লগইন করুন
وَأَصْدَقُ قِيلًا وَأَحْسَنُ حَدِيثًا مِنْ خَلْقِهِ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কালাম সর্বাধিক সত্য এবং তাঁর কথা সৃষ্টির কথার চেয়ে অধিক সুন্দর: তিনি যে সংবাদ দিয়েছেন, তা বাস্তব ও সত্য। আমাদের উপর আবশ্যক হচ্ছে আল্লাহর কথাকে সত্যায়ন করা এবং তার বিরোধীতা না করা। তিনি কুরআন মজীদে যেসব শব্দ নাযিল করেছেন, তা সর্বোত্তম, সর্বাধিক বিশুদ্ধ এবং সর্বাধিক সুস্পষ্ট।[1] তাঁর জন্য যেসব অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী শোভনীয়, তা তিনি নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন এবং সুস্পষ্ট ও পূর্ণরূপে তা বর্ণনা করেছেন। আমাদের উপর ওয়াজিব হচ্ছে সেসব নাম ও গুণাবলীর স্বীকৃতি প্রদান করা এবং তা কবুল করে নেওয়া।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,
ثُمَّ رُسُلُهُ صَادِقُونَ مُصَدَّقُونَ بِخِلَافِ الَّذِينَ يَقُولُونَ عَلَيْهِ مَا لَا يَعْلَمُونَ
আল্লাহ তাআলার রাসূলগণ সত্যবাদী এবং সত্যবাদী হিসাবে সমর্থিত। তারা ঐসব লোকদের সম্পূর্ণ বিপরীত, যারা আল্লাহ সম্পর্কে না জেনেই কথা বলে।
ব্যাখ্যা: শাইখুল ইসলামের এই কথাটি তার পূর্বোক্ত উক্তি: তিনি তাঁর নিজের সম্পর্কে এবং অন্যদের সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত, -এর সাথে সংযুক্ত। صِدق (সিদ্ক) সত্য খবর সেই খবরকে বলা হয়, যা বাস্তবের হুবহু অনুরূপ হয়। অর্থাৎ রাসূলগণ আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে আল্লাহর অতি সুন্দর নাম ও সু্উচ্চ গুণাবলী এবং অন্যান্য বিষয়ে যেসব খবর দিয়েছেন, তাতে তারা সত্যবাদী। ফেরেশতাদের মাধ্যমে তাদের কাছে আল্লাহর নিকট থেকে যেই খবর এসেছে, তাতে তারা সত্যায়িত। কেননা তা আল্লাহর নিকট হতে এসেছে। তারা নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে কোনো কথা বলেন না। আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে তাঁর রাসূলদের কাছে যেই সংবাদ পৌঁছেছে, শাইখুল ইসলাম উপরোক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে উহার সনদকে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করেছেন। আল্লাহ তাআলা রাসূলদের জন্য যা বলেছেন, তা সত্য। আর রাসূলগণ সেই সত্যকে সৃষ্টির নিকট পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং রাসূলগণ আল্লাহর যেসব সিফাত বর্ণনা করেছেন, তা কবুল করে নেয়া আবশ্যক। রাসূলদের কথা ঐসব লোকদের কথার সম্পূর্ণ বিপরীত, যারা আল্লাহ সম্পর্কে না জেনেই কথা বলে। যারা আল্লাহর শরীয়ত, দ্বীন, তাঁর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে বিনা ইলমে কথা বলে, তাদের কথা রাসূলদের কথার সম্পূর্ণ বিপরীত। শুধু তাই নয়; বরং তারা কেবল ধারণা ও কল্পনার বশবতী হয়েই আল্লাহ সম্পর্কে কথা বলে অথবা কেবল উহাই বলে, যা তারা শয়তান থেকে সংগ্রহ করে। যেমন বলে থাকে মিথ্যা নবুওয়াতের দাবীদার, বিদআতী এবং যিন্দীক (অন্তরে কুফরী লুকায়িত রেখে মুখে ইসলাম প্রকাশকারী), যাদুকর, গণক, জ্যোতিষী, স্বার্থান্বেষী ও নিকৃষ্ট আলেমরা। আললাহ তাআলা সূরা শুআরার ২২১-২২৩ নং আয়াতে তাদের পরিচয় উল্লেখ করে বলেন,
﴿هَلْ أُنَبِّئُكُمْ عَلَىٰ مَن تَنَزَّلُ الشَّيَاطِين تَنَزَّلُ عَلَىٰ كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيم يُلْقُونَ السَّمْعَ وَأَكْثَرُهُمْ كَاذِبُونَ﴾
‘‘হে লোকেরা! আমি কি তোমাদের জানাবো শয়তানরা কার উপর অবতীর্ণ হয়? তারা প্রত্যেক মিথ্যুক বদকারের উপর অবতীর্ণ হয়। তারা আকাশ থেকে চুরি করে শোনা কথা কানে ঢুকিয়ে দেয় এবং তাদের বেশির ভাগ লোকই মিথ্যুক’’। আল্লাহ তাআলা সূরা বাকারার ৭৯ নং আয়াতে আরো বলেনঃ
﴿فَوَيْلٌ لِّلَّذِينَ يَكْتُبُونَ الْكِتَابَ بِأَيْدِيهِمْ ثُمَّ يَقُولُونَ هَٰذَا مِنْ عِندِ اللَّهِ لِيَشْتَرُوا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا ۖ فَوَيْلٌ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ وَوَيْلٌ لَّهُم مِّمَّا يَكْسِبُونَ﴾
‘‘কাজেই তাদের জন্য ধ্বংস অবধারিত, যারা স্বহস্তে কিতাব লিখে তারপর লোকদের বলে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে৷ এভাবে তারা বিনিময়ে সামান্য স্বার্থ লাভ করে৷ তাদের হাতের লিখনই তাদের ধ্বংসের কারণ এবং তাদের এই উপার্জনও তাদের ধ্বংসের কারণ’’।
সুতরাং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যেহেতু তাঁর নিজের সম্পর্কে এবং সৃষ্টি সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত, তাঁর কালাম যেহেতু সর্বাধিক সত্য, তাঁর কথা যেহেতু সৃষ্টির কথার চেয়ে অধিক উত্তম, রাসূলগণ তাঁর সম্পর্কে যেসব সংবাদ দিয়েছেন, সেসব সংবাদের প্রত্যেকটিতেই যেহেতু তারা সত্যবাদী এবং রাসূলদের ও আল্লাহর মাঝে যেই واسطة (মাধ্যম) রয়েছে এবং যেই মাধ্যমে রাসূলদের কাছে আল্লাহর নিকট থেকে অহী আসে, তা যেহেতু একটি সত্য ও নির্ভুল মাধ্যম, সেটি যেহেতু সম্মানিত ফেরেশতাদের মাধ্যম, তাই আল্লাহ যা বলেছেন এবং তাঁর রাসূলগণ আল্লাহর পক্ষ হতে যেসব সংবাদ দিয়েছেন, তার উপর নির্ভর করা ও তা বিশ্বাস করা আবশ্যক। বিশেষ করে আল্লাহর আসমা এবং সিফাতের বিষয়ে আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের জন্য যা সাব্যস্ত করেছেন তা সাব্যস্ত করতে হবে এবং যা নিজের সত্তা হতে সরিয়ে রেখেছেন ও দূর করে দিয়েছেন, তা সরিয়ে ফেলতে হবে। সেই সাথে বিদআতী লোকেরা রূপক অর্থের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন পদ্ধতিতে আল্লাহর যেসব আসমা ওয়াস সিফাতকে অস্বীকার করেছে, তাদের মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। রাসূলগণ আল্লাহর আসমা এবং সিফাতের বিষয়ে আল্লাহর পক্ষ হতে যেই সংবাদ নিয়ে এসেছেন, বিদআতীরা তা থেকে বিমুখ হয়েছে এবং সেগুলোকে অস্বীকার করেছে। এ ক্ষেত্রে তারা নিজেদের প্রবৃত্তির উপর নির্ভর করেছে কিংবা এমন লোকদের অন্ধ অনুসরণ করেছে, যারা গোমরাহীতে লিপ্ত হওয়ার কারণে আদর্শ ও অনুসরণীয় হওয়ার অযোগ্য।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,
وَلِهَذَا قَالَ الله تعالى ﴿سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُونَ وَسَلامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ﴾ فَسَبَّحَ نَفْسَهُ عَمَّا وَصَفَهُ بِهِ الْمُخَالِفُونَ لِلرُّسُلِ وَسَلَّمَ عَلَى الْمُرْسَلِينَ ؛ لِسَلَامَةِ مَا قَالُوهُ مِنَ النَّقْصِ وَالْعَيْبِ
এই কারণেই আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ ‘‘কাফের-মুশরেকরা তোমার রব সম্পর্কে যেসব কথা তৈরি করেছে তা থেকে তোমার রব পবিত্র, তিনি ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী৷ আর সালাম আল্লাহর রাসূলদের প্রতি এবং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাববুল আলামীনের জন্যই’’। (সূরা সাফফাতঃ ১৮০-১৮২) সুতরাং নবী-রাসূলদের বিরুদ্ধাচরণকারীরা আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে যেসব অশোভনীয় কথা বলেছে, তা থেকে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র বলে ঘোষণা করেছেন। সেই সাথে রাসূলদের উপরও তিনি সালাম পেশ করেছেন। কারণ তারা আল্লাহর যেসব গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, সেগুলো সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র ছিল।
ব্যাখ্যা: শাইখুল ইসলামের উক্তি: لههذا এই কারণেই...: -এতে তিনি তাঁর পূর্বের বক্তব্যের কারণ বর্ণনা করেছেন। কারণ তিনি সেখানে বলেছেন আল্লাহর কালাম এবং রাসূলদের কথা সর্বাধিক সত্য ও সর্বোত্তম।
سبحانه সুবহানাঃ سبحان শব্দটি غفران শব্দের ন্যায় একটি মাসদার (ক্রিয়ামূল)। বাবে তাফ-ঈলের মাসদার التسبيح থেকে এটিকে নেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে সকল দোষ-ত্রুটি হতে আমি আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি।
ربك তোমার রবঃ যিনি রহমত ও নেয়ামত দ্বারা তাঁর সৃষ্টিকে প্রতিপালন করেন এবং যিনি সৃষ্টির একমাত্র মালিক ও প্রভু, তিনিই হলেন রব।
رب العزة রাববুল ইয্যাতঃ রাববুল ইয্যাত অর্থ হচ্ছে ক্ষমতাবান, মর্যাদাবান এবং প্রতাপশালী। এখানে মাওসুফকে (রবকে) সিফাতের দিকে ইযাফত (সম্বোধিত) করা হয়েছে। মূল বাক্যটি এ রকম ছিলঃ الرب العزيز প্রবল ক্ষমতাধর প্রভু।
يَصِفُونَ তারা আল্লাহর সাথে যেসব ওয়াস্ফ (দোষ) যুক্ত করেঃ অর্থাৎ নবী-রাসূলদের বিরোধীরা আল্লাহর সাথে এমনসব দোষ-ত্রুটি যুক্ত করে, যা তাঁর বড়ত্বের জন্য অশোভনীয়।
وَسَلامٌ সালামঃ কেউ কেউ বলেছেন سلام (সালাম) শব্দটি السلام থেকে নেওয়া হয়েছে, যা ইসলামের সম্ভাষণ অর্থে ব্যবহৃত। আবার কেউ বলেছেন سلام শব্দটি সালামত তথা السلامة من النقص والعيب থেকে নেওয়া হয়েছে, যা অপছন্দনীয় বস্ত্ত ও দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়।
الْمُرْسَلِينَরাসূলগণঃ তারাই রাসূল, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টির নিকট প্রেরণ করেছেন। তারা তাদের রবের রেসালাত সৃষ্টির নিকট পৌঁছিয়ে দিয়েছে। المرسلون শব্দটি مرسل এর বহুবচন। নবী ও রাসূলের সংজ্ঞা সম্পর্কে আলোচনা করার সময় উভয়ের মধ্যকার পার্থক্য পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে।
الْعَالَمِينَ সৃষ্টিজগৎঃ عالم এর বহুবচন হচ্ছে الْعَالَمِينَ। আল্লাহ ছাড়া বাকী সবই সৃষ্টিজগতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
উপরের আয়াত তিনটির সংক্ষিপ্ত অর্থঃ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) তাঁর উক্তি: فسبح بنفسه..الخ দ্বারা আয়াতের সংক্ষিপ্ত অর্থ বর্ণনা করেছেন।
উপরোক্ত আয়াতসমূহে যেসব শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে:(১) গোমরাহ ও অজ্ঞ লোকেরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার মর্যাদা ও বড়ত্বের জন্য অশোভনীয় যেসব দোষ-ত্রুটি যুক্ত করে, তা থেকে আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা বর্ণনা করা। (২) উপরোক্ত আয়াতসমূহ দ্বারা রাসূলদের সত্যতা প্রমাণিত হয়। আল্লাহর পক্ষ হতে তারা যা নিয়ে এসেছে এবং আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে তারা যে সংবাদ দিয়েছে, তা কবুল করে নেওয়া আবশ্যক। (৩) রাসূলদের উপর সালাম ও সালাত পেশ করা এবং তাদেরকে সম্মান করা ইসলামী শরীয়তের অন্তর্ভূক্ত। (৪) রাসূলগণ আল্লাহর নিকট থেকে যা নিয়ে এসেছেন, তার বিরোধী প্রত্যেক বিষয় প্রত্যাখ্যান করা ওয়াজিব। বিশেষ করে আল্লাহর আসমা ওয়াস সিফাতের ব্যাপারে রাসূলগণ যেই সংবাদ দিয়েছেন, তার বিরোধী হয় এমন প্রত্যেক কথার প্রতিবাদ করা জরুরী। (৫) আল্লাহর প্রশংসা বর্ণনা করা এবং তাঁর নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আবশ্যক। তাওহীদ হচ্ছে আল্লাহর নেয়ামত সমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ নেয়ামত।