লগইন করুন
উপরের অর্থেই কোনো কোনো আশআরী-মাতুরিদী আলিম বলেছেন, সালাফ সালিহীন একমত যে, এ সকল বিশেষণের বাহ্যিক অর্থ পরিত্যক্ত। বাহ্যিক অর্থ বলতে যদি ‘তুলনাযুক্ত বাহ্যিক অর্থ’ বুঝানো হয় তবে কথাটি ঠিক। অর্থাৎ হাত, অধিষ্ঠান, চক্ষু, নফস, ক্রোধ, সন্তুষ্টি, অবতরণ ইত্যাদি শব্দ থেকে যদি কেউ সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান এ সকল বিশেষণ বা কর্ম কল্পনা করে তবে তা বাতিল। আর যদি বাহ্যিক অর্থ বলতে ‘তুলনামুক্ত আভিধানিক অর্থ’ বুঝানো হয় তবে এ কথাটি সঠিক নয়। সালাফ সালিহীনের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, তারা এগুলোকে আভিধানিক অর্থে তুলনামুক্ত ও স্বরূপমুক্তভাবে বিশ্বাস করেছেন। তাঁরা বারবার বলেছেন: এগুলো বিশ্বাস করতে হবে। যদি এগুলোর অর্থ অজ্ঞাত থাকে বা প্রকাশ্য অর্থ বর্জিত হয় তবে কী বিশ্বাস করতে হবে?
পাঠক, উপরে উদ্ধৃত চার ইমাম ও অন্যান্য সালাফ সালিহীনের বক্তব্য আরেকবার পাঠ করুন। আপনি নিশ্চিত হবেন যে, তাঁরা মহান আল্লাহর বিশেষণগুলোকে বাহ্যিক অর্থে তুলনার কল্পনা মন থেকে তাড়িয়ে স্বরূপবিহীনভাবে বিশ্বাস করেছেন।
মহান আল্লাহ বলেন:
هَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا أَنْ يَأْتِيَهُمُ اللَّهُ فِي ظُلَلٍ مِنَ الْغَمَامِ وَالْمَلَائِكَةُ وَقُضِيَ الأَمْرُ
‘‘তারা কি শুধু এর প্রতীক্ষায় রয়েছে যে, আল্লাহ্ ও ফিরিশ্তারা মেঘের ছায়ায় তাদের কাছে উপস্থিত হবেন? এবং সবকিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে।’’[1]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বাগাবী হুসাইন ইবন মাসঊদ (৫১০ হি) বলেন:
والأولى في هذه الآية وما شاكلها أن يؤمن الإنسان بظاهرها ويكل علمها إلى الله تعالى، ويعتقد أن الله عز اسمه منزه عن سمات الحدث، على ذلك مضت أئمة السلف وعلماء السنة.
‘‘এ আয়াত এবং এ ধরনের আয়াতগুলোর বিষয়ে উত্তম এই যে, এগুলোর প্রকাশ্য অর্থ বিশ্বাস করবে এবং এর জ্ঞান আল্লাহর উপর সমর্পন করবে। এবং বিশ্বাস করবে যে, মহান আল্লাহ সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য থেকে পবিত্র। সালাফ সালিহীন ইমামগণ এবং আহলুস সুন্নাতের আলিমগণ এ বিশবাসের উপরেই থেকেছেন।’’[2]
মহান আল্লাহ জাহান্নামের মধ্যে পদ স্থাপন করবেন, তিনি হাসবেন, তিনি আনন্দিত হন ইত্যাদি অর্থের হাদীসগুলো উল্লেখ করে ইমাম বাগাবী বলেন:
فهذه ونظائرها صفات لله تعالى ورد بها السمع يجب الإيمان بها، وإمرارها على ظاهرها معرضا فيها عن التأويل، مجتنبا عن التشبيه، معتقدا أن الباري سبحانه وتعالى لا يشبه شيء من صفاته صفات الخلق، كما لا تشبه ذاته ذوات الخلق ... وعلى هذا مضى سلف الأمة ، وعلماء السنة ، تلقوها جميعا بالإيمان والقبول ، وتجنبوا فيها عن التمثيل والتأويل ، ووكلوا العلم فيها إلى الله عز وجل
‘‘এগুলো এবং এ ধরনের অন্যান্য বিষয় মহান আল্লাহর বিশেষণ। শ্রুতি বা ওহীর বর্ণনা এ বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। এক্ষেত্রে ওয়াজিব হলো: এগুলোকে বিশ্বাস করা এবং বাহ্যিক অর্থের উপর এগুলো চালিয়ে নেওয়া। এগুলোর ব্যাখ্যা বর্জন করতে হবে এবং তুলনা পরিত্যাগ করতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে যে, মহান সৃষ্টিকর্তার কোনো বিশেষণই সৃষ্টির বিশেষণের মত নয়; যেমন তাঁর সত্তা সৃষ্টির সত্তার মত নয়।... উম্মাতের সালাফ সালিহীন এবং আহলুস সুন্নাতের আলিমগণ এ বিশ্বাসের উপরেই থেকেছেন। তাঁরা সকলেই তা বিশ্বাসের সাথে গ্রহণ করেছেন এবং তুলনা ও ব্যাখ্যা বর্জন করেছেন। এর জ্ঞান মহান আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছেন।...।’’[3]
এ প্রসঙ্গে ইমাম যাহাবী বলেন: ‘‘বর্তমানে বাহ্যিক অর্থ দু প্রকার হয়ে গিয়েছে: একটি হক্ক ও অন্যটি বাতিল। ‘হক্ক বাহ্যিক অর্থ’ এ কথা বলা যে, মহান আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী, ইচ্ছাকারী, কথা বলেন, হায়াত বা প্রাণের অধিকারী চিরঞ্জীব, জ্ঞানী, তাঁর মুখমণ্ডল ছাড়া সব কিছুই ধ্বংস হবে, তিনি আদমকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেন, তিনি মুসার সাথে প্রকৃতই কথা বলেন, তিনি ইবরাহীমকে খলীল (বন্ধু) হিসেবে গ্রহণ করেন... এবং অনুরূপ বিষয়াদি; এগুলোকে আমরা যেভাবে এসেছে সেভাবেই চালিয়ে নিই। এগুলো থেকে আমরা সম্বোধনের অর্থ বুঝি যা মহান আল্লাহর মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এর ব্যতিক্রম কোনো ব্যাখ্যা আছে বলে আমরা বলি না। আর অন্য ‘বাহ্যিক অর্থ’ বাতিল এবং বিভ্রান্তি। তা হলো অদৃশ্যকে দৃশ্যমানের উপর কিয়াস বা তুলনা করা এবং স্রষ্টাকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করায় বিশ্বাস করা। মহান আল্লাহ এরূপ তুলনা থেকে পবিত্র ও ঊর্ধ্বে। বরং তাঁর বিশেষণও তাঁর সত্তার মতই। তার সমতুল্য নেই, বিপরীত নেই, নমুনা নেই, তুলনা নেই, প্রতিরূপ নেই, কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়, তাঁর সত্তার ক্ষেত্রেও নয় এবং তাঁর বিশেষণের ক্ষেত্রেও নয়। আর এ বিষয়টির ক্ষেত্রে আলিম-পণ্ডিত এবং সাধারণ মানুষ সকলেই সমান। মহান আল্লাহই ভাল জানেন।’’[4]
এভাবে আমরা দেখছি যে, সালাফ সালিহীন এগুলো ‘বাহ্যিক অর্থ’ জ্ঞাত বলে বিশ্বাস করেছেন এবং এগুলোকে বাহ্যিক অর্থে চালিয়ে নিতে ও বিশ্বাস করতে নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি এর ‘বাহ্যিক তুলনা’ বর্জন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এর ব্যাখ্যা ও হাকীকতের জ্ঞান আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছেন।
[2] বাগাবী, মাআলিমুত তানযীল: তাফসীর বাগাবী ১/২৪১।
[3] বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ (দিমাশক-বৈরুত, আল-মাকতাবুল ইসলামী, ২য় মুদ্রণ, ১৯৮৩ খৃ) ১/১৭০-১৭১।
[4] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৯/৪৪৯।