আল-ফিকহুল আকবর মুরজিয়া মতবাদ, নেক আমল, মুজিযা-কারামত, আখিরাত, ঈমান-ইসলাম ও অন্যান্য প্রসঙ্গ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
১২. হাউয

আখিরাত বিষয়ক ইসলামী আকীদার অন্যতম একটি বিষয় ‘‘হাউয’’ বিষয়ক বিশ্বাস। এ প্রসঙ্গে ইমাম আযম বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাউয সত্য।’’

হাউয (الحوض) অর্থ চৌবাচ্চা, পুকুর বা জলাশয়। আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে একটি পবিত্র ‘হাউয’ দান করেছেন যেখান থেকে তাঁর উম্মাত কিয়ামাতের দিন পানি পান করবে। মহান আল্লাহ বলেন:


إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ


‘‘নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রদান করেছি ‘‘কাওসার’’।[1]

কাওসার শব্দের অর্থ অধিক বা আধিক্য। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, কাওসার জান্নাতের একটি নদীর নাম, যা মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেছেন। হাউযের বিষয়ে বর্ণিত হাদীসগুলো মুতাওয়াতির পর্যায়ের। প্রায় ৩৫ জন সাহাবী থেকে এ বিষয়ক হাদীসগুলো বর্ণিত।[2] এক হাদীসে আনাস ইবন মালিক (রা) বলেন:


بَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ ﷺ ذَاتَ يَوْمٍ بَيْنَ أَظْهُرِنَا إِذْ أَغْفَى إِغْفَاءَةً ثُمَّ رَفَعَ رَأْسَهُ مُتَبَسِّمًا فَقُلْنَا مَا أَضْحَكَكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ أُنْزِلَتْ عَلَيَّ آنِفًا سُورَةٌ فَقَرَأَ بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ (إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ ...)، ثُمَّ قَالَ أَتَدْرُونَ مَا الْكَوْثَرُ؟ فَقُلْنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَالَ: فَإِنَّهُ نَهْرٌ وَعَدَنِيهِ (أعطانيه) رَبِّي عَزَّ وَجَلَّ عَلَيْهِ خَيْرٌ كَثِيرٌ هُوَ حَوْضٌ تَرِدُ عَلَيْهِ أُمَّتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ آنِيَتُهُ عَدَدُ النُّجُومِ فَيُخْتَلَجُ الْعَبْدُ مِنْهُمْ فَأَقُولُ رَبِّ إِنَّهُ مِنْ أُمَّتِي فَيَقُولُ مَا تَدْرِي مَا أَحْدَثَتْ (أحدث) بَعْدَكَ


‘‘একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের মাঝে ছিলেন। তিনি একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হন। এরপর তিনি হাসিমুখে মাথা উঠান। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি হাসছেন কেন? তিনি বলেন, এখন আমার উপরে একটি সূরা নাযিল করা হলো। অতঃপর তিনি সূরা কাউসার পাঠ করেন। তিনি বলেন, তোমরা কি জান কাউসার কী? আমরা বললাম: আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই অধিক অবগত। তিনি বলেন: কাউসার হলো একটি নদী যা মহান আল্লাহ আমাকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন (অন্য বর্ণনায়: যা তিনি আমাকে প্রদান করেছেন)। তাতে রয়েছে অনেক কল্যাণ। এ হলো হাউয, যেখানে আমার উম্মাত কিয়ামাতের দিন আমার নিকট আগমন করবে। তার পানপাত্রগুলো তারকারাজির ন্যায়। কোনো কোনো বান্দাকে সেখান থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বলব, হে আমার প্রতিপালক, এ তো আমার উম্মাতের একজন। তখন তিনি বলবেন, আপনি জানেন না, আপনার পরে এরা কি নব-উদ্ভাবন করেছিল।’’[3]

অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


إِنَّ حَوْضِي أَبْعَدُ مِنْ أَيْلَةَ مِنْ عَدَنٍ لَهُوَ أَشَدُّ بَيَاضًا مِنْ الثَّلْجِ وَأَحْلَى مِنْ الْعَسَلِ بِاللَّبَنِ وَلآنِيَتُهُ أَكْثَرُ مِنْ عَدَدِ النُّجُومِ وَإِنِّي لأَصُدُّ النَّاسَ عَنْهُ كَمَا يَصُدُّ الرَّجُلُ إِبِلَ النَّاسِ عَنْ حَوْضِهِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَتَعْرِفُنَا يَوْمَئِذٍ قَالَ نَعَمْ لَكُمْ سِيمَا لَيْسَتْ لأَحَدٍ مِنْ الأُمَمِ تَرِدُونَ عَلَيَّ غُرًّا مُحَجَّلِينَ مِنْ أَثَرِ الْوُضُوءِ


‘‘আদান (ইয়ামান) থেকে আইলা (ফিলিস্তিন)-এর যে দূরত্ব তার চেয়ে বেশি প্রশস্ততা আমার হাউযের। তার পানি বরফের চেয়েও বেশি শুভ্র এবং মধু মিশ্রিত দুগ্ধের চেয়েও বেশি মিষ্ট। তার পানপাত্রগুলি সংখ্যা আকাশের তারকারাজির চেয়েও বেশি। একজন মানুষ যেমন তার হাউয থেকে অন্য মানুষদের উট ঠেকিয়ে রাখে আমি তেমন ভাবে আমার উম্মাত ছাড়া অন্য মানুষদের সেভাবে ঠেকিয়ে রাখব। সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি আমাদেরকে চিনবেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ, তোমাদের এমন একটি চিহ্ন রয়েছে যা অন্য কোনো উম্মাতের নেই, তোমরা আমার নিকট যখন আগমন করবে তখন ওযুর কারণে তোমাদের ওযুর অঙ্গগুলি শুভ্রতায় উদ্ভাসিত থাকবে।’’[4]

সাহল ইবন সা’দ (রা) ও অন্যান্য সাহাবী বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


إِنِّي فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ مَنْ مَرَّ عَلَيَّ شَرِبَ وَمَنْ شَرِبَ لَمْ يَظْمَأْ أَبَدًا لَيَرِدَنَّ عَلَيَّ أَقْوَامٌ أَعْرِفُهُمْ وَيَعْرِفُونِي ثُمَّ يُحَالُ بَيْنِي وَبَيْنَهُمْ، فَأَقُولُ: إِنَّهُمْ مِنِّي فَيُقَالُ إِنَّكَ لا تَدْرِي مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ (في رواية: إِنَّكَ لا تَدْرِي مَا عَمِلُوا بَعْدَكَ)، فَأَقُولُ سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِي.


‘‘আমি তোমাদের আগে হাউযে গিয়ে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব। যে আমার কাছে যাবে সে (হাউয) থেকে পান করবে, আর যে পান করবে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না। অনেক মানুষ আমার কাছে (হাউযে পানি পানের জন্য) আসবে, যাদেরকে আমি চিনতে পারব এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে, কিন্তু তাদেরকে আমার কাছে আসতে দেওয়া হবে না, বাধা দেওয়া হবে। আমি বলব: এরা তো আমারই উম্মত। তখন উত্তরে বলা হবে : আপনি জানেন না, এরা আপনার পরে কী-সব নব উদ্ভাবন করেছিল। (দ্বিতীয় বর্ণনায় : আপনার পরে তারা কী আমল করেছে তা আপনি জানেন না।) তখন আমি বলব: যারা আমার পরে (আমার দ্বীনকে) পরিবর্তিত করেছে তারা দূর হয়ে যাক, তারা দূর হয়ে যাক!’’[5]

আনাস ইবন মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


إِنَّ قَدْرَ حَوْضِي كَمَا بَيْنَ أَيْلَةَ وَصَنْعَاءَ مِنْ الْيَمَنِ وَإِنَّ فِيهِ مِنْ الأَبَارِيقِ كَعَدَدِ نُجُومِ السَّمَاءِ


‘‘ফিলিস্তিন থেকে ইয়ামানের সান‘আ পর্যন্ত যে দূরত্ব আমার হাউযের পরিমাণ তদ্রূপ। তথায় পানপাত্রের সংখ্যা আকাশের তারকারাজির ন্যায়।’’[6]

আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


حَوْضِي مَسِيرَةُ شَهْرٍ وَزَوَايَاهُ سَوَاءٌ وَمَاؤُهُ أَبْيَضُ مِنْ الْوَرِقِ (مِنْ اللَّبَنِ) وَرِيحُهُ أَطْيَبُ مِنْ الْمِسْكِ وَكِيزَانُهُ كَنُجُومِ السَّمَاءِ فَمَنْ شَرِبَ مِنْهُ فَلا يَظْمَأُ بَعْدَهُ أَبَدًا


‘‘আমার হাউযের প্রশস্ততা একমাসের পথ। এর সকল কোণ সমান। এর পানি দুধের (অন্য বর্ণনায় রৌপ্যের) চেয়েও শুভ্র এবং মেশকের চেয়েও অধিক সুগন্ধ। তার পানপাত্রের সংখ্যা আকাশের তারকারাজির ন্যায়। যে ব্যক্তি এ থেকে পান করবে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না।’’[7]

কুরআন ও হাদীসের এ সকল নির্দেশনার ভিত্তিতে ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাউয সত্য’’। এ প্রসঙ্গে ইমাম তাহাবী বলেন:


وَالْحَوْضُ الَّذِيْ أَكْرَمَهُ اللهُ تَعَالَى بِهِ غِيَاثاً لأُمَّتِهِ حَقٌّ. ... وَالشَّفَاعَةُ الَّتِيْ ادَّخَرَهَا لَهُمْ حَقٌّ، كَمَا رُوِيَ فِيْ الأَخْبَارِ.


হাউয (হাউয কাউসার) সত্য। মহান আল্লাহ যদ্বারা তাঁর নবীকে সম্মানিত করেছেন, উম্মতের পিপাসা নিবারণার্থে তিনি তাঁকে তা দান করেছেন। ... নবী ﷺ এর শাফাআত সত্য। তিনি তা আপন উম্মতের জন্য সংরক্ষিত করে রেখেছেন। হাদীসে এর বিশদ বর্ণনা এসেছে।’’[8]

[1] সূরা (১০৮) কাউসার: ১ আয়াত।

[2] ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ২২৭।

[3] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩০০ (কিতাবুস সালাত, বাবু হুজ্জাতি মান কালাল বাসমালাতু আয়াত)।

[4] মুসলিম, আস-সহীহ ১/২১৭ (কিতাবুত তাহারাহ, বাবু ইসতিহবাবি ইতালাতিল গুর্রাহ)

[5] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২৪০৬ (কিতাবুর রিকাক, বাবুন ফিল হাউয)।

[6] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২৪০৫ (কিতাবুর রিকাক, বাবুন ফিল হাউয); মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৮০০ (কিতাবুল ফাদাইল, বাবু ইসবাতি হাউযি নাবিয়্যিনা ﷺ)।

[7] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২৪০৫ (কিতাবুর রিকাক, বাবুন ফিল হাউয); মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৯৩ (কিতাবুল ফাদাইল, বাবু ইসবাতি হাউযি নাবিয়্যিনা ﷺ)।

[8] তাহাবী, আল-আকীদাহ, পৃ. ১১।