লগইন করুন
ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে উগ্রতার পিছনে অন্যতম যে বিষয়টি দেখা যায় তা হলো, নিজের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেযে অন্যের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা। এটি আবেগপ্রসূত বিভ্রান্তিগুলির অন্যতম। দ্বীন প্রতিষ্ঠার দুটি পর্যায় রয়েছে: (১) নিজের জীবনে দীন প্রতিষ্ঠা করা এবং (২) অন্যের জীবনে তা প্রতিষ্ঠা করা। মুমিনের মূল দায়িত্ব নিজের জীবনে ও নিজের দায়িত্বাধীনদের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। ইসলামে নিজের জীবনে পালনীয় ইবাদতগুলিকে আরকানে ইসলাম, ফরয আইন বা সুন্নাত আইন হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। পক্ষান্তরে দাওয়াত, আদেশ, নিষেধ, জিহাদ ইত্যাদি ‘‘অন্যের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার’’ দায়িত্ব বিষয়ক ইবাদতগুলিকে মূলত ‘ফরয কিফায়া’ বা সামষ্টিক দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং সুযোগ ও সাধ্যের আলোকে কম বেশি পালনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির দায়িত্ব দাওয়াত দেওয়া। কেউ বা সকলে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলে বা অন্যায় পরিত্যাগ না করলে মুমিনের কোনোরূপ দায়বদ্ধতা থাকে না। কিন্তু উগ্রতায় লিপ্ত মানুষদেরকে আমরা এর উল্টো পথে চলতে দেখি। তারা মূলত ‘‘অন্যের জীবনে দীন প্রতিষ্ঠাকে’’ ফরয আইন ও বড় ফরয এবং নিজের জীবনে দীন পালনকে ‘‘ছোট ফরয’’ বা গুরুত্বহীন বলে মনে করেন। তারা অন্যের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তিগতভাবে হারাম-মাকরূহ কর্মে লিপ্ত হচ্ছেন এবং এরূপ হারাম-মাকরূহ কর্মে লিপ্ত হওয়াকে নানাভাবে বৈধ, বরং জরুরী বা ফরয বলে দাবি করছেন।
তাদের মনের একই চিন্তা, সমাজে বা দু&&নয়ায় অমুক অন্যায় হচ্ছে, আল্লাহর আইনের বিরোধিতা হচ্ছে, আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ করা হচ্ছে, কিভাবে নীরব থাকবে মুমিন। কাজেই যেভাবে পার ঝাপিয়ে পড়ে সব অন্যায় মিটিয়ে দিয়ে বিশ্বের সর্বত্র সকলের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা কর। বস্ত্তত এরূপ চিন্তা ভাল চিন্তার সাথে খারাপ চিন্তার সমন্বয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ মুমিনের মনে অবশ্যই থাকবে এবং মুমিন সাধ্যমত ইসলাম নির্দেশিত পথে তা প্রতিকারের চেষ্টা করবে বা দাওয়াত দিবে। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, মহান আল্লাহ মুমিনকে তাঁর নিজের ও নিজের দায়িত্বাধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাস করবেন, দুনিয়ার অন্য মানুষদের পাচাচার সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করবেন না। সাধ্যমত দাওয়াতের পরেও যদি মানুষ তা গ্রহণ না করে সে জন্য মুমিনের কোনোরূপ অপরাধ থাকে না। মহান আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ لَا يَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ
‘‘হে মুমিনগণ, তোমাদের উপরে শুধু তোমাদের নিজেদেরই দায়িত্ব। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও তাহলে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোনো ক্ষতি করবে না।’’[1] বস্ত্তত সমাজ, রাষ্ট্রে ও বিশ্বে অন্যায়, পাপ ও অপরাধ থাকবেই, কখনো বেশি এবং কখনো কম। মুমিনের দায়িত্ব দাওয়াত দেওয়া, মুমিনের দায়িত্ব হিদায়াত করে ফেলা বা ভাল করে ফেলা নয়। মহান আল্লাহ তার মহান রাসূল (ﷺ)-কে বলেন:
إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ
‘‘তুমি যাকে ভালবাস তাকে তুমি হিদায়াত দিতে পারবে না; বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দেন।’’[2]
আল্লাহ আরো বলেন:
وَمَا أَكْثَرُ النَّاسِ وَلَوْ حَرَصْتَ بِمُؤْمِنِينَ
‘‘আর তুমি যতই চাও না কেন, অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাসী হবার নয়।’’[3]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَآمَنَ مَنْ فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا أَفَأَنْتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّىٰ يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ
‘‘তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সকলেই ঈমান আনত; তবে কি তুমি মুমিন হওয়ার জন্য মানুষদের উপর জবরদস্তি করবে?’’[4] অনেক সময় আবেগী মুমিন সমাজের পাপাচারে বেদনাগ্রস্ত হয়ে দ্রুত সবকিছু ঠিক করে ফেলতে আগ্রহী হন। তিনি কুরআনসুন্নাহর নির্দেশ ও মানবজাতির পরিচালনায় আল্লাহর সুন্নাতের কথা ভুলে যান। দ্রুত ফলাফল লাভের জন্য ব্যস্ত হয়ে যান। তিনি ভাবেন: ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে বা ইসলামের বিজয় আনতে হবে। অমুক বা তমুক পদ্ধতিতে তা আসবে না, বরং আমাদের এ পদ্ধতিতেই এ বিজয় দ্রুত হাতের মুঠোয় এসে যাবে। অমুক পদ্ধতিতে শত বৎসর বা হাজার বৎসর কাজ করলেও ইসলামের বিজয় আসবে না, কিন্তু আমাদের পদ্ধতিতে কাজ করলে অল্প সময়েই তা এসে যাবে। মনে হয় কে কত তাড়াতাড়ি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারল এর উপরেই আল্লাহ নবী-রাসূল ও মুসলমানদের হিসাব নিবেন!!
ফলাফল লাভের উন্মাদনা আবেগী মুমিনকে বিপথগামী করে। মুমিন চায় যে, সমাজ থেকে ইসলাম বিরোধী ও মানবতা বিরোধী সকল অন্যায় ও পাপ দূরীভুত হোক। কোনো মুমিনের মনে হতে পারে যে, এত ওয়ায, বক্তৃতা, বইপত্র, আদেশ নিষেধ ইত্যাদিতে কিছুই হলো না, কাজেই মেরেধরে জোরকরে সব অন্যায় দূর করে ফেলতে হবে। তখন তিনি দাওয়াতের শরীয়ত সম্মত পদ্ধতি ও শরীয়ত নিষিদ্ধ পদ্ধতির মধ্যে বাছবিচার না করে ফলাফলের উন্মাদনায় শরীয়ত নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করতে চেষ্টা করেন।
এ জাতীয় চিন্তভাবনা সবই কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষার সাথে সাংঘষিক। মুমিনের দায়িত্ব নিজের জীবনে দীন প্রতিষ্ঠা ও দীনের দাওয়াত। দাওয়াতের দ্রুত ফলাফলের চিন্তা তো দূরের কথা, কোনো ফলাফলের চিন্তাই মুমিনের দায়িত্ব নয়। অগণিত নবী-রাসূল আজীবন দাওয়াত দিয়েছেন, কিন্তু অতি অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ তাদের দাওয়াত গ্রহণ করেছেন। এতে তাঁদের ‘‘দীন প্রতিষ্ঠার’’ বা ‘‘দাওয়াতের’’ দায়িত্ব পালনের কোনো ঘাটতি হয় নি।
পরবর্তী আলোচনা থেকে আমরা দেখব যে, ‘‘দ্রুত সকল অন্যায় মিটিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার’’ জন্য উদগ্রীব মানুষেরা কখনই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি, বরং সুন্নাত পদ্ধতিতে ন্যায়ের আদেশ, অন্যায়ের নিষেধ বা দাওয়াত ও দীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সমাজ সংস্কারের কর্ম সম্পাদিত হয়েছে। কাজেই মুমিনের দায়িত্ব হলো নিজের জীবন দীন পালনের পাশাপাশি কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত পন্থায় দীনের দাওয়াত দেওয়া। দাওয়াতের দায়িত্ব দুভাবে আঞ্জাম দেওয়া হয়: (১) অরাষ্ট্রীয়, অর্থাৎ ব্যক্তিগত, দলগত বা গোষ্ঠীগতভাবে এবং (২) রাষ্ট্রীয়ভাবে। অরাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার একটিমাত্রই মাধ্যম, তা হলো ‘দাওয়াত’ বা সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দাওয়াতের পাশাপাশি আরো দুটি মাধ্যম রয়েছে: (ক) আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও (খ) প্রয়োজনে শত্রুরাষ্ট্রের কবল থেকে দীন, রাষ্ট্র, জনগণ, দুর্বল মুসলিম বা অমুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জিহাদ বা কিতাল অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ করা। সকল পর্যায়ে ও ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশ হলো সহিংসতা ও সীমালঙ্ঘন বর্জন করা। শুধু সহিংসতা বর্জনই নয়, দাওয়াত, প্রচার, সৎকাজে আদেশ, অন্যায় থেকে নিষেধ ইত্যাদি ‘দ্বীন প্রতিষ্ঠার’ সকল কর্মে ‘অহিংসতা’ দ্বারা ‘সহিংসতা’-র প্রতিরোধ করতে এবং সহিংসতার প্রতিবাদে ‘উত্তম’ আচরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন:
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ
‘‘কথায় কে উত্তম ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা, যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি
আত্মসমর্পনকারীদের অন্তর্ভুক্ত। ভাল এবং মন্দ সমান হতে পারে না। (মন্দ) প্রতিহত কর উৎকৃষ্টতর (আচরণ) দ্বারা; ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত।’’[5]
অন্যত্র ইরশাদ করা হয়েছে:
ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ ۚ نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَصِفُونَ
‘‘মন্দের মুকাবিলা করুন যা উৎকৃষ্টতর তা দিয়ে, তারা যা বলে আমি সে সম্পর্কে বিশেষ অবহিত।’’[6]
বর্তমান বিশ্বে ইসলামী দা‘ওয়াত বা ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্ঠা অনেক সময় ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতিরোধ, অত্যাচার বা সহিংস আচরণের সম্মুখীন হয়। এতে দা‘ওয়াতে লিপ্ত মুসলিমের মধ্যে প্রতিক্রিয়ামূলক ‘সহিংসতা’র আবেগ তৈরি হয়। এর সাথে ‘দ্রুত ফললাভে’ চিন্তা ‘দাওয়াত’ বা ‘দ্বীন প্রতিষ্ঠা’র কর্মে রত ব্যক্তিকে ইসলাম নির্দেশিত এ ‘অহিংস’ পদ্ধতি পরিত্যাগ করে আবেগ নির্দেশিত ‘সহিংস’ পথে যাওয়ার প্ররোচনা দেয়। তিনি ভাবতে থাকেন ‘সহিংসতা’ বা কল্পিত ‘জিহাদ’ই দ্রুত ফললাভের বা ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথ, যদিও প্রকৃত সত্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামের ইতিহাসে ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর সহিংসতা, তথাকথিত ‘জিহাদ’ ও ‘শাহাদতের’ অনেক ঘটনা আছে। তারা সকলেই ‘দ্রুত ফললাভের’ আবেগ নিয়ে বৈধ বা কল্পিত ‘জিহাদে’ ঝাপিয়ে পড়ে ‘শহীদ’ হয়েছেন, কিন্তু কেউই দ্রুত বিজয় তো দূরের কথা কোনো স্থায়ী বিজয়ই অর্জন করতে পারেন নি। বস্ত্তত ইসলামের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, ‘অহিংস’ ও ‘মন্দের মুকাবিলায় উৎকৃষ্টতর’ আচরণই ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও ইসলামের বিজয়ের একমাত্র পথ। এ পদ্ধতিতেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরবের কঠোর হৃদয় যাযাবরদের হৃদয় জয় করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। পরবর্তী সকল যুগে এ পদ্ধতির অনুসরণকারী আলিম ও ‘দাঈ’গণই ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে সর্বোচ্চ অবদান রেখেছেন। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করুন।
[2] সূরা ২৮: কাসাস: ৫৬ আয়াত।
[3] সূরা ১২: ইউসূস: ১০৩ আয়াত।
[4] সূরা ১০: ইউনুস: ৯৯ আয়াত।
[5] সূরা হা মীম সাজদা (ফুসসিলাত): ৩৩-৩৫ আয়াত।
[6] সূরা মুমিনূন, ৯৬ আয়াত।