আল-ফিকহুল আকবর মহান আল্লাহর বিশেষণ, তাকদীর ইত্যাদি ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
৫. আল্লাহর কালাম বা কথা

জাহমী-মুতাযিলীগণ আল্লাহর কথাকে সৃষ্ট বলে দাবি করতেন। তারা বলতেন, আল্লাহ কথা বলেন না, তিনি কথা সৃষ্টি করেন। কুরআনও আল্লাহর একটি সৃষ্টি। কথা বলা সৃষ্টির কর্ম। আল্লাহ কথা বলেন বললে তাঁকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়। আল্লাহ বলেছেন ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়’’[1], কাজেই তিনি কথা বলেন বলে বিশ্বাসকারী কুরআনের এ আয়াত অবিশ্বাস করার কারণে কাফির বলে গণ্য।

কুরআনে বারবার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আল্লাহর কথা বলার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ নিজের বিষয়ে বা তাঁর রাসূল (ﷺ) তাঁর বিষয়ে যে বিশেষণ উল্লেখ করেছেন তা আল্লাহর পবিত্রতার অজুহাতে ব্যাখ্যা করে বাতিল করার অর্থ আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের (ﷺ) কথা অগ্রহণযোগ্য বলে দাবি করা এবং নিজেকে তাঁদের চেয়েও বুদ্ধিমান ও ধার্মিক বলে দাবি করা। আল্লাহর অতুলনীয়ত্বের বিশেষণটি যেমন কুরআন থেকে জানা যায়, তেমনি তাঁর কথা বলার বিশেষণটিও কুরআন থেকে জানা যায়। কোনো একটিকে গ্রহণ করতে অন্যটিকে ব্যাখ্যা করে বাতিল করার অর্থ নিজের বুদ্ধিকে ওহী গ্রহণ বা বর্জনের মানদন্ড বানানো। আর এটিই বিভ্রান্তির কারণ।

এজন্য মুসলিম উম্মাহর ইমামগণ একমত যে, ‘কালাম’ বা ‘কথা বলা’ আল্লাহর অনাদি বিশেষণসমূহের একটি। কুরআন আল্লাহর কালাম এবং তা সৃষ্ট নয়, বরং তা স্রষ্টার একটি বিশেষণ। আমরা দেখেছি, এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা ব্যাখ্যা করে ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন:

কুরআন আল্লাহ তা‘আলার কালাম, মুসহাফগুলোর মধ্যে লিপিবদ্ধ, হৃদয়গুলোর মধ্যে সংরক্ষিত, জিহবাসমূহ দ্বারা পঠিত এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপরে অবতীর্ণ। কুরআন পাঠে আমাদের জিহবার উচ্চারণ সৃষ্ট, কুরআনের জন্য আমাদের লিখনি সৃষ্ট, আমাদের পাঠ সৃষ্ট, কিন্তু কুরআন সৃষ্ট নয়। মহান আল্লাহ কুরআনের মধ্যে মূসা (আঃ) ও অন্যান্য নবী (আঃ) থেকে এবং ফিরাউন এবং ইবলীস থেকে যা উদ্ধৃত করেছেন তা সবই আল্লাহর কালাম (কথা), তাদের বিষয়ে সংবাদ হিসেবে। আল্লাহর কথা সৃষ্ট নয়, মূসা (আঃ) ও অন্য সকল মাখলূকের কথা সৃষ্ট। কুরআন আল্লাহর কথা কাজেই তা অনাদি, মাখলূকগণের কথা সেরূপ নয়। মূসা (আঃ) আল্লাহর কথা শুনেছিলেন, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: ‘‘মূসার সাথে আল্লাহ প্রকৃত বাক্যালাপ করেছিলেন’’[2] মূসা (আঃ)-এর সাথে কথা বলার আগেই- অনাদিকাল থেকেই- মহান আল্লাহ তাঁর কালাম বা কথার বিশেষণে বিশেষিত ছিলেন, যেমন সৃষ্টজগত সৃষ্টি করার পূর্বেই- অনাদিকাল থেকেই- তিনি সৃষ্টিকর্তার বিশেষণে বিশেষিত ছিলেন। ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়, তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’’[3] যখন তিনি মূসা (আঃ)-এর সাথে কথা বলেন তখন তিনি তাঁর সেই অনাদি বিশেষণ কথার বিশেষণ দ্বারা কথা বলেন। তাঁর সকল বিশেষণই মাখলূকদের বা সৃষ্টপ্রাণীদের বিশেষণের ব্যতিক্রম। তিনি জানেন, তবে তাঁর জানা আমাদের জানার মত নয়। তিনি ক্ষমতা রাখেন, তবে তাঁর ক্ষমতা আমাদের ক্ষমতার মত নয়। তিনি দেখেন, তবে তাঁর দেখা আমাদের দেখার মত নয়। তিনি কথা বলেন, তবে তাঁর কথা বলা আমাদের কথা বলার মত নয়। তিনি শুনেন, তবে তাঁর শোনা আমাদের শোনার মত নয়। আমরা বাগযন্ত্র ও অক্ষরের মাধ্যমে কথা বলি, আর মহান আল্লাহ বাগযন্ত্র এবং অক্ষর ছাড়াই কথা বলেন। অক্ষরগুলি সৃষ্ট। আর আল্লাহর কথা (কালাম) সৃষ্ট নয়।’’

এখানে তিনি যে মূলনীতিগুলো উল্লেখ করেছেন সেগুলোর সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ:

(১) কুরআন আল্লাহর কালাম, যা তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ করেন। কুরআন ‘‘মুসহাফ’’ বা গ্রন্থরূপ কুরআনের মধ্যে লিপিবদ্ধ, মুমিনদের অন্তরে মুখস্ত এবং মুমিনদের জিহবা দ্বারা পঠিত।

(২) কুরআন পাঠকারীর পাঠ বা উচ্চারণ তার নিজের কর্ম এবং তা মানবীয় কর্ম হিসেবে আল্লাহর সৃষ্ট। তবে কুরআন অনাদি ও অসৃষ্ট।

(৩) কুরআনে অনেক মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। এ সকল সৃষ্টি যে কথা পৃথিবীতে বলেছিলেন তা সৃষ্টির বক্তব্য হিসেবে সৃষ্ট। তবে মহান আল্লাহ তাঁর অনাদি বিশেষণে তাঁদের বিষয়ে যা বলেছেন তা সবই তাঁর অনাদি বিশেষণের অন্তর্ভুক্ত।

(৪) মহান আল্লাহ তাঁর নবী মূসা (আঃ)-এর সাথে কথা বলেন এবং সে কথা মূসা (আঃ) শ্রবণ করেন।

(৫) আল্লাহর সকল বিশেষণই মাখলূকের বিশেষণের ব্যতিক্রম ও অতুলনীয়।

এ প্রসঙ্গে ইমাম তাহাবী (রাহ) বলেন:


وَإِنًّ الْقُرْآنَ كَلاَمُ اللهِ مِنْهُ بَدَأَ بِلاَ كَيْفِيَّةٍ قَوْلاً وَأَنْزَلَهُ عَلَى رَسُوْلِهِ وَحْياً وَصَدَّقَهُ الْمُؤْمِنُوْنَ عَلَى ذَلِكَ حَقًّا وَأَيْقَنُوا أَنَّهُ كَلاَمُ اللهِ تَعَالَى بِالْحَقِيْقَةِ لَيْسَ بِمَخْلُوْقٍ كَكَلاَمِ الْبَرِيَّةِ. فَمَنْ سَمِعَهُ فَزَعَمَ أَنَّهُ كَلاَمُ الْبَشَرِ فَقَدْ كَفَرَ. وَقَدْ ذَمَّهُ اللهُ وَعَابَهُ وَأَوْعَدَهُ بِسَقَرَ حَيْثُ قَالَ تَعَالَى: "سَأُصْلِيْهِ سَقَرَ". فَلَمَّا أَوْعَدَ اللهُ بِسَقَرَ لِمَنْ قَالَ: "إِنْ هَذَا إِلاَّ قَوْلُ الْبَشَرِ" عَلِمْنَا وَأَيْقَنَّا أَنَّهُ قَوْلُ خَالِقِ الْبَشَرِ وَلاَ يُشْبِهُ قَوْلَ الْبَشَرِ.


‘‘আর নিশ্চয় কুরআন আল্লাহর কথা। কোনোরূপ স্বরূপ বা কিরূপ নির্ণয় ব্যতিরেকে কথা হিসেবে তাঁর থেকেই প্রকাশিত ও উদ্ভূত, তিনি তা তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর উপরে ওহীরূপে অবতীর্ণ করেছেন। আর মুমিনগণ তা সুনিশ্চিত সত্যরূপে বিশ্বাস ও গ্রহণ করেছেন এবং তারা সুদৃঢ়রূপে বিশ্বাস করেছেন যে, তা প্রকৃত ও আক্ষরিক অর্থেই আল্লাহর কালাম। তা সৃষ্টির কথার মত সৃষ্ট নয়। কাজেই যে ব্যক্তি ধারণা করবে যে তা মানুষের কথা, সে কাফির। আর এরূপ ব্যক্তিকে আল্লাহ নিন্দা করেছেন এবং জাহান্নামের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন: ‘অচিরেই আমি তাকে সাকার-জাহান্নামে প্রবিষ্ট করব’ । যে ব্যক্তি কুরআনের বিষয়ে বলে যে ‘এটি মানুষের কথা মাত্র’ [4] আল্লাহ তার এ পরিণতির কথা বলেছেন। এ থেকে আমরা জানলাম ও সুদৃঢ় বিশ্বাসে উপনীত হলাম যে, কুরআন মানুষের কথা নয়, মানুষের স্রষ্টার কথা।’’[5]

ইমাম তাহাবী আরো বলেন:


ولا نخوض في الله، ولا نماري في دين الله. ولا نجادل في القرآن، ونشهد أنه كلام رب العالمين. نزل به الروح الأمين، فعلمه سيد المرسلين محمداً صلى الله عليه وعلى آله وسلم. وهو كلام الله تعالى لا يساويه شيء من كلام المخلوقين. ولا نقول بخلقه، ولا نخالف جماعة المسلمين... ونقول الله أعلم فيما اشتبه علينا علمه.


‘‘আমরা আল্লাহর সত্ত্বা সম্পর্কে অহেতুক চিন্তা-গবেষণায় প্রবৃত্ত হই না। আমরা পবিত্র কুরআনে ব্যাপারে কোন বিতর্ক-বাদানুবাদে জড়িত হই না। আমরা একথার সাক্ষ্য প্রদান করি যে, তা নিখিল বিশ্বের প্রভু-প্রতিপালকের বাণী, রূহুল আমীন জিবরাঈল (আঃ) তা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। অতঃপর তিনি নবীদের নেতা মুহাম্মদ ﷺ-কে তা শিক্ষা দিয়েছেন। কুরআন মহান আল্লাহর কালাম। সৃষ্টিজগতের কোন কালাম এর সমকক্ষ হতে পারে না। ‘‘কুরআন সৃষ্ট’’ এমন মন্তব্য আমরা করি না এবং আমরা এ ব্যাপারে মুসলিম জামা’আতের বিরুদ্ধাচারণ করি না। ... যে বিষয়ে আমাদের জ্ঞান অস্পষ্ট সে সম্বন্ধে আমরা বলি: ‘‘আল্লাহই এ বিষয়ে সর্বাধিক জানেন।’’[6]

[1] সূরা (৪২) শূরা: ১১ আয়াত।

[2] সূরা (৪) নিসা: ১৬৪ আয়াত।

[3] সূরা (৪২) শূরা: ১১ আয়াত।

[4] সূরা (৭৪) মুদ্দাস্সির: ২৫ ও ২৬ আয়াত।

[5] তাহাবী, ইমাম আবূ জাফর, আল-আকীদা আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৯।

[6] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৬৩ ও পৃষ্ঠা ৮২।