আল-ফিকহুল আকবর হেদায়াত, কবর, অনুবাদ, আয়াতসমূহের মর্যাদা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আত্মীয়গণ, মিরাজ, কিয়ামতের আলামত ইত্যাদি ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
৮. ১. কুরআন মাজীদে ইসরা ও মিরাজ

মিরাজ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনের অত্যতম ঘটনা। কুরআনে একাধিক স্থানে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। ‘ইসরা’ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন:


سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آَيَاتِنَا


‘‘পবিত্র তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য।’’[1]

এ আয়াত ও বহুসংখ্যক সহীহ হাদীস প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে ‘ইসরা’ ও ‘মিরাজ’-এ গমন করেন। কারণ ‘বান্দা’ বলতে আত্মা ও দেহের সমন্বিত মানুষকেই বুঝানো হয়। কুরআনে বান্দা বলতে ‘দেহ ও আত্মা’ সমন্বিত মানুষকেই বুঝানো হয়েছে, শুধু আত্মাকে ‘বান্দা’ বলা হয় নি।[2]

‘‘মি’রাজ’’ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন:


أَفَتُمَارُونَهُ عَلَى مَا يَرَى وَلَقَدْ رَآَهُ نَزْلَةً أُخْرَى عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى عِنْدَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَى إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَى مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَى لَقَدْ رَأَى مِنْ آَيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى


‘‘সে (মুহাম্মাদ (ﷺ)) যা দেখেছে তোমরা কি সে বিষয়ে তার সাথে বিতর্ক করবে? নিশ্বয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল। সিদরাতুল মুনতাহা-র (প্রান্তবর্তী বদরী বৃক্ষের) নিকট। যার নিকট অবস্থিত জান্নাতুল মা‘ওয়া। যখন বৃক্ষটি যদ্বারা আচ্ছাদিত হবার তদ্বারা ছিল আচ্ছাদিত। তার দৃষ্টি বিভ্রম হয় নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয় নি। সে তো তার প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলি দেখেছিল।’’[3]

এ আয়াতও প্রমাণ করে যে, তিনি সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় সিদরাতুল মুনতাহার নিকট আল্লাহর মহান এ সকল নিদর্শন দেখেছিলেন। এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর মূলধারার আলিমগণ একমত। তবে সিদরাতুল মুনতাহার নিকট তিনি কাকে দেখেছিলেন? মহান আল্লাহকে? না জিবরাঈল (আঃ)-কে? এ বিষয়ে সাহাবীগণের যুগ থেকে মতভেদ রয়েছে। সূরা নাজমের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর অন্তর দিয়ে দুবার তাঁর রববকে দেখেছিলেন। এ মতের অনুসারী সাহাবী-তাবিয়ীগণ বলেছেন যে, মহান আল্লাহ মূসা (আঃ)-কে তাঁর সাথে কথা বলার মুজিযা দিয়েছিলেন এবং মুহাম্মাদ (ﷺ)-তে তাঁর দর্শনের মুজিযা দিয়েছিলেন।

পক্ষান্তরে আয়েশা (রা) ও অন্যান্য সাহাবী বলেছেন যে, তিনি আল্লাহকে দেখেন নি, জিবরাঈলকে (আঃ) দেখেছিলেন। ইমাম বুখারী সংকলিত হাদীসে প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মাসরূক বলেন: ‘‘আমি আয়েশা (রা)-এর নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। তিনি বলেন, হে আবূ আয়েশা (মাসরূক), তিনটি কথার যে কোনো একটি কথা যদি কেউ বলে তবে সে আল্লাহ নামে জঘন্য মিথা বলার অপরাধে অপরাধী হবে। আমি বললাম: সে কথাগুলো কী কী? তিনি বলেন, যদি কেউ মনে করে যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর প্রতিপালককে (আল্লাহকে) দেখেছিলেন তবে সে আল্লাহর নামে জঘন্য মিথ্যচারী বলে গণ্য হবে। মাসরূক বলেন, আমি তখন হেলান দিয়ে ছিলাম। তাঁর কথায় আমি উঠে বসলাম এবং বললাম: হে মুমিনগণের মাতা, আপনি আমাকে একটু কথা বলতে দিন, আমার আগেই আপনার বক্তব্য শেষ করবেন না। আল্লাহ কি বলেন নি[4]: ‘‘সে তো তাকে স্পষ্ট দিগন্তে দেখেছিল’’, ‘‘নিশ্চয় তাকে সে আরেকবার দেখেছিল’’?

আয়েশা (রা) বলেন: এ উম্মাতের মধ্যে আমিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যে এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা করেছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উত্তরে বলেন: ‘‘এ হলো জিবরীলের কথা। আল্লাহ তাঁকে যে আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন আমি দুবার ছাড়া আর কখনো তাঁকে তাঁর সে প্রকৃত আকৃতিতে দেখি নি। আমি দেখলাম তিনি আকাশ থেকে নেমে আসছেন। তাঁর আকৃতির বিশালত্ব আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী সবকিছু অবরুদ্ধ করে দিচ্ছে।’’ আয়েশা বলেন: তুমি কি আল্লাহকে বলতে শোন নি[5]: ‘‘তিনি দৃষ্টির অধিগম্য নন, কিন্তু দৃষ্টিশক্তি তাঁর অধিগত; এবং তিনিই সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক পরিজ্ঞাত’’? তুমি কি আল্লাহকে বলতে শোন নি[6]: ‘‘কোনো মানুষের জন্যই সম্ভব নয় যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন ওহীর মাধ্যম ব্যতিরেকে, অথবা পর্দার অন্তরাল ব্যতিরেকে, অথবা এমন দূত প্রেরণ করবেন যে দূত তাঁর অনুমতিক্রমে তিনি যা চান তা ব্যক্ত করবে, তিনি সমুন্নত, প্রজ্ঞাময়’’?’’[7]

[1] সূরা (১৭) ইসরা (বনী ইসরাঈল): ১ আয়াত।

[2] সূরা (৯৬) আলাক: ৯-১০ আয়াত; সূরা (৭২) জিন্ন: ১৯ আয়াত।

[3] সূরা (৫৩) নাজ্ম: ১২-১৮ আয়াত।

[4] সূরা (৮১) তাকবীর: ২৩ আয়াত ও সূরা (৫৩) নাজম: ১৩ আয়াত।

[5] সূরা (৬) আন‘আম: ১০৩ আয়াত।

[6] সূরা (৪২) শূরা: ৫১ আয়াত।

[7] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৮৪০ (কিতাবুত তাফসীর, বাবু তাফসীর সূরাতিন নাজম); মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৫৯-১৬১ (কিতাবুল ঈমান, বাবু মা’না কাওলিহি তাআলা: ওয়ালাকাদ রাআহু...); তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৬২ (কিতাবুত তাফসীর, বাবু ৭ ওয়া মিন সূরাতিল আনআম); ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৬/৩১৩, ৮/৬০৬।