লগইন করুন
আলী তানতাবী দুটি তীক্ষ মৰ্মভেদী ও হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।
প্রথমটি হচ্ছে- বৈরুতের সমুদ্র উপকূলে তিনি প্রায় ডুবে গিয়েছিলেন। তিনি যখন ডুবে যাচ্ছিলেন ও তার মৃত্যুর অবস্থা ঘনিয়ে আসছিল তখন তিনি তার প্রভুর নিকট সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করলেন এবং আকাঙ্ক্ষা করতে ছিলেন যদি তিনি এক ঘন্টার জন্য হলেও জীবন ফিরে পান তবে তিনি তার ঈমানকে ও তার আমলে সালেহকে নতুনভাবে শক্তিশালী করবেন। যাতে করে তার ঈমান সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে। এমন সময় তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন ও সে অবস্থায়ই তাকে তীরে উদ্ধার করা হলো।
দ্বিতীয়টিঃ সিরিয়া থেকে মক্কায় হজ্জ করতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি এক মরুচারী কাফেলার সাথে যোগ দিলেন। তাবুকের মরুভূমিতে তারা পথ হারিয়ে তিন দিন উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ালেন। যখন তাদের পানাহারের সরবরাহ শেষ হয়ে যেতে শুরু করল তখন তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেল। সবাই বুঝতে পারল যে মৃত্যু আসন্ন। এ অবস্থায় তিনি দাঁড়িয়ে লোকজনের সামনে এক ভাষণ দিলেন। এটা জীবনের বিদায়কালীন ভাষণের মতো ছিল। এ ভাষণ এমনই হৃদয়গ্রাহী ছিল যে এতে তিনি ও তার শ্রোতাগণ কেঁদে ফেললেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে তার ঈমান বাড়ছে এবং তিনি যথার্থই বুঝতে পারলেন যে মহান আল্লাহ ছাড়া কেউই তাদেরকে রক্ষা করতে বা সাহায্য করতে পারবে না। (অবশেষে তারা আল্লাহর রহমতে রক্ষা পেয়েছিলেন। -অনুবাদক)
“আসমানসমূহে ও পৃথিবীতে যারা আছে তারা সবাই তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে। তিনি প্রতিদিন (এখানে দিন বলতে মুহূর্ত বা সময় বুঝায়) কাজে রত। (ভিন্ন মতে তিনি সর্বদা আপন অবস্থায় (ব্যস্তহীন) আছেন, কেননা, সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে তকদীর লেখা হয়ে গেছে। আর সব কিছু সে মতে হচ্ছে, সুতরাং আল্লাহ ব্যস্ত নন।) (৫৫-সূরা আর রাহমানঃ আয়াত-২৯)
“আর কত নবীইনা যুদ্ধ করেছে আর তাদের সাথে বহু ধাৰ্মিক লোকজন ছিল। আল্লাহর পথে তাদের যে বিপদ হয়েছিল তাতে তারা মনোবল হারায়নি, দুর্বল হয়নি ও নত হয়নি, আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে ভালোবাসেন”। (৩-সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত-১৪৬)
আল্লাহ অবশ্যই সে সব শক্তিশালী মু’মিনদেরকে ভালোবাসেন যারা ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে তাদের শক্রদের মোকাবেলা করেন। তারা হাল ছেড়ে দেন না বা রণে ভঙ্গন দেন না, হতাশ বোধ করেন না বা অন্যদের হাতে নিজেদেরকে অপমানিত হতে দেন না। বরং, তারা কঠোর চেষ্টা বা সংগ্রাম করেন। আল্লাহর প্রতি ঈমান, রাসূলের প্রতি ঈমান ও ইসলাম ধর্মের প্রতি ঈমানের কারণে ঈমানদারদের উপর এসব কাজ বাধ্যতামূলক। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
الْمُؤْمِنُ الْقَوِىُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ
শক্তিশালী মু’মিন ব্যক্তি দুর্বল মু’মিন ব্যক্তির চেয়ে আল্লাহর নিকট অধিক ভালো ও প্রিয়; আর তাদের প্রত্যেকের মাঝে কল্যাণ আছে।”
আবু বকর (রাঃ) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বিছার দংশন থেকে রক্ষা করার জন্য গুহার ভিতরে এক ছোট গর্তের মুখে নিজের একটি অঙ্গুলি রেখে দিয়েছিলেন আর এর ফলে বিছা তাকেই দংশন করেছিল, তাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের আয়াত পড়ে তার অঙ্গুলিতে ফুঁক দিলেন আর এতেই আল্লাহ্র হুকুমে তার অঙ্গুলি ভালো হয়ে গেল।
একজন লোক আনতারাকে জিজ্ঞাসা করল, “তোমার বীরত্বের রহস্য কি যা দিয়ে তুমি মানুষকে পরাজিত কর?” তিনি উত্তর দিলেন, “তোমার অঙ্গুলি আমার মুখে রাখ আর আমার অঙ্গুলি তোমার মুখে রাখতে দাও।” প্রত্যেকেই নিজের অঙ্গুলি অন্যের মুখে রাখল এবং প্রত্যেকেই একে অপরের অঙ্গুলিতে কামাড়াতে শুরু করল। লোকটি বেদনায় চিৎকার দিয়ে উঠল, সে ধৈর্য ধরতে পারল না। আনতারা তাই তার মুখ থেকে লোকটির অঙ্গুলি বের করে ফেলল এবং বলল, এভাবেই আমি বীরদেরকে পরাজিত করি।” অন্য কথায়, ধৈর্যের মাধ্যমে ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তিনি লোকদের পরাজিত করেন। (এ অংশের অনুবাদ আরবী পুস্তক অনুসারে করা হলো)
ঈমানদার যখন বুঝতে পারে, সে আল্লাহর রহমতের, দয়ার ও ক্ষমার সান্নিধ্যে আছে তখন তার মনোবল (ঈমান) বৃদ্ধি পায়। সে তার ঈমান অনুপাতেই আল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণকে অনুভব করতে পারে।
وَإِن مِّن شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَٰكِن لَّا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ
এমন কোন বস্তু নেই যা আল্লাহর সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা ও মহিমা বর্ণনা করে না (অর্থাৎ প্রত্যেক বস্তুই আল্লাহর তসবীহ পাঠ করে), অথচ তোমরা তাদের তসবীহ পাঠ বুঝতে পার না।” (১৭-সূরা বনী ইসরাঈলঃ আয়াত-৪৪)
এদেশের কৃষকেরা জমি চাষ করার সময় প্রায়ই গল্পগুজব করে তাদের সময় কাটায়। (এদেশ বলতে আরব দেশ বুঝানো হয়েছে; কেননা মূল লেখক আরব দেশের অধিবাসী। আমাদের দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের চাষী-কৃষকরাও এমনটিই করে থাকে। -অনুবাদক)
“হে আসমানসমূহ ও জমিনের স্রষ্টা! তোমার হাতে একটি শুষ্ক দেশে (অর্থাৎ মরুর দেশে অর্থাৎ আরবদেশে) একটি শুষ্ক বীজ ।”
“তবে কি তোমরা যে বীজ বপন কর তার কথা ভেবে দেখেছ? (তাহলে বল) তোমরা কি সে বীজ থেকে ফসল) উৎপন্ন কর নাকি আমি উৎপন্ন করি।” (৫৬-সূরা ওয়াকেয়াহঃ আয়াত-৬৩-৬৪)
অন্ধ বাগ্মী বক্তা আদুল হামীদ কিশক (كِشْكٌ) বক্তৃতা দেয়ার জন্য মিম্বরে (মঞ্চে) উঠলেন। তারপর তার পকেট থেকে এমন একখানি খেজুরের ডাল বের করলেন যাতে প্রাকৃতিকভাবেই সুন্দর হরফে "আল্লাহ- الله” শব্দ লিখা ছিল। তারপর তিনি সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বললেন-
انظرْ لتلك الشجرة ٭ ذاتَ الغُصُون النضرة
من الذي انبتها ٭ وزانها بالخضرة
ذاك هو الله الذى ٭ قدرته مقتدره
অর্থাৎ “চাহো ঐ শ্যামশাখী তরু পানে,
কে সৃজিয়া তায়, তারে সাজাল সবুজ শোভনে?
তিনি আল্লাহ, প্রকৃষ্ট ক্ষমতার আধার যিনি।”
এ বাণী (হৃদয়গ্রাহী কবিতা) শুনে সমবেত জনতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। [কবি মারূফ রূসাফী এ কবিতাখানি ভিন্নভাবে লিখেছেন (নচেৎ আমরা তা ভিন্নভাবে লিখিত পেয়েছি) যার হৃদয়গ্রাহী বাংলা কবিতায় অনুবাদ (আমি (অনুবাদক) করেছি। এখানে উক্ত আরবী কবিতার ধারাবাহিকতা রক্ষা পায়নি, তাই বাংলা ছন্দায়িত অনুবাদও রক্ষা পায়নি।]
তিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর স্রষ্টা, সারা জগতে তার নিদর্শনের ছাপ আছে এবং সকল সৃষ্টিই তাকে একক সত্তা, অমুখাপেক্ষী, প্রভু (বা প্রতিপালক) ও উপাস্য হিসেবে ঘোষণা দেয়।
“হে আমাদের প্রতিপালক আপনি এ বিশ্বজগতকে অনর্থক সৃষ্টি করেননি; (আমরা আপনার সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি)।” (৩-সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত-১৯১)
আমাদের প্রভু যে করুণাময় এবং যে ব্যক্তি তওবা করে তার অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন এ কথা জানাও সুখের একটি স্তম্ভ। সুতরাং আল্লাহর এমন দয়াকে আনন্দের সাথে উপভোগ করুন যা আকাশসমূহ ও পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে। মহান আল্লাহ বলেন-
وَرَحْمَتِىْ وَسِعَتْ كُلَّ شَيْئ
আর আমার করুণা সবকিছুকে ঘিরে রেখেছে।
আল্লাহর দয়া কতইনা বিশাল! একটি সহীহ হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এক মরুবাসী আরব নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সালাত আদায় করছিল, যখন তাশাহহুদ পড়া শুরু করল তখন সে বলল, “হে আল্লাহ! আমাকে ও মুহাম্মদকে করুণা করুন এবং আমাদের সাথে অন্য কাউকে করুণা করবেন না।” তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, “তুমি অবশ্যই প্রশস্ত জিনিসকে সংকীর্ণ করে দিলে।
وَكَانَ بِالْمُؤْمِنِينَ رَحِيمًا
“এবং তিনি মু’মিনদের প্রতি সদা পরম করুণাময়।” (৩৩-সূরা আল আহযাবঃ আয়াত-৪৩)
এক যুদ্ধের পর এক মহিলা বন্দী তার সন্তানকে জড়িয়ে ধরে রক্ষা করার জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীদের মাঝে দৌড়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
لَلَّهُ أَرْحَمُ بِعِبَادِهِ مِنْ هَذِهِ بِوَلَدِهَا
“এ মহিলা তার সন্তানের প্রতি যতটা দয়াশীলা আল্লাহ তার বান্দার প্রতি এর চেয়েও বেশি দয়াশীল।”
একটি সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে আদেশ করে গেছে যে, তার মৃত দেহকে যেন পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং এর ছাইকে যেন জমিনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া হয়। আল্লাহ সেগুলোকে একত্রিত করে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে আমার বান্দা! তুমি যে কাজ করেছ তা কী উদ্দেশ্যে করেছ?” লোকটি বলল, “হে আমার প্রভু! আমি আপনাকে ভয় করেছি এবং আমার পাপের ভয় করেছি।” তাই তখন আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করালেন।
“আর যে ব্যক্তি তার প্রভুর সামনে (কিয়ামতের হিসাব দিতে) দাঁড়ানোর ভয় করল ও নিজেকে কুপ্রবৃত্তি হতে বিরত রাখল। নিশ্চয় জান্নাত হবে তার ঠিকানা।” (৭৯-সূরা আন নাযি’আতঃ আয়াত-৪০-৪১)
আল্লাহ এক অপচয়কারী লোককে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন যে নাকি নিজের বিষয়ে হিসাব ছাড়া খরচ করত। কিন্তু লোকটি তাওহীদপন্থী (একেশ্বরবাদী) ছিলেন। অর্থাৎ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করতেন না। আল্লাহ লোকটির আমলনামায় কোন নেক আমল খুঁজে পেলেন না। তবে একটি গুণ পেলেন যে, তিনি ব্যবসা করতেন এবং যারা অভাবী ছিল তাদের ঋণ ক্ষমা করে দিতেন। আল্লাহ বললেন, “আমি তোমার চেয়ে যোগ্যতর বা উত্তম দয়ালু।” এবং তাকে ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে দিলেন।
“এবং আমি আশা করি যে তিনি প্রতিদান দিবসে (কিয়ামতের দিন) আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।” (২৬-সূরা আশ শোয়ারাঃ আয়াত-৮২)
সহীহ মুসলিম শরীফে একটি হাদীস বর্ণিত আছে যে, একবার নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে জামায়াতে সালাত আদায় করার পর এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল যে, “আমি এক দণ্ডণীয় অপরাধ করেছি। অতএব, আমাকে শাস্তি দিন।” নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি কি আমাদের সাথে সালাত পড়েছ।” লোকটি বলল, “হ্যাঁ,” নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যাও, তোমাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে।”
وَمَن يَعْمَلْ سُوءًا أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللَّهَ يَجِدِ اللَّهَ غَفُورًا رَّحِيمًا
“আর যে ব্যক্তি বদআমল করে বা নিজের প্রতি জুলুম করে অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল ও পরম করুণাময় পাবে।” (৪-সূরা আন নিসাঃ আয়াত ১১০)
ঈমানদার ব্যক্তিকে চতুর্দিক থেকে এক অদৃশ্য করুণা ঘিরে রেখেছে। এই অদৃশ্য করুণার মালিক হলেন সমগ্র বিশ্ব জগতের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গুহায় নিরাপদ রেখেছিলেন এবং তিনি আসহাবুল কাহাফকে গুহাতে দয়া করেছিলেন। তিনি ইব্রাহীম (আঃ)-কে আগুনের প্রভাব থেকে রক্ষা করেছিলেন। তিনি মুসা (আঃ)-কে ডুবে মরা থেকে, নূহ (আঃ)-কে বন্যা থেকে, ইউসুফ (আঃ)-কে কূয়া থেকে ও আইয়ুব (আঃ)-কে রোগ থেকে রক্ষা করেছিলেন।