লগইন করুন
মুরজিয়াহ (المرجئة) ‘আরজাআ’ (أرجأ) ক্রিয়া থেকে গৃহীত। আরজাআ (أرجأ) অর্থ বিলম্বিত করা, পিছিয়ে দেওয়া, স্থগিত রাখা (To postpone, adjourn) ইত্যাদি। মুরজিউন (مرجئ) অর্থ বিলম্বিতকারী বা স্থগিতকারী। বহুবচন বা ফিরকা অর্থে ‘মুরজিয়াহ’ বলা হয়, অর্থাৎ বিলম্বিতকারীগণ বা স্থগিতকারীগণ।
পূর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, খারিজীদের মতে মুমিন পাপের কারণে কাফির হয়ে যান। যে মুমিন পাপ করে তাওবা ছাড়া মৃত্যু বরণ করবে সে অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। তার ঈমান তার কোনো কাজে লাগবে না। মুতাযিলাগণও এরূপ বিশ্বাস পোষণ করে। তাদের মতে মুমিন তার ঈমান সত্ত্বেও যখন কোনো কবীরা গোনাহ করে তখন তার ঈমান ও সকল নেক কর্ম বিনষ্ট হয়ে যায়। এরূপ ব্যক্তি কাফির না হলেও মুমিন থাকে না। অর্থাৎ সে মুমিনও নয়, কাফিরও নয়। তবে পরিণতি কাফিরেরই। সেও কাফিরের মত অনন্তকাল জাহান্নামে শাস্তিভোগ করবে।
এদের মতে ইসলামের বিধান পালন ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কর্মের ঘাটতি মানেই ঈমানের ঘাটতি। আর ঈমানের ঘাটতি অর্থই কুফর। এর বিপরীতে আরেক দলের উদ্ভব হয়। তারা বলে, ঈমানের সাথে আমলের কোনো সম্পর্ক নেই। ঈমান থেকে আমল বা কর্ম সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ঈমানের জন্য শুধু অন্তরের ভক্তি বা বিশ্বাসই যথেষ্ট। ইসলামের কোনো বিধিবিধান পালন না করেও একব্যক্তি ঈমানের পূর্ণতার শিখরে আরোহণ করতে পারে। আর এরূপ ঈমানদার ব্যক্তির কবীরা গোনাহ তার কোনো ক্ষতি করে না। যত গোনাহই করুক না কেন সে জান্নাতী হবে। এদের মূলনীতি:
لاَ يَضُرُّ مَعَ الإِيْمَانِ مَعْصِيَةٌ كَمَا لاَ يَنْفَعُ مَعَ الْكُفْرِ طَاعَةٌ
‘‘ঈমান থাকলে কোনো পাপই কোনো ক্ষতি করে না, যেমন কুফর থাকলে কোনো পুণ্যই কাজে লাগে না।’’
দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথম থেকেই এ মতটি বিশেষভাবে প্রসার লাভ করে। এদেরকে মুরজিয়া কেন বলা হলো সে বিষয়ে একাধিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ইবনুল আসীর বলেন, এরা যেহেতু বিশ্বাস করে যে, কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ শাস্তি দিবেন না বা তার শাস্তি স্থগিত রাখবেন সেহেতু তাদেরকে মুরজিয়া বলা হয়। আর আব্দুল কাহির বাগদাদী বলেন, এরা যেহেতু আমল বা কর্মকে ঈমান থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে বা স্থগিত করেছে এজন্য এদেরকে মুরজিয়া বলা হয়।[1]
খারিজীগণ যেরূপ কুরআন- হাদীসের কিছু বক্তব্য নিজেদের মতের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে তার বিপরীতে অন্য বক্তব্যগুলো ব্যাখ্যা বা বাতিল করেছে, মুরজিয়াগণও একইভাবে কুরআন ও হাদীসের ক্ষমা বিষয়ক ও তাওহীদের ফযীলত বিষয়ক বক্তব্যগুলোকে মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে বাকি আয়াত ও হাদীসগুলো ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করেছে। সমন্বয় বা উভয় প্রকার শিক্ষা গ্রহণ করতে তারা সচেষ্ট হয় নি।
এখানে লক্ষণীয় যে, খারিজী, মুতাযিলী এবং তাদের সংগে একমত বিভিন্ন ফিরকা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতকেও মুরজিয়াহ বলে আখ্যায়িত করে। কারণ এ সকল ফিরকা কবীরা গোনাহে লিপ্ত মুসলিমের বিধান তাৎক্ষণিক বলে দেয় যে, সে অনন্তকাল জাহান্নামে বাস করবে। আর আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে অনন্ত জাহান্নামবাসী না বলে তার বিষয়টি আল্লাহর হাতে বলে বিশ্বাস করেন এবং আল্লাহ তাকে ইচ্ছা করলে শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা করতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন। এভাবে তাঁরা পাপী মুসলিমের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের বিষয়টি পিছিয়ে দেন।
বস্ত্তত ‘আহলুস সুন্নাত’ কুরআন ও হাদীসের সকল নির্দেশ সমানভাবে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা কিছু আয়াত ও হাদীসকে অগ্রগণ্য করে অন্য আয়াত ও হাদীসকে ব্যাখ্যার নামে বাতিল করেন নি। বরং তাঁরা উভয় অর্থের ওহী সমানভাবে বিশ্বাস ও গ্রহণ করেছেন। আর এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন:
আমরা বলি না যে, পাপ মুমিনের কোনো ক্ষতি করবে না। আমরা এও বলি না যে, মুমিন জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। আমরা এও বলি না যে, মুমিন অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। মুমিন যদি ফাসিক বা পাপী হয়, কিন্তু ঈমানসহ পৃথিবী ত্যাগ করে তবে তার বিষয়ে আমরা এরূপ বলি না। আমরা বলি না যে, আমাদের নেক কর্মগুলি কবুলকৃত এবং পাপরাশি ক্ষমাকৃত, মুরজিয়াগণ এরূপ বলে থাকে।
বরং আমরা বলি যে, এ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যাকৃত। যে ব্যক্তি সকল শর্ত পূরণ করে এবং সকল বিনষ্টকারী ত্রুটি হতে মুক্ত থেকে কোনো নেক কর্ম করবে এবং কুফর বা ধর্মত্যাগ দ্বারা বা অশোভন আচরণ দ্বারা তার নেককর্মটি বিনষ্ট করবে না এবং ঈমানসহ পৃথিবী ত্যাগ করবে আল্লাহ তার কর্মটি নষ্ট করবেন না, বরং তিনি তা কবুল করবেন এবং তাকে তার জন্য সাওয়াব প্রদান করবেন।
কোনো মানুষ যদি শির্ক ও কুফর ছাড়া অন্য কোনো পাপ কর্ম করে তাওবা না করে ঈমান সহ মৃত্যুবরণ করে তবে তার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাধীন থাকবে। মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাকে জাহান্নামের মধ্যে শাস্তি দিবেন, আর ইচ্ছা করলে তিনি তাকে ক্ষমা করবেন এবং তাকে জাহান্নামে কোনোরূপ শাস্তিই দিবেন না। রিয়া যদি কোনো কর্মের মধ্যে প্রবেশ করে তবে তা সে কর্মের পুরস্কার বাতিল করে দেয়। ‘উজব’ও তদ্রূপ।
এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ও তাঁর সাথীদ্বয়ের আকীদা আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন ইমাম তাহাবী। তিনি বলেন:
وَلا نَقُولُ: لا يَضُرُّ مَعَ الإِيمَانِ ذَنْبٌ لِمَنْ عَمِلَهُ. نَرْجُو لِلْمُحْسِنِينَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْ يَعْفُوَ عَنْهُمْ، وَيُدْخِلَهُمُ الْجَنَّةَ بِرَحْمَتِهِ، وَلا نَأْمَنُ عَلَيْهِمْ، وَلا نَشْهَدُ لَهُمْ بِالْجَنَّةِ، وَنَسْتَغْفِرُ لِمُسِيئِهِمْ، وَنَخَافُ عَلَيْهِمْ، وَلا نُقَنِّطُهُمْ. ... وَالأَمْنُ وَالإِيَاسُ يَنْقُلانِ عَنْ مِلَّةِ الإِسْلامِ، وَسَبِيلُ الْحَقِّ بَيْنَهُمَا لأَهْلِ الْقِبْلَةِ. .... وَأَهْلُ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ ﷺ فِي النَّارِ لاَ يَخْلُدُونَ، إِذَا مَاتُوا وَهُمْ مُوَحِّدُونَ، وَإِنْ لَمْ يَكُونُوا تَائِبِينَ، بَعْدَ أَنْ لَقُوا اللَّهَ عَارِفِينَ مُؤْمِنِينَ، وَهُمْ فِي مَشِيئَتِهِ وَحُكْمِهِ إِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُمْ، وَعَفَا عَنْهُمْ بِفَضْلِهِ، كَمَا ذَكَرَ عَزَّ وَجَلَّ فِي كِتَابِهِ: "وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ"، وَإِنْ شَاءَ عَذَّبَهُمْ فِي النَّارِ بِعَدْلِهِ، ثُمَّ يُخْرِجُهُمْ مِنْهَا بِرَحْمَتِهِ وَشَفَاعَةِ الشَّافِعِينَ مِنْ أَهْلِ طَاعَتِهِ، ثُمَّ يَبْعَثُهُمْ إِلَى جَنَّتِهِ، وَذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ تَعَالَى تَوَلَّى أَهْلَ مَعْرِفَتِهِ، وَلَمْ يَجْعَلْهُمْ فِي الدَّارَيْنِ كَأَهْلِ نُكْرَتِهِ الَّذِينَ خَابُوا مِنْ هِدَايَتِهِ، وَلَمْ يَنَالُوا مِنْ وَلايَتِهِ.
‘‘আমরা এ কথাও বলি না যে, ঈমান থাকলে কোনো পাপ পাপীর ক্ষতি সাধন করে না। মু‘মিনগণের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল ইহসান অর্জনকারী নেককার তাদের সম্পর্কে আমরা আশা করি যে, আল্লাহ্ পাক তাদের দোষক্রটি ক্ষমা করবেন এবং নিজ রহমতে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তবে, আমরা তাদের সম্পর্কে সম্পুর্ণ নির্ভয় নই এবং তাদের জান্নাতী হওয়ার কোনো সাক্ষ্যও আমরা প্রদান করি না। আর মুমিনগণের মধ্যে যারা গুনাহগার তাদের ভূলক্রটির জন্য আমরা আল্লাহর নিকট মাগফেরাত কামনা করি এবং তাদের ব্যাপারে আশঙ্কাও পোষণ করি। তবে, আমরা তাদেরকে নিরাশাগ্রস্থ করি না।
নির্ভয় ও হতাশা উভয়ই বান্দাকে মিল্লাতে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। আহলু কিবলার জন্য এতদুভয়ের মাঝামাঝি সত্যের পথ নিহিত রয়েছে। .... মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উম্মতের মধ্যে যারা কবীরা গুণাহ করবে তারা জাহান্নামে চিরকাল থাকবে না, যদি তারা তাওহীদের সাথে মৃত্যু বরণ করে, যদিও তারা তাওবা না করে মারিফাত ও ঈমানসহ আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করে থাকে। তাদের পরিণতি আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশের উপর নির্ভর করবে। তিনি চাইলে নিজ দয়ায় তাদের ক্ষমা করে দিবেন। কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘এবং তিনি শিরক ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন।’’[2] আর তিনি চাইলে আপন ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে তাদের জাহান্নামে শাস্তি দিতে পারেন। অতঃপর তিনি নিজ অনুগ্রহে এবং তাঁর অনুগত বান্দাহগণের শাফা‘আতের ফলে তাদের বের করে জান্নাতে পাঠাবেন। এর কারণ, আল্লাহ তা’আলা তাঁর ঈমানদার বান্দাহগণের অভিভাবকত্ব বিশেষভাবে গ্রহণ করেছেন। তাদের ইহকাল ও পরকালে ঐসব কাফেরদের সমতুল্য করেন নি যারা তাঁর হেদায়াত থেকে নিজেদের বঞ্চিত করেছে এবং তাঁর বন্ধুত্ব ও অভিভাবকত্ব লাভে সক্ষম হয় নি।’’[3]
[2] সূরা (৪) নিসা: ৪৮ ও ১১৬ আয়াত।
[3] তাহাবী, আল-আকীদাহ, পৃ. ১৩-১৫।