হজ উমরা ও যিয়ারত তৃতীয় অধ্যায় : ইহরাম, হজ-উমরার শুরু ইসলামহাউজ.কম
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাথে সাহাবায়ে কিরাম যেভাবে হজ-উমরা করেছেন **

হজ বিষয়ক সর্ববৃহৎ একক হাদীস :

হজ বিষয়ক যত হাদীস রয়েছে তার মধ্যে হাদীসু জাবের রা. নামে খ্যাত এই হাদীসটির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে হাদীস বিশারদগণ একমত হয়েছেন। হাদীসটিতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হজের সফরের শুরু থেকে হজের সমাপ্তি পর্যন্ত হজ সম্পর্কিত যাবতীয় কাজের ধারাবাহিক বর্ণনা রয়েছে।

হাদীসটি রয়েছে মূলত মুসলিম শরীফে। তবে এই হাদীসের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হজ সংক্রান্ত জাবের রা. বর্ণিত অন্যসব হাদীস যা অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে রয়েছে এমনকি মুসলিম শরীফেরও অন্য অধ্যায়ে রয়েছে, সেগুলো এখানে সন্নিবেশিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে যথাযথ সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে।[1]

১- জাবের রা.[2] বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় বসবাসকালে দীর্ঘ নয় বছর পর্যন্ত হজ করেননি।[3]

২- দশম বছরে চারিদিকে ঘোষণা দেয়া হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বছর[4] হজ করবেন।

৩- অসংখ্য লোক মদীনায় এসে জমায়েত হল। ‘বাহনে চড়া অথবা পায়ে হাঁটার সামর্থ রাখে এরকম কোন ব্যক্তি অবশিষ্ট রইল না[5]’ ‘সকলেই এসেছে রাসূলের সাথে বের হওয়ার জন্য[6]’ সকলেরই উদ্দেশ্য হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর অনুসরণ করে তাঁর মতই হজের আমল সম্পন্ন করা।

৪- জাবের রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন [7] এবং বললেন,

«مُهَلُّ أَهْلِ الْمَدِينَةِ مِنْ ذِى الْحُلَيْفَةِ وَ [مُهَلُّ أَهْلِ] الطَّرِيقُ الآخَرُ الْجُحْفَةُ وَمُهَلُّ أَهْلِ الْعِرَاقِ مِنْ ذَاتِ عِرْقٍ وَمُهَلُّ أَهْلِ نَجْدٍ مِنْ قَرْنٍ وَمُهَلُّ أَهْلِ الْيَمَنِ مِنْ يَلَمْلَمَ».

‘মদীনাবাসিদের ইহরাম বাঁধার স্থান হচ্ছে, যুল হুলাইফা। অন্যপথের (লোকদের ইহরাম বাঁধার স্থান হচ্ছে) আল-জুহফা, আর ইরাকবাসীদের ইহরাম বাঁধার স্থান হচ্ছে, যাতু ইরক। নাজদবাসীদের ইহরাম বাঁধার স্থান হচ্ছে করন। ইয়ামানবাসীদের স্থান হচ্ছে, ইয়ালামলাম।’[8]

৫- ‘তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিলকদ মাসের পাঁচ দিন অথবা চার দিন অবশিষ্ট থাকতে বের হলেন’।[9]

৬- ‘এবং হাদী তথা কুরবানীর পশু পাঠিয়ে দিলেন’।[10]

৭- আমরা তাঁর সাথে বের হলাম। ‘আমাদের সাথে ছিল মহিলা ও শিশু’।[11]

৮- যখন আমরা যুল-হুলাইফাতে [12] পৌঁছলাম। তখন আসমা বিন্ত উমায়েস মুহাম্মদ ইবন আবূ বকর নামক সন্তান প্রসব করলেন।

৯- অতপর তিনি রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে লোক পাঠিয়ে জানতে চাইলেন যে, আমি কী করব?

১০- তিনি বললেন,

«اغْتَسِلِى وَاسْتَثْفِرِى بِثَوْبٍ وَأَحْرِمِى»

‘তুমি গোসল কর, রক্তক্ষরণের স্থানে একটি কাপড় বেঁধে নাও এবং ইহরাম বাঁধ।’

১১- এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে সালাত আদায় করলেন ‘এবং চুপচাপ রইলেন।[13]

ইহরাম

১২- অতপর কাসওয়া নামক উটে সওয়ার হলেন। উটটি তাঁকে নিয়ে বাইদা নামক জায়গায় গেলে ‘তিনি ও তাঁর সাথিগণ হজের তালবিয়া পাঠ করলেন।’[14]

১৩- জাবের রা. বলেন, আমি আমার দৃষ্টিপথে যতদূর যায় তাকিয়ে দেখলাম, তাঁর সামনে কেবল আরোহী ও পায়ে হেঁটে যাত্রারত মানুষ আর মানুষ। তাঁর ডানে অনুরূপ, তাঁর বামেও অনুরূপ তাঁর পেছনেও অনুরূপ মানুষ আর মানুষ। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে অবস্থান করছিলেন এবং তাঁর ওপর পবিত্র কুরআন নাযিল হয়। তিনিই তো তার ব্যাখ্যা জানেন। আর যে আমল তিনি করছিলেন আমরা তা হুবহু আমল করছিলাম।

১৪- তিনি তাওহীদ সম্বলিত [15]তালবিয়া পাঠ করেন,

لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ ، لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ ،[16] إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ ، لاَشَرِيكَ لَكَ.

১৫- আর মানুষেরাও যেভাবে পারছিল এই তালবিয়া পাঠ করছিল। তারা কিছু বাড়তি বলছিল। যেমন,

لَبَّيْكَ ذَا الْمَعَارِجِ, لَبَّيْكَ ذَا الْفَوَاضِلِ.

(লাব্বাইকা যাল মাআরিজি, লাব্বাইকা যাল ফাওয়াযিলি) কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে এটা রদ করতে বলেননি।

১৬- তবে তিনি বার বার তালবিয়া পাঠ করছিলেন।

১৭- জাবের রা. বলেন, আমরা বলছিলাম, لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ (লাব্বাইক আল্লাহুম্মা) لَبَّيْكَ بالحج (লাব্বাইকা বিলহাজ্জ)। আমরা খুব চিৎকার করে তা বলছিলাম। আর আমরা কেবল হজেরই নিয়ত করছিলাম। আমরা হজের সাথে উমরার কথা তখনও জানতাম না।[17]

১৮- আর আয়েশা রা. উমরার নিয়ত করে এলেন। ‘সারিফ’[18] নামক স্থানে এসে তিনি ঋতুবতী হয়ে গেলেন।[19]

মক্কায় প্রবেশ ও বায়তুল্লাহর তাওয়াফ

১৯- এমনিভাবে আমরা তাঁর সাথে বায়তুল্লাহ্ এসে পৌঁছলাম। সময়টা ছিল যিলহজের চার তারিখ ভোরবেলা।[20]

২০- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদের দরজার সামনে এলেন। অতপর তিনি তাঁর উট বসালেন। তারপরে মসজিদে প্রবেশ করলেন।

২১- তিনি হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করলেন।

২২- এরপর তিনি তাঁর ডান দিকে চললেন।[21]

২৩- অতপর তিনি তিন চক্করে রমল[22] করতে করতে হাজরে আসওয়াদের কাছে আসলেন, এভাবে তিনি চক্কর দিলেন। আর চার চক্করে স্বাভাবিকভাবে হাঁটলেন।

২৪- এরপর মাকামে ইবরাহীম আ.-এ পৌঁছে এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন : وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى (ওয়াত্তাখিযূ মিম মাক্বামি ইবরাহীমা মুসাল্লা)

তিনি উচ্চস্বরে এই আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন যাতে লোকেরা শুনতে পায়।[23]

২৫- এরপর মাকামে ইবরাহীমকে তাঁর ও বায়তুল্লাহ্‌র মাঝখানে রেখে দুই রাক‘আত সালাত আদায় করলেন।[24]

২৬- ‘তিনি এ দু’রাক‘আত সালাতে সূরা কাফিরূন ও সূরা ইখলাস পড়েছিলেন।’[25]

২৭- এরপর তিনি যমযমের কাছে গিয়ে যমযমের পানি পান করলেন এবং তাঁর নিজের মাথায় ঢাললেন।[26]

২৮- এরপর তিনি হাজরে আসওয়াদের নিকট গিয়ে তা স্পর্শ করলেন।

** রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করার পর মোট চার বার উমরা করেছেন। ১ম বার : হুদায়বিয়ার উমরা, ৬ষ্ট হিজরীতে যা পথে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সম্পন্ন করতে পারেননি। মাথা মুন্ডন করে হালাল হয়ে যান। ২য় বার : উমরাতুল কাযা ৭ম হিজরীতে। ৩য় বার : জিয়িররানা থেকে ৮ম হিজরীতে। ৪র্থ বার : বিদায় হজের সাথে ১০ হিজরীতে। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমরার উদ্দেশ্যে হারাম এলাকার বাইরে বের হয়ে উমরা করেছেন বলে কোনো প্রমাণ নেই। (বিস্তারিত দেখুন : যাদুল মা‘আদ : ২/৯২-৯৫)


[1]. এই অধ্যায়টি শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. সংকলিত ‘হিজ্জাতুন নবী’ থেকে বাংলায় রূপান্তর করা হয়েছে।

[2]. জাবের রা. উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন একজন সাহাবী। হজ সম্পর্কিত সবচে’ বড় হাদীসটির বর্ণনাকারী।

[3]. নাসাঈ, বিশুদ্ধ মতানুযায়ী হিজরী ৯ম অথবা ১০ম সালে হজ ফরয হয়। হজ ফরয হওয়ার পর বিলম্ব না করে রাসূল সা. ও তাঁর সাহাবীগণ হজ করেন। দ্র. ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মা‘আদ।

[4]. নাসাঈ।

[5]. নাসাঈ।

[6]. নাসাঈ।

[7]. বুখারী, মুসলিম ও মুসনাদে আহমদের বর্ণনা অনুসারে রাসূল সা. এই ভাষণ দিয়েছিলেন মসজিদে নববীতে। সময়টা ছিল মদীনা থেকে হজের সফরে বের হওয়ার পূর্বে।

[8]. মুসলিম।

[9]. নাসাঈ।

[10]. ইরওয়াউল গালীল।

[11]. মুসলিম।

[12]. যুলহুলাইফা মসজিদে নববী থেকে ৬ মাইল দূরে অবস্থিত।

[13] নাসাঈ ।

[14] ইবন মাজাহ্‌।

[15]. তাওহীদ ও শিরক বিপরীতমুখী দুটি বিষয় যা কোনোদিন একত্রিত হতে পারে না। এ-দুয়ের একটির উপস্থিতির অর্থ অন্যটির বিদায়, ঠিক রাত-দিন অথবা আগুন-পানির বৈপরিত্বের মতই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَأَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلَّهِ

‘তোমরা হজ ও ওমরাহ আল্লাহর জন্য সম্পন্ন করো।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনে তাওহীদ সবচে’ বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি তাওহীদকে তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য বানিয়েছেন। হজে নিম্নবর্ণিত আমলসমূহ সম্পাদনে তাওহীদের প্রতি তাঁর গুরুত্ব বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন, ১. তাঁর তালবিয়া পাঠ, ২. লোক-দেখানো ও রিয়া থেকে মুক্ত হজ পালনের জন্য আল্লাহর কাছে তাঁর দু‘আ। ৩. তাওয়াফ শেষে দু’রাকাত সালাত আদায় করার সময় তাওহীদ সম্বলিত ‘সূরা ইখলাস’ ও ‘সূরা আল-কাফিরুন’ পাঠ। ৪. সাফা ও মারওয়ায় তাওহীদনির্ভর দু‘আ পাঠ। ৫. আরাফার দু‘আ ও যিকরসমূহেও তাওহীদ সম্বলিত বাণী উচ্চারণ ৬. হাদী বা কুরবানীর পশু যবেহের সময় তাকবীর পাঠ। ৬. জামরাতে পাথর নিক্ষেপের সময় তাকবীর পাঠ ইত্যাদি। তাই প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য হচ্ছে, তাওহীদের হাকীকত সম্পর্কে সচেতন হওয়া। শিরক ও বিদ‘আত থেকে সতর্ক থাকা।

[16]. ইবরাহীম আ. এর তালবিয়া তাওহীদ সম্বলিত ছিল। সর্বপ্রথম আমর ইবন লুহাই খুযাঈ জাহেলী যুগে তালবিয়াতে শিরক যুক্ত করে বলে,

إِلاَّ شَرِيكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ.

‘কিন্তু একজন শরীক যার তুমিই মালিক এবং তার যা কিছু রয়েছে তারও।’ [উমদাতুল কারী : ২৪/ ৬৫; আখবারে মক্কা, আযরাকী : ১/২৩২]

তার অনুসরণে মুশরিকগণ হজ ও উমরার তালবিয়া পাঠে উক্ত শিরক সম্বলিত বাক্য তালবিয়াতে যুক্ত করত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তালবিয়ায় তাওহীদের স্পষ্ট ঘোষণা দিলেন এবং তা থেকে শিরকযুক্ত বাক্য সরিয়ে দিলেন। (মুসলিম : ১১৮৫)

[17]. ইবন মাজাহ্‌।

[18]. এই জায়গাটি তানঈমের কাছাকাছি বায়তুল্লাহ থেকে ১০ মাইল দূরে উত্তর দিকে অবস্থিত।

[19]. মুসলিম।

[20]. মুসলিম।

[21]. মুসলিম।

[22]. রমল হচ্ছে, ঘন পদক্ষেপে বীরের মত দ্রুত হাঁটা।

[23]. নাসাঈ।

[24]. বায়হাকী, মুসনাদে আহমদ।

[25]. নাসাঈ, তিরমিযী।

[26]. আহমদ।