আল-ফিকহুল আকবর ইমাম আবূ হানীফা ও আল-ফিকহুল আকবার ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
মাযহাবের ফিকহী গ্রন্থগুলিতে সংকলিত মাস্আলাগুলো কয়েকটি পর্যায়ের

প্রথমত: শরীয়তের মূলভিত্তি কুরআনের আয়াত বা হাদীসে নববীর বক্তব্যের সাথে, অথবা উম্মাতের ইজমা বা ইমামগণের কিয়াসের সাথে সুসমঞ্জস মাসআলা, যার বিপরীতে সুস্পষ্ট বা অস্পষ্ট হাদীস বা ‘নস্’ নেই।

দ্বিতীয়ত: শরীয়তের মূলভিত্তির অন্তর্ভুক্ত মাসাইল, যেগুলোর পক্ষে কুরআনের আয়াত বা হাদীসে নববীর প্রমাণ রয়েছে, কিন্তু এগুলোর বিপরীতেও কিছু আয়াত বা হাদীস রয়েছে। তবে এ সকল মাসাইলের পক্ষের আয়াত বা হাদীসের নির্দেশনা অধিক সহীহ ও অধিক শক্তিশালী, পক্ষান্তরে এগুলোর বিপরীত আয়াত বা হাদীসের নির্দেশনা অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও অস্পষ্ট। উপরের দু পর্যায়ের মাযহাবী মাসাইলের বিধান হলো, এগুলোকে গ্রহণ করতে হবে। কুরআন-সুন্নাহ ও বুদ্ধি-বিবেক সবই তা নির্দেশ করে।

তৃতীয়ত: শরীয়তের মূলভিত্তির অন্তর্ভুক্ত মাসাইল। কিন্তু এগুলির বিপরীত দলীলও সহীহ ও শক্তিশালী সনদে বর্ণিত। এরূপ মাসাইলের বিধান হলো, যার ইলম ও প্রজ্ঞা আছে তিনি বিস্তারিতভাবে এবং গভীরভাবে এগুলি অধ্যয়ন করবেন এবং অধিকতর শক্তিশালী মতটি গ্রহণ করবেন। আর যে ব্যক্তি এরূপ গবেষণায় অক্ষম তার জন্য এরূপ বিষয়ে মাযহাবের মতটি গ্রহণের অনুমোদন রয়েছে।

চতুর্থত: যে সকল মাসাইল শুধু কিয়াসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়েছে এবং সেগুলির বিপরীতে কিয়াসের ঊর্ধ্বের চিরন্তন কোনো দলীল (আয়াত বা হাদীস) বিদ্যমান। এ সকল মাসাইলের বিধান হলো, নিম্নমানের (কিয়াস ভিত্তিক) মত পরিত্যাগ করে উচ্চমানের (হাদীস ভিত্তিক) মত গ্রহণ করা। বিষয়টি বাহ্যত তাকলীদ পরিত্যাগ করা বলে মনে হলেও, তা তাকলীদ পরিত্যাগ নয়, বরং এটিই হলো প্রকৃত তাকলীদ।

পঞ্চমত: এমন কিছু মাসাইল মাযহাবের মধ্যে রয়েছে যেগুলোর পক্ষে কুরআন, হাদীস, ইজমা, বা কোনো মুজতাহিদের সুস্পষ্ট বা অস্পষ্ট কোনো কিয়াস বিদ্যমান নেই, সুস্পষ্টভাবে বা প্রাসঙ্গিভাবে কোনোভাবেই তা শরীয়তের এ সকল দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং এগুলো পরবর্তী যুগের মানুষদের আবিষ্কার মাত্র, যারা তাদের পিতা-পিতামহ ও শাইখ-মাশাইখদের অন্ধ অনুসরণ করেন। এ সকল মাসাইলের বিধান হলো এগুলি পরিত্যাগ করতে হবে এবং এগুলির ত্রুটি বর্ণনা করতে হবে।

লাখনবী বলেন, এ বিশ্লেষণটি ভালকরে আয়ত্ব করুন। কারণ খুব কম মানুষই এটি বুঝেন এবং এটি না বুঝার কারণে অনেকেই বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হয়েছেন।’’[1]

উল্লেখ্য যে, অন্যান্য মাযহাবের ফকীহগণও কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত প্রশস্ততা অবলম্বন করেছেন। তাকলীদের পাশাপাশি হাদীস অনুসরণ বা মতভেদীয় মাসআলায় ভিন্ন মাযহাব অনুসরণের বৈধতা দিয়েছেন তাঁরা। প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম নববী (৬৭৬ হি) ‘‘আল-মাজমূ’’ নামক শাফিয়ী ফিকহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থে লিখেছেন:


قَالَ الشَّيْخُ أَبُو عَمْرٍو: فَمَن وَجَدَ مِنَ الشَّافِعِيَّةِ حَدِيثًا يُخَالِفُ مَذْهَبَهُ نَظَرَ إنْ كَمُلَتْ آلاتُ الاجْتِهَادِ فِيهِ مُطْلَقًا أَوْ فِي ذَلِكَ الْبَابِ أَوْ الْمَسْأَلَةِ كَانَ لَهُ الاسْتِقْلَالُ بِالْعَمَلِ بِهِ. وَإِنْ لَمْ يَكْمُلْ وَشَقَّ عَلَيْهِ مُخَالَفَةُ الْحَدِيثِ بَعْدَ أَنْ بَحَثَ فَلَمْ يَجِدْ لِمُخَالَفَتِهِ عَنهُ جَوَابًا شَافِيًا فَلَهُ الْعَمَلُ بِهِ إنْ كَانَ عَمِلَ بِهِ إمَامٌ مُسْتَقِلٌّ غَيْرَ الشَّافِعِيِّ وَيَكُونُ هَذَا عُذْرًا لَهُ فِي تَرْكِ مَذْهَبِ إمَامِهِ هُنَا. وَهَذَا الَّذِي قَالَهُ حَسَنٌ مُتَعَيَّنٌ وَاَللَّهُ أَعْلَمُ


‘‘শাইখ আবূ আমর ইবনুস সালাহ (৬৪৩ হি) বলেন: যদি কোনো শাফিয়ী মুকাল্লিদ একটি হাদীসের সন্ধান পান যা তার মাযহাবের বিরোধী তাহলে দেখতে হবে, যদি তিনি পূর্ণভাবে অথবা শুধু একটি বিশেষ অধ্যায়ে বা শুধু একটি বিশেষ মাসআলাতে ইজতিহাদ করতে সক্ষম হন তবে তিনি এ হাদীসটি গ্রহণ ও পালন করবেন। আর যদি তার কোনোরূপ ইজতিহাদ-গবেষণা করার ক্ষমতা না থকে, কিন্তু হাদীসটির বিরোধিতা করা তার জন্য কষ্টকর হয় তবে সেক্ষেত্রেও তিনি মাযহাব বর্জন করে হাদীসটি পালন করবেন, যদি (দুটি শর্ত পূরণ হয়): (১) হাদীসটি বর্জন করার পক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো উত্তর তিনি খুঁজে না পান এবং (২) ইমাম শাফিয়ী হাদীসটি গ্রহণ না করলেও অন্য কোনো মুজতাহিদ ইমাম উক্ত হাদীসটি গ্রহণ করে থাকেন। এ মাসআলায় ইমামের মাযহাবের বাইরে যাওয়ার জন্য হাদীসটি তার ওজর হিসেবে গণ্য হবে।’ ইমাম নববী বলেন: এ কথাটি সুন্দর ও এটিই একমাত্র নিশ্চিত বিষয়।’’[2]

[1] লাখনবী, আন-নাফিউল কাবীর (আল-জামিউস সাগীরসহ), পৃ. ৭।

[2] নববী, আল-মাজমূ শারহুল মুহায্যাব ১/৬৪।