লগইন করুন
জঙ্গি ও জঙ্গিবাদ শব্দদ্বয় ইংরেজি (militant, militancy) শব্দদ্বয়ের অনুবাদ। ইদানিং এগুলি আমাদের মধ্যে অতি পরিচিত ও অতিব্যবহৃত। শব্দগুলি কিছু দিন আগেও এত প্রচলিত ছিল না। আর আভিধানিক বা ব্যবহারিকভাবে এগুলি নিন্দনীয় বা খারাপ অর্থেও ব্যবহৃত হতো না। শাব্দিক বা রূপক ভাবে যোদ্ধা, সৈনিক বা যুদ্ধে ব্যবহৃত বস্ত্ত বুঝাতে এ শব্দগুলি ব্যবহৃত হতো।
বৃটিশ ইন্ডিয়ার কমান্ডার ইন চিফকে ‘জঙ্গিলাট’ বলা হতো।[1]
শক্তিমত্ত বা উগ্র বুঝাতেও এ শব্দ ব্যবহার করা হয়। (Oxford Advanced Learner's Dictionary) -তে বলা হয়েছে: militant. adj. favouring the use of force or strong pressure to achieve one's aim. ...militant: n. militant person, esp. in politics. ‘‘মিলিট্যান্ট (জঙ্গি): যে ব্যক্তি তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য শক্তি বা জোরালো প্রভাব ব্যবহার করা সমর্থন করে।....’’[2]
Merriam-Wepster's Collegiate Dictionary --তে বলা হয়েছে: militant 1: engaged in warfare or
combat : fighting. 2: aggressively active (as in a cause). অর্থাৎ: মিলিট্যান্ট (জঙ্গি): যুদ্ধ বা সম্মুখসমরে লিপ্ত ব্যক্তি, যুদ্ধরত। উগ্রভাবে সক্রিয়।’’ দ্বিতীয় অর্থটিকে আরো একটু ব্যাখ্যা করে মাইক্রোসফট এনকার্টা অভিধানে মিলিট্যান্ট বা জঙ্গি শব্দের অর্থে বলা হয়েছে: (aggressive: extremely active in the defense or support of a cause, often to the point of extremism): ‘‘আগ্রাসী, কোনো বিষয়ের পক্ষে বা সমর্থনে চরমভাবে সক্রিয়, যা প্রায়শ চরমপন্থা পর্যন্ত পৌঁছায়।’’
এ সকল অর্থ কোনোটিই সরাসরি বে-আইনী অপরাধ বুঝায় না। এ সকল অর্থে আমাদের দেশের সকল রাজনৈতিক, আদর্শিক, পেশাজীবি ও সামাজিক দলই ‘‘মিলিট্যান্ট’’ বা ‘‘জঙ্গি’’। কারণ সকলেই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য শক্তি বা ‘প্রেসার’ প্রয়োগ পছন্দ করেন এবং সকলেই তাদের নিজেদের আদর্শ ও স্বার্থ রক্ষায় বা প্রতিষ্ঠায় ‘‘উগ্রভাবে সক্রিয়’’।
কিন্তু আমরা বর্তমানে ‘জঙ্গি’ বলতে বুঝি বে-আইনী সহিংসতা ও খুনখারাপি। এ অর্থে প্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত পরিভাষা সন্ত্রাস (terrorism) । কিন্তু আমরা বাংলায় পত্র-পত্রিকা, বক্তৃতা-বিবৃতি ও লেখালেখি থেকে বুঝি যে, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও চরমপন্থার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যারা সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র বা সর্বহারার রাজত্ব প্রতিষ্ঠার নামে উগ্রতা, অস্ত্রধারণ, সহিংসতা বা খুনখারাপিতে লিপ্ত হন তাদেরকে আমরা ‘‘চরমপন্থী’’ (extremist) বলি। আর যারা ইসলামের নামে বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে উগ্রতা, অস্ত্রধারণ, সহিংসতা বা খুনখারাপিতে লিপ্ত তাদেরকে বলি ‘‘জঙ্গি’’। আর যারা প্রচলিত সাধারণ রাজনৈতিক দলের নামে বা কোনো দল, মতবাদ বা আদর্শের নাম না নিয়ে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য উগ্রতা, অস্ত্রধারণ, সহিংসতা বা খুনখারাপিতে লিপ্ত হয় তাদেরকে সন্ত্রাসী বলি।
এরূপ বিভাজন বা পার্থক্যের কোনো ভাষাগত বা তথ্যগত ভিত্তি আছে বলে জানা যায় না। বরং ইংরেজি ব্যবহার থেকে বুঝা যায় যে, militant/ militancy জঙ্গি বা জঙ্গিবাদ শব্দ সরাসরি ‘বে-আইনী কর্ম’ বা অপরাধ বুঝায় না। বরং বেআইনী বা আইনসম্মত যে কোনো প্রকারের উগ্রতা বুঝাতে (militant, militancy): জঙ্গি ও জঙ্গিবাদ শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হয়। চরমপন্থা ও চরমপন্থী (extremism/extremist) শব্দদ্বয়ও সরাসরি অপরাধ বা বে আইনী কর্মকান্ড বুঝায় না। পক্ষান্তরে সন্ত্রাস (terrorism) শব্দটিই সরাসরি অপরাধ ও বে-আইনী কর্মকান্ড বুঝায়।
এভাবে আমরা দেখছি যে, ‘‘জঙ্গিবাদ’’ শব্দটি কোনোরূপ ভাষাগত ভিত্তি ছাড়াই ‘ইসলামের নামে সহিংসতা’ অর্থে ব্যবহার হচ্ছে। অথচ মূল ভাষাগত অর্থে ইসলামের নামে, অন্য কোনো ধর্মের নামে, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে, গণতন্ত্রের নামে, সমাজতন্ত্রের নামে, অন্য যে কোনো মতবাদ, আদর্শ বা অধিকারের নামে উগ্রতার আশ্রয় গ্রহণকারী মানুষকে জঙ্গি বলা চলে এবং তার মতামতকে জঙ্গিবাদ বলা চলে। ইংরেজি ব্যবহার এটিই প্রমাণ করে।
বস্ত্তত জঙ্গিবাদ বলতে আমরা যা বুঝাচ্ছি ও বুঝছি সে অর্থটি প্রকাশের জন্য সঠিক শব্দ হলো সন্ত্রাস। সন্ত্রাস-এর সাধারণ পরিচয় দিয়ে সন্ত্রাস বিষয়ক আলোচনার শুরুতে এনসাইক্লোপিডীয়া ব্রিটানিকায় বলা হয়েছে: terrorism: the systematic use of violence to create a general climate of fear in a population and thereby to bring about a particular political objective: ‘‘সন্ত্রাস: নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সমন্বিতভাবে সহিংসতার ব্যবহারের মাধ্যমে কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা।’’
মার্কিন সরকারের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফ. বি. আই) terrorism বা সন্ত্রাসের সংজ্ঞায় বলেছে: "the unlawful use of force and violence against persons or property to intimidate or coerce a government, the civilian population, or any segment thereof, in furtherance of political or social objectives: কোনো সরকার বা সাধারণ নাগরিকদেরকে ভয় দেখিয়ে রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ব্যক্তি বা সম্পদের বিরুদ্ধে ক্ষমতা বা সহিংসতার বেআইনি ব্যবহার করা।’’
এ সংজ্ঞায় কর্মের দিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে। শক্তি, ক্ষমতা বা সহিংসতার ব্যবহার যদি বে-আইনী হয় তবে তা ‘সন্ত্রাস’ বলে গণ্য হবে। আর যদি তা ‘আইন-সম্মত’ হয় তবে তা ‘সন্ত্রাস’ বলে গণ্য হবে না। এখানে সমস্যা আইন ও বে-আইন নির্ণয় নিয়ে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশ ইরাকে ‘রাজনৈতিক পরিবর্তন’, ‘স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি আনয়ন’, ‘মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা’ ইত্যাদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সরকার ও জনগণের বিরুদ্ধে ‘শক্তি ও সহিংসতা’ ব্যবহার করেছে এবং করছে। এ ব্যবহারকে তারা ‘আইনসম্মত’ ও তাদের মৌলিক অধিকার ও দায়িত্ব বলে মনে করছেন। কাজেই তারা একে সন্ত্রাস বলে মানতে রাজি নন, যদিও বিশ্বের অনেক মানুষই একে সন্ত্রাস বলেই মনে করছেন। পক্ষান্তরে ইরাকের প্রতিরোধ যোদ্ধাগণ ‘‘বিদেশী দখলদাত্বি’’ মুক্ত হতে মার্কিন সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে ‘‘শক্তি ও সহিংসতা’’ ব্যবহার করছেন এবং আফগানস্থানে তালিবানগণ রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন সাধনের উদ্দেশ্যে আফগান সরকারের সেনাবাহিনী, কর্মকর্তা ও বিদেশী সৈন্যদের বিরুদ্ধে ‘শক্তি ও সহিংসতা’ ব্যবহার করছেন। তারা তাদের এ কর্মকে আইনসঙ্গত দায়িত্ব বলে মনে করেন, পক্ষান্তরে অন্যরা একে ‘সন্ত্রাস’ বলে গণ্য করছেন। এভাবে আমরা দেখছি যে, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীকে চিহ্নিত করা কঠিন এবং এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ প্রায় অসম্ভব। এজন্য অন্য অনেক সমাজবিজ্ঞানী কর্মের উপর নির্ভর না করে আক্রান্তের উপর নির্ভর করে সন্ত্রাসকে সংজ্ঞায়িত করতে চেষ্টা করেছেন। তাদের ভাষায়: "terrorism is premeditated, politically motivated violence perpetrated against noncombatant targets রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে পূর্বপরিকল্পিতভাবে অযোদ্ধা লক্ষ্যের বিরুদ্ধে সহিংসতা সন্ত্রাস।’’
মার্কিন সরকার এ সংজ্ঞা গ্রহণ করেছেন বলে এনসাইক্লোপীডিয়া ব্রিটানিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ সংজ্ঞার দ্বারা সন্ত্রাস বা সন্ত্রাসী চিহ্নিত করাও বিতর্কিত হতে বাধ্য। নিরস্ত্র ফিলিস্তিনী যুবকগণ যখন সশস্ত্র ইসরায়েলী সৈন্যদের প্রতি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন অথবা ফিলিস্তিনী মুক্তিযোদ্ধাগণ যখন সশস্ত্র ইসরায়েলীয় সৈন্যদেরকে আক্রমন করেন, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য বিশ্ব তাকে সন্ত্রাস বলে আখ্যায়িত করে। অথচ ‘অযোদ্ধা’ নিরস্ত্র ফিলিস্তিনী শিশু ও নারীপুরুষদের প্রতি ইসরায়েলী সৈন্যদের গুলি ছোড়া, বোমা নিক্ষেপ ইত্যাদি কর্মকে তারা সন্ত্রাস বলে গণ্য করেন না। বরং আত্মরক্ষার স্বাভাবিক অধিকার বলে দাবি করেন।
ইরাকে প্রতিরোধ যোদ্ধা বা শিয়া-সুন্নি সংঘাতে লিপ্ত বিভিন্ন দল নিরস্ত্র অযোদ্ধা মানুষদের হত্যা করলে তাকে সকলেই সন্ত্রাস বলে গণ্য করেন। কিন্তু মার্কিন বাহিনী ফালুজা এবং অন্যান্য স্থানে অযোদ্ধা নিরস্ত্র মানুষদেরকে হত্যা করলে তাকে সন্ত্রাস বলে কখনোই স্বীকার করা হয় না।
এভাবে আমরা দেখছি যে, যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন, কোনো মানুষ বা মানবগোষ্ঠীকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। সর্বোপরি, যুগে যুগে সকল স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনসহ বিভিন্ন জাতি, দল বা রাষ্ট্র এরূপ সহিংসতার ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের স্বাধীনতা, মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করেছেন। আধুনিক ইতিহাসে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মী, আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস, তামিল টাইগার, পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতাকামী দলসমূহ ও অন্যান্য অনেক দল ও সংগঠন তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সন্ত্রাসী কর্মান্ডের আশ্রয় নিয়েছে ও নিচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে সকল রাষ্ট্র, এমনকি জাতিসংঘও এরূপ অনেক ‘সন্ত্রাসী’ কর্মকান্ড সমর্থন করেছে এবং সন্ত্রাসী সংগঠনগুলিকে সাহায্য করেছে। যেমন হিটলালের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ফরাসীদের ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘সহিংস’ প্রতিরোধ আন্দোলন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ‘সহিংস’ ও ‘সন্ত্রাসী’ প্রতিরোধ আন্দোলন।
আরো লক্ষণীয় যে, স্বাধীনতা আন্দোলন ও প্রতিরোধ যুদ্ধকে ‘‘সন্ত্রাস’’ বলে আখ্যায়িত করা স্বৈরাচার, দখলদার বা সাম্রাজ্যবাদীদের চিরচারিত নিয়ম। নেপালের মাওবাদীদেরকে সন্ত্রাসী তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। কিন্তু জনগণ তাদেরকেই পছন্দ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সর্বদা ‘‘সন্ত্রাসী’’ বলে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। এ জন্য বলা হয়: "One man's terrorist is another man's freedom fighter" যুদ্ধের ক্ষেত্রেও উভয় পক্ষ প্রতিপক্ষের সৈন্য ও নাগরিকদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারে সচেষ্ট থাকে। তবে সন্ত্রাসের সাথে যুদ্ধের মৌলিক পার্থক্য হলো, সাধারণ যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধ উভয় ক্ষেত্রেই যোদ্ধারা মুলত যোদ্ধা বা যুদ্ধ বিষয়ক লক্ষ্যবস্ত্ততে আঘাত করতে সচেষ্ট থাকে এবং সামরিক বিজয়ই লক্ষ্য থাকে। পক্ষান্তরে সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে সামরিক বিজয় উদ্দেশ্য থাকে না। এক্ষেত্রে মূল উদ্দেশ্যই হলো সামরিক অসামরিক নির্বিচারে সকল লক্ষ্যবস্ত্ততে আঘাত করে ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা। "Terrorism proper is thus the systematic use of violence to generate fear, and thereby to achieve political goals, when direct military victory is not possible. This has led some social scientists to refer to guerrilla warfare as the 'weapon of the weak' and terrorism as the 'weapon of the weakest'." এজন্য মূলত সন্ত্রাস হলো যেখানে সামরিক বিজয় সম্ভব নয় সেখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সুশৃঙ্খলিতভাবে সহিংসতার ব্যবহারের মাধ্যমে ভীতি সঞ্চার করা। এজন্য কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন যে, গেরিলা যুদ্ধ দুর্বলের অস্ত্র এবং সন্ত্রাস দুর্বলতমের অস্ত্র।[3]
[2] A.S Hornby, Oxford Advanced Learner’s Dictionary, P 738.
[3] Encyclopaedia Britannica, CD Version, 2005, Article: Terrorism