লগইন করুন
“এবং আমি অবশ্যই তোমাদের আশে পাশের জনপদসমূহ ধ্বংস করেছিলাম।” (৪৬-সূরা আল আহকাফঃ আয়াত-২৭)
বারমাক পরিবারের বেদনাদায়ক উদাহরণ রয়ে গেছে। এ পরিবার সমৃদ্ধ, আরামের ও অতিরিক্ত ব্যয়বহুল জীবন-যাপন করত। যাহোক, তাদের ধ্বংস তাদের পরবর্তী সকল আরবদের জন্য শিক্ষা ও উদাহরণ হিসেবে কাজ করেছে। তাদের সময়কার শাসক বাদশা হারুনুর রশীদ বারমাক পরিবার ও তাদের সম্পত্তির ওপর এক অপ্রত্যাশিত আক্রমণের হুকুম জারি করেন। তাদের নিকটতম ব্যক্তির হাতে কোন এক সকাল বেলা তাদের উপর আল্লাহর বিধান জারি হয়ে গেল। তিনি তাদের ঘর-বাড়ি ধ্বংস করে দিলেন, তাদের চাকর-বাকরদেরকে অধিকার (দখল) করে নিলেন এবং তাদের রক্তপাত ঘটালেন। তাদের প্রিয়জনরা ও সন্তানরা তাদের অপমানে কান্নাকাটি করল। আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ (উপাস্য) নেই। যারা গল্পটি জানেন তাদের এ দুনিয়ার ক্ষমতার ও সম্পদের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতিকে বিশেষভাবে অনুধাবন করা উচিত।
فَاعْتَبِرُوا يَا أُولِي الْأَبْصَارِ
অতএব হে দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।” (৫৯-সূরা আল হাশরঃ আয়াত-২)
তাদের অধঃপতনের মাত্র এক ঘণ্টা পূর্বেও তারা রেশমী পোশাক পরে আত্মগর্বে গটগট করে হাটছিল, আনন্দ ও আত্মপ্রসাদে পূর্ণ ছিল। সর্বপ্রকার ক্ষতি থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করছিল এবং জীবনের উত্থান-পতন সম্বন্ধে বেখবর ছিল।
“আর যারা নিজের প্রতি জুলুম করেছিল, তোমরা সে সব লোকের বাসভূমিতে বাস করতে এবং আমি তাদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলাম তাও তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছিল। আর আমি তোমাদের জন্য বহু দৃষ্টান্তও উপস্থাপন করেছি।” (১৪-সূরা ইবরাহীমঃ আয়াত-৪৫)
তাদের খেল-তামাশার জিন্দিগিতে তারা বড়াই করে চলেছিল। যাহোক, তাদের জন্য এটা দুঃখজনক যে তারা মরীচিকাকে পানি বলে ভুল করেছিল এবং চিরস্থায়ী জীবনের বদলে তারা ইহকালীন জীবনকে বরণ করেছিল। তারা ভুল ভেবেছিল যে, তাদের ওপর ন্যায়বিচার বর্তাবে না এবং অত্যাচারিতের পক্ষে প্রমাণ, ন্যায়বিচার ও প্রতিশোধের ব্যবস্থা করা হবে না।
وَظَنُّوا أَنَّهُمْ إِلَيْنَا لَا يُرْجَعُونَ
আর তারা ভেবেছিল যে তাদেরকে আমার নিকটে ফিরিয়ে আনা হবে না।” (২৮-সূরা আল কাসাসঃ আয়াত-৩৯)
সেদিন প্রাতে তো তারা আনন্দপূর্ণভাবেই জেগে উঠেছিল। কিন্তু রাত গড়াতে গড়াতে তারা তাদের কবরে চলে গিয়েছিল। এক রাগের মুহুর্তে ও খেয়ালের বশে বাদশা হারুনুর রশীদ তাদের ওপর তার ক্রোধের তরবারী উন্মুক্ত করেছিলেন এবং জাফর ইবনে ইয়াহইয়া বারমাকিকে শুলে চড়িয়ে হত্যা করে তার মৃতদেহকে আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তার পিতা ইয়াহয়াকে ও ভাই ফযলকে কারাগারে বন্দী করেছিলেন। তাদের ধন-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। তাদের দুর্দশা নিয়ে অনেক আরব কবি শোকগাথা রচনা করেছে। একজন আরব কবি বলেছেন
“আমি যখন জাফরের দেহে তরবারী বিদ্ধ দেখলাম, আর ইয়াহইয়ার বন্দীর সংবাদ যখন একজন ঘোষককে বাদশার নিকট ঘোষণা করতে শুনলাম। তখন আমি এ দুনিয়ার জন্য বিলাপ করলাম ও সত্যসত্যই বিশ্বাস করলাম যে নিকট দিগন্তে এমন একটি দিন আছে যেদিন এ পৃথিবী থেকে একটি বালক বিদায় নিবে, এক রাজা আরেক রাজাকে ও এক দেশ আরেক দেশকে উচ্ছেদ করে মাত্র।
নাজ নেয়ামত ভোগের পরই দুঃখ-দুর্দশার ঘটনা ঘটে, একজন যদি সুউচ্চ রাজপ্রাসাদে বাস করে, তবে আরেকজন দুঃখ-দুর্দশার সর্বনিম্ন গভীরতম প্রদেশে ডুবে থাকে।” কিন্তু এখন হারুনুর রশীদ কোথায় আর বারমাক পরিবারই বা কোথায়? কোথায় হত্যাকারী আর কোথায় বা নিহত ব্যক্তি?
নিজের প্রাসাদে বিছানায় শুয়ে শুয়ে যিনি হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন তিনি কোথায়? আর যাকে শূলে চড়ানো হয়েছিল তিনিই বা কোথায়? অতীত ও অতীতের কর্মীরা উভয়ই অতীত হয়ে গেছে। কিন্তু সর্বাপেক্ষা ন্যায়বিচারক তাদের মাঝে এমন একদিন ন্যায়বিচার করবেন। যেদিন সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই, যে দিনটি এমন একদিন, যেদিন কোন অন্যায়-অত্যাচার-অবিচার হবে না।
“ওটার জ্ঞান আমার প্রভুর নিকট নথিপত্রে লিপিবদ্ধ আছে; আমার প্রভু ভুল করেন না এবং তিনি ভুলেও যান না।” (২০-সূরা ত্বাহাঃ আয়াত-৫২)
“সেদিন সকল মানুষ সমগ্র বিশ্ব জগতের প্রতিপালকের সামনে (হিসাব-নিকাশ দেয়ার জন্য) দাড়াবে।” (৮৩-সূরা আল মুতাফফিফীনঃ আয়াত-৬)
“সেদিন তোমাদেরকে (বিচারের জন্য) হাজির করা হবে, তোমাদের কোন কিছুই গোপন থাকবে না।” (৬৯-সূরা আল হাক্কাহঃ আয়াত-১৮)
ইয়াহইয়া ইবনে খালেদ বারমাকিকে এই মুসিবতের কারণ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “আপনি কি এর কারণ জানেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “সম্ভবত আমরা কোন লোকের উপর অত্যাচার করেছিলাম এটা তার ফরিয়াদ যা রাতারাতি তাদের অজ্ঞাতসারেই (আসল জায়গায়) পৌছে গিয়েছিল।”
আব্দুল্লাহ ইবনে মুয়াবিয়াহ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর জেলখানায় থেকে তার বন্দী হওয়া সম্বন্ধে বলেছেনঃ “আমরা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি, অথচ এখনও আমরা দুনিয়ার অধিবাসী।” আমরা না মৃত, না জীবিত; কোন না কোন কারণে যদি কারারক্ষী ভিতরে আসে, আমরা বিস্মিত হয়ে বলিঃ এ লোক পৃথিবী থেকে এসেছে। কোন স্বপ্ন দেখলে আমরা অতি আনন্দিত হই কেননা, যখন আমরা জেগে উঠি তখন আমাদের অধিকাংশ আলাপই আমরা যে স্বপ্ন দেখেছি তা নিয়ে হয়। তা যদি ভালো স্বপ্ন হয় তবে তা খুবই ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হয়। আর যদি তা দুঃস্বপ্ন হয় তবে তা অপেক্ষা না করে দ্রুত এসে পড়ে।”
শেষের দু’লাইনে অনেকটা নৈরাশ্য ও হতাশা আছে; এ সম্বন্ধে আমার জাহিরের কথা মনে পড়ে গেল।
“ডাক পিয়ন যখন আমাদের নিকট মন্দ ঘটনার সংবাদ নিয়ে আসে তখন সে সময় নষ্ট না করে দ্রুত এসে পড়ে। এভাবে ঘটনা মন্দ হলে একদিন এক রাত্রি পরেই তা এসে পড়ে, আর ঘটনা ভালো হলে সময় নিয়ে এক সপ্তাহ পরে আসে।”
সমৃদ্ধি ও অপচয়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌছার পর আন্দালুসের সুলতান ইবনে আব্বাদ (বাদশা) সংকটের সম্মুখীন হলো। যখন চপলতা, বাদ্যযন্ত্র ও নর্তকী তার রাজপ্রাসাদে প্রবল আকার ধারণ করল তখন রোমকগণ তাকে আক্রমণ করে বসল আর তাই সে মরক্কোর সুলতান ইবনে তাশফীনের নিকট সাহায্য চাইল। ইবনে তাশফীন তার সেনাবাহিনী নিয়ে মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ইবনে আব্বাদকে বিজয় এনে দিল। কিন্তু ইবনে তাশফীন অবস্থাকে সিংহের মত শিকারী দৃষ্টিভঙ্গি মনোভাব নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিল এবং তার অন্যান্য মতলব ছিল।
মাত্র তিনদিন পরই ইবনে তাশফীন ও তার সেনাবাহিনী আন্দালুসের দুর্বল রাজ্যকে আক্রমণ করে বসল। ইবনে আব্বাদকে বন্দী করে তার সম্পদকে বাজেয়াপ্ত করা হলো। তার প্রাসাদ ও বাগানকে ধ্বংস করে দিয়ে তাকে তার জন্মভূমি আগমাত প্রদেশে বন্দী হিসেবে চালান করা হলো।
“আর দিনসমূহ তো এমনই (ভালো বা মন্দ), এগুলোকে আমি মানুষের মাঝে পালাক্রমে দিই।” (৩-সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত-১৪০)
আন্দালুসের রাজত্ব ইবনে তাশফীনের হাতে এসে পড়ল। তিনি দাবি করলেন যে, (আন্দালুসের) নেতৃত্ব ন্যায়সঙ্গতভাবেই তার। কারণ আন্দালুসের জনগণই প্রথমে তাকে মরক্কো থেকে তলব করে এনেছে।
দীর্ঘদিন পরে একদিন ইবনে আব্বাদের মেয়েরা তাকে জেলখানায় এসে দেখার সুযোগ পেল। তারা নগ্নপদে, ক্ষুধার্ত অবস্থায়, শীর্ণ দেহে ও অশ্রুসজল নয়নে (তাকে দেখতে) আসল। ইবনে আব্বাদ যখন তার মেয়েদের এ করুণ অবস্থা দেখল, তখন আর্তনাদ করে উঠল।
“আমার অতীত জীবনে আমি বিশেষ ঘনঘটা করে আমোদ করতাম, কিন্তু আগমাতে বন্দী অবস্থায় এ কী শোচনীয় ঘটনা! তুমি তোমার মেয়েদেরকে শীর্ণ ও ক্ষুধার্ত দেখছ, তারা মানুষের সুতা কেটে দেয় আর তাদের কিছুই নেই। তারা ভীত-সন্ত্রস্ত ও দুর্বল অবস্থায়, বিষন্ন নয়নে ও ভগ্ন হৃদয়ে, নগ্নপায়ে কাদা মাড়িয়ে তোমাকে দেখতে এসেছে, যেন তারা কভু দামী সুগন্ধি ও গোলাপ মাড়ায়নি।”
“অতএব যখন আমার আদেশ এলো তখন আমি (সমকামপ্রবণ নগরসমূহকে) উল্টিয়ে দিলাম।” (১১-সূরা হুদঃ আয়াত-৮২)
“দুনিয়ার উদাহরণ তো এরূপ যেমন নাকি আকাশ থেকে আমি পানি (বৃষ্টি) বর্ষণ করি, তা দিয়ে ভূমির উদ্ভিদ ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে গজায়, যা মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তু খায়। এমনকি যখন ভূমি সুশোভিত হয় ও নয়নাভিরাম হয় তখন এর মালিকেরা মনে করে যে, তারা এগুলোর উপর ক্ষমতাবান (বা এগুলো তাদের আয়ত্ত্বাধীন), এমন সময় কোন এক রাতে বা দিনে আমার নির্দেশ এসে পড়ে তখন আমি সেগুলোকে নির্মুল করে দিই যেন ওগুলোর অস্তিত্ব গতকালও ছিল না। এভাবেই আমি চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য আমার নিদর্শনাবলিকে বিশদভাবে বর্ণনা করি।” (১০–সুরা ইউনুসঃ আয়াত-২৪)