লগইন করুন
তাগুত অবিশ্বাস ও বর্জন বিষয়ক আয়াতগুলিকে জামাআতুল মুসলিমীন নেতৃবৃন্দ তাদের মতের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে পেশ করতেন। তাগুত শব্দটি কুরআনে ৮ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে।[1] ইতোপূর্বে একটি আয়াতে দেখেছি যে আল্লাহ বলেছেন: ‘‘দীনে কোনো জবরদস্তি নেই। ... যে তাগূতকে অবিশ্বাস করবে এবং আল্লাহকে বিশ্বাস করবে সে এমন এক মযবুত হাতল ধরবে যা কখনো ভাঙ্গবে না।’’ অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَىٰ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا
‘‘তুমি কি দেখ নি তাদেরকে যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাগূতকে অবিশ্বাস করার আর শয়তান চায় তাদেরকে ভিষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে? তাদেরকে যখন বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে এস, তখন মুনাফিকদেরকে তুমি তোমার নিকট হতে মুখ একেবারে ফিরিয়ে নিতে দেখবে।’’[2]
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
‘‘আল্লাহর ইবাদত করার এবং তাগূতকে বর্জন করার নির্দেশ দিয়ে আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি।’’[3]
এখানে তাগুতকে বর্জন করা বলতে তাগুতের ইবাদত বর্জন করা বুঝানো হয়েছে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ আরো বলেছেন:
وَالَّذِينَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوتَ أَنْ يَعْبُدُوهَا وَأَنَابُوا إِلَى اللَّهِ لَهُمُ الْبُشْرَىٰ
‘‘যারা তাগূতের ইবাদত করা বর্জন করে এবং আল্লাহ অভিমুখী হয়, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ।’’[4]
তাগূত শব্দটি আরবী ‘তুগইয়ান’ শব্দ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, যার অর্থ সীমালঙ্ঘন করা। অবাধ্যতা, জুলুম বা অন্যায়ের ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘনকারীকে ‘তাগী’ বা ‘সীমালঙ্ঘনকারী’ বলা হয়। অত্যধিক সীমলঙ্ঘনকারীকে ‘তাগিয়াহ’ বা তাগূত বলা হয়। এভাবে আমরা দেখছি যে, আভিধানিকভাবে ‘তাগূত’ অর্থ ‘মহা-সীমালঙ্ঘনকারী’।[5]
আভিধানিকভাবে সকল সীমালঙ্ঘনকারী বা অবাধ্যকে ‘তাগূত’ বা ‘তাগিয়াহ’ বলা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো কুরআনের পরিভাষায় এ ‘মহা-সীমালঙ্ঘনকারী’ কে, কাফিরগণ যাকে বিশ্বাস করে এবং যার পথে যুদ্ধ করে, আর যাকে অবিশ্বাস ও যার ইবাদত বর্জন করা মুমিনের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ? যার কাছে বিচার প্রার্থনা করা মুনাফিকদের কর্ম? তাগুতের নিকট বিচারপ্রার্থনা বিষয়ক আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী বলেন:
قال جابر كانت الطواغيت التي يتحاكمون اليها في جهينه واحد وفي اسلم واحد وفي كل حي واحد كهان ينزل عليهم الشيطان وقال عمر ... الطاغوت الشيطان وقال عكرمة ... الطاغوت الكاهن
‘‘জাবির (রা) বলেন, তারা যে সকল তাগূতের নিকট বিচার প্রার্থনা করত তার একজন ছিল জুহাইনা গোত্রে, একজন ছিল আসলাম গোত্রে এবং প্রত্যেক গোত্রেই গণক-পুরোহিত ছিল যাদের উপর শয়তান অবতীর্ণ হতো। উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেছেন, তাগূত অর্থ শয়তান। ইকরিমা বলেছেন, তাগূত অর্থ কাহিন বা গণক-পুরোহিত।[6]
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু জারীর তাবারী (৩১০ হি) তাঁর তাফসীরে বিভিন্ন সনদে মুফাসসির সাহাবী ও তাবিয়ীগণ থেকে ‘তাগূতের’ ব্যাখ্যায় তিনটি মত উল্লেখ করেছেন। সাহাবী উমার (রা), তাবিয়ী মুজাহিদ, শা’বী, কাতাদাহ, দাহ্হাক, সুদ্দী প্রমুখ মুফাস্সির বলেন, তাগূত অর্থ শয়তান। তাবিয়ী আবুল আলিয়াহ ও মুহাম্মাদ ইবনু সিরীন বলেন, তাগূত অর্থ যাদুকর। সাহাবী জাবির (রা), তাবিয়ী সাঈদ ইবনু জুবাইর, রুফাই, ইবনু জুরাইজ প্রমুখ মুফাস্সির বলেছেন, তাগূত অর্থ ‘কাহিন’ বা গণকপুরোহিত।[7]
কুরআনে বিভিন্ন স্থানে তাগূত শব্দটির ব্যবহারের মধ্যে তুলনা করলে প্রথম ব্যাখ্যাটির শক্তিশালী বলে প্রতীয়মান হয়। আল্লাহ বলেন:
اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ
‘‘যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে নিয়ে যান। আর যারা কুফরী করেছে তাদের অভিভাবক তাগূত। তারা তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়।’’[8]
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا
‘‘যারা ঈমানদার তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে। আর যারা কুফরী করেছে তারা তাগূতের পথে যুদ্ধ করে। অতএব তোমরা শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; শয়তানের কৌশল অবশ্যই দুর্বল।’’[9]
এ দুটি আয়াতে স্পষ্টতই তাগুত বলতে শয়তান বুঝানো হয়েছে। প্রথম আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কাফিরদের বন্ধু তাগূত এবং পরের আয়াতে বলা হয়েছে যে, কাফিরগণ শয়তানের বন্ধ। এথেকে স্পষ্টত বুঝা যায় যে, তাগূত ও শয়তান একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া দ্বিতীয় আয়াতে তাগূত ও শয়তান শব্দদ্বয়ের ব্যবহার থেকে বুঝা যায় যে, দুটি দ্বারা একই অর্থ বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ কাফিরগণ তাগূতের পথে যুদ্ধ করে, কাজেই তোমরা তাগূতের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর।
ইবনু কাসীর বলেন, ‘‘তাগূতের অর্থ শয়তান বলা অত্যন্ত জোরালো মত। কারণ মুর্তি, স্তম্ভ, পাথর, গাছপালা ইত্যাদির পূজা, এগুলির কাছে বিচার চাওয়া, এগুলির জন্য লড়াই করা ইত্যাদি জাহিলী যুগের সকল অকল্যাণের উৎস হলো শয়তান। কাজেই এক কথায় সকল অর্থ এসে যায়।’’[10]
হাদীস শরীফে মূর্তি-প্রতিমাকে ‘তাগূত’ বা ‘তাগিয়াহ’ বলা হয়েছে। দেব-দেবীর নামে শপথের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
لا تحلِفُوا بالطواغيتِ (بالطواغي) ولا تحلِفُوا بآبائِكم
‘‘তোমরা তাগুতদের নামে শপথ করবে না এবং তোমাদের পিতাদের নামে শপথ করবে না।’’[11]
আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
لا تقومُ الساعةُ حتى تضطَّرِبَ أليَاتُ نساءِ دَوْسٍ على (حولَ) ذي الخلَصَةِ طاغِيَةُ دَوْسٍ التي كانوا يعبدونَها في الجاهِلِيَّةِ
কিয়ামতের পূবেই দাওস গোত্রের মহিলাদের নিতম্ব দাওস গোত্রের তাগিয়াহ ‘যুল খালাসা’ প্রতিমার নিকট আন্দোলিত হবে।[12] উপরের আয়াতগুলিতে আমরা দেখেছি যে, মহান আল্লাহ ঈমানের দুটি অংশ উল্লেখ করেছেন: আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং তাগূতকে অবিশ্বাস করা। আর এ অর্থে অন্যত্র বলা হয়েছে যে, আল্লাহর ইবাদত করতে হবে এবং তাগূতের ইবাদত বর্জন করতে হবে। এ অর্থে একটি হাদীস প্রণিধান যোগ্য। তারিক ইবনু আশইয়াম (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
من قالَ : لا إلهَ إلَّا اللَّهُ ، وكفر بما يُعبَدُ من دون اللَّهِ ، حُرِّم مالُهُ ودمُهُ . وحسابُهُ على اللَّهِ
‘‘যদি কেউ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলে এবং আল্লাহ ছাড়া যা কিছু ইবাদত করা হয় তা অবিশ্বাস করে, তবে তার রক্ত ও সম্পদ নিষিদ্ধ হবে, তার হিসাব হবে আল্লাহর উপর।’’[13] উপরের আয়াতগুলির সাথে এ হাদীসের অর্থ সমন্বয় করলে বুঝা যায় যে, ‘তাগূত’ বলতে ‘আল্লাহ ছাড়া যা কিছু ইবাদত করা হয়’ বুঝানো হয়েছে। পরবর্তী যুগের অনেক মুফাসসির এ প্রকারের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। ইমাম মালিক (১৭৯ হি) থেকে বর্ণিত, আল্লাহকে ছাড়া যাকেই ইবাদত করা হয় সেই তাগূত।[14] ইমাম তাবারী (৩১০ হি) এ অর্থই সঠিক বলে উল্লেখ করেছেন।’’[15] কোনো কোনো মুফাসসির বলেন, ‘‘আল্লাহ ছাড়া যার ইবাদত করা হয় অথবা আল্লাহর বিরোধিতায় যার আনুগত্য করা হয় সেই তাগূত।’’[16] এখানে লক্ষণীয় যে, আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত করা হয়েছে এবং হচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছেন ঈসা, উযাইর, ইয়াগূস, ইয়াউক, নসর ও অন্যান্য নবী, ওলী ও ফিরিশতাগণ। এদেরকে তো তাগূত বলা যায় না। তাহলে মুফাসসিরদের এ ব্যাখ্যা কিভাবে গ্রহণ করা যাবে? এক্ষেত্রে তারা বলেছেন যে, যারা ইবাদত গ্রহণে তুষ্ঠ তাদেরকেই তাগূত বলা হবে; কারণ তারা আল্লাহর অবাধ্যতায় মহা-সীমালঙ্ঘনকারী। অথবা ইবাদতকারীদের কর্মের ভিত্তিতে তাদেরকে তাগূত বলা হবে। অর্থাৎ ইবাদতকারীগণ তাদের ইবাদত করে মহা-সীমালঙ্ঘনকারীতে পরিণত হয়েছে।[17]
এভাবে আমরা দেখছি যে, ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং তাঁর ইবাদত করা এবং তাগূতকে অবিশ্বাস করা এবং তাগূতের ইবাদত বর্জন করা। শয়তানই এ তাগূত। এছাড়া শয়তানের নির্দেশে আল্লাহ ছাড়া যা কিছু ইবাদত করা হয়েছে সবই তাগূত। মুমিনের দায়িত্ব ইবাদতের অধিকার একমাত্র আল্লাহরই বলে বিশ্বাস করা, শুধু আল্লাহরই ইবাদত করা, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুর ইবাদত গ্রহণের অধিকার অবিশ্বাস করা এবং এবং অন্য কিছুর ইবাদত বর্জন করা। আল্লাহর যা অবতীর্ণ করেছেন তা এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে পরিত্যাগ করে অন্য ধর্মের গণক-পুরোহিতর নিকট বিচার প্রার্থনা করা বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) বিচারকে অগ্রহণযোগ্য বিবেচনা করে অন্য কারো কাছে বিচার প্রার্থনা করা মুনাফিকদের কর্ম, যা কখনোই কোনো মুমিন করতে পারেন না। এ সকল বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কোনো মতভেদ নেই। তবে মুফাসসিরগণের কোনো কথা ও আভিধানিক অর্থকে ভিত্তি করে ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ নেতৃবৃন্দ দাবি করেন যে, আল্লাহর আইন ছাড়া বিচার-শাসনকারী সকল সরকারই ‘তাগূত’ এবং এদেরকে বর্জন করা ও অবিশ্বাস করা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই যে ব্যক্তি ঈমানের দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও এরূপ শাসক বা সরকারকে বর্জন করবে না বা সহযোগিতা ও আনুগত্য করবে, অথবা এ সকল দেশের আদালতে বিচার প্রার্থনা করবে সে কাফির, যদিও সে সালাত, সিয়াম ও ইসলামের অন্য সকল ইবাদত পালন করে। এক্ষেত্রে তাদের বিভ্রান্তি সুস্পষ্ট:
প্রথমত: তাঁরা ‘‘তাগুত’’-এর ব্যাখ্যায় সীমালঙ্ঘন করেছেন এবং ‘তাগূতের’ শাব্দিক ও কুরআনী অর্থের মধ্যে পার্থক্য নষ্ট করেছেন। সকল অবাধ্য পাপী সীমালঙ্ঘনকারীই আভিধানিকভাবে ‘তাগূত’ বলে অভিহিত হতে পারে, কিন্তু কুরআনে যে তাগূতকে অবিশ্বাস করতে ও ইবাদত বর্জন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সে শয়তান এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে ইবাদত করা হয়।
দ্বিতীয়ত: তাঁরা তাগূতের প্রতি মুমিনের দায়িত্বের বর্ণনায় সীমালঙ্ঘন করেছেন। কুরআনে তাগূতের প্রতি মুমিনের দুটি দায়িত্ব উল্লেখ করা হয়েছে: ‘‘অবিশ্বাস করা’’ ও ‘‘ইবাদত বর্জন করা’’। অবিশ্বাস অর্থ তার অস্তিত্বে বা রাষ্ট্রক্ষমতায় অবিশ্বাস নয়, তার ইবাদত পাওয়ার অধিকারে অবিশ্বাস করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নির্দেশ দিয়েছেন, আল্লাহ ছাড়া যা কিছু ইবাদত করা হয় তা অবিশ্বাস করতে হবে। আমরা জানি, আল্লাহ ছাড়া অনেক ফিরিশতা ও নবীর (আঃ) ইবাদত করা হয়েছে। এখানে এদের অস্তিত্ব বা এদের মর্যাদা অবিশ্বাস করতে নির্দেশ দেওয়া হয় নি। বরং ‘ইবাদত পাওয়ার কোনোরূপ অধিকার এদের আছে’ তা অস্বীকার করতে হবে। অনুরূপভাবে ফিরাউন ও অন্যান্য শাসকের ইবাদত করা হয়েছে। তাদের প্রতি অবিশ্বাস অর্থ তাদের অস্তিত্বে বা রাজত্বে অবিশ্বাস নয়, বরং তাদের ‘ইবাদত- যোগ্যতা’ অবিশ্বাস করা।
তৃতীয়ত: তারা ইবাদত ও আনুগত্যের পার্থক্য নষ্ট করেছেন। আমরা ইতোপূর্বে বিষয়টি আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, শয়তানই মূলত তাগূত। আর তাগূতের আনুগত্য বা সহযোগিতা করলেই যদি কুফর বা শিরক হয়, তবে প্রত্যেক মানুষই কাফির ও মুশরিক বলে গণ্য হবে। কারণ প্রতিটি মানুষই শয়তানের প্ররোচনাই বিভিন্ন ভাবে আল্লাহর অবাধ্যতা বা পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান আছে এরূপ কোনো মানুষই এ ধরনের কথা বলবেন বলে মনে হয় না।
চতুর্থত: তাগূতের নিকট বিচারপ্রার্থনার ব্যাখ্যায় তারা সীমালঙ্ঘন করেছেন। অন্য ধর্মের গণক-পুরোহিত- যারা অলৌকিক বা গায়েবী জ্ঞান এবং সে জ্ঞানের ভিত্তিতে সঠিক বিচার করার যোগ্যতা ও অধিকার দাবি করেন- তাদের এরূপ জ্ঞান ও বিচারের যোগ্যতায় বিশ্বাস করা বা এরূপ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাদের কাছে বিচার চাওয়া নিঃসন্দেহে কুফরী। এছাড়া আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) নিকট ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে না বা তাদের ফয়সালা অগ্রহণযোগ্য মনে করে অন্য যে কোনো ব্যক্তির নিকট বিচার চাওয়াও কুফরী। এখানে কুফরী বিশ্বাসে, অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) বিচারকে অগ্রহণযোগ্য মনে করা বা অন্য কারো অলৌকিক জ্ঞান ও নির্ভুল বিচারের যোগ্যতা আছে বলে বিশ্বাস করা।
আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখব যে, সমকালীন মুসলিম দেশগুলির অধিকাংশ আইনই ইসলামী বা ইসলাম সম্মত। কিছু আইন ইসলাম বিরোধী। কোনো মুমিন আল্লাহর আইনের শ্রেষ্ঠতে বিশ্বাস-সহ আল্লাহর আইনের অবিদ্যমানতার কারণে নিজের ন্যূনতম অধিকার রক্ষার জন্য এরূপ আইনের আশ্রয় নিলে তা কখনোই কুফরী বা পাপ বলে গণ্য নয়। মুফাস্সিরগণ সহীহ, যয়ীফ, বানোয়াট অনেক মতামত উদ্ধৃত করেন, যেগুলি ‘‘মতামত’’ মাত্র। হালাল-হারাম বা ঈমান-কুফর নির্ধারণে সনদবিচার ও সহীহ হাদীস প্রয়োজন। এ সকল ‘‘মতামত’’ সনদভিত্তিক বিচার না করে পছন্দভিত্তিক গ্রহণ করার কারণে আমরা অনেক সময় ভুলের মধ্যে নিপতিত হই। তাগূতের নিকট বিচারপ্রার্থনার আয়াতের ক্ষেত্রেও তা ঘটেছে।
এ প্রসঙ্গে তাফসীরে যে সকল হাদীস বা সাহাবীগণের মতামত উল্লেখ করা হয়েছে তার অধিকাংশেরই কোনো নির্ভরযোগ্য সনদ নেই। এরূপ একটি ‘‘হাদীস’’ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয় যে, একজন ইহূদী ও মুনাফিক মুসলিমের মধ্যে কোনো বিষয়ে বিবাদ হয়। মুনাফিক ব্যক্তি একজন পুরোহিত বা ইহূদী নেতার কাছে বিচারপ্রার্থনা করতে চায়, কিন্তু ইহূদী লোকটি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)এর কাছে বিচারপ্রার্থনায় আগ্রহী ছিল। একপর্যায়ে তারা রাসুলুল্লাহ (ﷺ)এর কাছে বিচার চাইলে তিনি সবকিছু শুনে ইহূদীর পক্ষে বিচার করেন। মুনাফিক ব্যক্তি এতে অসন্তুষ্ট হয়ে উমার (রা)-এর নিকট বিচার প্রার্থনা করেন। তিনি বাদী ও বিবাদীর বক্তব্য শোনার পর উক্ত মুনাফিককে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। বিভিন্ন ভাষায় বর্ণিত এ ‘‘হাদীসটি’’র কোনো গ্রহণযোগ্য সনদ নেই। ইবনু কাসীর তা উল্লেখ করেছেন।[18]
এ বর্ণনা বিশুদ্ধ হলেও সমকালীন আদালতে বিচার প্রার্থনা কুফরী বলে প্রমাণিত হয় না। বাদী ও বিবাদীর কর্ম থেকে বুঝা যায় যে, মদীনার প্রশাসন-ব্যবস্থায় উমার (রা)-এর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ছিল। আর মুনাফিক লোকটি নিজে উমার (রা)-এর কাছে বিচার চেয়েছে এবং স্বীকার করেছে যে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ)এর বিচার সে অপছন্দ করেছে। বিবাদীও তার বক্তব্য সঠিক বলে সাক্ষ্য দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (ﷺ)এর বিচারকে আপত্তিকর মনে করা কুফরী। যেহেতু ব্যক্তি নিজেই নিজের অপরাধের জন্য বিচার প্রার্থনা করেছে কাজেই তাকে তার পাওনা শাস্তি প্রদান বৈধ। কিন্তু জামাআতুল মুসলিমীন ও অন্যান্যরা এরূপ যয়ীফ বা অনির্ভরযোগ্য বর্ণনার উপর তাদের মতামতের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং তাদের পছন্দমত এর ব্যাখ্যা করেন।
[2] সূরা (৪) নিসা: ৬০-৬১ আয়াত।
[3] সূরা নাহল, ৩৬ আয়াত।
[4] সূরা যুমার, ১৭ আয়াত।
[5] রাযী, মুখতাসারুল সিহাহ, পৃ. ৪০৩।
[6] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬৭৩।
[7] তাবারী, তাফসীর ৩/১৮-১৯।
[8] সূরা বাকারা, ২৫৭ আয়াত।
[9] সূরা নিসা, ৭৬ আয়াত।
[10] ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৩১২।
[11] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৪৫০, মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১২৬৮; আবূ আওয়ানা, আল-মুসনাদ ৪/২৮; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১১/৫৩৬।
[12] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬০৪।
[13] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫৩।
[14] কুরতুবী, তাফসীর ৫/২৪৮।
[15] তাবারী, তাফসীর ৩/১৯।
[16] কুরতুবী, তাফসীর ৫/২৪৮-২৪৯।
[17] উসাইমিন, মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ, আল-কাওলুল মুফীদ ১/৩০।
[18] ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫২২।