আল-ফিকহুল আকবর মুরজিয়া মতবাদ, নেক আমল, মুজিযা-কারামত, আখিরাত, ঈমান-ইসলাম ও অন্যান্য প্রসঙ্গ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
৫. ২. ৩. ৩. বিলায়াতের নিশ্চয়তার ধারণা

এ বিষয়ক আরেকটি বিভ্রান্তি অলৌকিক কর্মের কারণে বা অন্য কোনো কারণে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে ‘‘ওলী’’ বলে বিশ্বাস করা। আমরা দেখেছি যে, ঈমান ও তাকওয়া বিলায়াতের মূল এবং ফরয ও নফল ইবাদত পালন এর পথ। ঈমান ও তাকওয়া দুটিই মূলত আভ্যন্তরীণ বিষয়, যা দেখা যায় না বা নিশ্চিতরূপে জানা যায় না। এজন্য কে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ওলী তা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। কার ইবাদত আল্লাহ কতটুকু কবুল করেছেন বা কে আল্লাহর কতটুকু ওলী তা একমাত্র তিনিই জানেন।

আমরা ইতোপূর্বে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর বক্তব্য থেকে জেনেছি যে, কুরআন বা হাদীসে যাঁদের কবুলিয়াত বা জান্নাতের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে তাঁদের বাইরে কাউতে ব্যক্তিগতভাবে নির্দিষ্ট করে আল্লাহর ওলী বলা তো দূরের কথা ‘‘জান্নাতী’’ বলেও সাক্ষ্য দেওয়া যাবে না। কোনো কারামত বা অলৌকিকত্বও এবিষয়ে কোনো রকম প্রমাণ পেশ করে না। কারণ আমরা যাকে কারামত মনে করছি তা শয়তানী অলৌকিকত্ব বা ইসতিদরাজ কি-না তা কেউ বলতে পারবে না। কুরআনের বিবরণ থেকে আমরা আরো জেনেছি যে, অনেক সময় কারামতের অধিকারী ওলীও গোমরাহ ও বিভ্রান্ত হয়েছেন। কাজেই বাহ্যিক আমল ও কুরআন-সুন্নাহর পরিপূর্ণ অনুসরণ দেখে আমরা কোনো মুমিনের বিষয়ে ধারণা ও আশা করি যে, তিনি আল্লাহর ওলী বা প্রিয়। তবে নিশ্চিত বিশ্বাসের সুযোগ নেই।

মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ‘কারামত’-এর দাবিদার সবচেয়ে বেশি শীয়াদের মধ্যে। ইরানে ও অন্যান্য দেশে শীয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে আপনি অগণিত ওলীর কথা জানবেন যাদের অগণিত কারামত জনগণের মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ। অথচ সুন্নীগণ তাদেরকে ওলী তো দূরের কথা মুসলিম বলে মানতেই রাজি নন। মূলধারার মুসলিমদের মধ্যে অনেকেই তাদের বুজুর্গদের কারামত প্রচার করেন, কিন্তু বিরুদ্ধ মতের মানুষেরা তাদেরকে বিদ‘আতী, ওহাবী বা বিভ্রান্ত বলে বিশ্বাস করেন। মুজাদ্দিদ-ই-আলফ-ই-সানী ‘‘মাকতুবাত’’-এ ও সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী ‘সেরাতে মুসতাকীম’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কোনো ফাসিক বা কাফিরও তাসাউফের আমল পালন করে বিভিন্ন হালত, তাজাল্লী ও কাশ্ফ অর্জন করতে পারে। এগুলি কখনো বিলায়াত বা কামালাতের প্রমাণ নয়।[1]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কারো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভালো-মন্দ বলতে নিষেধ করেছেন। বাহ্যিক যা দেখা যায় তাই বলতে নির্দেশ দিয়েছেন। একবার একজন সাহাবী তাঁর সামনে এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন যে: তাঁকে তিনি মু’মিন বলে মনে করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে বলেন: মুমিন না বলে বল: মুসলিম। অর্থাৎ, ইসলামের বিধান পালনকারী হিসাবে বাহ্যিক যা দেখা যায় তাই বলতে হবে। ঈমানের গভীরতা ও বিশুদ্ধতা আল্লাহই জানেন।[2]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দুধ-ভাই, প্রথম অগ্রবর্তী মুহাজিরদের অন্যতম, প্রসিদ্ধ বুজুর্গ সাহাবী উসমান ইবন মাযঊন (রা)-এর ওফাতের পরের ঘটনা বর্ণনা করে মহিলা সাহাবী উম্মুল আলা (রা) বলেন:


فَدَخَلَ عَلَيْنَا النَّبِيُّ ﷺ فَقُلْتُ رَحْمَةُ اللَّهِ عَلَيْكَ أَبَا السَّائِبِ شَهَادَتِي عَلَيْكَ لَقَدْ أَكْرَمَكَ اللَّهُ فَقَالَ النَّبِيُّ ﷺ وَمَا يُدْرِيكِ أَنَّ اللَّهَ أَكْرَمَهُ قَالَتْ قُلْتُ لاَ أَدْرِي، بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي يَا رَسُولَ اللَّهِ فَمَنْ يُكْرِمُهُ الله؟ قَالَ أَمَّا هُوَ فَقَدْ جَاءَهُ وَاللَّهِ الْيَقِينُ وَاللَّهِ إِنِّي لأَرْجُو لَهُ الْخَيْرَ وَمَا أَدْرِي وَاللَّهِ وَأَنَا رَسُولُ اللَّه مَا يُفْعَلُ بِي قَالَتْ فَوَاللَّهِ لا أُزَكِّي أَحَدًا بَعْدَهُ


‘‘তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিকট আসলেন। আমি বললাম, হে আবুস সাইব (উসমান ইবন মাযঊন) আমি আপনার বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ আপনাকে সম্মানিত করেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: তুমি কিভাবে জানলে যে, আল্লাহ তাঁকে সম্মানিত করেছেন? আমি বললাম, আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবানী হোন, আমি তো জানি না, তবে তাঁকে যদি আল্লাহ সম্মানিত না করেন তবে আর কাকে করবেন? তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম, তাঁর কাছে একীন এসেছে, আল্লাহর কসম, আমি তাঁর বিষযে ভাল আশা করি। আল্লাহর কসম, আমি আল্লাহর রাসূল, আমিও জানি না যে, আমার বিষয়ে কি করা হবে।’ উম্মুল আলা (রা) বলেন, আল্লাহর কসম! এরপর আমি আর কাউকে ভাল বলি না।’’[3]

[1] মুজাদ্দিদ আলফসানী, মাকতুবাত শরীফ ১/১/ মাকতুব ৭, পৃ: ১৪; সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী, সেরাতে মুস্তাকীম (উর্দু) পৃ: ৫১।

[2] বুখারী, আস-সহীহ ১/১৮ (কিতাবুল ঈমান, বাবু ইযা লাম ইয়াকুনিল ইসলাম...); মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩২ (কিতাবুল ইমান, বাবু তাআল্লুফি কালবি মান ইউখাফু...)

[3] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১৪২৯ (কিতাবু ফাদায়িলিস সাহাবা, বাবু মাকদামিন্নাবিয়্যি...)