লগইন করুন
১। প্রথম তথ্যঃ লক্ষ্য করা যায় যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ছালাত পাঠের শব্দাবলীর প্রকারসমূহের অধিকাংশ প্রকারেই ইবরাহীম নাবীকে তার বংশধর (آلِ) থেকে বিচ্ছিন্নরূপে স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা হয়নি। বরং তাতে এই শব্দ উল্লেখ হয়েছে- كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ যেভাবে ইবরাহীমের বংশধরের প্রতি সম্মান ও রহমত দার্ন করেছ।
এর কারণ হলো আরবী ভাষায় কোন ব্যক্তির বংশধর বলতে গেলে সে ব্যক্তিও তাদের মধ্যে পরিগণিত হয়। যেমনভাবে পরিগণিত হয় তারা যারা তার সাথে সম্বন্ধ যুক্ত। যেমনটি আল্লাহর এই বাণীতে এসেছেঃ
إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَىٰ آدَمَ وَنُوحًا وَآلَ إِبْرَاهِيمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِينَ
নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম, নূহ, ইবরাহীমের বংশধর ও ইমরানের বংশধরকে বিশ্বের ভিতর থেকে বাছাই করেছেন- (আলে-ইমরান- ৩৩ আয়াত)। আল্লাহ তা’আলার এই বাণীতেও
إِلَّا آلَ لُوطٍ نَجَّيْنَاهُمْ بِسَحَرٍ
শুধু লুত নাবীর বংশধরকে প্রভাতকালে পরিত্ৰাণ দান করেছি। (আল-কামার- ৩৪ আয়াত)
এরই পর্যয়ভুক্ত হলো নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই বাণী-
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى أبِىْ اَوْفَى
হে আল্লাহ! সম্মান ও রহমত দান কর আবু আউফার বংশধরের প্রতি। আর এরূপই (আহলুল বাইত) শব্দের অবস্থা। যেমন আল্লাহর এ বাণীতে এসেছে رَحْمَتُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ আল্লাহর রহমত ও বরকত অবতীর্ণ হোক তোমাদের উপর হে (ইবরাহীমের) গৃহের সদস্যবৃন্দ অর্থাৎ পরিবার বর্গ- (সূরা হুদ- ৭৩ আয়াত)। ইবরাহীম নবীও তাদের বংশধরের মধ্যে গণ্য ।
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেছেনঃ এজন্যই অধিকাংশ শব্দের ভিতরে এসেছে- كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ যেমনভাবে ইবরাহীম নবীর বংশধর এর উপর রহমত ও সম্মান দান করেছ। এমনিভাবে এসেছে- كَمَا بَارَكْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ যেমনভাবে ইবরাহীম নবীর বংশধরের উপর বরকত অবতীর্ণ করেছ। আবার কোন শব্দে স্বয়ং ‘ইবরাহীম’ এসেছে, কারণ সম্মান ও পরিশুদ্ধির এ দু'আয় তিনিই মূল এবং তার সমস্ত বংশধর আনুষঙ্গিকভাবে এটা প্ৰাপ্ত হয়। আর কোন শব্দে এরূপ ও কোন শব্দে ঐরূপ এসেছে এই দুই অবস্থার ব্যাপারে সচেতন করার জন্যই (এ আলোচনার অবতারণা করা হলো)।
পাঠক যখন এটা জানলেন তখন আরেকটি বিষয়ে জানুন, আলিম সমাজের মাঝে একটি প্রশ্ন প্রসিদ্ধি লাভ করেছে তা হচ্ছে- كَمَا صَلَّيْتَ الخ (যেমনভাবে সম্মান ও রহমত দান করেছি... শেষ পর্যন্ত) এর ভিতর উপমার কারণ নিয়ে
আর তা এই জন্য যে, যা উপমিত বিষয় তাকে যার সাথে উপমা দেয়া হয় তার চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের হয়। অথচ এখানে বাস্তবে তার বিপরীত। কারণ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইবরাহীম নবীর চেয়ে উত্তম। অতএব তার উত্তম হওয়ার দাবী এই যে, তার জন্য কাম্য ছালাত অতীতে প্রাপ্ত ও ভবিষ্যতে প্ৰাপ্য সকল ছালাত অপেক্ষা উত্তম হওয়া উচিত।
আলিমগণ এর অনেকগুলো উত্তর দিয়েছেন যার অনেকগুলো আপনি ফাতহুল বারী ও জালাউল আফহান গ্রন্থে পাবেন। সেখানে প্রায় দশটির কাছাকাছি উক্তি রয়েছে। যার একটা আর একটার চেয়ে অধিক দুর্বল- কেবল একটি মাত্র উক্তি ছাড়া। সেটিই কেবল শক্তিশালী- আর এটাকে পছন্দ করেছেন ইবনুল তাইমিয়াহ ও তার শিষ্য ইবনুল কাইয়িম (রহ) আর তা হচ্ছে এই উক্তিটি- ‘নিশ্চয় ইবরাহীম নবীর বংশধরের মধ্যে বহু নবী রয়েছে যাদের মত কোন ব্যক্তি মুহাম্মাদ এর বংশধরের মধ্যে নেই। অতএব, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বংশধরের জন্য যদি ঐ ধরনের ছালাত কামনা করা হয় যে ছালাতের অধিকারী নবী ইবরাহীম ও তার বংশধর ছিল যাদের মধ্যে অনেক নবীও রয়েছেন তাহলে মুহাম্মাদের বংশধরের জন্য এমন মর্যাদা উপার্জিত হচ্ছে যা তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ তারা (যত কৃতিত্বই অর্জন করুক) নবীগণের স্তরে পৌঁছতে পারে না।[1] সুতরাং, নবীগণের জন্য (যাদের ভিতর ইবরাহীম নবীও) প্রযোজ্য অতিরিক্ত মর্যাদার অধিকারী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এথেকেই তার এমন মর্যাদা অর্জিত হচ্ছে যা অন্য কারো জন্য অর্জিত হয় না।
ইবনুল কায়ইম (রহঃ) বলেছেনঃ এ উক্তিটি পূর্বোক্ত উক্তিগুলোর ভিতর সর্বোত্তম। আর এর চেয়ে উত্তম হলো একথা বলা যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবরাহীম নাবীর বংশধরের অন্তর্ভুক্ত বরং তিনি ইবরাহীম নাবীর বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। যেমনটি বর্ণনা করেছেন আলী বিন তলহাহ ইবনু আব্বাস থেকে আল্লাহর এ বাণীর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গেঃ
إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَىٰ آدَمَ وَنُوحًا وَآلَ إِبْرَاهِيمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِينَ
নিশ্চয় আল্লাহ আদম, নূহ, ইবরাহীমের বংশধর ও ইমরানের বংশধরকে সমগ্র জগতের মধ্যে বাছাই করে নিয়েছেন। (সূরা আলে ইমরান ৩৩ আয়াত)
ইবনু আব্বাস (রাযিঃ) বলেনঃ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবরাহীমের বংশের অন্তর্ভুক্ত। আর এটা স্পষ্ট কথা যে, ইবরাহীমের সন্তান সন্ততির অভ্যন্তরস্থ নাবীগণ যদি তার বংশধরের অন্তর্ভুক্ত হয় তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্তর্ভুক্ত হওয়া আরো অগ্ৰাধিকারযোগ্য। অতএব আমাদের কথাঃ
كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ
তাকে (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও ইবরাহীম নাবীর বং সকল নাবীকে শামিল করছে।
অতঃপর আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন আমরা যেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বংশধরের প্রতি বিশেষভাবে ঐ পরিমাণ ছালাত প্ৰদান করি- যে পরিমাণ ছালাত প্ৰদান করি তার উপর সাধারণভাবে ইবরাহীম নাবীর বংশধরের সাথে সম্পৃক্ত করে।
আর তার বংশধরের জন্য এই পরিমাণ ছালাত অর্জিত হচ্ছে যা তাদের জন্য প্রযোজ্য এবং অবশিষ্ট সম্পূর্ণ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্ৰাপ্য। নিঃসন্দেহে ইবরাহীমের বংশধরের জন্য প্ৰাপ্য ছালাত যাদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রয়েছেন এটা ঐ ছালাত অপেক্ষা পরিপূর্ণ যা তাদেরকে সংযুক্ত না করে শুধু তার জন্য কাম্য হয়। তাঁর জন্য উক্ত প্রকার ছালাত থেকে ঐ সুমহান বিষয়টিই কাম্য যা নিঃসন্দেহে ইবরাহীম নাবীর জন্য প্রাপ্য বিষয়ের চেয়ে উত্তম। আর তখনই প্রকাশ পায় উপমা আর মূল অর্থে একে ব্যবহার করার উপকারিতা।
সুতরাং এই শব্দের মাধ্যমে তার জন্য কাম্য ছালাত অন্য শব্দের মাধ্যমে কাম্য ছালাত অপেক্ষা আরো মহান। দু'আর মাধ্যমে যদি ঐ ব্যক্তির অনুরূপ কাম্য হয় যার সাথে উপমা দেয়া হয়েছে المشبه به অর্থাৎ ইবরাহীম ও তাঁর বংশধর তবে তার জন্য তা থেকেও পরিপূর্ণ অংশ সাব্যস্ত, সুতরাং উপমিত المشبه অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য যা কাম্য হচ্ছে তা ইবরাহীম ও অন্যান্যদের চেয়ে বেশী। উপরন্তু এর সাথে যোগ হয়েছে যার সাথে উপমা দেয়া হয়েছে তার (ইবরাহীম) থেকে এমন এক অংশ যা অন্য আর কারো জন্য অর্জিত হয় না।
এ থেকেই ইবরাহীম নাবী ও তাঁর বংশধরের চেয়ে (যাদের মধ্যে অনেক নবী রয়েছেন) তাঁর (আমাদের নাবীর) মর্যাদা ও সম্মান প্রস্ফুটিত হচ্ছে যা তার জন্য উপযোগী। এ ছালাত (দরূদ) এ মর্যাদার প্রতিই নির্দেশকারী এবং তা অনিবার্যকারী ও তার দাবীদার বিষয়াদির একটি বিষয়।
সুতরাং আল্লাহ তা'আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার বংশধরকে মর্যাদা, রহমত ও শান্তি প্ৰদান করুন এবং তাকে তার চেয়েও উত্তম প্রতিদান দান করুন যে কোন নাবীকে তার উম্মাতের পক্ষ থেকে যে প্রতিদান দান করেছেন।
অতএব হে আল্লাহ! রহমত ও মর্যাদা দান কর মুহাম্মাদের প্রতি এবং মুহাম্মাদের বংশধরের প্রতি যেমনভাবে রহমত ও মর্যাদা দান করেছ। ইবরাহীমের বংশধরের প্রতি, নিশ্চয় তুমি অতি প্রশংসিত মহিমান্বিত। আর বরকত দান কর মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের বংশধরের প্রতি যেমনভাবে বরকত দান করেছ ইবরাহীমের বংশধরের প্রতি, নিশ্চয় তুমি অতি প্ৰশংশিত মহিমান্বিত।