লগইন করুন
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, তৃতীয় শতকে ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে প্রচারণা ব্যাপকতা লাভ করে। বিশেষত মুতাযিলী শাসনের অবসানের পরে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়। বাহ্যত এর কারণগুলি নিম্নরূপ:
৭. ১. প্রসারতা ও ক্ষমতার ঈর্ষা
আমরা আগেই বলেছি যে, তাবিয়ী যুগের অন্য কোনো ফকীহ ইমাম আবূ হানীফার মত প্রসিদ্ধি ও মর্যাদা লাভ করেন নি। তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর মত প্রসিদ্ধি লাভ করে। আববাসী খলীফা মাহদীর যুগ (১৫৮-১৬৯হি) থেকে হানাফী ফিকহ রাষ্ট্রীয় ফিকহে পরিণত হয়। এ ফিকহে পারদর্শীগণই বিভিন্ন বিচারিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। পরবর্তী শতাব্দীর পর শতাব্দী এ নেতৃত্বের ও কর্তৃত্বের ধারা অব্যাহত থাকে। হানাফী বিরোধীদের ক্ষোভ এতে বাড়তে থাকে এবং তাঁদের বৈরী প্রচারণাও ব্যাপক হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ প্রচারণা হানাফী ফিকহের বিরুদ্ধে না হয়ে ব্যক্তি আবূ হানীফার চরিত্র হননের দিকে ধাবিত হয়।
৭. ২. মুতাযিলী ফিতনা ও সম্পৃক্তি
২০০ হিজরীর দিকে আববাসী খলীফা মামুন (রাজত্ব ১৯৮-২১৮ হি) মুতাযিলী ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ করেন এবং একে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। পরবর্তী খলীফা মু’তাসিম বিল্লাহ (২১৮-২২৭ হি) ও ওয়াসিক বিল্লাহ (২২৮-২৩২ হি) এ মতবাদ অনুসরণ করেন। গ্রীক দর্শন নির্ভর এ মতবাদে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের সাথে সুস্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক বিভিন্ন বিশ্বাস বিদ্যমান। এ সকল বিশ্বাসের মধ্যে রয়েছে ‘‘কুরআন সৃষ্ট বা মাখলূক’’। এ ছাড়া মুতাযিলীগণ আল্লাহর ‘‘বিশেষণগুলো’’ ব্যাখ্যা করে অস্বীকার করেন। এ মত প্রতিষ্ঠায় এ তিন খলীফা ছিলেন অনমনীয়। এ মত গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী আলিমদেরকে গ্রেফতার করে তাঁরা অবর্ণনীয় অত্যাচার করতে থাকেন। পরবর্তী শাসক মুতাওয়াক্কিল (২৩২-২৪৭ হি) এ অত্যাচারের অবসান ঘটান। সকলেই স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ ও পালনের সুযোগ পান।
প্রায় ত্রিশ বৎসরের মুতাযিলী শাসনের সময়ে স্বভাবতই প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থায় হানাফী ফকীহগণ ছিলেন। তাঁদের অনেকেই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মুতাযিলীদের সাথে সহযোগিতা করেছেন বা তাদের মত গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। বিশেষত খলীফা মামুনের মুতাযিলী ফিতনার মূল স্থম্ভ বিশর আল-মারীসী: বিশর ইবন গিয়াস ইবন আবী কারীমা আব্দুর রাহমান (২১৮ হি) এবং বিচারপতি আহমদ ইবন আবী দুওয়াদ (আবী দাউদ) ইবন জারীর (১৬০-২৪০ হি) উভয়েই ফিকহী মতে ইমাম আবূ হানীফার অনুসারী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। মুতাযিলী মতের প্রচার-প্রসার, দেশের সকল আলিমকে খলীফার দরবারে ডেকে মুতাযিলী মত গ্রহণে বাধ্য করা এবং ইমাম আহমদ ও মুতাযিলা মতবিরোধী অন্যান্য প্রসিদ্ধ ইমামগণের উপর নির্মম নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের মূল হোতা ছিলেন তাঁরা।[1]
মুতাযিলী অত্যাচারের অবসানের পরেও হানাফী ফকীহগণ বিচারিক ও প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। এছাড়া মুতাযিলীগণ ‘হানাফী’ নামের ছত্রছায়ায় তাদের মত প্রচার করতে থাকেন। অপরদিকে হানাফী বিরোধীগণ আহলুস সুন্নাতের নামে, বিদআত বিরোধিতা বা মুতাযিলী বিরোধিতার নামে ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে থাকেন। অনেকে এ বিষয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিতে থাকেন। অনেক সরলপ্রাণ প্রাজ্ঞ আলিমও এরূপ অপপ্রচারে প্রভাবিত হন।
৭. ৩. বিচার ও শাসন বনাম ইলম ও কলম
আমরা দেখেছি যে, দ্বিতীয় হিজরী শতকের শেষ দিক থেকেই হানাফী ফিকহ রাষ্ট্রীয় ফিকহে পরিণত হয়। হানাফী ফকীহগণ ফিকহ ও বিচারিক দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তৃতীয় হিজরী শতক থেকে হাদীস চর্চায় হানাফী ফকীহগণের সম্পৃক্তি কমতে থাকে। এছাড়া ফিকহী বিষয়ে অতিরিক্ত মনোসংযোগের কারণে হাদীস বিষয়ে তাদের দুর্বলতা বাড়তে থাকে। এভাবে তাদের সাথে মুহাদ্দিসগণের দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা বাড়তে থাকে।
৭. ৪. মাযহাবী গোঁড়ামি ও বিদ্বেষ
চতুর্থ হিজরী শতক থেকে মাযহাবী গোঁড়ামি ও বিদ্বেষ ব্যাপকতা লাভ করতে থাকে। এ সময়ে তিনটি মাযহাব প্রসিদ্ধ ছিল: হানাফী, মালিকী ও শাফিয়ী। মালিকী মাযহাব উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনে বিস্তার লাভ করে। মুসলিম বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র মিসর, ইরাক ও পারস্যে হানাফী-শাফিয়ী দ্বন্ধ ব্যাপক রূপ গ্রহণ করে। ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও প্রসারতা ছিল হানাফীদের বেশি। কিন্তু হাদীস চর্চা ও লিখনীতে শাফিয়ীগণ অগ্রগামী ছিলেন। মুহাদ্দিসগণের মধ্যে শাফিয়ী মাযহাব প্রসার লাভ করে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস হানাফীদের ‘ঘায়েল’ করার জন্য তাদের ইমামকে ছোট করতে চেষ্টা করেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে সত্য, মিথ্যা, জাল-বানোয়াট সবকিছু সংকলন করেন।
এ প্রচারণার কারণে তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি থেকে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে তাঁর প্রতি কঠোর আপত্তি ও বিদ্বেষের ভাব জন্ম নিতে থাকে। এ সময়ে ‘‘আহলুস সুন্নাহ’’ ও মুহাদ্দিসদের মধ্যে বিদ্যমান অনুভূতি অনেকটা নিম্নরূপ: যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস অস্বীকার করত!! হাদীসের বিপরীতে নিজের মত দিয়ে দীন তৈরি করত!!! সকল বিদআতী আকীদার প্রচারক ছিল!! সে কিভাবে এত প্রসিদ্ধি লাভ করল? তার মত কেন এত প্রসার লাভ করল? কোনো অজুহাতেই তাকে সহ্য করা যায় না!!!!
হানাফীগণ এ সকল অভিযোগ খন্ডন করেছেন। তবে মুহাদ্দিসগণের সাথে দূরত্বের কারণে তাঁদের মধ্যে তা তেমন প্রভাব বিস্তার করে নি। এছাড়া হানাফীগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে অনেক সময় ইলমী প্রতিবাদের চেয়ে শক্তির প্রতিবাদ বেশি জোরদার হয়েছে। কখনো বা ইমামের বিরুদ্ধে অভিযোগ খন্ডন করতে যেয়ে প্রতিপক্ষকে ছোট করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কখনো তাঁর মর্যাদা প্রমাণ করার নামে তাঁর নামে প্রচলিত সবকিছু নির্ভুল ও নির্বিচারে গ্রহণযোগ্য বলে দাবি করা হয়েছে। পক্ষের-বিপক্ষের সকলেই আবেগ ও বাড়াবাড়িতে আক্রান্ত হয়েছেন।
আমরা জানি, ইমাম আবূ হানীফাকে হক্ক বলা আর তাঁর অন্ধ অনুসরণকে হক্ক বলা এক নয়। ইমাম আবূ হানীফাকে হক্ক বলার অর্থ তাঁকে নিষ্পাপ বা নির্ভুল বলা নয়। ইমাম আবূ হানীফাকে ভাল বলতে যেয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যারা আপত্তিকর কথা বলেছেন তাদেরকে মন্দ বলাও ঠিক নয়। ইমাম আবূ হানীফাকে হক্ক বাতিলের মাপকাঠি বানিয়ে দেওয়াও ঠিক নয়।
এভাবে অভিযোগ ও প্রতিবাদ প্রক্রিয়া মাযহাবী আক্রোশের গন্ডি থেকে বের হতে পারে নি। হিজরী ৫ম শতক থেকে অন্য মাযহাবের কতিপয় আলিম এ সব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেন। এদের অন্যতম প্রসিদ্ধ মালিকী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইউসূফ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন আব্দুল বার্র (৩৬৮-৪৬৩ হি)। তিনি ‘‘আল-ইন্তিকা ফী ফাদায়িলিল আয়িম্মাতিস সালাসাহ’’ নামক গ্রন্থে তিন ইমাম: আবূ হানীফা, মালিক ও শাফিয়ীর মর্যাদা ব্যাখ্যা করেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার জ্ঞানবৃত্তিকভাবে খন্ডন করেন।
পরবর্তীকালে অন্যান্য মাযহাবের কতিপয় ফকীহ, মুহাদ্দিস, ঐতিহাসিক ও জারহ-তাদীল বিশেষজ্ঞ নিরপেক্ষ বিচার ও পর্যালোচনার চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে রয়েছেন প্রসিদ্ধ হাম্বালী ফকীহ ও মুজতাহিদ শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া আহমদ ইবন আব্দুল হালীম (৬৬১-৭২৮ হি), তাঁর তিন ছাত্র: প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইউসূফ ইবন আব্দুর রাহমান, আবুল হাজ্জাজ আল-মিয্যী (৬৫৪-৭৪২ হি), প্রসিদ্ধ শাফিয়ী-হাম্বালী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম যাহাবী: মুহাম্মাদ ইবন আহমদ (৬৭৩-৭৪৮ হি), প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকহী ও মুহাদ্দিস আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবন উমার ইবন কাসীর (৭০১-৭৭৪ হি) এবং অষ্টম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইবন হাজার আসকালানী: আহমদ ইবন আলী (৭৭৩-৮৫২ হি)।