লগইন করুন
এখানে আরো লক্ষণীয় সমাজ বা রাষ্ট্রের পাপের কারণে মুমিনের নিজ ইবাদত পালনে অবহেলা। অনেক সময় আবেগী মুসলিম মনে করেন, ‘‘নামায পড়ব কার পিছে? সবাই তো বিভিন্ন পাপ বা অপরাধে জড়িত’’, অথবা মনে করেন: ‘‘এত পাপ, জুলুম বা কুফরের মধ্যে থেকে জুমুআ, জামা‘আত ইত্যাদি করে কি লাভ? অথবা আগে এ সকল পাপ, জুলুম ইত্যাদি দূর করি, এরপর জুমুআ-জামা‘আত পালন করব।
এ আবেগ মুমিনকে ভুল পথে পরিচালিত করে। মুমিনের মূল দায়িত্ব নিজের জীবনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাত অনুসারে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপালন করা। পাশাপাশি তিনি অন্যদেরকে সাধ্যমত দীন পালন ও প্রতিষ্ঠার দাওয়াত দিবেন। অন্যের পাপের দায়ভার তার নয়। তার সাধ্যমত দাওয়াত, আদেশ, নিষেধ, আপত্তি বা ঘৃণার পরেও সমাজের সকল মানুষ, অধিকাংশ মানুষ এবং সালাতের বা রাষ্ট্রের ইমাম পাপে লিপ্ত থাকলে সে জন্য তিনি দায়ী হবেন না বা তার দীনদারী ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। পাপের প্রতি ঘৃণা ও আপত্তি-সহ পাপী সমাজে বাস করা, পাপী ইমামের পিছনে সালাত আদায় করা বা পাপী শাসকের আনুগত্য করার অর্থ তার পাপের স্বীকৃতি দেওয়া নয় বা তার পাপের অংশী হওয়া নয়; বরং ঐক্য বা ‘জামা‘আত’ রক্ষায় নিজের দীনী দায়িত্ব পালন করা। মহান আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ لا يَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ
‘‘হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর শুধু তোমাদের নিজেদের দায়িত্ব। তোমরা যদি সৎপথে থাক তবে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোনো ক্ষতি করবে না।’’[1]
পাপী শাসক-প্রশাসকদের পিছনে সালাতের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
يُصَلُّونَ لَكُمْ فَإِنْ أَصَابُوا فَلَكُمْ وَإِنْ أَخْطَئُوا فَلَكُمْ وَعَلَيْهِمْ
‘‘তারা তোমাদের জন্য সালাত আদায় করবে। যদি তারা সঠিক করে তবে তোমরা সাওয়াব পাবে। আর তারা যদি অপরাধ করে তবে তোমরা সাওয়াব পাবে এবং তারা পাপী হবে।’’[2]
৩৫ হিজরী সালে খলীফা উসমান (রা)-কে মদীনায় অবরুদ্ধ করে একদল বিদ্রোহী পাপাচারী এবং শেষে তারা তাঁকে নির্মমভাবে শহীদ করে। পাপিষ্ট বিদ্রোহীরা মসজিদে নববীর ইমামতি দখল করে। এরূপ ইমামের পিছনে সালাত আদায় বিষয়ে অবরুদ্ধ উসমান (রা)-কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন:
الصَّلاةُ أَحْسَنُ مَا يَعْمَلُ النَّاسُ فَإِذَا أَحْسَنَ النَّاسُ فَأَحْسِنْ مَعَهُمْ وَإِذَا أَسَاءُوا فَاجْتَنِبْ إِسَاءَتَهُمْ
‘‘মানুষ যত কর্ম করে তার মধ্যে সালাত সবচেয়ে ভাল কর্ম। যখন মানুষ ভাল কর্ম করে তখন তাদের সাথে তুমিও ভাল কর্ম কর। আর যখন তারা অন্যায় করে তখন তুমি তাদের অন্যায় বর্জন কর।’’[3]
রাষ্ট্রীয় পাপ ও ইসলাম বিরোধিতার প্রসার ঘটে উমাইয়া যুগে। সাহাবীগণ পাপের বিরোধিতার পাশাপাশি পাপী ইমামের পিছনে সালাত আদায় করতেন ও তাদের নেতৃত্বে জিহাদ ও অন্যান্য ইবাদত পালন করতেন। তারিক ইবন শিহাব বলেন:
أَوَّلُ مَنْ بَدَأَ بِالْخُطْبَةِ يَوْمَ الْعِيدِ قَبْلَ الصَّلاةِ مَرْوَانُ فَقَامَ إِلَيْهِ رَجُلٌ فَقَالَ الصَّلاةُ قَبْلَ الْخُطْبَةِ فَقَالَ قَدْ تُرِكَ مَا هُنَالِكَ فَقَالَ أَبُو سَعِيدٍ أَمَّا هَذَا فَقَدْ قَضَى مَا عَلَيْهِ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ يَقُولُ مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ
‘‘প্রথম যে ব্যক্তি সালাতুল ঈদের খুতবা সালাতের আগে নিয়ে আসে সে মারওয়ান ইবনুল হাকাম। তখন এক ব্যক্তি তার দিকে দাঁড়িয়ে বলে, খুতবার আগে সালাত। মারওয়ান বলেন: তৎকালীন নিয়ম পরিত্যক্ত হয়েছে। তখন আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, এ ব্যক্তি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি: ‘তোমাদের কেউ যদি কোন অন্যায় দেখে তবে সে যেন তা তার বাহুবল দিয়ে পরিবর্তন করে। যদি তাতে সক্ষম না হয় তবে সে যেন তার বক্তব্য দিয়ে তা পবিবর্তন করে। এতেও যদি সক্ষম না হয় তাহলে সে যেন তার অন্তর দিয়ে তা পরিবর্তন (কামনা) করে, আর এ হলো ঈমানের দুর্বলতম পর্যায়।’’[4]
এখানে অন্যায়্যের প্রতিবাদের সমর্থন-সহ আবূ সাঈদ খুদরী (রা) মারওয়ানের পিছনে সালাত আদায় করেছেন।
প্রসিদ্ধ সাহাবী আবূ আইঊব আনসারী (রা) ইয়াযিদ ইবন মুআবিয়ার নেতৃত্বে জিহাদে অংশ গ্রহণ করেন।[5] অন্যান্য প্রসিদ্ধ সাহাবীও উমাইয়া যুগে ইয়াযিদ ও অন্যান্য ফাসিক ও ইসলাম বিরোধী আইন-কানুন ও বিধিবিধানে লিপ্ত (খারিজী ও শীয়া বিচারে কাফির) শাসক ও আমীরদের অধীনে জিহাদে অংশ গ্রহণ করেছেন বা রাষ্ট্রীয় চাকরী ও দায়িত্ব পালন করেছেন। ইয়াযিদ ও পরবর্তী উমাইয়া শাসকদের সবচেয়ে কুখ্যাত প্রশাসক ছিলেন হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ। আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) ও অন্যান্য সাহাবী হাজ্জাজের ইমামতিতে আরাফার মাঠে সালাত আদায় করতেন।[6]
উমাইয়া প্রশাসক ওয়ালীদ ইবন উকবা মদপান করতেন। তিনি একদিন মাতাল অবস্থায় ফজরের সালাতে ইমামতি করেন। তার পিছনে আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) জামাআতে শরীক ছিলেন। ওয়ালীদ মাতাল অবস্থায় থাকার কারণে ফজরের সালাত চার রাকআত আদায় করেন এবং সালাম ফিরিয়ে বলেন: কম হলো কি? আরও লাগবে? তখন ইবন মাসঊদ (রা) ও মুসল্লীগণ বলেন: আজ সকালে তো আপনি বেশি বেশিই দিচ্ছেন (ইতোমধ্যেই দু রাকআত বেশি দিয়েছেন! আর লাগবে না!)।’’[7]
এখানে ইবন মাসঊদ (রা) ইমামের পাপ, মদপান ইত্যাদির কারণে বিদ্রোহ বা তার পিছনে সালাত পরিত্যাগ করে একাকী সালাতের মত প্রকাশ করেন নি। কারণ জুমুআ, সালাতের জামাআত ইত্যাদি ইসলামী সমাজের ঐক্য, সংহতি বা ‘জামাআতের’ মূল ভিত্তি। জামা‘আত রক্ষা করা অন্যতম দীনী দায়িত্ব। অন্যের পাপের কারণে মুমিন নিজের দীনী দায়িত্ব বর্জন করতে পারেন না।
ইমাম বুখারী তাঁর আত-তারীখুল কাবীর গ্রন্থে তাবিয়ী আব্দুল কারীম বাক্কা থেকে উদ্ধৃত করেছেন, ‘‘আমি দশজন সাহাবীর সঙ্গ পেয়েছি যারা পাপী-জালিম শাসক-প্রশাসকদের পিছনে সালাত আদায় করতেন।’’[8]
[2] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৪৬ (কিতাবুল জামা‘আত, বাবু ইযা লাম ইউতিম্মিল ইমাম...)।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৪৬ (কিতাবুল জামা‘আত, বাবু ইমামাতিল মাফতূন ওয়াল মুবতাদি)।
[4] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৬৯ (কিতাবুল ঈমান, বাবু ... নাহই আনিল মুনকারি মিনাল ঈমান)।
[5] ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ৬/১০৩
[6] বুখারী, আস-সহীহ ২/৫৯৭ (কিতাবুল হাজ্জ, বাবুত তাহজীরি বির-রাওয়াহ ইয়াওমা আরাফা)।
[7] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৩/৪১৪
[8] বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর ৬/৯০