লগইন করুন
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরের গভীরে স্বাভাবিক ও আবেগময় চাহিদা ও প্রয়োজনিয়তা মজ্জাগত ভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রতি নিয়তই তা সামাজিক, পারিবারিক ও ঘর কেন্দ্রিক প্রকাশ পেয়ে থাকে, সমস্ত জিনিসের মধ্য থেকে যে জিনিসটি অন্তরের নিকটতম করে দেয় ও হৃদয়কে জয় করে নেয় তা হল: হাদিয়া বা উপহার-উপঢৌকন।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন:
«أن النبي - صلى الله عليه وسلم - كان يقبل الهدية ويثيب عليها»
নিশ্চয়ই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপহার গ্রহণ করতেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন।[1]
আর এ উপহার প্রদান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হল: অন্তরাত্মার উদারতা, বদান্যতা ও পরিশুদ্ধিতার বহি:প্রকাশ। উদারতা ও মহানুভবতার চরিত্র হল নবীদের চরিত্র এবং রাসূলদের নীতি।
এ ক্ষেত্রে আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন অগ্রনায়ক। কেননা তিনিই তো বলেছেন:
«من كان يؤمن بالله واليوم الآخر فليكرم ضيفه جائزته يوم وليلة، والضيافة ثلاثة أيام فما بعد ذلك فهو صدقة ولا يحل له أن يثوي عنده حتى يحرجه؟».
যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা ও আখেরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন মেহমানদের সমাদর করে। তিন দিন মেহমানদারী, এর মাঝে এক দিন ও এক রাত্রি মেহমানদারী করা মেহমানের প্রাপ্য, এরপর খাওয়ানো সাদকা। মেজবান অতিষ্ট হওয়া অবধি মেহমানের অবস্থান করা বৈধ না।[2]
অতীতের কোন কাল, পৃথিবীর কোন ভূমি এমনকি আরবের হেজাজ বা আরব উপদ্বীপের কোন অঞ্চল বরং বিশ্ব জগত এমন অনুপম আদর্শ ও মহান চরিত্রের অধিকারী কাউকে দেখেনি। আপনার দুই নয়ন সেই দৃশ্যগুলি হতে কয়েকটি দৃশ্য দেখবে।
সাহাল বিন সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
أن امرأة جاءت إلى رسول الله ببردة منسوجة فقالت: نسجتها بيدي لأكسوكها، فأخذها النبي - صلى الله عليه وسلم - محتاجًا إليها، فخرج إلينا وإنها لإزاره فقال فلان: اكسنيها ما أحسنها فقال: «نعم» فجلس النبي - صلى الله عليه وسلم - في المجلس، ثم رجع فطواها، ثم أرسل بها إليه فقال له القوم: ما أحسنت، لبسها النبي - صلى الله عليه وسلم - محتاجًا إليها، ثم سألته، وعلمت أنه لا يرد سائلاً، فقال: إني والله ما سألته لألبسها، إنما سألته لتكون كفني قال سهل: فكانت كفنه».
জনৈক মহিলা হাতে বুনানো সুন্দর একটি চাদর নিয়ে রাসূলের দরবারে উপস্থিত হয়ে বলল: আমি এ চাদরটি নিজ হাতে বুনে আপনাকে পরানোর জন্য নিয়ে এসেছি। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা প্রয়োজনীয় মনে করে গ্রহণ করলেন। এরপর তিনি সেটিকে লুঙ্গির মত পরিধান করে আমাদের মাঝে বের হলেন। ইতিমধ্যে এক ব্যক্তি বলল: কতই না সুন্দর এটি! এটি আমাকে দিবেন কি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাঁ দিব। তিনি আমাদের বৈঠকে কিছুক্ষণ বসার পর উঠে গিয়ে চাদরটি ভাঁজ করে তার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। লোকেরা তাকে বলতে লাগল, তুমি সুন্দর কাজই করেছ! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রয়োজন বশত সেটি পরিধান করেছিলেন তা সত্বেও তুমি তা চেয়েছ। আর তুমি জান যে, তিনি কোন আবেদনকারীকে নিরাশ করেন না। অত:পর সে বলল: আমি এটিকে পরিধান করার জন্য তার কাছে চাইনি, বরং আমি এটিকে কাফন বানানোর জন্য চেয়েছি। সাহাল বলেন: সেটি তার কাফনের কাজেই ব্যবহৃত হয়েছে।[3]
যাকে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা চয়ন করে তাঁর চোখের সামনে প্রতিপালন করেন এবং যাকে আদর্শ বানিয়েছেন তার অনুপম চরিত্র দেখে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দানশীলতায় ও বদান্যতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
হাকীম বিন হিযাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
سألت رسول الله - صلى الله عليه وسلم - فأعطاني ثم سألته فأعطاني، ثم سألته فأعطاني، ثم قال: «يا حكيم، إن هذا المال خضر حلو، فمن أخذه بسخاوة نفس بورك له فيه، ومن أخذه بإشراف نفس لم يبارك له فيه، وكان كالذي يأكل ولا يشبع واليد العليا خير من اليد السفلى».
আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আবেদন করায় তিনি আমাকে দিলেন, আমি আবার আবেদন জানালাম, তিনি পুনরায় আমাকে দিলেন, আবার আবেদন করায় তিনি আমাকে আবেদনানুযায়ী দিয়ে বললেন: হে হাকীম! এই যে সম্পদগুলি এগুলি সবুজ ও মিষ্টি, যে ব্যক্তি একে তৃপ্ত চিত্তে গ্রহণ করবে তাতে বরকত হবে, আর যে ব্যক্তি তা অতৃপ্ত চিত্তে গ্রহণ করবে তাতে বরকত হবে না। এর উদাহরণ ঐ ব্যক্তির মত যে খায় ঠিকই কিন্তু পরিতৃপ্ত হয় না। আর জেনে রেখো! উপরের হাত অর্থাৎ দানকারী, নিচের হাত অর্থাৎ দান গ্রহণকারী চেয়ে উত্তম।[4]
আরবী কবি ঠিকই বলেছেন:
وله كمالُ الدين أعلى همّةيعلو ويسمو أن يقاس بثاني
لمّا أضاء على البرية زانهاوعلا بها فإذا هو الثقلان
فوجدت كل الصيد في جوف الفَرا
ولقيت كلَّ الناس في إنسان
তিনি ইসলামের পরিপূর্ণতায় উচ্চাভিলাষী, তিনি তো জগতে অদ্বিতীয় অতুলনীয় উচ্চাসীন। যেহেতু তাঁর সৌন্দর্য সারা সৃষ্টির উপর আলোকময়। যার মাধ্যমে তিনি জ্বিন ও ইনসানের শীর্ষে আসীন, সবাই তো নির্বুদ্ধিতা ও বর্বরতায় নিমজ্জিত ছিল, তারপর তো মানুষ মানুষে পরিণত হল।
জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
ما سئل النبي - صلى الله عليه وسلم - عن شيء قط فقال، لا.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর নিকট কোন কিছু চাওয়া হলে তিনি কখনো তা না করতেন না।[5]
যতই দানশীলতা, বদান্যতা ও উত্তম চরিত্র হোক না কেন, তার বদান্যতা, দানশীলতা, উদারতা, উত্তম আচরণ ও প্রকৃত আন্তরিকতার কোন নজীর নেই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভ্যাসই ছিল যে তিনি সবার সাথেই হাস্যোজ্জল মুখে কথা বলতেন এমনকি তাঁর সকল সাহাবীই এ ধারনাই পোষণ করত যে, তাঁর নিকট সেই বেশী প্রিয় ব্যক্তি।
জারির ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
«ما حجبني رسول الله - صلى الله عليه وسلم - ولا رآني منذ أسلمت إلا تبسم».
আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই আমার নিকট হতে আড়াল হতেন এবং যখনই আমাকে দেখতেন তখনই তিনি মুচকি হাসি দিতেন।[6]
এক ব্যক্তির সাক্ষ্য তাঁর সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়াটাই আপনার জন্য যথেষ্ট ও উপদেশ মূলক হবে।
আব্দুল্লাহ বিন আলহারেস বলেন:
مارأيت أحدًا أكثر تبسمًا من رسول الله - صلى الله عليه وسلم -».
আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মত হাস্যোজ্জল মুখ আর কারো দেখিনি।[7]
প্রিয় পাঠক! আপনি কি তাঁর মুখের হাসির বর্ণনা শুনে আশ্চর্য হচ্ছেন? আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তিনিই তো বলেছেন: «وتبسمك في وجه أخيك صدقة». “হাস্যোজ্জল মুখে তোমার ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করাটাও সাদকাহ সমতূল্য”।[8]
আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর খাদেম আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর এমন গুণ বর্ণনা করেছেন যা স্বল্প লোকের মাঝেই বর্তমান রয়েছে, বা তাঁর কতিপয় গুণ অল্প সংখ্যক মানুষের মাঝেই কিছু রয়েছে। তিনি বলেন,
أشد الناس لطفًا فما سأله سائل قط إلا أصغى إليه فلا ينصرف رسول الله - صلى الله عليه وسلم - حتى يكون السائل هو الذي ينصرف وما تناول أحد يده قط إلا ناوله إياها فلا ينزع - صلى الله عليه وسلم - يده حتى يكون الرجل هو الذي ينزعها منها».
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাপেক্ষা বিনয়ী ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমীপে কেউ আবেদন করলে তিনি তার দিকে এমন মগ্ন হতেন, যতক্ষণ আবেদনকারী নিজেই না ফিরতেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তার জন্য মগ্ন থাকতেন, এবং কেউ তাঁর হাত ধারণ করলে, তিনি নিজে স্বীয় হাতকে, টেনে নিতেন না, যতক্ষণ না সে লোক স্বীয় হাত টেনে না নিয়েছে”।[9]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত অতিথি পরায়ণ ও তার সাথে এত কোমল ব্যাবহার করতেন এমনকি তিনি তাঁর উম্মতের জন্যই ছিলেন অতীব দয়াশীল। এজন্যই তো তিনি কারো নিকট থেকে শরীয়াহ বিরোধী কোন কিছু প্রকাশ পাওয়া পছন্দ করতেন না।
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুামা হতে বর্ণিত,
أن رسول الله - صلى الله عليه وسلم - رأى خاتمًا من ذهب في يد رجل فنزعه فطرحه، وقال: «يعمد أحدكم إلى جمرة من نار فيجعلها في يده».
তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তির হাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি স্বর্ণের আংটি দেখে তা খুলে ফেলে দিয়ে বললেন: তোমাদের মাঝে কেউ কি এটা চায় যে তার হাতে আগুনের জ্বলন্ত আঙ্গার থাক?।[10]
[2] বুখারী, হাদিস: ৬১৩৫
[3] বুখারী, হাদিস: ১২৭৭
[4] বুখারী, হাদিস: ২৭৫০; মুসলিম, হাদিস: ১০৫২
[5] বুখারী, হাদিস: ৬০৩৪
[6] বুখারী, হাদিস: ৩০৩৫
[7] তিরমিযী, হাদিস: ৩৬৪১
[8] তিরমিযী, হাদিস: ১৯৫৬
[9] আবু নাঈম ফিদ দালায়েল
[10] মুসলিম, হাদিস: ২০৯০