লগইন করুন
আমরা আগেই বলেছি, শীয়াগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা, চাচা, দাদা ও পূর্বপুরুষদের মুমিন বলে দাবি করেন। বিশেষত তাঁর চাচা ও আলী (রা)-এর পিতা আবূ তালিবকে মুমিন বলে প্রমাণ করতে তারা অগণিত বইপুস্তক রচনা করেছেন। আবূ তালিবকে কাফির প্রমাণ করার চেষ্টাকে তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর বংশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং তাঁর সাথে চরমতম বেয়াদবী বলে দাবি করেছেন। এ বিষয়ক আলোচনার আগে নিম্নের বিষয়গুলো অনুধাবন করতে পাঠককে অনুরোধ করছি।
(ক) আকীদার উৎস বিষয়ে আমরা দেখেছি যে, সাহাবী-তাবিয়ীগণ এবং আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত কুরআন ও সহীহ হাদীসকে আকীদার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং নিজেদের আবেগ ও পছন্দ-অপছন্দকে এর ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। পক্ষান্তরে শীয়াগণ তাদের পণ্ডিতগণের মত, ব্যাখ্যা ও আবেগকেই আকীদার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং এর আলোকে কুরআনের ব্যাখ্যা করেছেন।
(খ) শীয়া ধর্মমতের মূল বিষয় রাজনৈতিক অপপ্রচারের ধর্মীয়করণ। রাজনৈতিক মতভেদ, সংঘর্ষ, ইত্যাদি মানব ইতিহাসের চিরপরিচিত চিত্র এবং মানবীয় প্রকৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানবীয় প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য হলো যে, এরূপ সংঘর্ষে লিপ্তগণ নিজের স্বার্থে ধর্মের ব্যবহারের চেষ্টা করেন, ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্য করেন। কিন্তু নিজ ধর্মকে সচেতনভাবে বিকৃত করতে চেষ্টা করেন না। বরং প্রত্যেকেই নিজ অবস্থানকে ধর্মীয়ভাবে সঠিক বলে দাবি করেন। ইহূদী, খৃস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু ও সকল ধর্মের অনুসারীদের মধ্যকার আভ্যন্তরীণ অগণিত যুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ, শতবর্ষের যুদ্ধ ইত্যাদি সবই এ কথাই প্রমাণ করে।
শীয়াগণ রাজনৈতিক সংঘর্ষকে ধর্মীয়করণ করেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলি যেমন নিজেদের নেতৃবৃন্দকে দেবতা ও অন্যদেরকে জাতির শত্রু, স্বাধীনাতার শত্রু, ধর্মের শত্রু ইত্যাদি আখ্যায়িত করেন, যে কোনোভাবে অপরপক্ষের চরিত্রহননে সচেষ্ট থাকেন এবং এজন্য সকল প্রকার গালগল্প বানান ঠিক তেমনিভাবে শীয়াগণ রাজনৈতিক ক্ষমতাগ্রহণের জন্য যাদের নাম ব্যবহার করতেন তাদেরকে দেবতা এবং বিরোধীদেরকে দানব হিসেবে চিত্রিত করতে সকল প্রকার অপপ্রচারের আশ্রয় গ্রহণ করেন।
(গ) মানুষের মর্যাদার দুটি দিক রয়েছে: (১) মানুষের নিজের সচেতন ইচ্ছাধীন কর্মের মাধ্যমে অর্জিত মর্যাদা এবং (২) মানুষের রক্ত, বংশ, জন্ম, পরিবার ইত্যাদি ইচ্ছাবহির্ভুত-কর্মবহির্ভুত বিষয় নির্ভর মর্যাদা। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা অনুসারে সাহাবী-তাবিয়ী ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত প্রথম বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিষয়টি একেবারে অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। শীয়াগণ একেবারেই বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তাঁরা বংশ, রক্ত, বর্ণ, পরিবার ইত্যাদি বিষয়কে মানুষের মর্যাদার মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কর্ম, তাকওয়া ইত্যাদিকে একেবারেই অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। নবী-বংশের বা আলী-বংশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদের মূল আলোচ্য বিষয় তাদের অলৌকিক জন্ম, নূর দ্বারা সৃষ্টি, পবিত্র বংশধারা ইত্যাদি। আর বংশধারার পবিত্রতা প্রমাণের জন্য তারা তাঁদের সকলকে ঈমানদার প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এজন্য আমরা দেখি যে, তাঁরা আবূ তালিব, আব্দুল মুত্তালিব ও অন্যান্যদেরকে মুমিন, মুসলিম ও আল্লাহর প্রিয়তম ও পবিত্রতম হিসেবে প্রচার করেছেন। পাশাপাশি আবূ বকর, উমর, উসমান, তালহা, যুবাইর, সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাস, আবূ হুরাইরা, আনাস ও অন্যান্য সকল মুহাজির-আনসার সাহাবী (রাঃ)-কে কাফির, মুরতাদ ও ইসলামের অন্যতম শত্রু হিসেবে বিশ্বাস করাকে ইসলামী আকীদার মূল ভিত্তি বলে গণ্য করেছেন।
উপরের মূলনীতির ভিত্তিতে আহলূস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইমামগণ আবূ তালিব কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন বলে বিশ্বাস করেছেন। কারণ সাহাবীগণ থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত অনেকগুলো হাদীস বিষয়টি প্রমাণ করে। ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস আব্দুর রায্যাক সানআনীর সূত্রে মা‘মার থেকে যুহরী থেকে সায়ীদ ইবনুল মুসাইবি থেকে সাহাবী মুসাইয়িব (রা) থেকে, তিনি বলেন:
إنَّ أَبَا طَالِبٍ لَمَّا حَضَرَتْهُ الْوَفَاةُ دَخَلَ عَلَيْهِ النَّبِيُّ ﷺ وَعِنْدَهُ أَبُو جَهْلٍ فَقَالَ أَيْ عَمِّ قُلْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ كَلِمَةً أُحَاجُّ لَكَ بِهَا عِنْدَ اللَّهِ فَقَالَ أَبُو جَهْلٍ وَعَبْدُ اللَّهِ بْنُ أَبِي أُمَيَّةَ يَا أَبَا طَالِبٍ تَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَلَمْ يَزَالا يُكَلِّمَانِهِ حَتَّى قَالَ آخِرَ شَيْءٍ كَلَّمَهُمْ بِهِ عَلَى مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَقَالَ النَّبِيُّ ﷺ لأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ مَا لَمْ أُنْهَ عَنْهُ فَنَزَلَتْ: مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ. وَنَزَلَتْ: إِنَّكَ لا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ.
‘‘যখন আবূ তালিবের মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলো, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার নিকট প্রবেশ করেন। তখন তার নিকট আবূ জাহল উপস্থিত ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: চাচা, আপনি বলুন: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’; এ বাক্যটি দিয়ে আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্য দাবি-দাওয়া পেশ করব। তখন আবূ জাহল এবং আব্দুল্লাহ ইবনু আবী উমাইয়া বলল: হে আবূ তালিব, আপনি কি আব্দুল মুত্তালিবের ধর্ম অপছন্দ করবেন? উক্ত দু ব্যক্তি এভাবে অনবরত তাকে বুঝাতে থাকলেন। ফলশ্রুতিতে আবূ তালিব সর্বশেষ কথটি তাদেরকে বললেন: ‘আব্দুল মুত্তালিবের ধর্মের উপরেই’। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন: আমাকে নিষেধ না করা পর্যন্ত আমি আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকব। তখন নাযিল হয়[1]: ‘‘নবী ও মুমিনদের জন্য উচিত নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে, যদিও তারা আত্মীয় হয়, তাদের নিকট এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যে, নিশ্চয় তারা প্রজ্বলিত আগুনের অধিবাসী।’’ আরো নাযিল হয়[2]: ‘‘তুমি যাকে ভালবাস তাকে তুমি হেদায়াত করতে পারবে না; বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দেন..।’’[3]
আরেকটি হাদীস ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস নবী-বংশের প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনুল হারিস ইবনু নাওফাল ইবন আব্দুল মুত্তালিব হাশিমী (৮৪ হি) থেকে উদ্ধৃত করেছেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চাচা আব্বাস ইবন আব্দুল মুত্তালিব (রা) তাঁকে বলেন: আপনি আপনার চাচার কী উপকার করেছেন? তিনি তো আপনাকে ঘিরে রাখতেন, হেফাযত করতেন এবং আপনার জন্যই অন্যদের উপর ক্রুদ্ধ হতেন? তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
هُوَ فِى ضَحْضَاحٍ مِنْ نَارٍ ، وَلَوْلاَ أَنَا لَكَانَ فِى الدَّرَكِ الأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ
‘‘তিনি সামান্য গোড়ালি পরিমাণ আগুনের মধ্যে রয়েছেন। আমি না হলে তিনি আগুনের (জাহান্নামের) তলদেশে থাকতেন।’’[4]
অন্য হাদীসে ইমাম বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাবিয়ী আব্দুল্লাহ ইবন খাব্বাব আনসারী (১০০ হি)-এর সূত্রে উদ্ধৃত করেছেন, আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট তাঁর চাচা আবূ তালিবের বিষয় উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন:
لَعَلَّهُ تَنْفَعُهُ شَفَاعَتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَيُجْعَلُ فِى ضَحْضَاحٍ مِنَ النَّارِ، يَبْلُغُ كَعْبَيْهِ، يَغْلِى مِنْهُ دِمَاغُهُ
‘‘সম্ভবত আমার শাফাআত কিয়ামতে তার উপকার করবে; ফলে তিনি পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত সামান্য আগুনের মধ্যে থাকবেন, তাতেই তাঁর মস্তিষ্ক ফুটতে থাকবে।’’[5]
আবূ দাউদ, নাসায়ী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস কর্তৃক সহীহ সনদে সংকলিত হাদীসে তাবিয়ী নাজিয়া ইবন কা’ব বলেন, আলী (রা) বলেন:
قُلْتُ لِلنَّبِيِّ ﷺ إِنَّ عَمَّكَ الشَّيْخَ الضَّالَّ قَدْ مَاتَ قَالَ اذْهَبْ فَوَارِ أَبَاكَ
‘‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- কে বললাম, আপনার চাচা পথভ্রষ্ট শাইখ মৃত্যুবরণ করেছেন। তখন তিনি বললেন, তুমি যাও এবং তোমার পিতাকে কবরস্থ কর।’’[6]
এ সকল হাদীসের আলোকে সাহাবী, তাবিয়ী ও আহলুস সুন্নাত-এর ইমামগণ আবূ তালিব কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন বলে মেনে নিয়েছেন। এ বিষয়টিকে তাঁরা নবী-বংশের, আলী-বংশের বা আলী (রা)-এর প্রতি বেয়াদবী বা অবমাননা বলে কোনোভাবে মনে করেন নি। এ আকীদা ব্যাখ্যা করে ইমাম আযম লিখেছেন: ‘‘তাঁর চাচা এবং আলী (রা)-এর পিতা আবু তালিব কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।’’
পক্ষান্তরে শীয়াগণ আবূ তালিবকে মুমিন হিসেবে বিশ্বাস করা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন। এ অর্থে তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ), আলী (রা) ও তাঁর বংশের ইমামগণের নামে অনেক বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। আলী (রা)-এর খুতবা হিসেবে সংকলিত ‘নাহজুল বালাগা’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায় ৭ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শীয়া-মুতাযিলী পন্ডিত ইবন আবিল হাদীদ আব্দুল হামীদ ইবন হিবাতুল্লাহ (৬৫৬ হি) বলেন:
وروى أن رجلا من رجال الشيعة وهو إبان بن محمود كتب إلى على بن موسى الرضا عليه السلام جعلت فداك إنى قد شككت في إسلام أبى طالب فكتب إليه (ومن يشاقق الرسول من بعد ما تبين له الهدى ويتبع غير سبيل المؤمنين) الاية، وبعدها إنك إن لم تقر بإيمان أبى طالب كان مصيرك إلى النار
‘‘বর্ণিত আছে যে, আবান ইবন মাহমূদ নামক একজন শীয়া নেতা (শীয়া মতবাদের অষ্টম ইমাম, ইমাম) আলী রিদা ইবন মূসা কাযিম (২০৩ হি)-কে পত্র লিখেন যে, আমি আপনার জন্য কুরবানি হই! আবূ তালিবের ঈমান গ্রহণের বিষয়ে আমার মনে আমি সন্দেহ অনুভব করি। তখন আলী রিদা কুরআনের নিম্নের আয়াত লিখেন: ‘‘কারো নিকট সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসুলের বিরুদ্ধাচারণ করে এবং মু’মিনদের পথ ছাড়া অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সে দিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব, আর ওটা কত মন্দ আবাস!’’ (সূরা নিসা: ১১৫ আয়াত)। এরপর তিনি লিখেন: তুমি যদি আবূ তালিবের ঈমানের স্বীকৃতি না দাও তবে তোমাকে জাহান্নামেই যেতে হবে।’’[7]
শীয়া পন্ডিতগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা, চাচা আবূ তালিব, দাদা আব্দুল মুত্তালিব ও সকল পূর্বপুরুষকে ঈমানদার দাবি করার জন্য অনেক পুস্তক রচনা করেছেন। আবূ তালিবের বিষয়ে তাদের লেখালেখি সবচেয়ে বেশি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতার বিষয়ে তাদের লেখালেখির তুলনায় আলী (রা)-এর পিতার বিষয়ে তাঁদের লেখালেখি অনেক অনেক বেশি। এ বিষয়ক বইয়ের মধ্যে রয়েছে: আল্লামা শাইখ আব্দুল হুসাইন আমীনী নাজাফীর লেখা: ‘‘ঈমান আবী তালিব (আঃ) ও সীরাতুহূ’’, আয়াতুল্লাহ শাইখ নাসির মাকারিম শীরাযী রচিত ‘ঈমান আবী তালিব’’, শাইখ আব্দুল্লাহ খানবাযী রচিত ‘আবূ তালিব মুমিন কুরাইশ’ ইত্যাদি। এ সকল পুস্তকে উদ্ধৃত ‘হাদীস’ বা ‘দলীল-প্রমাণগুলো’ আলোচনা অর্থহীন; কারণ এগুলোর কোনো সনদ তারা উল্লেখ করেন না এবং সনদ যাচাইয়ের কোনো উপায়ও আমাদের নেই। তাঁদের কয়েকটি যুক্তি নিম্নরূপ:
(ক) তাঁরা দাবি করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ), তাঁর বংশ, আলী (রা) ও তাঁর বংশের প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষের কারণে সাহাবীগণ, তাবিয়ীগণ ও মূলধারার ইমামগণ বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে উদ্ধৃত এ সকল হাদীস জালিয়াতি করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইবন আবিল হাদীস বলেন:
أما حديث الضحضاح من النار، فإنما يرويه الناس كلهم عن رجل واحد ، وهو المغيرة بن شعبة ، وبغضه لبنى هاشم وعلى الخصوص لعلى عليه السلام مشهور معلوم ، وقصته وفسقه أمر غير خاف .
‘‘আবূ তালিব পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত সামান্য আগুনের মধ্যে অবস্থান করবেন বলে যে হাদীসটি প্রচলিত সে হাদীসটি দুনিয়ার সকল মানুষ একজন মাত্র মানুষ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি হলেন: মুগীরা ইবন শুবা। আর হাশিমী বংশ (নবী-বংশ), বিশেষত আলী (আঃ)-এর প্রতি তাঁর শত্রুতা-বিদ্বেষ অতি প্রসিদ্ধ এবং তাঁর কাহিনী ও পাপাচারের বিষয়ও কারো অজানা নয়।’’[8]
আমরা দেখেছি যে, ‘গোড়ালি পর্যন্ত আগুনে থাকার’ হাদীসগুলো মুহাদ্দিসগণ মুগীরা ইবন শু’বা (রা) থেকে বর্ণনা করেন নি, বরং বিভিন্ন সহীহ সনদে আব্বাস (রা) ও আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। এছাড়া আমরা বলেছি যে, দুজন সৎ মানুষের মধ্যে বিরোধিতা স্বাভাবিক। তবে একারণে কাউকে মিথ্যাচারে অভিযুক্ত করা যায় না। আলী (রা)-এর সাথে শত্রুতার কারণে অন্য কোনো সাহাবী মিথ্যা বলবেন এরূপ ধারণা করার অর্থ রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে একজন ব্যর্থ নবী বলে দাবি করা (নাউযু বিল্লাহ!)। কিন্তু শীয়াগণ এভাবে সাধারণ মানুষদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন।
সর্বোপরি, শীয়াগণের এ মতের বিষয়ে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। সাহাবীগণ ও তাঁদের অনুসারীরা যদি এরূপ বিদ্বেষ পোষণ করেই থাকতেন তবে হামযা, আব্বাস, আলী (রা) ও নবী বংশের অন্যান্যদের মর্যাদায় এত হাদীস তাঁরা কেন বর্ণনা করলেন? পিতামাতা, চাচা ও দাদা যদি সত্যই ইসলাম গ্রহণ করতেন তবে তাঁদের গল্প ও মর্যাদার কথা কি আরো বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করতো না?
(খ) শীয়াগণ প্রশ্ন করেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা, চাচা, দাদা ও তাঁর বংশের অন্যান্যদেরকে জাহান্নামী বানিয়ে আপনাদের কী লাভ? আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত বিষয়টিকে কুরআন ও হাদীসের কাছে আত্মসমর্পণ হিসেবে গণ্য করেন। তাঁরা বলেন: কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যগুলো মেনে নিলে আপনাদের কী ক্ষতি? রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রিয়জনদের প্রতি আবেগ ও ভালবাসা কোনো মুমিনেরই কম নেই। কিন্তু বিভিন্ন সহীহ হাদীস প্রমাণ করছে যে, তাঁরা ঈমান গ্রহণ না করে মৃত্যুবরণ করেছেন। এর বিপরীতে একটিও সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য মুমিনকে আবেগ বিসর্জন দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশনার কাছে আত্মসমর্পন করতে হবে।
(গ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ও চাচার কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার মতটিকে শীয়াগণ তাঁর সাথে চরম বেয়াদবি বলে গণ্য করেছেন। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পরবর্তী যুগের যে সকল আলিম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার ঈমান গ্রহণের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন তাঁরাও এরূপ যুক্তি দিয়েছেন। এ যুক্তি গ্রহণ করলে প্রসিদ্ধ ইমাম ও আলিমগণের অনেককেই বেয়াদব বলে গণ্য করতে হয়। তবে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত আদব ও বেয়াদবির ক্ষেত্রেও কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণকেই সর্বোচ্চ স্থান প্রদান করেছেন। তাঁদের মতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সকল মত ও বক্তব্য নির্বিচারে গ্রহণ করাই মূলত আদব এবং তাঁর কোনো বক্তব্য, মত বা শিক্ষা অমান্য করাই তাঁর সাথে বেয়াদবি। মহান আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ
‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সম্মুখে অগ্রবর্তী হয়ো না।’’[9]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
‘‘যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের উপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’’[10]
এজন্য মনের আবেগ যেদিকেই ধাবিত হোক না কেন দীনের সকল বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা বিনা বাক্যে মেনে নিতে হবে। আর এটিই দীনের আদব।
[2] সূরা (২৮) কাসাস: ৫৬ আয়াত।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১৪০৮ (কিতাবু ফাদাইলিস সাহাবা, বাবু কিস্সাতি আবী তালিব)
[4] বুখারী, ৩/১৪০৮, নং ৩৬৭০ (কিতাবু ফাদাইলিস সাহাবা, বাবু কিস্সাতি আবী তালিব); মুসলিম ১/১৯৫ (কিতাবুল ঈমান, বাব (৯০) শাফাআতিন নাবিয়্যি লি আবি তালিব...)
[5] বুখারী, ৩/১৪০৯, ৫/২৪০০, মুসলিম ১/১৯৫-১৯৬ (কিতাবুল ঈমান, বাব আহওয়নি আহলিন্নার)
[6] আবূ দাউদ, আস-সুনান ৩/২১১, নং ৩২১৪; নাসায়ী, আস-সুনান ৪/৭৯, নং ২০০৬।
[7] ইবন আবিল হাদীদ, শারহ নাহজিল বালাগা (কাইরো, দার এহইয়ায়িল কুতুবিল আরাবিয়্যা: ঈসা বাবী হালাবী) ১৪/৬৭।
[8] ইবন আবিল হাদীদ, শারহ নাহজিল বালাগা ১৪/৭০।
[9] সূরা (৪৯) হুজুরাত: ১ আয়াত।
[10] সূরা (২৪) নূর: ৬৩ আয়াত।