লগইন করুন
ইরাদায়ে কাওনীয়া এবং ইরাদায়ে শরঈয়ার মধ্যে পার্থক্য:
(১) ইরাদায়ে কাওনীয়া তথা আল্লাহর সৃষ্টি ও অমোঘ বিধানগত ইচ্ছার মাধ্যমে যা হয়, আল্লাহ কখনো তাকে ভালবাসেন ও তাতে সন্তুষ্ট থাকেন আবার কখনো তা তিনি ভালবাসেন না এবং উহার প্রতি সন্তুষ্টও থাকেন না।
আর ইরাদায়ে শারঈয়ার মাধ্যমে যা সংঘটিত হয়, তাকে তিনি অবশ্যই ভালবাসেন এবং উহার প্রতি সন্তুষ্টও থাকেন। সুতরাং সকল প্রকার পাপকাজ এবং অকল্যাণও আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে শামিল। সে হিসাবে সৃষ্টি ও অমোঘ বিধানগত দিক থেকে তিনি পাপাচার সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেছেন, কিন্তু আল্লাহ তাআলা পাপ কাজকে ভালবাসেন না এবং উহার প্রতি সন্তুষ্টও থাকেন না। তিনি তাতে লিপ্ত হওয়ার আদেশও করেন নি; বরং তা থেকে বিরত থাকার জন্য কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।
(২) ইরাদায়ে কাওনীয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা যা সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেন, তা সৃষ্টি করা মূল উদ্দেশ্য হয়না; বরং তা অন্য এক বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা ইবলীস এবং সকল প্রকার পাপাচার ও অকল্যাণ সৃষ্টি করেছেন। যাতে করে মুমিন বান্দাগণ নফ্সে আম্মারা ও শয়তানের সাথে সর্বদা জিহাদে লিপ্ত থাকে। শয়তানের প্ররোচনা ও ধোঁকায় নিপতিত হয়ে মানুষ পাপকাজে লিপ্ত হয়ে গেলেও আল্লাহর কাছে তারা তাওবা করে এবং ক্ষমা চায়। এমনি আরো ভালো উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা অন্যায় ও অকল্যাণ সৃষ্টি করেছেন।[1]
ঐদিকে শরঈ ইচ্ছার দ্বারা আল্লাহ তাআলা যা সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেন, তা মূলতই উদ্দেশ্য হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি ও শরীয়তগত এই উভয় দিক থেকেই ইচ্ছা করেছেন যে, বান্দারা তাঁর আনুগত্য করুক। কেননা তিনি আনুগত্যের কাজকে ভালবাসেন এবং উহার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন।
(৩) আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি ও অমোঘ বিধানগত ইচ্ছা অবশ্যই সংঘটিত হয়। অর্থাৎ এর মাধ্যমে তিনি যা সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেন, সাথে সাথে তা সৃষ্টি হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ (৮২) فَسُبْحَانَ الَّذِي بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ﴾
‘‘আল্লাহ তাআলা যখন কোন কিছুর ইচ্ছা করেন তখন তিনি শুধু বলেন যে, হয়ে যাও। সাথে সাথেই তা হয়ে যায়৷ পবিত্র সেই সত্তা, যার হাতে রয়েছে প্রত্যেকটি জিনিষের পূর্ণ কর্তৃত্ব এবং তাঁরই দিকে তোমাদের ফিরে যেতে হবে’’। (সূরা ইয়াসীনঃ ৮২-৮৩)
আর শারঈ ইচ্ছার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা যা ইচ্ছা করেন, তা সকল ক্ষেত্রে সংঘটিত হওয়া আবশ্যক নয়। কখনো তা সংঘটিত হয়, আবার কখনো হয়না।
একটি জ্ঞাতব্য বিষয়:
অনুগত একনিষ্ঠ মুমিন মুখলিস বান্দার মধ্যে ইরাদায়ে কাওনীয়া এবং ইরাদায়ে শারঈয়াহ উভয়টিই একত্রে বাস্তবায়ন হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিগত ও নির্ধারণের দিক থেকে সৎকাজ সংঘটিত হওয়ার ইচ্ছা করেছেন এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্য ইরাদায়ে শরঈয়ার মাধ্যমে আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহর যেই বান্দা আল্লাহর এই হুকুম কবুল করে নিয়েছে, তার মধ্যে আল্লাহর দু’টি ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে।
আর অপরাধীর অপরাধের মধ্যে শুধু ইরাদায়ে কাওনীয়াই বাস্তবায়ন হয়। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্যের পথ বর্জন করে, তার দ্বারা অপরাধটি হয় শুধু এই হিসাবে যে, আল্লাহ তাআলা উক্ত অপরাধের স্রষ্টা;[2] তাতে আদৌ আল্লাহর আদেশ ও সন্তুষ্টি থাকেনা।
আরেকটি জ্ঞাতব্য বিষয়: যারা আল্লাহ তাআলার উপরোক্ত উভয় প্রকার ইরাদাহ সাব্যস্ত করেনি এবং উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করেনি, তারা পথভ্রষ্ঠ হয়েছে। যেমন জাবরীয়া এবং কাদরীয়া (মুতাযেলা) সম্প্রদায়ের লোকেরা। জাবরীয়ারা শুধু আল্লাহর ইরাদায়ে কাওনীয়া সাব্যস্ত করেছে। কাদরীয়ারা শুধু আল্লাহ তাআলার ইরাদায়ে শারঈয়া সাব্যস্ত করেছে। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের লোকেরা উভয় প্রকার ইরাদাই আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেছে এবং উভয়ের মধ্যে পার্থক্যও করেছে।[3]
বিষয়টি সহজভাবে বুঝানোর জন্য কিছু দৃষ্টান্ত পেশ করা যেতে পারে। যেমন ধরুন কুরাইশ নেতা ও মক্কার প্রভাবশালী ব্যক্তি আবু তালিবের ঈমান না আনা এবং কিয়ামতের দিন তার শাস্তি ভোগ করার উদাহরণটি পেশ করা যেতে পারে। সম্ভবত তার ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার হিকমতটি এমন ছিল যে, আল্লাহ তাআলা তাকে তার বাপ-দাদাদের দ্বীনের উপর রেখেই তার দ্বারা তাঁর প্রিয় বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হেফাজত করবেন এবং মুসলমানদের চরম বিপদের সময় এমন কল্যাণ সাধন করবেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত ইতিহাসে লিখা থাকবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আবু তালেবকে তার পিতৃধর্মে লিপ্ত রেখে মুসলমানদের জন্য প্রচুর কল্যাণ সাধন করেছেন। কিন্তু সে যেহেতু তার ভাতিজার নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনয়ন করেনি, তাই আল্লাহ তাআলার ন্যায় বিচারের কারণেই পরকালের নেয়ামত তার ভাগ্যে জুটবেনা।
বিষয়টিকে আরো খোলাসা করে বুঝানোর জন্য খিযির (আঃ) কর্তৃক মিসকীন লোকদের নৌকা ছিদ্র করে ফেলা ও একজন নিরপরাধ শিশুকে হত্যা করার উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে। এর পিছনে আল্লাহ তাআলার কী হিকমত লুকায়িত ছিল- মুসা (আঃ) প্রথমে বুঝতে পারেন নি বলেই তিনি খিযির (আঃ)এর কাজের জোরালো প্রতিবাদ করেছেন। পরক্ষণেই খিযির (আঃ) স্বীয় কর্ম-কান্ডের হিকমত খোলাসা করে বলে দিয়েছেন। মূলতঃ শুধু শুধু ক্ষতির জন্যই আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় কোন অন্যায় কর্ম সংঘটিত হয়না। আল্লাহর প্রত্যেকটি কাজের পিছনেই কোন না কোন হিকমত ও কল্যাণ থাকে।
নৌকা ছিদ্র করা মিসকীন লোকদের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু তার মধ্যে যেই কল্যাণ রয়েছে, তা সেই ক্ষতির চেয়ে বহুগুণ উপকারী। কারণ ভালো নৌকাগুলো যালেম বাদশাহর লোকেরা ছিনিয়ে নেয়। ত্রুটিপূর্ণ নৌকার উপর তারা হস্তক্ষেপ করেনা। সুতরাং নৌকা একেবারেই না থাকার চেয়ে ছিদ্র অবস্থায় তা থাকা তাদের জন্য কল্যাণকর।
খিযির (আঃ) যেহেতু জানতে পারলেন ছেলেটি বড় হয়ে কাফের হবে এবং পিতামাতাকে কষ্ট দিবে, তাই হত্যা করা বাহ্যিক দৃষ্টিতে অন্যায় হলেও এই হত্যাকান্ডের পিছনেই রয়েছে ছেলেটির জন্য কল্যাণকর এবং তার পিতামাতার জন্যও কল্যাণকর। ছেলেটির জন্য এই বয়সে নিহত হওয়া এই দিক থেকে উপকারী যে, এখনো তার দ্বারা কোন অন্যায় কাজ হয়নি। সে নিহত হওয়ার পর জান্নাতে যাবে। অপর পক্ষে বড় হয়ে কুফুরী ও পাপ কাজে লিপ্ত হয়ে জাহান্নামে যাওয়া তার জন্য ক্ষতিকর ছিল। ঐ দিকে আল্লাহ তাআলা তার বিনিময়ে পিতামাতাকে এমন সৎ সন্তান দান করবেন, যারা পিতামাতার প্রতি আনুগত্য থাকবে।
এমনি প্রচুর বৃষ্টি অনেক সময় কারো জন্য ক্ষতিকর হলেও তাতে আম মানুষের জন্য প্রচুর কল্যাণ থাকে। অনেক সময় বন্যায় কারো ঘরবাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। বাড়িঘর নষ্ট হওয়া অবশ্যই তাদের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এর মধ্যেও তাদের কল্যাণ থাকতে পারে। যেমন ধরুন ঝড়ে কোন গ্রামের কতিপয় লোকের বাড়িঘর ধ্বংস হলো আবার কারো বাড়িঘর অক্ষত রইল। যাদের বাড়িঘর নষ্ট হলো তারা মনক্ষুন্ন হলো। আর যাদের বাড়িঘর নষ্ট হলোনা, তারা খুশী হলো। পরক্ষণই যখন সরকারী ঘোষণা আসল, যাদের বাড়িঘর নষ্ট হয়েছে, তাদের প্রত্যেককে উত্তরায় একটি বাড়ি দেয়া হবে, তখন যাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়নি, তারাও কামনা করল যে, তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হলেই ভাল হতো। সুতরাং আল্লাহর প্রত্যেক কাজই ভাল। যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে কোন কোন কাজ ক্ষতিকর দেখা যায়।
আল্লাহ তাআলা মদপানসহ অন্যান্য সকল ক্ষতিকর কাজ সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে লিপ্ত হতে নিষেধ করেছেন। ইচ্ছার স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে সে আল্লাহর এই নিষেধাজ্ঞা লংঘন করে মানুষ মদপানে লিপ্ত হতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই অুনতপ্ত হয়ে তাওবা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন। শুধু তাই নয় এই তাওবাও তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি এবাদতে পরিণত হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে মদ পান করে শুধু আল্লাহর নাফরমানী করা হোক এই জন্যই আল্লাহর ইচ্ছায় মদ সৃষ্টি হয়নি; বরং সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে পরীক্ষার ক্ষেত্র তৈরী হয় কিংবা ভুল করে মদ পান করা হলেও তা থেকে তাওবা করে মদ্যপায়ী আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হতে পারে।
মোট কথা, আল্লাহ তাআলা অযথা কোন কিছুই সৃষ্টি করেন না এবং তার কোন কর্মও হিকমত ছাড়া সংঘটিত হয়না। যা আমরা অনেক ক্ষেত্রেই বুঝতে পারিনা। তাই আমাদের সকল অবস্থাতেই আল্লাহর প্রশংসা করা আবশ্যক।
[2] - আল্লাহ তাআলা মানুষের মধ্যে ভাল বা মন্দের যে কোন একটি বেছে নেয়ার যে স্বাধীনতা সৃষ্টি করেছেন, মানুষ তার সেই স্বাধীনতার অপব্যবহর করে বলেই তার দ্বারা অপরাধ সংঘটিত হয়। আল্লাহ তাআলা তা সৃষ্টি করেছেন; এ জন্য নয়। সেই সাথে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, বান্দার কর্ম সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পূর্ব থেকেই অবগত আছেন। ফলে তিনি তা লিখিয়েছেন। তাই এ কথা বলার আদৌ কোনো অবকাশ নেই যে, আল্লাহ তাআলা লিখিয়ে রেখেছেন বলেই বান্দারা পাপ করে থাকে।
[3] - আল্লাহর ইচ্ছার ক্ষেত্রে জবরীয়া ও কাদরীয়া সম্প্রদায়ের মতবাদ ভালভাবে বুঝার জন্য আরেকটু খোলাসা করার প্রয়োজন রয়েছে। জাবরীয়ারা বলে থাকে ভাল-মন্দ সবকিছুই আল্লাহর একটিমাত্র ইচ্ছা তথা সৃষ্টিগত ইচ্ছাতেই সংঘটিত হয় এবং আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে শুধু তাঁর এই একটি ইচ্ছারই বাস্তবায়ন হয়। এমনকি বান্দার কর্মে সে স্বাধীনও নয়। তারা মনে করে এতে বান্দার ইচ্ছা ও স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে খর্ব করা হয়েছে। কুরআন-সুন্নাহর দলীল-প্রমাণ এবং বাস্তবতা তাদের এই মতবাদকে বাতিল প্রমাণিত করেছে।
আর কাদরীয়া তথা মুতাযেলাদের মতে আল্লাহর জন্য শুধু ইরাদায়ে শরঈয়া সাব্যস্ত। অর্থাৎ আল্লাহ শুধু তার বান্দাদেরকে ভাল কাজ করার আদেশ দিয়েছেন। আর বান্দারা তাদের কাজ-কর্মের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন। অন্য কথায় তারাই তাদের কর্মের স্রষ্টা ও ইচ্ছা পোষণকারী। এমনকি বান্দার দ্বারা কাজ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে আল্লাহ সে স্পর্কে জানেনও না। (নাউযুবিল্লাহ) এটিও একটি বাতিল ও তাওহীদ বিরোধী কথা। কারণ (নাউযুবিল্লাহ) এতে একাধিক স্রষ্টা থাকা আবশ্যক হয়।
এ সম্পর্কে এবং অন্যান্য বিষয়ে কাদরীয়া ও জাবরীয়া সম্প্রদায়ের কথা ও তাদের কথার জবাব বিস্তারিতভাবে জানার জন্য আমাদের অন্যতম অনুবাদগ্রন্থ শরহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া পড়ার অনুরোধ করা গেল। (আল্লাহই তাওফীক দাতা)