লগইন করুন
বিভ্রান্ত ফিরকাগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ভিন্নমতের মুমিনকে কাফির বলার বিষয়ে উদগ্রীবতা। তারা ভিন্নমতের মুমিনের কর্ম বা মতের ব্যাখ্যা করে সে ব্যাখ্যার অজুহাতে তাকে কাফির বলেন। আরবীতে একে বলা হয় ‘লাযিমুল কাওল’ (لازم القول), বা ‘মাআল’ (مآل) অর্থাৎ কথার দাবি বা পরিণতি। অর্থাৎ ‘ক’ কথাটির অবশ্যম্ভাবী অর্থ বা পরিণতি ‘খ’। আর ‘খ’ কথা বললে সে নিশ্চিত কাফির। কাজেই ‘ক’ কথাটি যে বলেছে সেও নিশ্চিত কাফির। যেমন মুতাযিলীগণ দাবি করত, যে ব্যক্তি আখিরাতে আল্লাহর দর্শন পাওয়া যাবে বলে বিশ্বাস করে সে কাফির। কারণ (১) আল্লাহকে মাখলূকের সাথে তুলনা করা কুফর, (২) আল্লাহকে আখিরাতে দেখা যাবে বলার অর্থই তাঁকে মাখলুকের সাথে তুলনা করা, (৩) অতএব এরূপ বিশ্বাসকারী কাফির।
কুরআন এবং হাদীসে আখিরাতে আল্লাহর দর্শনের কথা বলা হয়েছে। এর বিপরীতে একটি আয়াত বা হাদীসেও বলা হয় নি যে, আখিরাতে আল্লাহর দর্শন অসম্ভব বা এরূপ বিশ্বাস কুফর। যে ব্যক্তি আখিরাতে আল্লাহর দর্শন লাভের বিশ্বাস পোষণ করেন তিনি কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনার উপর নির্ভর করেন। উপরন্তু তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন যে, আল্লাহ মাখলুকের সাথে তুলনীয় নন এবং তাঁকে তুলনীয় মনে করা কুফরী। কিন্তু এ মুতাযিলীগণ এ ঘোষণার প্রতি কর্ণপাত করতেন না। তাদের একই কথা ‘‘আখিরাতে আল্লাহর দর্শন লাভে বিশ্বাস করার অর্থই তাঁকে মাখলুকের সাথে তুলনা করা। কাজেই এরূপ ব্যক্তি যদি শতকোটিবারও বলে আল্লাহ মাখলূকের সাথে তুলনীয় নন, আমি তুলনাবিহীনভাবে তাঁর দর্শনে বিশ্বাস করি- তাহলেও তাকে কাফির বলে গণ্য করতে হবে।’’ এরূপ দাবির ভিত্তিতেই খলীফা মামুন, মুতাসিম ও ওয়াসিক ইমাম আহমদ-সহ অগণিত আলিমকে নির্মমভাবে নির্যাতন করেন এবং কয়েকজনকে হত্যা করেন।
শীয়াগণ বিশ্বাস করেন যে, আলী (রা) ও তাঁর বংশের ইমামগণ সাধারণ মানুষ নন। বরং তাঁরা নূরের তৈরি এবং গাইবী-অলৌকিক ইলম ও ক্ষমতার অধিকারী। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে এরূপ দাবি না করে শুধু ইমামদের নামে দাবি করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না, এজন্য তারা দাবি করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-ও নূরের তৈরি এবং গাইবী ইলম ও ক্ষমতার অধিকারী। যারা এ কথা মানেন না তারা কাফির। কারণ: (১) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও ইমামগণের পরিপূর্ণ মর্যাদায় বিশ্বাস করা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ, (২) তাঁদের নূরত্ব এবং অলৌকিক ইলম ও ক্ষমতায় বিশ্বাস না করলে তাঁদের অবমর্যাদা করা হয়, (৩) অতএব তাঁদের নূরত্ব, গাইবী ইলম ও ক্ষমতায় অবিশ্বাসকারী কাফির এবং নবী (ﷺ) ও নবী-বংশের দুশমন।
আমরা জানি যে, কুরআন ও হাদীসে বারবার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মানুষ ছিলেন এবং মানুষ মাটি থেকে সৃষ্ট। কুরআন-হাদীসে আরো বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ ছাড়া কেউ গাইব জানে না। বারবার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আলিমুল গাইব ছিলেন না। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত ওহীর জ্ঞান ছাড়া অন্য কোনো গাইব তিনি জানতেন না। তিনি তাঁর নিজের বা অন্যের কোনো কল্যাণ-অকল্যাণের অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না। অন্য কাউকে আল্লাহ কোনো ক্ষমতা প্রদান করেন নি। এ সকল সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বক্তব্যের বিপরীতে একটি আয়াতে বা সহীহ হাদীসেও বলা হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা ইমামগণ কেউ নূর দ্বারা সৃষ্ট, তাঁরা কেউ আলিমুল গাইব ছিলেন বা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও ইমামগণের নূরত্ব, গাইবী ইলম ও ক্ষমতার বিষয় অস্বীকার করেন তাঁরা কুরআন ও হাদীসের এ সকল সুস্পষ্ট নির্দেশনার উপর নির্ভর করেন। পাশাপাশি তাঁরা বলেন: আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে ওহীর মাধ্যমে অগণিত গাইবের কথা জানিয়েছেন, তাঁর ও তাঁর বংশধরের বিষয়ে কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত সকল মর্যাদায় আমরা বিশ্বাস করি এবং তাঁদের মর্যাদা রক্ষার জন্য আমরা অকাতরে জীবন দিতে প্রস্ত্তত। কিন্তু শীয়াগণ এ সকল কথায় কর্ণপাত করেন নি; বরং বিভিন্ন যুক্তি, তর্ক ও অজুহাতে ভিন্নমতের মানুষদের কাফির বলেছেন, সুন্নী সমাজ ও রাষ্ট্রগুলোকে ‘‘তাগূতী’’ ও কাফির রাষ্ট্র বলে গণ্য করেছেন।[1]
কথার দাবি বা পরিণতি দিয়ে একে অন্যকে কাফির বলা উম্মাতের ভয়ঙ্কর ব্যাধি। বিভ্রান্ত সম্প্রদায়গুলোর পাশাপাশি অনেক সময় ভাল মানুষেরা এতে আক্রান্ত হন। বর্তমান যুগে এ জাতীয় তাকফীরের দুটি নমুনা দেখুন:
(১) যে ব্যক্তি মীলাদ-কিয়াম করে না.... রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- কে হাযির-নাযির বলে বিশ্বাস করে না, সে তাঁর মর্যাদায় বিশ্বাস করে না। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অমর্যাদা সর্বসম্মতভাবে কুফর। কাজেই যে মীলাদ-কিয়াম করে না.... সে কাফির!
(২) যে ব্যক্তি মীলাদ পড়ে, কিয়াম করে, কোনোরূপ লিপ্ত হয়, কোনো জাল হাদীস বলে সে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নুবুওয়াত ও সুন্নাতের পূর্ণতায় বিশ্বাস করে না। আর যে ব্যক্তি তাঁর নুবুওয়াত ও সুন্নাতের পূর্ণতায় বিশ্বাস করে না সে সর্বসম্মতভাবে কাফির। কাজেই যে ব্যক্তি মীলাদ পড়ে, কিয়াম করে... সে কাফির!