শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া আরশ ও কুরসীসহ আল্লাহর আরো কতিপয় বিশাল বিশাল সৃষ্টি সম্পর্কে অনুবাদকের সংযুক্তি ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী]
আরশ ও কুরসীসহ আল্লাহর আরো কতিপয় বিশাল বিশাল সৃষ্টি সম্পর্কে অনুবাদকের সংযুক্তি

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,

ما السموات السبع والأرضون السبع في كف الرحمن إلا كحبة خردل في كف أحدكم

‘‘তোমাদের কারো হাতে একটা সরিষার দানা যেমন সামান্য স্থান দখল করে, সাত আসমান ও সাত যমীন আল্লাহ তাআলার হাতের তালুতে ঠিক তেমনই’’।[1]

ইবনে জারীর তাবারী (রঃ) স্বীয় তাফসীরে বর্ণনা করেন, আমার কাছে বর্ণনা করেছেন ইউনুস। ইউনুস বলেনঃ আমাকে সংবাদ দিয়েছেন ইবনে ওয়াহাব, ইবনে ওয়াহাব বলেনঃ ইবনে যায়েদ তার পিতা হতে বর্ণনা করেছেন। ইবনে যায়েদ বলেনঃ ‘‘আমার পিতা আমাকে বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম বলেছেন,্র

ما السموات السبع فى الكرسى إلا كدراهم سبعة القيت فى ترس

‘‘কুরসীর মধ্যে সাত আসমানের অবস্থান ঠিক তেমনি, যেমন একটি ঢালের মধ্যে নিক্ষিপ্ত সাতটি দিরহামের অবস্থান’’।

তিনি আরো বলেনঃ ‘আবু যার (রাঃ) বলেছেনঃ ‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­ামকে এ কথা বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেনঃ

ما الكرسى فى العرش إلا كحلقه من حديد القيت بين ظهرى فلاة من الأرض

‘‘আরশের মধ্যে কুরসীর অবস্থান ঠিক সে রকমই যেমন ভূপৃষ্ঠের কোন উন্মুক্ত ময়দানে পড়ে থাকা একটি আংটি’’।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,

ما بين السماء الدنيا والتي تليها مسيرة خمس مئة عام ومابين كل سماء مسيرة خمس مائة عام وما بين السماء السابعة والكرسي مسيرة خمس مئة عام وما بين الكرسي والماء مسيرة خمس مئة عام والعرش على الماء والله عز و جل على العرش يعلم ما أنتم عليه

‘‘দুনিয়ার আকাশ এবং এর পরবর্তী আকাশের মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ’ বছরের পথ। আর এক আকাশ থেকে অন্য আকাশের দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। এমনি সপ্তমাকাশ এবং কুরসীর মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। কুরসী এবং পানির মাঝখানে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। আরশ হচ্ছে পানির উপরে। আর আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে। তোমাদের আমলের কোন কিছুই তাঁর কাছে গোপন নয়’’।

হাম্মাদ বিন সালামা হতে এই হাদীছ ইবনে মাহদী বর্ণনা করেন আসেম হতে, আসেম বর্ণনা করেন যির্ হতে, তিনি বর্ণনা করেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে। অনুরূপ বর্ণনা করেন মাসউদী আসেম হতে, তিনি আবি ওয়ায়েল হতে এবং তিনি আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন।

ইমাম যাহাবী (রঃ) উপরোক্ত সনদ বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেনঃ অনেক সনদে এই বর্ণনা এসেছে।

আববাস বিন আবদুল মুত্তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ্র

هَلْ تَدْرُونَ كَمْ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ قَالَ قُلْنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَال্َর بَيْنَهُمَا مَسِيرَةُ خَمْسِمِائَةِ سَنَةٍ وَمِنْ كُلِّ سَمَاءٍ إِلَى سَمَاءٍ مَسِيرَةُ خَمْسِمِائَةِ سَنَةٍ وَكِثَفُ كُلِّ سَمَاءٍ مَسِيرَةُ خَمْسِمِائَةِ سَنَةٍ وَبَيْنَ السَّمَاءِ السَّابِعَةِ وَالعَرْشِ بَحْرٌ بَيْنَ أَسْفَلِهِ وَأَعْلاَهُ كَمَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ وَاللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى فَوْقَ ذَلِكَ وَلَيْسَ يَخْفَى عَلَيْهِ مِنْ أَعْمَالِ بَنِى آدَمَ شَىْءٌ

‘‘তোমরা কি জানো, আসমান ও যমীনের মধ্যকার দূরত্ব কত?’’ আমরা বললামঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সবচেয়ে অধিক জানেন। তিনি বললেন, ‘‘আসমান ও যমীনের মাঝে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। এক আকাশ থেকে অন্য আকাশের দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ’ বছরের পথ। প্রত্যেক আকাশের ঘনত্বও (পুরুত্ব) পাঁচশ’ বছরের পথ। সপ্তমাকাশ ও আরশের মধ্যখানে রয়েছে একটি সাগর। যার উপরিভাগ ও তলদেশের মাঝে দূরত্ব হচ্ছে আকাশ ও যমীনের মধ্যকার দূরত্বের সমান। আল্লাহ তাআলা এর উপরে রয়েছেন। আদম সন্তানের কোন কর্মকান্ডই তাঁর অজানা নয়’’। ইমাম আবু দাউদ (রঃ) এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[2]

আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের হাদীছটি লেখক এখানে সংক্ষিপ্ত করে উল্লেখ করেছেন। আবু দাউদের বর্ণনাটি ঠিক এ রকম, আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ) বলেন,্র

كُنْتُ فِى الْبَطْحَاءِ فِى عِصَابَةٍ فِيهِمْ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَمَرَّتْ بِهِمْ سَحَابَةٌ فَنَظَرَ إِلَيْهَا فَقَالَ مَا تُسَمُّونَ هَذِهِ قَالُوا السَّحَابَ قَالَ وَالْمُزْنَ قَالُوا وَالْمُزْنَ قَالَ وَالْعَنَانَ قَالُوا وَالْعَنَانَ قَالَ أَبُو دَاوُدَ لَمْ أُتْقِنِ الْعَنَانَ جَيِّدًا قَالَ هَلْ تَدْرُونَ مَا بُعْدُ مَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ قَالُوا لاَ نَدْرِى قَالَ إِنَّ بُعْدَ مَا بَيْنَهُمَا إِمَّا وَاحِدَةٌ أَوِ اثْنَتَانِ أَوْ ثَلاَثٌ وَسَبْعُونَ سَنَةً ثُمَّ السَّمَاءُ فَوْقَهَا كَذَلِكَ حَتَّى عَدَّ سَبْعَ سَمَوَاتٍ ثُمَّ فَوْقَ السَّابِعَةِ بَحْرٌ بَيْنَ أَسْفَلِهِ وَأَعْلاَهُ مِثْلُ مَا بَيْنَ سَمَاءٍ إِلَى سَمَاءٍ ثُمَّ فَوْقَ ذَلِكَ ثَمَانِيَةُ أَوْعَالٍ بَيْنَ أَظْلاَفِهِمْ وَرُكَبِهِمْ مِثْلُ مَا بَيْنَ سَمَاءٍ إِلَى سَمَاءٍ ثُمَّ عَلَى ظُهُورِهِمُ الْعَرْشُ بَيْنَ أَسْفَلِهِ وَأَعْلاَهُ مِثْلُ مَا بَيْنَ سَمَاءٍ إِلَى سَمَاءٍ ثُمَّ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى فَوْقَ ذَلِكَ

‘‘আমি একদা একদল সাহাবীর সাথে খোলা ময়দানে বসা ছিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও সেখানে ছিলেন। তখন তাদের উপর দিয়ে এক খন্ড মেঘ অতিক্রম করার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেদিকে তাকিয়ে বললেনঃ তোমরা এটিকে কী বলো? তারা বললোঃ السحاب ‘‘এটিকে আমরা মেঘ বলি’’। তিনি তখন বললেনঃ والمزن (আলমুয্ন)। সাহাবীরা বললোঃ আমরা এটিকে মুয্নও বলি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ والعنان (আলআনান)। সাহাবীগণ বললোঃ আমরা আনানও বলি। ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বলেনঃ আমি আনান শব্দটি ভালভাবে বুঝতে পারিনি। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তোমরা কি জানো আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানের দূরত্ব কতটুকু? সাহাবীগণ বললোঃ আমরা জানিনা। তিনি বললেনঃ উভয়ের মধ্যে রয়েছে হয় একাত্তর বছরের, না হয় বাহাত্তর বছরের না হয় তেহাত্তর বছরের দূরত্ব। এমনি প্রত্যেক আকাশ ও তার পরবর্তী আকাশের মধ্যবর্তী দূরত্ব হচ্ছে একই রকম। এভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাতটি আসমান গণনা করলেন। সপ্তম আকাশের উপর রয়েছে একটি সাগর। সাগরের উপর হতে নীচের দূরত্ব (গভীরতা) হচ্ছে এক আসমান থেকে অন্য আসমানের মধ্যকার দূরত্বের সমান। সাগরের উপরে রয়েছে আটটি ওয়াল (বিশাল আকারের আট ফেরেশতা)। তাদের হাঁটু থেকে পায়ের খুর পর্যন্ত দূরত্ব এক আসমান থেকে অন্য আসমানের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। তাদের পিঠে রয়েছে আল্লাহর আরশ। আরশ এত বিশাল যে, তার নীচের অংশ হতে উপরের ছাদ পর্যন্ত দূরত্ব হচ্ছে এক আসমান থেকে অন্য আসমানের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। আর আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আরশের উপরে’’।[3] অনুবাদকের সংযুক্তি এখানেই শেষ।

وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا আর আসমান ও যমীনকে ধারণ করা তাঁর জন্য মোটেই কঠিন নয়ঃ আসমান-যমীনসহ উর্ধ্বজগৎ ও নিম্নজগতের সবকিছু সংরক্ষণ করা আল্লাহর জন্য মোটেই কঠিন ও ভারী অনুভব হয়না। কেননা তাঁর শক্তি ও ক্ষমতা সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত।

وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ আর তিনি সর্বোচ্চ ও মহান সত্তাঃ অর্থাৎ সকল দিক থেকেই আল্লাহ তাআলার জন্য সৃষ্টির উপরে হওয়া সুপ্রমাণিত ও সুসাব্যস্ত। আল্লাহর যাত সুউচ্চ। অর্থাৎ তিনি সকল সৃষ্টির উপরে। তিনি আরশেরও উপরে।

আল্লাহর মর্যাদা ও বড়ত্ব সর্বোচ্চ। সুতরাং তাঁর জন্য রয়েছে পরিপূর্ণ সিফাতসমূহ এবং সুমহান গুণাবলী।

আল্লাহ তাআলার শক্তি এবং ক্ষমতাও সর্বোচ্চ। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান, সকল সৃষ্টির পরিচালক এবং কোন কিছুই তাঁর জন্য অসম্ভব নয়।

الْعَظِيمُ (সুমহান) হচ্ছেন এমন সত্তা, যার মধ্যে বড়ত্বের সকল সিফাতই বিদ্যমান। সুতরাং নবী, ফেরেশতা এবং মুমিন বান্দাদের অন্তরে রয়েছে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ সম্মান।

সুতরাং আয়াতুল কুরসীর মধ্যে যেহেতু আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব ও মর্যাদার এতগুলো গুণ বিদ্যমান, তাই এটি কুরআনের সর্বাধিক মর্যাদাবান আয়াত হওয়ার দাবী রাখে এবং এটি তার পাঠকারীকে সকল প্রকার অকল্যাণ ও শয়তান থেকে হেফাজতকারী হিসাবে পরিগণিত হওয়ারও হকদার।

আয়াতুল কুরসী থেকে এই দলীল পাওয়া গেল, আল্লাহ তাআলা নিজেকে যেসব গুণে গুণান্বিত করেছেন এবং নিজেকে যেসব নামে নামকরণ করেছেন, সে ক্ষেত্রে তিনি আয়াতুল কুরসীতে শির্কের নেতিবাচক বক্তব্য এবং তাওহীদের ইতিবাচক বক্তব্য একত্রিত করেছেন। আয়াতুল কুরসী আল্লাহর জন্য একদিকে যেমন সুমহান, সর্বোচ্চ ও পরিপূর্ণ গুণাবলী সাব্যস্ত করেছে, অন্যদিকে তাঁর পবিত্র সত্তা হতে সকল দোষ-ত্রুটি এবং অশোভনীয় বৈশিষ্টগুলোকে দূর করে দিয়েছে।

আল্লাহ তাআলার বাণীঃ اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ ‘‘তিনি আল্লাহ, তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই’’ এতে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য এবাদত অস্বীকার করা হয়েছে এবং একমাত্র আল্লাহর জন্য এবাদতকে সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার বাণী:

﴿الْحَيُّ الْقَيُّومُ﴾

‘‘তিনি চিরজীবন্ত ও সবকিছুর ধারক’’ এতে সাব্যস্ত করা হয়েছে যে, আল্লাহর জন্য রয়েছে হায়াত (পূর্ণ জীবন), অবিনশ্বরতা এবং সবকিছুর রক্ষণাবেক্ষণ ও ধারণ করার গুণাবলী। আল্লাহ তাআলার বাণী﴾: لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ﴿ ‘‘তন্দ্রা ও নিদ্রা তাকে স্পর্শ করতে পারেনা’’ এতে আল্লাহ তাআলা থেকে তন্দ্রা ও নিদ্রাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার বাণীঃ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ‘‘আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, সব তাঁরই’’ এতে উর্ধ্ব জগতের এবং নিম্ন জগতের পূর্ণ মালিকানা কেবল আল্লাহর জন্যই সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার বাণী: ﴾ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ ﴿ ‘‘এমন কে আছে যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে?’’ আল্লাহর জন্য যেহেতু রয়েছে পূর্ণ বড়ত্ব, মর্যাদা এবং তিনি যেহেতু তাঁর সৃষ্টি হতে সম্পূর্ণ অমূখাপেক্ষী, তাই বিনা অনুমতিতে তাঁর নিকট শাফাআত অস্বীকার করা হয়েছে। আল্লাহর বাণী: ﴿يَعْلَم مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ﴾ ‘‘তাদের সম্মুখের ও পশ্চাতের সবই তিনি অবগত আছেন’’ এতে আল্লাহর জন্য প্রত্যেক বস্ত্ত, ঘটনা এবং বিষয় সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত ইলম সাব্যস্ত করা হয়েছে। চাই তা অতীতের বিষয় হোক কিংবা ভবিষ্যতের। আল্লাহর বাণী:

﴿ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ﴾

‘‘তাঁর জ্ঞান থেকে কোন কিছুই তারা পরিবেষ্টন করতে পারেনা। কিন্তু তিনি নিজে যে জিনিষের জ্ঞান মানুষকে দিতে চান, সেটুকুর কথা ভিন্ন’’ সমস্ত মাখলুক যে আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী এবং কোন সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর যে কোন প্রয়োজন নেই- এখানে তা সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহর বাণী: وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ  ‘‘তাঁর কুরসী আসমান ও যমীন পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে’’ এখানে আল্লাহর জন্য কুরসী এবং পূর্ণ বড়ত্ব সাব্যস্ত করা হয়েছে। সেই সাথে আরো সাব্যস্ত করা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলার তুলনায় সৃষ্টি খুবই ছোট ও নগণ্য। আল্লাহর বাণী:﴿وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا﴾ ‘‘আর আসমান ও যমীনকে ধারণ করা তাঁর জন্য মোটেই কঠিন নয়’’ এতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা থেকে অক্ষমতা, অপারগতা এবং ক্লান্তি অস্বীকার করা হয়েছে। আল্লাহর বাণী: وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ  ‘‘আর তিনি সুউচ্চ, সমুন্নত ও মহান’’ এতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার জন্য সকল মাখলুকের উপরে থাকা, সমুন্নত হওয়া এবং বড়ত্বের গুণ সাব্যস্ত করা হয়েছে।

অতঃপর শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ আয়াতুল কুরসীতে আল্লাহর বড় বড় সিফাতের আলোচনা হয়েছে বলেই যে ব্যক্তি রাতে ইহা পাঠ করবে, সারা রাত আল্লাহর পক্ষ হতে তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত থাকবে এবং সকাল পর্যন্ত তাঁর নিকট শয়তান আসতেই পারবেনাঃ এই বক্তব্যের দ্বারা শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) ঐ হাদীছের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যা ইমাম বুখারী (রঃ) আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। তাতে এই কথা রয়েছে, যখন তুমি বিছানায় আশ্রয় নিবে তথা শয্যা গ্রহণ করবে, তখন তুমি আয়াতুল কুরসী তথা ....اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ পাঠ করো। কেননা তুমি যদি উহা পাঠ করো, তাহলে সারা রাত আল্লাহর পক্ষ হতে তোমার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত থাকবে এবং সকাল পর্যন্ত তোমার নিকট শয়তান আসতেই পারবেনা।

জিন ও ইনসানের মধ্য হতে প্রত্যেক বিদ্রোহী ও সীমালংঘনকারীকে শয়তান বলা হয়। شطن থেকে شيطان এর উৎপত্তি হয়েছে। شطَن অর্থ بعُد (দূর হয়েছে)। শয়তান আল্লাহর রহমত থেকে অনেক দূরে চলে গেছে বলেই তাকে শয়তান বলা হয়। অথবা شيطان এর উৎপত্তি হয়েছে شاط يشيط হতে। যখন কোনো জিনিষ খুব কঠিন ও শক্ত হয়, তখনই কেবল তাকে উদ্দেশ্য করে এ রকম কথা বলা হয়।


[1] - সহীহ হাদীছে يد الله (আল্লাহর হাত), كف الله (আল্লাহর হাতের তালু), كف الرحمن (রাহমানের হাতের তালু) এবং আল্লাহ তাআলার সিফাত সংক্রান্ত ইত্যাদি আরো অনেক বিষয়ই বর্ণিত হয়েছে। এ জাতিয় বিষয়ে ইমাম তিরমিযী (রঃ) বলেনঃ আলেমগণ আল্লাহর সুউচ্চ সিফাত সম্পর্কিত হাদীছগুলো এবং দুনিয়ার আসমানে আল্লাহ তাআলার নেমে আসা সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো সুসাব্যস্ত ও সুপ্রমাণিত বলেছেন। আমরা এগুলো বিশ্বাস করি, কোন প্রকার ধারণা করা যাবেনা এবং এ কথা বলা যাবেনা যে, كيف (তা কিভাবে?)। ইমাম মালেক, সুফিয়ান বিন উয়াইনা এবং আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রঃ) থেকে এভাবেই বর্ণিত হয়েছে। এই হাদীছগুলোর ব্যাপারে কথা হচ্ছে أمروها بلا كيف অর্থাৎ যেভাবে এসেছে, সেভাবেই ছেড়ে দাও। এ কথা বলোনা যে, কিভাবে? আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের কথাও তাই।

কিন্তু জাহমীয়ারা এই বর্ণনাগুলোকে অস্বীকার করেছে। তাদের কথা হচ্ছে এগুলো আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা হলে সৃষ্টির সাথে তাশবীহ (তুলনা) হয়ে যায়। (নাউযুবিল্লাহ) অথচ আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবের অনেক জায়গায় আল্লাহর হাত, চোখ, শ্রবণ, দৃষ্টি ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন। জাহমীয়ারা এই আয়াতগুলোর তাবীল (ব্যাখ্যা) করেছে। আলেমগণ এগুলোর যেই ব্যাখ্যা করেছেন, তারা এর ভিন্ন ব্যাখ্যা করেছে। তাদের কথা আল্লাহ তাআলা আদমকে স্বীয় হাত দিয়ে সৃষ্টি করেন নি। তাদের কথা হচ্ছে হাত অর্থ কুদরত (শক্তি)!! ইসহাক বিন ইবরাহীম বলেনঃ তাশবীহ (তুলনা) তখনই হবে, যখন বলা হবে আল্লাহর হাত মাখলুকের হাতের মতই, আল্লাহর হাত বান্দার হাতের মতই। এমনিভাবে আল্লাহর শ্রবণ, আল্লাহর দৃষ্টি বান্দার দৃষ্টির মতই। এটি তাশবীহ।

আর আল্লাহ যেমন বলেছেন, সেভাবেই বলা হবে অর্থাৎ হাত, শ্রবণ, দৃষ্টি এবং এই প্রশ্ন করা হবেনা যে, তা কিভাবে? অথবা এটি বলা হবেনা যে, আল্লাহর হাত সৃষ্টির হাতের মতই এবং শ্রবণ শ্রবণের মতই, তখন কোনো তাশবীহ হবেনা। তখন কেবল তেমনই হবে যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃلَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَ هُوَ السَّميْعُ الْبَصِيْرُ ‘‘কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি শুনেন এবং দেখেন’’। (সূরা শুরাঃ ১১) (দেখুনঃ তাফসীরে তাবারী, (৬/২০) ঈষৎ পরিবর্তিত))


[2] - ইমাম আলবানী (রঃ) এই হাদীছকে যঈফ বলেছেন, দেখুনঃ শরহুল আকীদুত্ তাহাবীয়া, (১/৩০৫)।

[3] - তিরমিযী, অধ্যায়ঃ কিতাবুত্ তাফসীর, মুসনাদে আহমাদ, (১/২০৬)। আলেমগণ হাদীছটি সহীহ ও যঈফ হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং তাঁর ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম হাদীছটি সহীহ বলেছেন। ইমাম তিরমিযী বলেনঃ হাদীছটি হাসান গরীব। ইমাম আলবানী হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলায়ে যঈফা, হাদীছ নং- ১২৪৭। যঈফ হওয়া সত্ত্বেও আলেমগণ আসমানের উপর আল্ল­াহর সমুন্নত হওয়া প্রমাণ করতে গিয়ে হাদীছটিকে উল্লেখ করেছেন। তবে আল্লা­হ্ তাআলা উপরে হওয়ার বিষয়ে অনেক বিশুদ্ধ দলীল-প্রমাণ থাকার পরও এ ধরণের যঈফ হাদীছ দ্বারা দলীল গ্রহণ না করাই উত্তম।

এখানে আরেকটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তা এই যে, أوعال (আওআল) শব্দটি وعل এর বহুবচন। এর অর্থে আলেমগণ থেকে একাধিক উক্তি পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেছেনঃ এরা হচ্ছেন বিশাল আকারের ফেরেশতা। কুরআনে ফেরেশতা কর্তৃক আরশ বহনের কথা সুস্পষ্ট করেই বলা হয়েছে।

আবার কেউ কেউ বলেছেনঃ আওআল হচ্ছে আল্লাহর বিশেষ এমন এক সৃষ্টি, যার প্রকৃত রূপ আল্ল­াহ তাআলা ব্যতীত অন্য কেউ জানেনা। কেউ কেউ বলেছেনঃ আওআল হচ্ছে বিশাল আকারের ষাঁড়। আবার কেউ বলেছেনঃ বিরাট আকৃতির শকুন। মোট কথা এগুলো পৃথিবীর পরিচিত কোনো প্রাণী নয়; বরং ফেরেশতা। আল্লাহই অধিক জানেন