আল-ফিকহুল আকবর ইমাম আবূ হানীফা ও আল-ফিকহুল আকবার ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
১৫. ফিকহ প্রসঙ্গে ইমাম আবূ হানীফা

আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, ইবন হিব্বান, খতীব বাগদাদী প্রমুখ মুহাদ্দিস ইমাম আবূ হানীফা থেকে হাদীসের বিরুদ্ধে ও কিয়াসের পক্ষে এমন কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন যা কোনো তাবিয়ী ফকীহ তো দূরের কথা কোনো ফাসিক মুমিনও বলতে পারেন না। সনদ বিচারে এগুলো জাল। তবে এগুলির সনদ বিচার জরুরী নয়। যদি কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিও বর্ণনা করেন যে, ইমাম আবূ হানীফা এরূপ কথা বলেছেন, তবে তা উক্ত নির্ভরযোগ্য রাবীর নির্ভরযোগ্যতা নষ্ট করবে এবং তার ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বলে গণ্য হবে। কারণ আমরা দেখেছি যে, ইমাম আবূ হানীফা তাঁর জীবদ্দশাতেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন। অগণিত তাবি-তাবিয়ী আলিম তাঁর নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র তাঁর মত প্রচার করেন। তাঁর ছাত্র ও অনুসারীরা তাঁর সকল মত সংরক্ষণ ও প্রচারে আপোষহীন ছিলেন। তাঁরা তাঁর থেকে যে সকল বক্তব্য বর্ণনা করেছেন সেগুলোর বিপরীত উদ্ভট বর্ণনাগুলো ভিত্তিহীন বলে গণ্য। এখানে তাঁর ছাত্র ও অনুসারীদের সূত্রে বর্ণিত ফিকহ, হাদীস, মাযহাব, তাকলীদ ইত্যাদি বিষয়ক তাঁর কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করছি।

১৫. ১. হাদীস ও কিয়াসের ক্ষেত্র

তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য থেকে আমরা দেখি যে, সহীহ হাদীসকেই তিনি তাঁর মাযহাবের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এমনকি তাঁর মত বা মাযহাবের বিপরীতে কোনো সহীহ হাদীস পাওয়া গেলে তা অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি কিয়াস অপছন্দ করতেন। যেখানে কোনো আয়াত, হাদীস বা সাহাবীর মত নেই সেখানেই শুধু কিয়াস করতেন। ইতোপূর্বে এ বিষয়ে তাঁর কিছু বক্তব্য আমরা দেখেছি। এ প্রসঙ্গে তাঁর আরো অনেক বক্তব্য তাঁর ছাত্র ও অনুসারীরা উদ্ধৃত করেছেন। কয়েকটি বক্তব্য দেখুন:


إذا صح الحديث فهو مذهبي


১. ‘‘কোনো হাদীস সহীহ প্রমাণিত হলে সেটিই আমার মাযহাব।’’[1]


البول في المسجد أحسن من بعض القياس


২. ‘‘অনেক কিয়াস আছে যার চেয়ে মসজিদে পেশাব করা উত্তম।’’[2]


إياكم والقول في دين الله تعالى بالرأي عليكم باتباع السنة فمن خرج عنها ضل... لولا السنة ما فهم أحد منا القرآن ... لم تزل الناس في صلاح ما دام فيهم من يطلب الحديث فإذا طلبوا العلم بلا حديث فسدوا


৩. ‘‘খবরদার! আল্লাহর দীনের বিষয়ে যুক্তি-কিয়াস বা নিজস্ব মত দিয়ে কথা বলবে না। তোমরা অবশ্যই সুন্নাতের অনুসরণ করবে। যে ব্যক্তি সুন্নাতের বাইরে যাবে সে বিভ্রান্ত হবে। ... সুন্নাত না হলে আমাদের মধ্যে কেউই কুরআন বুঝতো না। .... যতদিন পর্যন্ত মানুষদের মধ্যে হাদীস শিক্ষাকারী বিদ্যমান থাকবে ততদিন তারা ভাল থাকবে। যখন তারা হাদীস বাদ দিয়ে ইলম চর্চা করবে তখন তারা নষ্ট হয়ে যাবে।’’[3]


كذب والله وافترى علينا من يقول: إننا نقدم القياس على النص، وهل يحتاج بعد النص إلى قياس! أننا ننظر في دليل المسألة من الكتاب والسنة أو أقضية الصحابة ، فإن لم نجد دليلا قسنا حينئذ مسكوتا عنه على منطوق به.


৪. ‘‘যারা বলেন যে, আমরা কুরআন-হাদীসের বক্তব্যের উপর কিয়াসকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি- আল্লাহর কসম! তারা আমাদের নামে মিথ্যা বলেন এবং অপবাদ প্রদান করেন। কুরআন হাদীসের বক্তব্য বা নস্স থাকলে কি কিয়াসের কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকে?! আমরা মাসআলার দলীল দেখি আল্লাহর কিতাব বা সুন্নাতের মধ্যে অথবা সাহাবীগণের ফয়সালার মধ্যে। যখন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো দলীল না পাই তখন কুরআন-সুন্নাহে বর্ণিত কোনো বিধানের উপর সংশ্লিষ্ট বিষয়কে কিয়াস করি।’’[4]

প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ মুহাম্মাদ মুরতাযা যাবীদী (১২০৬হি) বলেন:


نسب إلى إمامنا أنه يقدم القياس على النص... هذه النسبة إليه غير صحيحة فإن الصحيح المنقول في مذهبه تقديم النص على القياس.


‘‘আমাদের ইমামের নামে বলা হয়েছে যে, তিনি কিয়াসকে ‘নস’ (কুরআন-হাদীসের বক্তব্য বা ওহীর কথা)-এর উপরে স্থান দেন। এ কথাটি সঠিক নয়। কারণ তাঁর মাযহাবে সহীহভাবে বর্ণিত মত হলো ‘নস’-কে অর্থাৎ কুরআন বা হাদীসের বক্তব্যকে ‘কিয়াস’-এর চেয়ে অগ্রগণ্য করা।’’[5]

মোল্লা আলী কারী বলেন:


وسموا الحنفية أصحاب الرأي على ظن أنهم ما يعملون بالحديث بل ولا يعلمون الرواية والتحديث لا في القديم ولا في الحديث مع أن مذهبهم القوي تقديم الحديث الضعيف على القياس المجرد الذي يحتمل التزييف


‘‘বিরোধীরা হানাফীদেরকে ‘রায়পন্থী’ (কিয়াসপন্থী) বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ তাঁদের ধারণা যে, হানাফীগণ হাদীস পালন করেন না; বরং তারা হাদীস জানেন না; অতীতেও না বর্তমানেও না; অথচ হানাফীগণের শক্তিশালী মাযহাব হলো যয়ীফ হাদীসকে কিয়াসের বিপরীতে অগ্রগণ্য ও গ্রহণ করা কারণ কিয়াসে বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতার সম্ভাবনা বিদ্যমান।’’[6]

আব্দুল হাই লাখনবী (১৩০৪হি) ইমাম শারানী (৯৭৩হি)-এর সূত্রে বলেন:


قد أطال الإمام أبو جعفر الكلام في تبرئة أبي حنيفة من القياس بغير ضرورة ورد على من نسب إلى الإمام تقديم القياس على النص وقال : إنما الرواية الصحيحة عنه تقديم الحديث ثم الآثار ثم يقيس بعد ذلك ولا خصوصية للإمام في القياس بشرطه المذكور بل جميع العلماء يقيسون في مذائق الأحوال إذا لم يجدوا في المسئلة نصا انتهى وفيه أيضا : اعتقادنا واعتقاد كل منصف في أبي حنيفة أنه لو عاش حتى دونت أحاديث الشريعة وبعد رحيل الحفاظ في جمعها من البلاد والثغور وظفر بها لأخذ بها وترك كل قياس كان قاسه وكان القياس قل في مذهبه كما قل في مذهب غيره لكن لما كانت أدلة الشريعة متفرقة في عصره مع التابعين وتبع التابعين في المدائن والقرى كثر القياس في مذهبه بالنسبة إلى غيره من الأئمة ضرورة لعدم وجود النص في تلك المسائل التي قاس فيها


‘‘ইমাম আবূ হানীফা প্রয়োজন ছাড়া কিয়াস করেছেন বা কিয়াসকে কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যের উপরে স্থান দিয়েছেন বলে যে অভিযোগ করা হয় ইমাম আবূ জা’ফর তাহাবী বিস্তারিতভাবে তা খন্ডন করেছেন। তিনি বলেন: তাঁর থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, হাদীসকে সর্বপ্রথম এবং এরপর সাহাবী-তাবিয়ীগণের মতামত অগ্রগণ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এরপর তিনি কিয়াস করতেন। আর এরূপ কিয়াস করা ইমাম আবূ হানীফার একক বৈশিষ্ট্য নয়; বরং সকল আলিমই এরূপ অবস্থায় কিয়াস করেন; যখন তাঁরা সংশ্লিষ্ট মাসআলায় কুরআন-হাদীসের বক্তব্য পান না। ... আবূ হানীফার বিষয়ে আমাদের বিশ্বাস এবং সকল নিরপেক্ষ মানুষের বিশ্বাস যে, তিনি যদি শরীয়তের হাদীসগুলো সংকলিত ও গ্রন্থায়িত হওয়া পর্যন্ত এবং মুহাদ্দিসগণ মুসলিম বিশ্বের সকল দেশ থেকে হাদীস সংগ্রহ করার পরেও বেঁচে থাকতেন এবং সেগুলো তাঁর হস্তগত হতো তবে তিনি যত কিয়াস করেছিলেন সকল কিয়াস পরিত্যাগ করতেন এবং অন্যান্য ইমামের মাযহাবের মতই তাঁর মাযহাবে কিয়াস কমে যেত। কিন্তু তাঁর যুগে শরীয়তের দলীলগুলো বিভিন্ন দেশে ও শহরে বিদ্যমান তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণের নিকট বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল এজন্য তাঁর মাযহাবে অন্যান্য মাযহাবের চেয়ে কিয়াস-এর পরিমাণ বেশি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মাসাইলে কুরআন-হাদীসের বক্তব্য না পাওয়ার কারণেই তাঁকে বাধ্য হয়ে কিয়াস করতে হয়েছে।’’[7]

আল্লামা সাখাবী (৮৩১-৯০২ হি) বলেন:


المرسل يحتج به إذا لم يوجد دلالة سواه .... جميع الحنفيه على أن مذهب إمامهم أيضا ضعيف الحديث أولى عنده من الرأي والقياس ... قول ابن منده على أنه أريد بالضعيف هذا الحديث الحسن


‘‘অন্য দলীল না থাকলে মুরসাল হাদীস প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হবে (অর্থাৎ মুরসাল হাদীস একটু দুর্বল হলেও কিয়াস বা যুক্তির চেয়ে উত্তম) ... হানাফী ফকীহগণ সকলেই বলেছেন, তাঁদের ইমামের মত হলো কিয়াসে চেয়ে দুর্বল হাদীস উত্তম। ... ইবন মান্দহ বলেছেন: এক্ষেত্রে ‘যায়ীফ’ (দুর্বল) হাদীস বলতে ‘হাসান’ (সামান্য দুর্বল গ্রহণযোগ্য) হাদীস বুঝানো হয়।’’[8]

[1] ইবন আবিদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ১/৬৩।

[2] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফাহ, পৃ. ২৭।

[3] ইরাকী, আব্দুর রহীম ইবন হুসাইন (৮০৬ হি), আল-মুসতাখরাজ আলাল মুসতাদরাক, পৃ ১৫; শা’রানী, আল-মীযানুল কুবরা ১/১৫।

[4] মোল্লা আলী কারী, শারহু মুসনাদি আবী হানীফাহ ১/৬।

[5] যাবীদী, উকূদুল জাওয়াহিলি মুনীফা, পৃ. ১৯।

[6] মোল্লা আলী কারী, মিরকাতুল মাফাতীহ ১/৩।

[7] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-জামিউস সাগীর: আন-নাফিউল কাবীর-সহ, পৃ. ৩৪।

[8] সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/৮৩।