লগইন করুন
আল্লাহর ইচ্ছা সম্পর্কিত মাসআলাটি আকীদাহর মাসআলাসমূহের অন্যতম একটি গুরুত্বপূণ বিষয় হওয়ার কারণে তা অধিকতর খোলাসা করার জন্য এ বিষয়ে শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উছাইমীন (রঃ)এর বিশ্লেষণটি এখানে যোগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
তিনি বলেনঃ ইরাদাহ তথা আল্লাহর ইচ্ছা দুই প্রকার। (১) ইরাদায়ে কাওনীয়া। এটি সম্পূর্ণরূপেই المشيئة-এর সমার্থবোধক। সেই হিসাবে أراد الله (আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন) এবং شاء الله (আল্লাহ চেয়েছেন)এর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই প্রকার ইরাদার ব্যাব্যাপারে প্রথম কথা হচ্ছে, যেসব বিষয় ও কাজ আল্লাহ ভালবাসেন এবং যেগুলোকে আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন না, তার সব ক্ষেত্রেই এই প্রকার ইরাদাহ বিদ্যমান থাকে।
শাইখ বলেনঃ এর উপর ভিত্তি করে আপনাকে যদি কেউ যখন প্রশ্ন করে, আল্লাহ তাআলা কি কুফুরীর ইচ্ছা করেন? অন্য কথায় কুফুরীও কি আল্লাহর ইচ্ছায় হয়? উত্তরে আপনি বলুনঃ হ্যাঁ, আল্লাহ্ তাআলার ইরাদায়ে কাওনীয়া তথা সৃষ্টিগত ইচ্ছার অধীনে কুফুরীও সংঘটিত হয়। আল্লাহ তাআলা যদি সৃষ্টিগতভাবে কুফুরী হওয়ার ইচ্ছা না করতেন, তাহলে কখনোই পৃথিবীতে কুফুরী হতোনা।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ইরাদায়ে কাওনীয়ার দ্বারা আল্লাহ তাআলা যার ইচ্ছা করেন, তা অবশ্যই সংঘটিত হয়। অন্য কথায় আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা অবশ্যই হয় এবং তা না হওয়ার প্রশ্নই আসেনা।
(২) দ্বিতীয় প্রকার ইরাদাহ হচ্ছে ইরাদায়ে শরঈয়া। এটি المحبة (ভালাবাসা)এর সমার্থক। এই প্রকার ইরাদায় أراد الله (আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন) অর্থ হলো, أحب الله আল্লাহ ভালবেসেছেন ও পছন্দ করেছেন।
এই প্রকার ইরাদার ক্ষেত্রে প্রথম কথা হচ্ছে, এটি আল্লাহর ভালবাসা ও পছন্দের সাথে খাস। সুতরাং তিনি ইরাদায়ে শরঈয়ার মাধ্যমে কুফুরী ও পাপাচার পছন্দ করেন না। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, তাতে উদ্দিষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়ন হওয়া জুরুরী নয়। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা কোন জিনিষ হওয়া পছন্দ করেন, কিন্তু কখনো তা হয় আবার কখনো হয়না। আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করেছেন যে, বান্দারা তাঁর এবাদত করুক। কিন্তু জরুরী হিসাবে সকল সৃষ্টির পক্ষ হতে এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়না।[1] দেখা যাচ্ছে কিছু সংখ্যক মানুষ তার এবাদত করে আর অন্যরা তাঁর এবাদত করেনা। কিন্তু ইরাদায়ে কাওনীয়া এর বিপরীত। সেখানে আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তায়ন হবেই হবে।
সুতরাং দুইদিক থেকে দুই প্রকার ইরাদার মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। (১) ইরাদায়ে কাওনীয়ার মাধ্যমে যা ইচ্ছা করা হয়, তা সংঘটিত হওয়া অবধারিত। আর ইরাদায়ে শারঈয়ার মধ্যে তা আবশ্যক নয়।
(২) ইরাদায়ে শারঈয়া কেবল ঐ সব বস্ত্তর মধ্যেই সীমিত, যা হওয়া আল্লাহ তাআলা ভালবাসেন। আর ইরাদায়ে কাওনীয়া হচ্ছে ব্যাপক। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যা পছন্দ করেন আর যা পছন্দ করেন না, উভয়টিই এর মধ্যে শামিল।
এর উপর ভিত্তি করে এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে, আল্লাহ তাআলা কিভাবে এমন জিনিষের ইচ্ছা করেন, যা তিনি ভালবাসেন না? অন্য কথায় আল্লাহ তাআলা কিভাবে কুফুরী, পাপাচার এবং সীমালংঘন হওয়ার ইচ্ছা করেন? অথচ তিনি তা পছন্দ করেন না।
এর উত্তর হচ্ছে অন্যায় ও ক্ষতিকর বস্ত্ত সংঘটিত হওয়া একদিক থেকে আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং অন্যদিক বিচারে উহা অপছন্দনীয়। এর মধ্যে যেই বিরাট কল্যাণ নিহিত থাকে, সেই দিক বিচারে এটি আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং এতে যেহেতু আল্লাহর অবাধ্যতা রয়েছে, সেই হিসাবে এটি তাঁর কাছে অপ্রিয়।[2]
সুতরাং একই জিনিষ দুইদিক বিচারে একই সাথে প্রিয় এবং অপ্রিয় হওয়াতে কোন মানা নেই।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, মানুষ তার কলিজার টুকরা শিশু সন্তানকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। যাতে করে ডাক্তার শিশুর পেট ফেড়ে ভিতর থেকে দূষিত জিনিষ বের করে ফেলে। অথচ অন্য কেউ তার শিশুর গায়ে সুইয়ের একটি খোঁচা দিতে চাইলেও সে রাজী হয়না’ বরং সে তার সাথে ঝগড়া করে।
অপরপক্ষে সে নিজেই পেট ফেড়ে ফেলার জন্য শিশুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার শিশুর পেট কাটে ও চিরে ফেলে। পিতা এই দৃশ্য খুশী মনেই দেখে। এতে তার শিশুর কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কি কারণে সে রাজী হয়? রাজী হওয়ার কারণ হলো, এই মূহুর্তে শিশুর কষ্ট হলেও অন্য কারণে অর্থাৎ শিশুর জন্য এমন এক বিরাট স্বার্থ ও কল্যাণ হাসিলের আশায় সে একটি অপছন্দনীয় বিষয় পছন্দ করে, যা ভবিষ্যতে অর্জিত হবে। (সংযুক্তি এখানেই শেষ)
[1] - সুতরাং দেখা যাচ্ছে ইরাদায়ে শরঈয়ার দ্বারা যা হয়, তা আল্লাহর কাছে প্রিয় হলেও তা সকল ক্ষেত্রে কার্যকর ও বাস্তবায়ন হয়না। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য যা কিছু ইসলামী শরীয়তের অন্তর্ভূক্ত করেছেন এবং যত আদেশ-নিষেধ করেছেন, তা এই প্রকার ইরাদার সাথে খাস। যেমন নামায কায়েম করা, রোযা রাখা, যাকাত প্রদান করাসহ ইত্যাদি আরো অনেক আমল করার আদেশ। এই কাজগুলো বাস্তবায়ন হওয়া আল্লাহর কাছে প্রিয়। সেই সাথে দৃষ্টি নত রাখা, চুরি-ডাকাতি না করা, যেনা-ব্যাভিচার ইত্যাদি আরো অনেক হারাম কাজ থেকে আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন। এ সব কাজ থেকে বান্দার বিরত থাকা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়। কিন্তু কতক বান্দার দ্বারা আল্লাহ এই প্রকার ইরাদাহ বাস্তবায়িত হয়। আবার অনেকের দ্বারা বাস্তবায়িত হয়না। না হওয়ার কারণ হলো আল্লাহ সকল মানুষকে সৎকাজের উপর বাধ্য করেন নি। তিনি ইচ্ছা করলে বাধ্য করতে পারতেন, সেই ক্ষমতা তাঁর অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু তা না করে পরীক্ষা করার জন্য তাদেরকে ভাল-মন্দের যে কোন একটি ইখতিয়ার করার স্বাধীনতা দিয়েছেন। কুরআন, সুন্নাহর দলীল এবং মানুষের বিবেক-বুদ্ধির দ্বারা মানুষের এই স্বাধীনতার বিষয়টি প্রমাণিত ও স্বীকৃত।
[2] - আবু তালেবকে কুরাইশদের দ্বীনে রাখা কোন্ দিক মূল্যায়নে আল্লাহর কাছে প্রিয় ছিল এবং খিযির (আঃ) কর্তৃক নিরপরাধ শিশুকে হত্যা করা ও মিসকীনদের নৌকা ভেঙে ফেলা কোন্ দিক বিবেচনায় আল্লাহর কাছে ভাল ছিল, তা পূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এখানে শুধু এতটুকু বলা হচ্ছে যে, অনেক জিনিষ মূলতই ঘৃণিত এবং অপছন্দনীয় হয়। কিন্তু তার দ্বারা আবার ভাল ফলাফলও অর্জিত হয়। তাই আল্লাহ তাআলা কিছু নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত জিনিষ নির্ধারণ করেন এবং তা সংঘটিত করেন। কিছু কিছু জিনিষ প্রিয় হওয়া সত্ত্বে তা সংঘটিত করেন না। কেননা যেই নিকৃষ্ট জিনিষটি তিনি নির্ধারণ করেন, তার পথ ধরে অন্য এমন একটি প্রিয় জিনিষ (ফলাফল) অর্জিত হয়, যা আল্লাহর কাছে ঐ প্রিয় বস্ত্ত হতেও অধিক প্রিয় হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ إِنْ يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِثْلُهُ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنْكُمْ شُهَدَاءَ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ وَلِيُمَحِّصَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَيَمْحَقَ الْكَافِرِينَ﴾
‘‘আর তোমরা নিরাশ হয়োনা এবং দুঃখ করোনা। যদি তোমরা মুমিন হও তবে তোমরাই জয়ী হবে। তোমরা যদি আহত হয়ে থাক, তবে তারাও তো তেমনি আহত হয়েছে। আর এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি। এভাবে আল্লাহ্ জানতে চান, কারা ঈমানদার আর তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করতে চান। আর আল্লাহ্ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না। আর এ কারণে আল্লাহ্ ঈমানদারদেরকে পাক-সাফ করার ইচ্ছা করেন এবং কাফেরদেরকে ধ্বংস করে দিতে চান।’’ (সূরা আল-ইমরানঃ ১৩৯-১৪১)
সুতরাং আল্লাহ তাআলা চান যে, মুমিনদের মধ্য হতে এমন কতিপয় মুমিন বিদ্যমান থাকুক, যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে, তাঁর সন্তুষ্টির আশায় তাদের জীবন কোরবানী করবে এবং শহীদ হয়ে তাঁর নৈকট্য হাসিল করবে। এটি আল্লাহর কাছে সমস্ত মানুষের ঈমান আনয়ন থেকেও উত্তম। এই জন্যই তিনি নির্ধারণ করেছেন যে, পৃথিবীতে কাফের থাকুক, কুফুরী থাকুক এবং কাফেরদের মাঝে ও মুসলিমদের মাঝে যুদ্ধ চলতে থাকুক। যাতে করে তার বান্দাদের মধ্য হতে কতিপয়কে শহীদ হিসাবে গ্রহণকরতে পারেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَوْ لَمْ تُذْنِبُوا لَذَهَبَ اللَّهُ بِكُمْ وَلَجَاءَ بِقَوْمٍ يُذْنِبُونَ فَيَسْتَغْفِرُونَ اللَّهَ فَيَغْفِرُ لَهُمْ
ঐ আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তোমরা যদি গুনাহ না করো, তাহলে আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে ধ্বংস করে ফেলবেন এবং তোমাদের বদলে অন্য এমন জাতি সৃষ্টি করবেন, যারা গুনাহ করবে। অতঃপর তারা তাওবা করবে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ৭১৪১)
সুতরাং আল্লাহ তাআলা চেয়েছেন যে, বান্দারা পাপ কাজ করবে এবং তা করার পর অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করার মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকবে। অপরাধ হয়ে যাওয়ার পর তাওবা করা আল্লাহর কাছে একাধারে আনুগত্যের উপর বিদ্যমান থাকার চেয়ে অধিক প্রিয়। এই জন্যই আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য পাপকাজ নির্ধারণ করেছেন। ঠিক তেমনি বান্দার দ্বারা পাপ হওয়ার মধ্যে আল্লাহ তাআলার الغفور গাফুর (ক্ষমাকারী), الرحيم (দয়াকারী) ইত্যাদি অতি সুন্দর নাম ও সুমহান সিফাতের প্রভাব প্রকাশিত হয়। সুতরাং আল্লাহর নিকট অপছন্দনীয় বিষয় তথা পাপ কাজ থাকার কারণেই আল্লাহর অনেক সুমহান গুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তাই দেখা গেল আল্লাহ তাআলা যেসব অকল্যাণ সৃষ্টি করেন, তার মধ্যে হিকমতে ইলাহী হচ্ছে, তাতে অন্যান্য প্রিয় ফলাফল অর্জিত হয়। সুতরাং সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রশংসা করা আবশ্যক। বলাবহুল্য যে, পূর্বোক্ত হাদীছে আল্লাহ পাক আদৌ পাপের প্রতি উৎসাহ দিচ্ছেন না; বরং পাপ হয়ে গেলে যাতে বান্দা নিরাশ হয়ে ক্ষমা চাওয়া থেকে বিরত না হয়, তা বলা উদ্দেশ্য। তাই তো মূলনীতি হচ্ছে, পাপ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে আল্লাহর ভয়কে প্রাধান্য দেয়া, যাতে পাপ না সংঘটিত হয়। পক্ষান্তরে শত অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পাপ যদি হয়েই যায়, তাহলে এহেন মুহূর্তে আশাকে প্রাধান্য দিতে হবে। যাতে ক্ষমা চাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে না যায়।