্টিকর্তা এবং অন্যান্য সকল জিনিষের সৃষ্টিকর্তা। এক কথায় বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ তাআলার এমন কোন সমকক্ষ নেই, যে সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে আল্লাহর শরীক হতে পারে।

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ اللَّهِ أَندَادًاমানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে, যারা আল্লাহর সাথে অন্যদেরকে আল্লাহর অংশীদার বা সমতুল্য হিসেবে গ্রহণ করেঃ এই আয়াতের পূর্বের আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর একত্বের অনেকগুলো দলীল উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা সূরা বাকারা ১৬৪ নং আয়াতে বলেনঃ

﴿إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنزَلَ اللَّهُ مِنَ السَّمَاءِ مِن مَّاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِن كُلِّ دَابَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ﴾

‘‘আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিবা-রাত্রির অনবরত আবর্তনে, মানুষের উপকারী সামগ্রী নিয়ে সাগরে চলমান জলযানসমূহে, বৃষ্টিধারার মধ্যে, আল্লাহ যা উপর থেকে বর্ষণ করেন, অতঃপর তার মাধ্যমে মৃত ভূমিকে জীবন দান করার মধ্যে, পৃথিবীতে সব রকমের প্রাণী ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়ার মধ্যে, আর বায়ুর প্রবাহে এবং আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালার মধ্যে বিবেকবানদের জন্য অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে’’।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা উপরোক্ত আয়াতে একত্বের এই নিদর্শন ও দলীল-প্রমাণ বর্ণনা করার পর সংবাদ দিয়েছেন যে, আল্লাহর বিরাট শক্তি, মহান ক্ষমতা এবং একাই সকল মাখলুক সৃষ্টি করার এই উজ্জ্বল প্রমাণ বিদ্যমান থাকার পরও মানুষের মধ্যে এমন লোকও দেখা যাচ্ছে, যারা অক্ষম-অপারগ মূর্তিগুলোকে তাঁর সমকক্ষ নির্ধারণ করে এবং সেগুলোর এবাদত করে।

يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ الله আল্লাহকে ভালবাসার মতই তারা তাদেরকে ভালবাসেঃ অর্থাৎ এই কাফেররা এই মূর্তিগুলোর এবাদত করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং তারা এগুলোকে অত্যন্ত ভালবাসে। মূর্তিগুলোর প্রতি ভালবাসায় তারা এত বাড়াবাড়ি করেছে যে, তারা এগুলোকে আল্লাহর ভালবাসার মতই ভালবাসতে শুরু করেছে। তারা ভালবাসার ক্ষেত্রে তাদেরকে আল্লাহর সমান করে ফেলেছে, সৃষ্টি করা, রিযিক দান করা এবং সৃষ্টির কার্যাদি পরিচালনা করার মধ্যে তারা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক নির্ধারণ করেনি।উপরোক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহর জন্য অতি সুন্দর নাম, তাঁর বড়ত্ব ও সম্মান সাব্যস্ত করা হয়েছে। একই সাথে আল্লাহর সমতুল্য, সমকক্ষ এবং শরীক থাকার কথাও অস্বীকার করা হয়েছে। যেসব বিষয় আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা শোভনীয় নয়, সেগুলো গৌণ এবং সংক্ষিপ্ত আকারে অস্বীকার করার পদ্ধতিই কুরআন ও সুন্নায় বর্ণিত হয়েছে।

[1] - البركة (বারাকাহ) শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, প্রচুর পরিমাণ কল্যাণ হওয়া এবং উহা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া। تبارك -এর ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ বরকত দুই প্রকার। (১) এমন বরকত, যা আল্লাহ তাআলা হতে প্রকাশিত হয়। البركة থেকে بارك (তিনি বরকত দান করেছেন) فعل (ক্রিয়া) ব্যবহৃত হয়। এই ফেলটি কখনো নিজে নিজেই বাক্যে ব্যবহৃত হয়। কখনো على হারফে জার আবার কখনো في হরফে জারের মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়। البركة থেকে اسم مفعول এর সীগা হয় مباركٌ। অর্থাৎ যার মধ্যে বরকত রাখা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ তাআলা যাকে বরকতময় করেছেন, কেবল সেই বরকতময় হয়েছে।

(২) আল্লাহ তাআলার দিকে যেমন রহমত ও ইজ্জতের সম্বন্ধ করা হয়, তেমনি বরকতকেও তাঁর দিকে সম্বধিত করা হয়। বরকত শব্দটি যখন এই অর্থে ব্যবহৃত হয়, তখন এ থেকে فعل (ক্রিয়া) হয় تَبَارَكَ । তাই আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য تبارك ক্রিয়াটি ব্যবহৃত হয়না এবং অন্যের জন্য এটি ব্যবহার করা বৈধ নয়। সুতরাং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা متبارك তথা বরকতের অধিকারী ও বরকত দানকারী। তাঁর রাসূল এবং তাঁর অনুগত বান্দা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম مبارك তথা বরকতময়। সুতরাং تبارك এর সিফাতটি তথা বরকত দান করা কেবল আল্লাহর সাথে খাস। আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের পবিত্র সত্তার জন্য এই সিফাতটি সাব্যস্ত করেছেন। তিনি সূরা আরাফের ৫৪ নং আয়াতে বলেন, ﴾ ﴿ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ ‘‘আল্লাহ বড়ই বরকতের অধিকারী। তিনি সমগ্র বিশ্ব জাহানের মালিক ও প্রতিপালক’’। আল্লাহ তাআলা সূরা মুলকের ১ নং আয়াতে বলেনঃ

﴿تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾

‘‘অতি মহান তিনি, যাঁর হাতে রয়েছে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের কর্তৃত্ব। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান’’।[1]

হে পাঠক! আপনি কি লক্ষ্য করেন না! কুরআনে কিভাবে আল্লাহ তাআলার জন্য নির্দিষ্ট করে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে? তিনি ব্যতীত অন্য কারো জন্য কুরআনে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। تبارك শব্দটি প্রশস্ততা এবং বৃদ্ধির অর্থ প্রদান করে। এটি تعالى (উঁচু হলেন), تعاظم (মহান হলেন) এবং অনুরূপ শব্দের মতই। সুতরাং تبارك শব্দটি تعالى এর মতই। ‘তাআলা’ শব্দটি যেমন আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সর্বোচ্চ উপরে হওয়ার অর্থ বহন করে, তেমনি تبارك শব্দটি আল্লাহ তাআলার বরকতের পূর্ণতা, বড়ত্ব এবং তাঁর বরকতের প্রশস্ততার অর্থ বহন করে। কোন কোন সালাফ বরকতের এই অর্থ মোতাবেক تبارك শব্দের অর্থ করেছেন تعاظم শব্দ দ্বারা। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেনঃ تبارك অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা সকল বরকত আনয়ন করেছেন।

মূলতঃ আল্লাহ তাআলার জন্য এখানে تَبَارَكَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর পূর্ণ অর্থ এক শব্দে তো দূরের কথা এক বাক্যে বর্ণনা করাও কঠিন। এর শব্দমূল রয়েছে ب - ر - ك অক্ষর। এ থেকে بَرَكَة ও بُرُوك দু'টি ধাতু নিষ্পন্ন হয়। بَرَكَة এর মধ্যে রয়েছে বৃদ্ধি, সমৃদ্ধি, বিপুলতা, প্রাচুর্যের অর্থ। আর بُرُوك এর মধ্যে স্থায়িত্ব, দৃঢ়তা, অটলতা ও অনিবার্যতার অর্থ রয়েছে। অতঃপর এ ধাতু থেকে যখন تَبَارَكَ ক্রিয়াপদ তৈরী করা হয় তখন تفاعل এর বৈশিষ্ট্য হিসেবে এর মধ্যে বৃদ্ধি পাওয়া ও পূর্ণতা প্রকাশের অর্থও শামিল হয়ে যায়। এ অবস্থায় এর অর্থ দাঁড়ায় সর্বোচ্চ, বর্ধমান প্রাচুর্য ও চূড়ান্ত পর্যায়ের স্থায়িত্ব। এ শব্দটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে কোন জিনিষের প্রাচুর্য বা তার দৃঢ়তা ও স্থায়িত্বের অবস্থা বর্ণনা করার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন কখনো এর অর্থ হয় উচ্চতায় অনেক বেশী এগিয়ে যাওয়া। বলা হয়, تباركت النخلة অর্থাৎ অমুক খেজুর গাছটি অনেক উঁচু হয়ে গেছে। আসমায়ী বলেন, এক বন্ধু একটি উঁচু টিলায় উঠে নিজের সাথীদেরকে বলতে থাকে تَبَارَكْتُ عَلَيْكُمْ ‘‘আমি তোমাদের চেয়ে উঁচু হয়ে গেছি’’। কখনো মর্যাদায় ও শ্রেষ্ঠত্বে বেশী অগ্রণী হওয়ার অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কখনো একে ব্যবহার করা হয় দয়া ও সমৃদ্ধি পৌঁছানো এবং শুভ ও কল্যাণের ক্ষেত্রে অগ্রণী হওয়ার অর্থে। কখনো এ থেকে পবিত্রতার পূর্ণতা ও চূড়ান্ত বিশুদ্ধতার অর্থ গ্রহণ করা হয়। পূর্বাপর বক্তব্যই বলে দেয় কোথায় একে কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং উপরোক্ত আয়াতে ব্যবহৃত تبارك শব্দের যেসব ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,

এক) মহা অনুগ্রহকারী ও সর্বজ্ঞ। কারণঃ তিনি নিজের বান্দাকে ফুরকানের মহান নিয়ামত দান করে সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছেন।

দুই) বড়ই মর্যাদাশালী ও সম্মানীয়। কারণ, পৃথিবী ও আকাশে তাঁরই রাজত্ব চলছে।

তিন) বড়ই পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন। কারণ, তাঁর সত্তা সকল প্রকার শির্কের গন্ধমুক্ত। তাঁর সমজাতীয় কেউ নেই। ফলে আল্লাহর সত্তার সার্বভৌমত্বে তাঁর কোন নযির ও সমকক্ষ নেই। তাঁর কোন ধ্বংস ও পরিবর্তন নেই। কাজেই তাঁর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য কোনো পুত্রের প্রয়োজন নেই।

চার) বড়ই উন্নত ও শ্রেষ্ঠ। কারণ, সমগ্র রাজত্ব তাঁরই কতৃত্বাধীন। তাঁর ক্ষমতায় অংশীদার হবার যোগ্যতা ও মর্যাদা কারো নেই।

পাঁচ) শক্তির পূর্ণতার দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ। কারণ, তিনি বিশ্ব-জাহানের প্রত্যেকটি জিনিষ সৃষ্টিকারী ও তার ক্ষমতা নির্ধারণকারী। {(বাগাবী, আলুসী এবং ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রচিত জালাউল আহকাম, (১/৩০৬)}

[2] - الإكرام হচ্ছে أكرم يكرم إكراما এর মাসদার। সে হিসাবে ذو الإكرام অর্থ হচ্ছে যিনি তাঁর বান্দাকে সম্মানিত, অনুগ্রহ করেন এবং নেয়ামত দান করেন। সুতরাং বান্দাদের মধ্যে যত নেয়ামত রয়েছে, তার সবই আল্লাহর অনুগ্রহ থেকেই এবং তিনি তাঁর বান্দাদের থেকে যেসব কষ্ট দূর করেন, তাও আল্লাহর অনুগ্রহের ফলেই। কেউ কেউ বলেছেনঃ যুল ইকরাম হচ্ছে ঐ সত্তা, যাকে তাঁর বান্দাগণ সম্মান করে এবং তাঁর বড়ত্ব বর্ণনা করে। সুতরাং যুল ইকরামের দুই অর্থ। তিনি তাঁর বান্দাদেরকে নেয়ামত প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করেন এবং বান্দাগণও তাঁকে সম্মান করে এবং তাঁর মর্যাদা বর্ণনা করে। উভয় অর্থই আয়াতের উদ্দেশ্য হতে পারে। (আল্লাহই অধিক জানেন)

[3] - আলেমগণ বলেনঃ এবাদতের মোট রুকন চারটি। (১) أقصى غاية الحب সর্বোচ্চ ভালবাসা, (২) أقصى الخضوع والتذلل সর্বোচ্চ বিনয়, (৩) الخوف ভয় এবং (৪) الرجاء আশা। এই চারটি রুকন কোন আমলের মধ্যে এক সাথে পাওয়া গেলে, তা এবাদতে পরিণত হবে। সুফীরা শুধু ভালবাসা নিয়ে আল্লাহর এবাদত করে। এ জন্যই তারা গোমরাহ হয়েছে। আর যারা শুধু আশা নিয়ে এবাদত করে, তারা মুরজীয়া। আর খারেজীরা শুধু অন্তরে ভয় নিয়ে আল্লাহর এবাদত করে। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা উপরোক্ত চারটি বিষয় অন্তরে নিয়েই আল্লাহর এবাদত করেন। তারা একই সাথে অন্তরে আল্লাহর প্রতি সর্বোচ্চ ভালবাসা নিয়ে, তাঁর সামনে পূর্ণরূপে নত হয়ে, তাঁর শাস্তির ভয়সহ এবং তাঁর রহমতের আশা নিয়ে আল্লাহর এবাদত করেন।