আল-ফিকহুল আকবর ইসমাতুল আম্বিয়া, সাহাবায়ে কেরাম, তাকফীর, সুন্নাত ও ইমামাত ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
৫. ৫. তাকফীর বিষয়ে আহলুস সুন্নাতের মূলনীতি

কুরআন-হাদীসের নির্দেশনা ও সাহাবীগণের কর্মধারার আলোকে ‘আহলুস সুন্নাত’ ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। তাঁদের মুলনীতি হলো, মুমিন নিজের ঈমানের বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। সকল কুফর, শিরক ও পাপ থেকে সতর্কতার সাথে আত্মরক্ষা করবেন। কিন্তু অন্যের ঈমানের দাবি গ্রহণ করার বিষয়ে বাহ্যিক দাবির উপর নির্ভর করবেন। কোনো ঈমানের দাবিদারকেই কাফির না বলার জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবেন। ভুল করে কোনো মু’মিনকে কাফির বলে মনে করার চেয়ে ভুল করে কোনো কাফির-মুশরিককে মুসলিম মনে করা অনেক অনেক ভাল ও নিরাপদ। প্রথম ক্ষেত্রে কঠিন পাপ ও নিজের ঈমান নষ্ট হওয়ার ভয় রয়েছে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কোনোরূপ পাপ বা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

এ নীতির ভিত্তিতে তাঁরা বিশ্বাস করেন, যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করছেন, তাকে কোনো পাপের কারণে ‘অমুসলিম’, কাফির বা ধর্মত্যাগী বলে গণ্য করা যাবে না, তিনি তার পাপ থেকে তাওবা করুন, অথবা না করুন, যতক্ষণ না তিনি সুষ্পষ্টভাবে ইসলামী বিশ্বাসের পরিপন্থী কোনো বিশ্বাস পোষণ করার ঘোষণা দিবেন। ইসলামী আইন লঙ্ঘনকারী বা আল্লাহর নির্দেশ অমান্যকারী মুসলিম পাপী মুসলিম বলে গণ্য হবেন। তবে যদি তার এ পাপ বা অবাধ্যতাকে তিনি বৈধ মনে করেন, ইসলামী বিধানকে অচল বা ‘অপালনযোগ্য’ বলে মনে করেন অথবা ইসলামের কিছু বিধান পরিত্যাগ করেও ভাল মুসলিম হওয়া যায় বলে মনে করেন তবে তা কুফর বা ধর্মত্যাগ বলে গণ্য হবে। কারো কর্ম দেখে ‘‘মনে করা’’-র দাবি করা যাবে না। অর্থাৎ কারো ইসলাম বিরোধী কর্ম দেখে এ কথা দাবি করা যাবে না যে, সে নিশ্চয় পাপকে হালাল মনে করে বা আল্লাহর বিধানকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেই এরূপ করছে। বরং তার মুখের স্বীকৃতির উপর নির্ভর করতে হবে।

ঈমানের দাবিদার জেনে শুনে কুফরী করবেন না বলেই ধরে নিতে হবে। কারো কথা বা কর্ম বাহ্যত কুফরী হলেও যদি তার কোনোরূপ ইসলাম সম্মত ব্যাখ্যা দেওয়া যায় তবে দূরবর্তী হলেও ইসলামী ব্যাখ্যা গ্রহণ করে তাকে মুমিন বলে মেনে নিতে হবে। সর্বোপরি ঈমানের দাবিদার কোনো ব্যক্তি যদি সুস্পষ্ট কোনো কুফরী বা শিরকী কাজে লিপ্ত হয়, তবে তার কর্মকে কুফরী বলা হলেও ব্যক্তিগতভাবে তাকে কাফির বলার আগে এ বিষয়ে তার কোনো ওযর আছে কিনা তা জানতে হবে। সে ব্যক্তি অজ্ঞতা, ভয় বা অন্য কোনো ওজরের কথা উল্লেখ করলে তা গ্রহণ করা হবে।

মুসলিম নামধারী ব্যক্তিকে ‘‘কাফির’’ বলা মূলত নির্ভর করে তার স্বীকৃতির উপর। যদি সে তাওহীদ, রিসালাত বা আরকানুল ঈমানের মৌলিক কোনো বিষয়কে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অস্বীকার করে তাহলে তাকে কাফির বলে গণ্য করতে হবে।

একটি উদাহরণ দেখুন। কুফরীর প্রতি সন্তুষ্টি কুফর। কেউ যদি অমুসলিম, নাস্তিক বা ইসলাম অবমাননাকারীর শিরক-কুফর মত বা কর্মের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে বা তারাও আখিরাতে মুক্তি লাভ করবে বলে বিশ্বাস করে তবে সে ব্যক্তি কাফির, যদিও সে ইসলামের সকল বিশ্বাস ও আহকাম পালন করে। কোনো মুসলিম নামধারী ব্যক্তি যদি এরূপ মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব করে, সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয়ে তাদের সহযোগিতা করে তবে তার এরূপ অন্যায় কর্মের দ্বিবিধ কারণ থাকতে পারে: জাগতিক স্বার্থ, লোভ, ভয় বা না-বুঝে এরূপ করা অথবা কুফর, শিরক বা নাস্তিকতার প্রতি সন্তুষ্টির কারণে এরূপ করা। মুসলিম নামধারী ব্যক্তি প্রথম কারণেই এরূপ করছেন বলে ধরে নিতে হবে। তাকে তার কর্মের ভয়াবহতা বুঝাতে হবে, কিন্তু মুখের সুস্পষ্ট স্বীকৃতি ছাড়া তাকে কাফির বলে গণ্য করা যাবে না। ইমাম তাহাবী বলেন:


وَنُسَمِّي أَهْلَ قِبْلَتِنَا مُسْلِمِينَ مُؤْمِنِينَ، مَا دَامُوا بِمَا جَاءَ بِهِ النَّبِيُّ ﷺ مُعْتَرِفِينَ، وَلَهُ بِكُلِّ مَا قَالَ وَأَخْبَرَ مُصَدِّقِينَ... وَلا نُكَفِّرُ أَحَدًا مِنْ أَهْلِ الْقِبْلَةِ بِذَنْبٍ، مَا لَمْ يَسْتَحِلَّهُ، وَلا يَخْرُجُ الْعَبْدُ مِنَ الإِيمَانِ إِلاَّ بِجُحُودِ مَا أَدْخَلَهُ فِيهِ.


‘‘আমাদের কিবলাপন্থীদের ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা মু‘মিন মুসলিম বলে আখ্যায়িত করব যতক্ষণ তারা নবী (ﷺ) যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা স্বীকার করবে এবং তিনি যা কিছু বলেছেন সব সত্য বলে সাক্ষ্য দিবে। ... আমাদের কিবলাপন্থী কোনো মুমিনকে কোনো পাপের কারণে আমরা কাফির বলি না, যতক্ষণ না সে এ পাপ হালাল মনে করবে। .... যেসব বিষয় বান্দাকে ঈমানের অন্তর্ভূক্ত করেছে, এমন কোনো বিষয় অস্বীকার না করলে, সে ঈমানের গণ্ডি হতে বের হয় না।’’[1]

এ প্রসঙ্গে মোল্লা আলী কারী (রাহ) উল্লেখ করেছেন যে, ‘আহলু কিবলা’ বলতে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসগুলি যারা মেনে নিয়েছেন তাদেরকে বুঝানো হয়। তাওহীদ, রিসালাত, আরকানুল ঈমান ও আনুষঙ্গিক সকল বিষয় যা কুরআন কারীমে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে, মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, মুসলিম উম্মাহর সকল আলিম যে বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন বা যে বিষয়টি মুসলিম উম্মার মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ এরূপ কোনো বিষয় যদি কেউ অস্বীকার করেন বা অবিশ্বাস করেন তবে তাকে ‘আহলু কিবলা’ বলা হয় না। যেমন তাওহীদুর রুবূবিয়্যাত অস্বীকার করা, তাওহীদুল উলূহিয়্যাত অস্বীকার করা, মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাতের সর্বজনীনতা বা খাতমুন নুবুওয়াত অস্বীকার করা, কাউকে কোনো পর্যায়ে তাঁর শরীয়তের ঊর্ধ্বে বলে বিশ্বাস করা, আখিরাত অস্বীকার করা ইত্যাদি। এরূপ অবিশ্বাসে লিপ্ত ব্যক্তি যদি আজীবন কিবলামুখি হয়ে সালাত পড়েন বা ইসলামের অন্যান্য বিধান পালন করেন তবুও তাকে ‘আহলু কিবলা’ বলা হবে না। কারণ তিনি ঈমানই অর্জন করেন নি, কাজেই তার ইসলাম বা কিবলামুখি হওয়া অর্থহীন।

তিনি উল্লেখ করেছেন যে, কোনো মুমিন মুসলিম যদি এমন কোনো কর্মে লিপ্ত হয় বা কথা বলে যা কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশ অনুসারে কুফর বা শিরক বলে গণ্য তবে তার কর্মকে অবশ্যই শির্ক বা কুফর বলা হবে, তবে উক্ত ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে কাফির বা মুশরিক বলার আগে দেখতে হবে যে, অজ্ঞতা, ব্যাখ্যা, ভুল বুঝা বা এজাতীয় কোনো ওযর তার আছে কিনা।[2]

হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম আবূ হামিদ গাযালী (৫০৫হি) ‘‘কিতাবুত তাফরিকা বাইনাল ঈমান ওয়ায যানদাকা’’ (ঈমান ও বেঈমানীর মধ্যে পার্থক্য) গ্রন্থে বলেন:


إِنَّ التَّكْفِيْرَ هُوَ صَنِيْعُ الْجُهَّالِ، وَلاَ يُسَارِعُ إِلَى التَّكْفِيْرِ إِلاَّ الْجَهَلَةُ، فَيَنْبَغِيْ الاِحْتِرَازُ مِنَ التَّكْفِيْرِ مَا وَجَدَ الإِنْسَانُ إِلَى ذَلِكَ سَبِيْلاً، فَإِنَّ اسْتِبَاحَةَ الدِّمَاءِ وَالأَمْوَالِ مِنَ الْمُصَلِّيْنَ إِلَى الْقِبْلَةِ، الْمُصَرِّحِيْنَ بِقَوْلِ: "لاَ إِلَهَ إِلاّ اللهُ مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ"، خَطَأٌ. وَالْخَطَأُ فِيْ تَرْكِ أَلْفِ كَافِرٍ أَهْوَنُ مِنَ الْخَطَأِ فِيْ سَفْكِ مَحْجَمَةٍ مِنْ دَمِ مُسْلِمٍ. ... فَإِنَّ التَّكْفِيْرَ فِيْهِ خَطَرٌ، وَالسُّكُوْتُ لاَ خَطَرَ فِيْهِ!".


‘‘তাকফীর বা কাফির বলা মুর্খদের কর্ম। মুর্খরা ছাড়া কেউ কাউকে কাফির বলতে ব্যস্ত হয় না। মানুষের উচিত সাধ্যমত কাউকে কাফির বলা থেকে বিরত থাকা। কিবলাপন্থীগণ যারা ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’’ বলে সাক্ষ্য দেন তাদের রক্ত ও সম্পদ নষ্ট করা কঠিন অপরাধ (কাফির বলা থেকেই এর সূত্রপাত)। ভুলক্রমে এক হাজার কফিরকে পরিত্যাগ করা ভুল করে একজন মুসলিমের প্রাণ বা সম্পদের সামান্যতম ক্ষতি করা থেকে সহজতর। .... কাফির বলার মধ্যে রয়েছে ভয়ঙ্কর ঝুঁকি, আর নীরব থাকায় কোনোই ঝুঁকি নেই।’’[3]

[1] তাহাবী, আল-আকীদাহ, পৃ. ১৩-১৫।

[2] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ২৫৭-২৬২।

[3] আহমদ বুকরীন, আত-তাকফীর, পৃ. ৭৪; মুনাবী, ফাইযুল কাদীর ৪/১৬৭।