লগইন করুন
আমরা দেখেছি যে, ‘সালাফ সালিহীন’ আকীদা বিষয়ে ওহী বা কুরআন-সুন্নাহের বক্তব্যের উপরে সার্বিকভাবে নির্ভর করতেন। পক্ষান্তরে আশআরী-মাতুরিদী মতের কোনো কোনো আলিম উল্লেখ করেছেন যে, আকীদা প্রমাণের ক্ষেত্রে ‘আকলী দলীল’ বা মানবীয় জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিই মূল। আকলী দলীল একীন বা নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে। পক্ষান্তরে ‘নকল’ বা কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য একীন প্রদান করে না। বিশেষত আকীদা বিষয়ে তা একীন বা নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে না। এ প্রসঙ্গে আশআরী মতবাদের সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও শাফিয়ী ফকীহ আল্লামা আব্দুর রাহমান ইবন আহমদ আযুদুদ্দীন ঈজী (৭৫৬) এবং সুপ্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ সাইয়িদ শরীফ আলী ইবন মুহাম্মাদ জুরজানী (৮১৬ হি) ‘আল-মাওয়াকিফ’ ও ‘শারহুল মাওয়াকিফ’ গ্রন্থে বলেন:
الدلائل النقلية هل تفيد اليقين بما يستدل بها عليه من المطالب أو لا؟ قيل: لا تفيد، وهو مذهب المعتزلة وجمهور الأشاعرة لتوقفه.... فقد تحقق أن دلالتها أي دلالة الأدلة النقلية على مدلولاتها يتوقف على أمور عشرة ظنية فتكون دلالتها أيضا ظنية .... وإذا كانت دلالتها ظنية لم تكن مفيدة لليقين بمدلولاتها هذا ما قيل والحق أنها أي الدلائل النقلية قد تفيد اليقين أي في الشرعيات بقرائن ....، نعم في إفادتها اليقين في العقليات نظر
‘‘নকলী দলীল বা কুরআন-হাদীসের বক্তব্য যে অর্থে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয় সে অর্থে তা নিশ্চিত বিশ্বাস বা একীন প্রদান করে কি না? বলা হয় যে, তা নিশ্চিত বিশ্বাস বা নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে না। এটিই মুতাযিলীগণের মত এবং আশআরী মতবাদের অধিকাংশ আলিমের মত। কারণ নকলী দলীল বা কুরআন-হাদীসের বক্তব্যের অর্থ অনুধাবন অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। .... এভাবে প্রমাণিত হয় যে, কুরআন-হাদীসের বক্তব্য তার প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত কি না তা জানার আগে দশটি ধারণা-নির্ভর বিষয় জানতে হয়। এজন্য ওহীর বক্তব্য অনুমান বা ধারণা প্রদানকারী মাত্র। .... আর যেহেতু ওহীর বক্তব্য ধারণা প্রদানকারী কাজেই ওহী দ্বারা তার অর্থের বিষয়ে একীন বা নিশ্চিত বিশ্বাস অর্জন করা যায় না। এভাবেই এ বিষয়টি বলা হয়। তবে সঠিক বিষয় (আশআরী মতবাদের অল্পসংখ্যক আলিমের মত) হলো, কুরআন-হাদীসের বক্তব্য আনুষঙ্গিক প্রমাণাদির মাধ্যমে ফিকহী বিষয়ে কখনো কখনো নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করতেও পারে।... তবে আকীদার আকলী বিষয়ে কুরআন-হাদীসের বক্তব্যের একীন বা নিশ্চিত জ্ঞান প্রদানের বিষয়ে আপত্তি আছে।’’[1]
আল্লামা মুহাম্মাদ আব্দুল আযীয ফারহারী (১২৩৯ হি) ‘নিবরাস’ গ্রন্থে বলেন:
قد ذهبت الأشاعرة إلى أن النص المخالف للدليل العقلي مصروف عن الظاهر: لأن صحة النص إنما تعرف بالدليل العقلي، وهو أنه كلام صاحب المعجزة المصدوق من عند الله تعالى. فالعقل هو أصل النقل فلا يدفع الأصل بالفرع. بل ذهب جمهورهم إلى أن النصوص لا تفيد القطع بمعانيها أصلاً؛ لأن اللغة والنحو والصرف إنما نقلها الآحاد كالأصمعي والخليل وسيبويه، ومع هذا فاحتمال المجاز والاشتراك قائم. ولكن الصحيح خلافه إذ من العربية ما نقل بالتواتر، وقد تقدم القرائن على أن المراد هذا المعنى دون ذلك، فلا يمتنع أن يفيد بعض النقليات القطع.
‘‘আশআরীগণের মাযহাব এই যে, আকলী (জ্ঞানবৃত্তিক) দলীলের বিপরীত ‘নস্স’ অর্থাৎ কুরআন-হাদীসের বক্তব্যকে তার প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করা যাবে না; বরং অন্য অর্থ গ্রহণ করতে হবে। কারণ কুরআন-হাদীসের বক্তব্যের বিশুদ্ধতা তো কেবলমাত্র আকলী দলীল দ্বারাই প্রমাণিত হয়। আকলই নির্দেশ করে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্যবাদী বলে প্রমাণিত মু’জিযার অধিকারী নবীর কথা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য আকলই হলো নকল বা কুরআন-হাদীসের দলীলের মূল ভিত্তি। কাজেই কোনো শাখা বা দ্বিতীয় পর্যায়ের দলীলের কারণে মূল বা প্রথম পর্যায়ের দলীলকে বাদ দেওয়া যাবে না। উপরন্তু আশআরীগণের অধিকাংশের মত এই যে, কুরআন-হাদীসের বক্তব্যগুলো মূলতই তাদের অর্থের বিষয়ে নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে না। কারণ ভাষা, শব্দতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয় তো আসমায়ী, খলীল, সিবাওয়াইহি প্রমুখ একক ব্যক্তির বর্ণনা। এছাড়া ভাষার মধ্যে রূপক অর্থ ও একাধিক অর্থ গ্রহণের সম্ভাবনা বিদ্যমান। তবে তাদের কথা পুরো সঠিক নয়। কারণ আরবী ভাষার মধ্যে কিছু বিষয় রয়েছে যা মুতাওয়াতিরভাবে বর্ণিত এবং পারিপার্শিক প্রমাণ দ্বারা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এ শব্দের এটিই অর্থ। কাজেই কুরআন-হাদীসের কোনো কোনো বক্তব্য দ্বারা নিশ্চিত জ্ঞান লাভ অসম্ভব নয়।’’[2]
[2] ফারহারী, আন-নিবরাস, পৃষ্ঠা ১১৯।