আল-ফিকহুল আকবর ইমাম আবূ হানীফা ও আল-ফিকহুল আকবার ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
১১. ১. ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন (১৫৮-২৩৩ হি)

ইতোপূর্বে ইবন মায়ীন (রাহ)-এর কথায় আমরা দেখেছি যে, তাঁর যুগেই মুহাদ্দিসগণ ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর সাথীদের বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করতেন। পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, তাঁর যুগেই মুতাযিলী বিরোধিতা, মুরজিয়া বিরোধিতা, বিদআতী আকীদা বিরোধিতা ও হাদীস অস্বীকার বিরোধিতার নামে ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর সাথীদের বিরুদ্ধে প্রচারণা তুঙ্গে উঠেছে। ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে ইবন মায়ীনের গ্রন্থে ও তাঁর থেকে বর্ণিত বক্তব্যগুলোতে আমরা নিম্নের বিষয়গুলো দেখি:

(ক) তিনি পূর্ববর্তী আলিমগণ থেকে ইমাম আবূ হানীফার পক্ষে কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। এরূপ একটি বর্ণনা নিম্নরূপ:


يحيى بن ضريس يقول شهدت سفيان وأتاه رجل (رجل له مقدار في العلم والعبادة) فقال ما تنقم على أبي حنيفة قال وماله قال سمعته يقول قولا فيه إنصاف وحجة: آخذ بكتاب الله فما لم أجد فبسنة رسول الله ﷺ (والآثار الصحاح عنه التي فشت في أيدي الثقات عن الثقات) فإن لم أجد في كتاب الله ولا سنة آخذ بقول أصحابه آخذ بقول من شئت منهم وأدع قول من شئت ولا أخرج من قولهم إلى قول غيرهم فإذا ما انتهى الأمر إلى إبراهيم والشعبي وابن سيرين والحسن ... فقوم اجتهدوا فأجتهد كما اجتهدوا قال فسكت سفيان طويلا ثم قال ... نسمع التشديد من الحديث فنخافه ونسمع اللين فنرجوه لا نحاسب الأحياء ولا نقضي على الأموات نسلم ما سمعنا ونكل ما لم نعلم إلى عالمه ونتهم رأينا لرأيهم


‘‘ইয়াহইয়া ইবন দুরাইস বলেন, আমি সুফইয়ান সাওরীর কাছে বসে ছিলাম। এমতাবস্থায় একব্যক্তি তাঁর নিকট আসলেন, যিনি ইলম ও ইবাদতে বড় মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন। তিনি বললেন, আপনি কেন আবূ হানীফার প্রতি বিরক্ত? তিনি বলেন: কেন? তাঁর কি হয়েছে? লোকটি বলে: আমি তাঁকে যা বলতে শুনেছি তা ইনসাফ ও দলিলপূর্ণ। তিনি বলেন: ‘‘আমি আল্লাহর কিতাবের উপর নির্ভর করি। আল্লাহর কিতাবে যা না পাই সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) সুন্নাত ও নির্ভরযোগ্য রাবীদের সূত্রে নির্ভরযোগ্য রাবীদের থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীসগুলোর উপর নির্ভর করি। কিতাব ও সুন্নাতে যা না পাই সে বিষয়ে সাহাবীগণের বক্তব্যের উপর নির্ভর করি। তাঁদের মধ্য থেকে যার মত ইচ্ছা গ্রহণ করি এবং যার মত ইচ্ছা বাদ দেই, তবে তাঁদের মত ছেড়ে অন্য কারো কথার দিকে যাই না। আর যখন বিষয়টি ইবরাহীম নাখয়ী, শা’বী, ইবন সীরীন, ... তাবিয়ীদের পর্যায়ে আসে তখন তাঁরা যেমন ইজতিহাদ করেছেন আমিও তেমন ইজতিহাদ করি।’’ এ কথা শুনে সাওরী দীর্ঘসময় চুপ করে থাকেন। ... এরপর বলেন: আমরা অনেক সময় কঠিন বা খারাপ কথা শুনি, তখন তাতে ভীত হই, কখনো নরম কথা শুনি তখন আশাবাদী হই। আমরা জীবিতদের হিসাব লই না এবং মৃতদের বিচারও করি না। যা শুনি তা মেনে নিই এবং যা না জানি তা যিনি জানেন তার উপর ছেড়ে দিই। তাঁদের মতের বিপরীতে আমাদের মতকেই অভিযুক্ত করি।’’[1]

এ থেকে আমরা জানতে পারি যে, অনেক সময় মানুষেরা ইমাম সাওরীর কাছে যেয়ে, ইমাম আবূ হানীফার নামে এমন সব কথা বলত যে তিনি তাঁর ঈমানী চেতনায় ক্রুদ্ধ ও ক্ষুদ্ধ হয়ে বিরূপ মন্তব্য করতেন। আবার যখন তিনি ভাল কথা শুনতেন তখন তাঁর প্রতি ভাল ধারণা পোষণ করতেন। ইবন মায়ীন শুধু ভাল বিষয়ই উল্লেখ করেছেন।

(খ) তিনি তাঁর উস্তাদ দ্বিতীয় শতকের জারহ-তাদীলের ইমাম ইয়াহইয়া ইবন সায়ীদ আল-কাত্তান থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, তিনি আবূ হানীফার প্রশংসা করতেন এবং ফিকহী মতে তাঁর অনুসরণ করতেন। এ বিষয়ক একটি উদ্ধৃতি আমরা উপরে উল্লেখ করেছি। অন্য বক্তব্যে ইবন মায়ীন বলেন: আমি ইয়াহইয়া ইবন সায়ীদ আল-কাত্তানকে বলতে শুনেছি:


لا نكذب الله ربما رأينا الشيء من رأى أبي حنيفة فاستحسناه فقلنا به


‘‘আমরা আল্লাহকে মিথ্য বলব না, অনেক সময় আমরা আবূ হানীফার মতের কিছু বিষয় দেখি যা আমাদের ভাল লাগে, তখন আমরা সে কথা মতই ফাতওয়া প্রদান করি।’’[2]

(গ) ইবন মায়ীন নিজেও ইমাম আবূ হানীফার ফিকহের অনুসারী বা ভক্ত ছিলেন। তাঁর ছাত্র আব্বাস ইবন মুহাম্মাদ আদ-দূরী (১৮৩-২৭১হি) বলেন:


قال يحيى قال ابن وهب عن مالك بن أنس في المرأة يكون وليها ضعيفا أو يكون غائبا أو لا يكون لها ولي فتولي أمرها رجلا فيزوجها قال جائز وقال ابن وهب لا إلا بولي قلت ليحيى هذا يوافق قول أبي حنيفة قال نعم يعنى قول مالك.


ইয়াহইয়া বলেন: (মিসরের প্রসিদ্ধ ফকীহ আব্দুল্লাহ) ইবন ওয়াহব (১৯৭ হি) মালিক ইবন আনাস (১৭৯ হি) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, যদি কোনো মহিলার অভিভাবক দুর্বল হয় বা অনুপস্থিত থাকে, অথবা তার অভিভাবক না থাকে এবং সে মহিলা অন্য কোনো পুরুষকে দায়িত্ব প্রদান করে এবং সে তার বিবাহ সম্পাদন করে তবে সে বিবাহ বৈধ হবে। আর ইবন ওয়াহাবের নিজের মত হলো, এ বিবাহ বৈধ হবে না, অভিভাবক ছাড়া বিবাহ হবে না। তখন আমি ইয়াহইয়া ইবন মায়ীনকে বললাম, মালিকের এ মত কি আবূ হানীফার মতের সাথে মিলে? তিনি বললেন: হ্যাঁ।’’[3]

এ বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, ইবন মায়ীন ইমাম আবূ হানীফার ফিকহ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ বলে বিবেচিত হতেন, যে কারণে কোনো বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফার মাযহাব জানতে তাঁকে প্রশ্ন করা হতো।

(ঘ) ৪র্থ-৫ম শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ হুসাইন ইবন আলী সাইমারী (৩৫১-৪৩৬হি) তাঁর সনদে উদ্ধৃত করেন, ইবন মায়ীন বলেন:

القراءة عندي قراءة حمزة والفقه فقه أبي حنيفة على هذا أدركت الناس


‘‘আমার মতে কিরাআত হলো হামযার কিরাআত এবং ফিকহ হলো আবূ হানীফার ফিকহ। আমি মানুষদেরকে এ সিদ্ধামেত্মর উপরেই পেয়েছি।’’[4]

এ উক্তি থেকেও জানা যায় যে, ইবন মায়ীন হানাফী ফিকহকেই অনুকরণীয় বিশুদ্ধ ফিকহ বলে গণ্য করতেন।

(ঙ) ৪র্থ শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন আযদী (৩৭৪ হি) ও ৫ম শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইবন আব্দুল বারর (৩৬৮-৪৬৩ হি) তাঁদের সনদে উদ্ধৃত করেছেন:


قال يحيى: وقد سمعت من أبي يوسف الجامع الصغير


‘‘ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন বলেন, আমি আবূ ইউসূফের নিকট থেকে ‘‘জামি সাগীর’’ গ্রন্থটি শুনেছি।’’[5]

‘‘জামি সাগীর’’ হানাফী ফিকহের অন্যতম মৌলিক গ্রন্থ, যাতে ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান শাইবানী (১৩১-১৮৯ হি) ইমাম আবূ হানীফা, আবূ ইউসূফ ও তাঁর নিজের ফিকহী মতামত সংকলন করেন। এ কথাটিও প্রমাণ করে যে, ইবন মায়ীন হানাফী ফিকহের প্রতি আকৃষ্ট ও এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন।

(চ) তিনি ইমাম আবূ হানীফার নির্ভরযোগ্যতার সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিভাষা ব্যবহার করেন। আযদী ও ইবন আব্দুল বারর তাঁদের সনদে উদ্ধৃত করেছেন:


قيل ليحيى بن معين: أيما أحب إليك أبو حنيفة أو الشافعي ...؟ فقال: أما الشافعي فلا أحب حديثه، وأما أبو حنيفة فقد حدث عنه قوم صالحون، وأبو حنيفة لم يكن من أهل الكذب وكان صدوقا، ولكن ليس أرى حديثه يجزئ.


‘‘ইবন মায়ীনকে বলা হয়: আপনার নিকট কে প্রিয়তর? আবূ হানীফা, না শাফিয়ী...? তিনি বলেন: শফিয়ীর বিষয় হলো, তাঁর হাদীস আমি পছন্দ করি না। আর আবূ হানীফার বিষয় হলো, তাঁর থেকে অনেক নেককার মানুষ হাদীস বর্ণনা করেছেন। আবূ হানীফা মিথ্যাবাদী ছিলেন না। তিনি সত্যপরায়ণ ছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয় তাঁর হাদীস যথেষ্ট নয়।’’[6]

এখানে ইবন মায়ীন বলছেন যে, তিনি ইমাম শাফিয়ীর হাদীস পছন্দ করেন না, বরং হাদীসের ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে ইমাম আবূ হানীফা শক্তিশালী ও অধিকতর গ্রহণযোগ্য। এরপরও বলছেন যে, তাঁর হাদীস যথেষ্ট নয়। এ বক্তব্যকে ইমাম শাফিয়ীর অগ্রহণযোগ্যতা ও ইমাম আবূ হানীফার গ্রহণযোগ্যতা বা দুর্বলতার দলীল হিসেবে পেশ করা ঠিক নয়। কিয়াসপন্থী রাবীয়াহ, কাযী মুহাম্মাদ ইবন হাযম, ইমাম জাফর সাদিক সম্পর্কে ইবন উয়াইনাহর বক্তব্য এবং ইমাম আবূ হানীফা সম্পর্কে ইবনুল মুবারাকের বক্তব্যের অর্থ আর এ বক্তব্যের অর্থ একই বলে প্রতীয়মান হয়। অর্থাৎ ফিকহী বিষয়ে ব্যস্ততার কারণে মুহাদ্দিসদের তুলনায় তাঁদের হাদীসে ভুলভ্রান্তি বেশি হতো অথবা তাঁদের বর্ণিত হাদীসের পরিমাণ কম ছিল। এর মধ্যে ইবন মায়ীনের দৃষ্টিতে ইমাম আবূ হানীফা ইমাম শাফিয়ীর চেয়ে অধিকতর নির্ভরযোগ্য।

(ছ) ইবন আদী (৩৬৫ হি) ও খতীব বাদগাদী (৪৬৩ হি) আহমদ ইবন সাদ ইবন আবী মরিয়ম (২৫৩ হি) থেকে উদ্ধৃত করেছেন:


سألت يحيى بن معين عن أبى حنيفة قال لا تكتب حديثه


‘‘আমি ইয়াহইয়া ইবন মায়ীনকে আবূ হানীফার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি বললেন, তুমি তাঁর হাদীস লিখ না।’’[7]

শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী বলেন, এ কথা থেকে বুঝা যায় যে, ইবন মায়ীন আবূ হানীফাকে দুর্বল বলে গণ্য করছেন।[8] পক্ষান্তরে শাইখ আব্দুর রাহমান ইবন ইয়াহইয়া মুআল্লিমী (১৩৮৬ হি) বলেন:


(لا تكتب حديثه) ليست بصريحة في الجرح فقد يكون ابن معين ... علم أن أحمد قد استكثر من سماع الحديث ويمكنه أن يشتغل بما هو أنفع له من تتبع أحاديث أبي حنفية


‘‘(তুমি তাঁর হাদীস লিখ না) এ কথাটি সুস্পষ্টভাবে দুর্বলতা প্রকাশক নয়। হতে পারে যে, ইবন মায়ীন জানতেন যে, ইবন আবী মরিয়ম হাদীস শিক্ষায় অনেক অগ্রবর্তী, কাজেই আবূ হানীফার বর্ণিত হাদীস অনুসন্ধান না করে অন্যান্য উপযোগী বিষয়ে ব্যস্ত হওয়া তাঁর জন্য সম্ভব।’’[9]

অর্থাৎ ফিকহে অত্যধিক ব্যস্ততার কারণে ইমাম আবূ হানীফার বর্ণিত হাদীস তুলনামূলকভাবে কম। কাজেই ইবন মায়ীনের মতে ইবন আবী মরিয়মের জন্য তাঁর হাদীস না লিখলেও চলবে। উলেস্নখ্য যে, ইমাম আবূ হানীফার মুহাদ্দিস ছাত্রদের সংখ্যা এবং তাঁর কিতাবুল আসার ও মুসনাদ গ্রন্থের হাদীসের সংখ্যার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, তাঁর বর্ণিত হাদীস তাঁর প্রজন্মের মুহাদ্দিসদের তুলনায় কম ছিল না।

(জ) ইবন মায়ীনের মারিফাতুর রিজাল গ্রন্থের বর্ণনাকারী তাঁর ছাত্র আহমদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন কাসিম ইবন মুহরিয বলেন:


سمعت يحيى بن معين يقول كان أبو حنيفة لا بأس به وكان لا يكذب ... وسمعت يحيى يقول مرة أخرى أبو حنيفة عندنا من أهل الصدق ولم يتهم بالكذب ولقد ضربه ابن هبيرة على القضاء فأبى أن يكون قاضيا


‘‘আমি ইয়াহইয়া ইবন মায়ীনকে বলতে শুনেছি, আবূ হানীফার বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই। তিনি মিথ্যা বলতেন না। ... আমি ইয়াহইয়াকে অন্য একবার বলতে শুনেছি: আবূ হানীফা আমাদের নিকট সত্যপরায়ণ, তাঁকে মিথ্যায় অভিযুক্ত করা হয় নি। (ইরাকের উমাইয়া গভর্নর) ইবন হুবাইরা (১৩২ হি) তাঁকে বিচারক পদ গ্রহণে বাধ্য করতে প্রহার করেন; তা সত্ত্বেও তিনি বিচারকের পদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।’’[10]

এ কথাগুলোও বাহ্যত উপরের অর্থেই, তবে অধিক শক্তিশালী। কারণ মুহাদ্দিসগণ জানেন যে, ইবন মায়ীনের পরিভাষায় ‘‘আপত্তি নেই’’ অর্থ তিনি ‘সিকাহ’ বা বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য।[11]

(ঝ) ইবন আব্দুল বার্র (৩৬৮-৪৬৩ হি) তাঁর সনদে ইবন মায়ীনের ছাত্র আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ ইবন ইবরাহীম দাওরাকী (২৭৬ হি) থেকে উদ্ধৃত করেন:


سئل يحيى بن معين وأنا اسمع عن أبى حنيفة فقال ثقة ما سمعت أحدا ضعفه هذا شعبة بن الحجاج يكتب اليه أن يحدث ويأمره وشعبة شعبة


‘‘আমার উপস্থিতিতে ইয়াইয়া ইবন মায়ীনকে আবূ হানীফা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, আমি শুনছিলাম, তিনি বলেন: তিনি নির্ভরযোগ্য-বিশ্বস্ত। কেউ তাঁকে দুর্বল বলেছেন বলে আমি শুনি নি। এ তো শুবা ইবনুল হাজ্জাজ, তিনি আবূ হানীফাকে হাদীস বর্ণনা করতে লিখেন এবং অনুরোধ করেন। আর শুবা তো শুবাই।’’[12]

এখানে খুব স্পষ্ট করে ইবন মায়ীন তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন যে, তাঁকে দুর্বল বলেছে এমন একজনকেও তিনি জানেন না। উপরন্তু শুবার মতকে তিনি প্রমাণ হিসেবে পেশ করছেন।

(ঞ) ইমাম মিয্যী (৭৪২হি), ইমাম যাহাবী (৭৪৮ হি), ইবন হাজার আসকালানী (৮৫২ হি) প্রমুখ রিজালবিদ ইবন মায়ীনের ছাত্র মুহাম্মাদ ইবন সাদ আল-আউফী থেকে উদ্ধৃত করেন, আমি ইবন মায়ীনকে বলতে শুনেছি:


كان أبو حنيفة ثقة في الحديث، كان لا يحدث بالحديث إلا بما يحفظه، ولا يحدث بما لا يحفظ.


‘‘আবূ হানীফা হাদীসে নির্ভরযোগ্য-বিশ্বস্ত ছিলেন। যে হাদীস তাঁর মুখস্থ সে হাদীস ছাড়া কোনো হাদীস তিনি বলতেন না। যা তাঁর মুখস্থ নয় তা তিনি বলতেন না।’’

এছাড়া তাঁরা ইবন মায়ীনের অন্য ছাত্র সালিহ ইবন মুহাম্মাদ আসাদী জাযরাহ (২৯৩ হি) থেকে উদ্ধৃত করেছেন, তিনি বলেন, ইবন মায়ীন বলেন:


كان أبو حنيفة ثقةً في الحديث


‘‘আবূ হানীফা হাদীসে নির্ভরযোগ্য ছিলেন।’’[13]

এভাবে আমরা দেখছি যে, ইবন মায়ীন সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন যে, পূর্ববর্তী কোনো মুহাদ্দিস ইমাম আবূ হানীফাকে দুর্বল বলেন নি। অধিকাংশ বক্তব্যে তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। কখনো বা তাঁকে কিছুটা দুর্বল বলেছেন। বাহ্যত এ দুর্বলতা ফিকহী বিষয়ে ব্যস্ততার জন্য হাদীস বর্ণনায় গুরুত্ব কম দেওয়ার কারণে। এক্ষেত্রে তিনি ইমাম শাফিয়ীর চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য বলে ইবন মায়ীন বলেছেন।

[1] ইবন মায়ীন, তারীখ (দূরীর সংকলন) ৪/৬৩; সাইমারী, আখবারু আবী হানীফাহ, পৃ. ৪২।

[2] ইবন মায়ীন, তারীখ, (দূরীর সংকলন) ৩/৫১৭, ৪/২৮৩; মারিফাতুর রিজাল ২/৩৮।

[3] ইবন মায়ীন, তারীখ (দূরীর সংকলন) ৪/৪৬১।

[4] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফাহ, পৃ. ৮৭; খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৪৭; ইবন খাল্লিকান, ওয়াফাইয়াতুল আইয়ান ৫/৪০৯।

[5] ইবন আব্দুল বার্র, জামিউ বায়ানিল ইলম ২/২৯২।

[6] ইবন আব্দুল বার্র, জামিউ বায়ানিল ইলম ২/২৯১।

[7] ইবন আদী, আল-কামিল ১/৭৯; খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৪/৪২০, ৪৫০।

[8] আলবানী, মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন, সিলসিলাতুল আহাদীসিদ দায়ীফাহ ১/৬৬৫।

[9] মা’লামী, আত-তানকীল ১/২২০।

[10] ইবন মায়ীন, মারিফাতুর রিজাল ১/৭৯।

[11] আব্দুল হাই লাখনবী, আর-রাফউ ওয়াত তাকমীল, পৃ. ২২১-২২৩।

[12] ইবন আব্দুল বার্র, আল-ইনতিকা, পৃ. ১২৭।

[13] মিয্যী, তাহযীবুল কামাল ২৯/৪১৭-৪৪৪; যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩৯০-৪০৩; ইবন হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ১০/৪০১-৪০২।