লগইন করুন
অনেক পাশ্চাত্য পন্ডিত জঙ্গিবাদের জন্য ইসলাম ধর্মকে দায়ী করেন। এদের মধ্যে কেউ মনে করেন, ইসলামে অনেক ভাল কথা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং ইসলামী সভ্যতার সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার সহ-অবস্থান সম্ভব। তবে ইসলামের মধ্যে ভাল বিষয়ের সাথে জিহাদ, ধর্মত্যাগ, বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ক কিছু উগ্র ও অসহিষ্ণু বিষয়ও শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, যেগুলি মানবাধিকার বা সভ্যতার সহঅবস্থান বা বিকাশের বিপক্ষে। এ সকল শিক্ষা থেকেই জঙ্গিবাদের জন্ম। এজন্য জঙ্গিবাদ দমনের জন্য ইসলামের ‘ভাল শিক্ষাগুলির’ প্রসংশা করতে হবে ও সেগুলির বিকাশ ঘটাতে হবে। পাশাপাশি উগ্র বা ‘খারাপ’ শিক্ষার বিস্তার রোধ করতে হবে। ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। এ থেকে ‘উগ্রতা’-র উৎসাহ দিতে পারে এরূপ শিক্ষা বাদ দিতে হবে।
এভাবে মুসলিম সমাজগুলিতে ‘মডারেট’ মুসলিমদের উত্থান ঘটাতে পারলেই জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। অন্য অনেক পাশ্চাত্য পন্ডিত মনে করেন বা দাবি করেন যে, ইসলামের মূল শিক্ষাই ‘‘জঙ্গি’’। তাদের মতে, ইসলাম তার অনুসারীদের অসহিষ্ণুতা শিক্ষা দেয়। ইসলামে জিহাদের নামে অমুসলিমদেরকে হত্যা করার উদাত্ত আহবান জানানো হয়েছে। আর এর ফলেই মুসলিমদের মধ্যে জঙ্গিবাদের উত্থান। তাদের মতে ইসলামী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বন্ধ করার একমাত্র উপায় ইসলাম ধর্মকে নির্মুল অথবা নিয়ন্ত্রণ করা। এরা দাবি করেন যে, ইসলামী সভ্যতার সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংঘাত আবশ্যম্ভাবী। একে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদের উত্থান ‘সভ্যতার সংঘাত’ তত্ত্বের সঠিকত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
ইহূদী-খৃস্টান ধর্মগুরু ও ধর্মীয় উগ্রবাদীরাই শুধু নয়, পাশ্চাত্যের অনেক ‘‘ধর্মনিরপেক্ষ’’ রাষ্ট্রনেতা বা রাজনৈতিক নেতাও বিশ্বাস করেন যে, ইসলাম ও সন্ত্রাস সমার্থক এবং ইসলামকে প্রতিরোধ করাই সন্ত্রাসকে প্রতিরোধ করা। অনেকে চক্ষু লজ্জায় বা ‘ডিপোম্যটিক-রাজনৈতিক’ প্রয়োজনে তা সরাসরি বলেন না। তারা বলেন না যে ‘ইসলামের বিরুদ্ধে’ যুদ্ধ করতে হবে, বরং বলেন, ‘ইসলামী জঙ্গিবাদের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু অনেকেই মনের কথাটি বলে ফেলেন, তাঁরা ‘ইসলামী জঙ্গিবাদের’ বিরুদ্ধে নয়, বরং ‘ইসলামের’ বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে ডেনমার্কের রানী এক বিবৃতিতে বলেন:
We are being challenged by Islam these years- globally as well as locally. It is a challenge we have to take seriously... We have to show our opposition to Islam and we have to, at times, run the risk of having unflattering labels placed on us because there are some things for which we should display no tolerance.
‘‘বর্তমান বছরগুলিতে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে এবং স্থানীয়ভাবে ইসলামের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছি। এ চ্যালেঞ্জকে আমাদের কঠিনভাবে গ্রহণ করতে হবে। ইসলামের প্রতি আমাদের বিরোধিতা আমাদেরকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হবে। প্রয়োজনে এজন্য আমাদেরকে অপ্রশংসনীয় বদনাম গ্রহণের ঝুঁকিও গ্রহণ করতে হবে। (ইসলামের প্রতি বিরোধিতা বা বিদ্বেষ প্রকাশের কারণে
সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, বর্ণবাদী ইত্যাদি খারাপ বিশেষণে ভূষিত হওয়ার ঝুঁকিও মেনে নিতে হবে।) কারণ কিছু কিছু বিষয় আছে যে বিষয়ে আমাদের কোনো নমনীয়তা বা সহনশীলতা প্রদর্শন করা উচিত নয়। (ইসলাম অনুরূপ বিষয় যার প্রতি কোনোরূপ সহশীলতা প্রদর্শন করা যাবে না, যদিও তাতে আমাদেরকে উগ্র, মৌলবাদী বা অনুরূপ কিছু বলা হয়।)’’![1]
এরা মনে করেন, মানব সভ্যতার সংরক্ষণের জন্য জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়, শক্তির মাধ্যমে বিশ্বের সকল মুসলমানকে হত্যা করা, বন্দী করা, জোরপূর্বক খৃস্টান বানানো ও মুসলিম দেশগুলিকে সামরিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। বিশেষত, ইসলামী শিক্ষার বিস্তার রোধ করা।
বর্তমানে আমরা পত্রপত্রিকায় প্রতিনিয়তই দেখতে পাই যে, ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ (?) রাজনীতিবিদ তাদের দেশগুলিতে মসজিদ তৈরি নিষিদ্ধ করতে, মুসলিমদের নাগরিকত্ব প্রদান বন্ধ করতে বা বহিষ্কার করতে সরকারের নিকট প্রকাশ্যে দাবি দাওয়া তুলছেন। উপরন্তু এ সকল দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে তারা নির্বাচনে ভাল ভোটও লাভ করছেন। এছাড়া এরূপ অনেক পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষ (?) রাজনৈতিক নেতা দাবি করছেন যে, ইউরোপে বা আমেরিকায় যদি কোনো সন্ত্রাসী হামলা হয় তবে নিশ্চিত ধরে নিতে হবে যে, মুসলিম সন্ত্রাসীরাই তা করেছে এবং এর জবাবে ক্ষেপনাস্ত্রের মাধ্যমে মক্কা-মদীনা ধ্বংস করে দিতে হবে। আমেরিকার প্রসিদ্ধ ও প্রভাশালী চিন্তাবিদ ও লেখিকা অ্যান কালটার (Ann Coulter) সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনের জন্য সকল মুসলিম দেশ দখল করে মুসলিমদেরকে জোরপূর্বক খৃস্টধর্মে দীক্ষিত করার দাবি জানিয়ে লিখেন: "we should invade their countries, kill their leaders and convert them to Christianity." ‘‘আমাদের উচিত তাদের দেশগুলি আক্রমন করা, তাদের নেতাদেরকে হত্যা করা এবং ধর্মান্তরিত করে তাদেরকে খৃস্টান বানানো।’’[2]
এ সকল গবেষক-পন্ডিতকে হয়ত মুসলিমগণ ‘ইসলাম-বিদ্বেষী’ বলে মনে করতে পারেন, তবে এদের অনেকের ক্ষেত্রেই এরূপ মতপ্রকাশের জন্য বিদ্বেষের চেয়ে অজ্ঞতাই বড় কারণ। এরা দেখছেন যে, কোনো কোনো মুসলিম নির্বিচারে নিরপরাধ মানুষ হত্যা করছে এবং এজন্য তারা ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কুরআনের উদ্ধৃতি পেশ করছে। কাজেই তাঁরা ধারণা করেন যে, কুরআন এরূপই শিক্ষা দিয়ে থাকে। এদের অনেকেই ইসলামের জিহাদ বিষয়ক কিছু নিদের্শ হয়ত পাঠ করেছেন, কিন্তু জিহাদের প্রকৃত অর্থ, শর্ত বা বিধানাবলি জানেন নি। এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিম ধর্ম-প্রচারক বা ধর্মগুরুদের প্রচারণামূলক বইপুস্তকই পাঠ করেছেন, ইসলামী জ্ঞানের সূত্রগুলি থেকে নিরপেক্ষভাবে তথ্য সংগ্রহ করেন নি। বিশেষত ইসলাম বিদ্বেষী অপপ্রচারের জোয়ারের মধ্যে নিরপেক্ষভাবে তথ্য সংগ্রহ বা যাচাই করা অনেকের জন্যই খুব কঠিন কর্ম। এজন্য প্রচলিত প্রচারের ভিত্তিতে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, জঙ্গিবাদের জন্য ইসলামই দায়ী এবং ইসলামকে নিয়ন্ত্রণ করাই এ সমস্যা দূরীকরণের একমাত্র উপায়।
মুসলমানের সন্ত্রাসের জন্য তার ধর্ম ইসলামকে অভিযুক্ত করার ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। বিশ্বের সর্বত্র ও সকল জাতির মধ্যেই সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটছে। অন্য কোনো ধর্মের সন্ত্রাসীর সন্ত্রাসের জন্য তার ধর্মকে কখনোই দায়ী করা হয় না। কিন্তু মুসলিমের সন্ত্রাসের জন্য ইসলামকে ঢালাওভাবে দায়ী করা হয়। আসাম, মনিপুর, মিজোরাম, বিহার, শ্রীলঙ্কা, আয়ারল্যান্ড, স্পেন, ফ্রান্স বা অন্য কোনো স্থানের হিন্দু, খৃস্টান, বৌদ্ধ, ক্যাথলিক, প্রটেসট্যান্ট বা অন্য ধর্মের সন্ত্রাসীদের বিষয়ে তাদের ধর্ম উল্লেখ করা হয় না বা ধর্মকে দায়ী করা হয় না। তাদের দেশ বা জাতির পরিচয় দিয়ে বলা হয় আইরিশ, তামিল, মনিপুরী, আসামীয়, বাস্ক, ইটালীয়, স্পেনীয় বা জার্মান সন্ত্রাসী। কিন্তু কোথাও কোনো মুসলিম এরূপ করলে তার ধর্মকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, ফিলিপাইন, ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান বা কাশ্মীরের ইসলামী বা মুসলিম সন্ত্রাসী...। অথচ সকল ক্ষেত্রেই সন্ত্রাসের কারণ ও দাবী একই। সকলেই তাদের ধারণা অনুসারে অধিকার রক্ষার সাধারণ পথে ব্যর্থ হয়ে সন্ত্রাসের পথ ধরে এবং সকলেই সন্ত্রাসের বৈধতা ও অনুপ্রেরণার জন্য নিজেদের ধর্মের বাণী ও শিক্ষা ব্যবহার করে। শুধু ধর্মাবলম্বীদের সন্ত্রাসই নয়, একান্তই ধর্মের নামে ও ধর্মের জন্য হত্যা, গণহত্যা ও সন্ত্রাসের অগণিত ঘটনা রয়েছে, যেগুলিতে কখনোই ধর্মকে দায়ী করা হয় না, বরং সন্ত্রাসে লিপ্ত মানুষদেরকে দায়ী করা হয়। সামান্য একটি তালিকা দেখুন:
(১) ধর্মের নামে ও একান্তই ধর্মীয় প্রেরণায় ইউরোপের খৃস্টানগণ বিগত প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে চার্চের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ও তত্ত্বাবধানে এবং কখনো কখনো খৃস্টান শাসকদের নির্দেশে বিভিন্নভাবে নিরস্ত্র সাধারণ ইহূদীদেরকে নির্যাতন ও হত্যা করেছেন। এর মধ্যে অনেক ‘‘গণহত্যা’’র ঘটনা রয়েছে যেগুলিতে একসাথে হাজার হাজার ইহূদীকে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৩৯-১৯৪৫) হলোকস্ট (holocaust) এ প্রায় ৬ মিলিয়ন ইহূদী নারী, পুরুষ ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
(২) একান্তু ধর্মীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইউরোপের খৃস্টানগণ স্পেনে ও ক্রুসেড যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার অযোদ্ধা নিরস্ত্র মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশুকে চরম বর্বরতার সাথে হত্যা করেছে। এর মধ্যে অনেক গণহত্যার ঘটনা রয়েছে। সর্বশেষ ঘটনা বসনিয়ায় (Bosnia and Herzegovina) সার্ব খৃস্টানগণ কর্তৃক মুসলিম হত্যাযজ্ঞ। এ হত্যাযজ্ঞের অনেক ঘটনার মধ্যে অন্যতম স্রেব্রেনিসায় (Srebrenica) গণহত্যা। একান্তই ধর্মীয় প্রেরণায় এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ ও জাতিগত প্রতিহিংসার ভিত্তিতে জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত নিরাপদ আশ্রয়ে জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর নাকের ডগায় ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে সার্ব খৃস্টানগণ স্রেব্রেনিসায় ৮,০০০ নিরস্ত্র অযোদ্ধা মুসলিম যুবক, কিশোর ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সর্বোপরি এ গণহত্যার বিষয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার প্রাথমিক ঠান্ডা প্রতিক্রিয়ার কারণ বোধহয় একমাত্র এ-ই যে, ঘাতকগণ ছিল খৃস্টান আর নিহতরা ছিল মুসলমান। এ বিষয়ে এনকার্টার (The Bosnian War Crimes Investigations) রিপোর্টে বলা হয়েছে: Although the ICTY's inquiry focuses on war crimes committed by the warring parties within Bosnia, it has also raised serious questions among human rights observers about the role of the United States and other Western powers. Specifically, did U.S. intelligence agencies have advance knowledge of the Bosnian Serb attack on Srebrenica and fail to warn the United Nations (UN) forces guarding the city? Why were the U.S. and other Western intelligence agencies slow in releasing evidence of Bosnian Serb war crimes during the nearly four-year-long conflict? And why have Western officials in charge of enforcing the peace accord failed to arrest the two men indicted by the ICTY for masterminding the Bosnian Serb campaign of ethnic cleansing—the organized program of mass murder, rape, and destruction of homes and places of worship? ‘‘যদিও আই.সি.টি.ওয়াই (International Criminal Tribunal for the Former Yugoslavia) -এর তদন্ত মূলত বসনিয়ার যুদ্ধরত পক্ষগুলির যুদ্ধপরাধ উদ্ঘাটনের জন্য, তা সত্ত্বেও এ ট্রাইবুনাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য শক্তির ভূমিকা সম্পর্কে মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের মধ্যে গুরুতর কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। বিশেষত, স্রেব্রেনিসায় সার্বদের আক্রমন সম্পর্কে অগ্রিম কোনো তথ্য কি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলির কাছে ছিল? তা সত্ত্বেও কি তারা এ শহর রক্ষায় নিয়োজিত জাতিসঙ্ঘ বাহিনীকে সে তথ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছিল? প্রায় চার বছর দীর্ঘ সংঘাতের সময়ে বোসনিয়ায় সার্বদের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক তথ্যপ্রমাণাদি প্রকাশ করতে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলি এমন ধীরতা অবলম্বন করল কেন? যে সকল পশ্চিমা কর্মকর্তা শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলেন তারা এ গণহত্যা, গণধর্ষণ ও বাড়িঘর ও উপাসনালসমূহের ধ্বংসযজ্ঞের মূল পরিকল্পনাকারী নায়ক হিসেবে আইসিটিওয়াই যে দু ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছিল তাদেরকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হলেন কেন?’’
(৩) ২০০২ সালে গুজরাট ও কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং পুলিশের প্রত্যক্ষ সহায়তা জঙ্গি হিন্দুরা প্রায় দুই হাজার মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে, হাজার হাজার মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করা হয় ও হাজার হাজার মুসলিম নাগরিকদের বাড়িঘর ও সম্পদ লুট করা হয়।
(৪) ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসের অন্যতম ঘটনা আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির (IRA)) সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। বৃট্রিশদের সাথে আইরিশদের শত্রুতা ও বিরোধিতার মূল উৎস ধর্ম। বৃটিশগণ প্রটেস্ট্যান্ট ও আইরিশগণ ক্যাথলিক। ইউরোপের ইতিহাসে প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যকার ভয়ঙ্কর যুদ্ধগুলি ছাড়াও অনেক গণহত্যার ঘটনা সুপরিচিত। তারই অংশ হিসেবে এ দু দেশের মানুষের মধ্যে শতশত বছরের পুঞ্জিভুত বিদ্বেষের একটি প্রকাশ বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা লাভের জন্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়া।
লক্ষণীয় যে, উত্তর আয়ারল্যন্ডের প্রটেস্ট্যান্টগণ সর্বদা বৃটিশ শাসনের পক্ষে থেকেছে আর আই. আর. এর সন্ত্রাস পরিচালিত হয়েছে অনেক সময় এ সকল আইরিশ প্রটেস্ট্যান্টদের বিরুদ্ধে। বিশেষত ১৯৭০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আইআরএর গুপ্তহত্যা, বোমা হামলা, গাড়ি বোমা, বাণিজ্যিক কেন্দ্রে বোমা বিস্ফোরণ ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে শতশত বেসামরিক নিরস্ত্র নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছেন এবং অগণিত মানুষ আহত হয়েছেন।
(৫) ধর্মভিত্তিক ও ধর্মীয় সন্ত্রাসের অন্যতম উদাহরণ যায়নবাদী (Zionist) ইহূদীদের সন্ত্রাস। ফিলিস্তিনে ইহূদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এরা অগণিত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়েছে। ধর্মের নামে ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাস করে তারা অগণিত নিরস্ত্র মানুষ হত্য কারেছে এবং গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছে। এ সকল সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মধ্যে ছিল মেনাহেম বেগিনের নেতৃত্বে কিং ডেভিড হোটেল উড়িয়ে দেওয়া ও দির ইয়াসিন নামক গ্রামের নিরস্ত্র নিরীহ মানুষদের গণহত্যা।
মেনাহেম বেগিনের নেতৃত্বে ২২ জুলাই ১৯৪৬ সালে জেরুজালেমের কিং ডেভিড হোটেলে বোমা হামলা চালিয়ে ইরগুন যাভি লিয়াম (the Irgun Zvai Le’umi: National Military Organization) নামক ইহূদী সন্ত্রাসী জঙ্গি সংগঠন নিরস্ত্র শিশু ও মহিলা সহ আরব, বৃটিশ ও ইহূদী শতাধিক নিরস্ত্র অযোদ্ধা মানুষকে হত্যা করে এবং আরো অনেক মানুষ আহত হয়।
এনকার্টা এনসাইক্লোপীডিয়ার এ ঘটনাকে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ-জমকালো সন্ত্রাসী ঘটনা (The most spectacular terrorist incident) এবং বিংশ শতাব্দীর ভয়ঙ্করতম সন্ত্রাসী ঘটনা (the most deadly terrorist incidents of the 20th century) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ সন্ত্রাসী মেনাহেম বেগিন পরবর্তীকালে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছে এবং তাকে শান্তি তে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়েছে।
দির ইয়াসিনের বর্বর হত্যাকান্ডের নিন্দাজ্ঞাপন করে আলবার্ট আইনস্টাইন এবং ১৮ জন বিশিষ্ট ইহূদী নিউইয়র্ক টাইমসে চিঠি লিখেন ৪ ডিসেম্বর ১৯৪৮। এ চিঠিতে তারা বলেন: ‘‘আরব গ্রাম দির ইয়াসিন-এ তাদের (মেনাহেম বেগিন ও তার দলের) আচরন এ পার্টির নির্মমতার এক হৃদয় বিদারক দৃষ্টান্ত। প্রধান সড়ক থেকে দূরে ইহূদী ভূমি বেষ্টিত এই গ্রামবাসী কোন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় নি বরং আরর গোষ্ঠীরা যারা এই গ্রামকে তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল তাদের তারা তাড়িয়ে দিয়েছে। সন্ত্রাসী দল ৯ এপ্রিল এই শান্তিকামী গ্রামবাসীর উপর আক্রমন করে। এরা কোনোভাবেই যুদ্ধের প্রয়োজনে কোনো সামরিক লক্ষ্য ছিল না। এই হামলায় গ্রামের অধিকাংশ অধিবাসী (২৪০ জন) নিহত হন, এবং জেরুজালেমের রাস্তায় বন্দী হিসেবে হটিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের কয়েকজনকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। ... সন্ত্রাসীরা এই বর্বরোচিত ঘটনার জন্য লজ্জিত হওয়া তো দূরের কথা, এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় তারা গর্ববোধ করে ও এটি ব্যাপকভাবে প্রচার করে এবং দেশে উপস্থিত সকল বিদেশী সংবাদ সংস্থাকে দির ইয়াসিন-এ তাদের কৃত ধ্বংসযজ্ঞ ও লাশের স্ত্তপ দেখার আমন্ত্রণ জানায়।’’[3]
এরূপ ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসের অগণিত উদাহরণ আমরা সমকালীন ইতিহাসে দেখতে পাই। এ সকল ঘটনাকে সন্ত্রাসী ও ন্যাক্কারজনক ঘটনা বলে অনেকে স্বীকার করেছেন ও করছেন। কিন্তু কখনোই এ সকল সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য সন্ত্রাসীদের ধর্মকে দায়ী করা হয় নি। যদিও এ সকল সন্ত্রাসী কর্ম একান্তই ধর্মীয় প্রেরণায়, ধর্মীয় বিদ্বেষে বা ধর্মগ্রন্থের বাণীকে ভিত্তি করে করা হয়েছে, তবুও কখনোই তাদের বিষয়ে খৃস্টান সন্ত্রাসী, ক্যাথলিক সন্ত্রাসী, প্রটেস্ট্যান্ট সন্ত্রাসী, অর্থোডক্স সন্ত্রাসী, হিন্দু সন্ত্রাসী, ইহূদী সন্ত্রাসী বা অনুরূপ কিছু বলা হয় না। বরং তাদের জাতি, গোষ্ঠী বা অন্যান্য পরিচয়কে তুলে ধরা হয়। সর্বোপরি কখনোই তাদের সন্ত্রাসী বা মানবতা বিরোধী কর্মকান্ডের জন্য তাদের ধর্মকে দায়ী করা হয় না।
সন্ত্রাস উদযাপনও করা হচ্ছে। ১৯৪৬ সালে কিং ডেভিড হোটেলের এ সন্ত্রাসী ঘটনার ৬০ বর্ষপূর্তি ইস্রাইলে ঘটা করে উদযাপন করা হয়। ২০০৬ এর জুলাই মাসে ইস্রায়েল রাষ্ট্র প্রশাসন ও জনগণ এ সন্ত্রাসী ঘটনার ৬০ বৎসর পূর্তি উপলক্ষে ‘‘জয়ন্তী’’ উৎসব পালন করে। এ বিষয়ে ভারতের জাতীয় দৈনিক ‘দি হিন্দু’র ২৪/৭/২০০৬ তারিখের অনলাইন সংস্করণে ‘‘সন্ত্রাস উদযাপন: ইসরাইলী স্টাইল (Celebrating Terror, Israeli-style) প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।[4]
অনেকেই এরূপ গণহত্যা ও সন্ত্রাস উদযাপনের নিন্দা করেছেন, কিন্তু কেউই এজন্য ইহূদী ধর্ম, ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মগ্রন্থকে দায়ী করেন নি। কিন্তু ইহূদী রাষ্ট্রের বর্বর সন্ত্রাস ও গণহত্যার প্রতিবাদে অন্য কোনো উপায় না পেয়ে যখন কোনো ফিলিস্তিনী সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয় তখন তার সন্ত্রাসকে ‘‘ইসলামী সন্ত্রাস’’ ও তাকে ‘‘মুসলিম সন্ত্রাসী’’ বলে উল্লেখ করা হয়। উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখছি যে, জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাস সকল ধর্মের, দেশের ও মতাদর্শের মানুষদের মধ্যে বিরাজমান। এ বিষয়ে মুসলিমদের ‘‘শেয়ার’’ নিতান্তই সীমিত। আর ইহূদী, আইরিশ, জার্মান, সার্ব, তামিল, আসামীয়, মনিপুরি, নেপালী, তিববতী, চীনা, আমেরিকান ও অন্যান্য সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসের জন্য যেমন ইহূদী, খৃস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্ম দায়ী নয়, তেমনি মুসলিমদের সন্ত্রাসের জন্য কখনোই তার ধর্ম দায়ী নয়। কারো অপরাধের জন্য তার ধর্মকে দায়ী করা শুধু অপরাধই নয়, বরং তা অপরাধীর পক্ষে জনমত তৈরি করে এবং অপরাধ দমন বাধাগ্রস্ত করে। আমরা পরবর্তী অনুচ্ছেদে তা আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।
[2] The Wisdom of Ann Coulter, a Newsnetwork feature, The Independent (Dhaka), 8/9/2006, p 12.
[3] আজহারুল ইসলাম এ. কে. এম, নিন্দিত বিশ্ব নন্দিত গন্তব্য, পৃ. ৫৮-৫৯ (from www.rense.com/general127/let.htm)
[4] আজহারুল ইসলাম, নিন্দিত বিশ্ব, পৃ. ৯২-৯৩।