লগইন করুন
আল্লাহ্ তা‘আলার দেয়া কল্যাণময় বিধানকে লঙ্ঘন করে মানব রচিত যে কোন বিধানের আলোকে বিচার কার্য পরিচালনা বা গ্রহণ করাও আরেকটি কবীরা গুনাহ্। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَمَنْ لَّمْ يَحْكُمْ بِمَآ أَنْزَلَ اللهُ فَأُوْلَآئِكَ هُمُ الْكَافِرُوْنَ»
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার দেয়া বিধানানুযায়ী বিচার করে না সে তো কাফির’’। (মা’য়িদাহ্ : ৪৪)
আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন:
«وَمَنْ لَّمْ يَحْكُمْ بِمَآ أَنْزَلَ اللهُ فَأُوْلَآئِكَ هُمُ الظَّالِـمُوْنَ»
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার দেয়া বিধানানুযায়ী বিচার করে না সে তো জালিম’’। (মা’য়িদাহ্ : ৪৫)
তিনি আরো বলেন:
«وَمَنْ لَّـمْ يَحْكُمْ بِمَآ أَنْزَلَ اللهُ فَأُوْلَآئِكَ هُمُ الْفَاسِقُوْنَ»
’’যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার দেয়া বিধানানুযায়ী বিচার করে না সে তো ফাসিক্ব তথা ধর্মচ্যুত নাফরমান’’। (মা’য়িদাহ্ : ৪৪)
আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আন মাজীদের মধ্যে মানব রচিত আইন গ্রহণকারীদেরকেও ঈমানশূন্য তথা কাফির বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِيْنَ يَزْعُمُوْنَ أَنَّهُمْ آمَنُوْا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيْدُوْنَ أَنْ يَّتَحَاكَمُوْا إِلَى الطَّاغُوْتِ وَقَدْ أُمِرُوْا أَنْ يَّكْفُرُوْا بِهِ، وَيُرِيْدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُّضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيْدًا،.. فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُوْنَ حَتَّى يُحَكِّمُوْكَ فِيْمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوْا فِيْ أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا»
‘‘আপনি কি ওদের ব্যাপারে অবগত নন? যারা আপনার প্রতি অবতীর্ণ কিতাব ও পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের উপর ঈমান এনেছে বলে ধারণা পোষণ করছে, অথচ তারা তাগূতের (আল্লাহ্ বিরোধী যে কোন শক্তি) ফায়সালা কামনা করে। বস্ত্তত: তাদেরকে ওদের বিরুদ্ধাচরণের আদেশ দেয়া হয়েছে। শয়তান চায় ওদেরকে চরমভাবে বিভ্রান্ত করতে। ... অতএব আপনার প্রতিপালকের কসম! তারা কখনো ঈমানদার হতে পারে না যতক্ষণ না তারা আপনাকে নিজেদের আভ্যন্তরীণ বিরোধের বিচারক বানিয়ে নেয় এবং আপনার সকল ফায়সালা নি:সঙ্কোচে তথা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়’’। (নিসা’ : ৬০-৬৫)
তবে মানব রচিত বিধান কর্তৃক বিচার কার্য পরিচালনা করার কয়েকটি পর্যায় রয়েছে। যা নিম্নরূপ:
ক. যে বিচারক বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ্ তা‘আলার বিধান বর্তমান যুগে বিচার কার্য পরিচালনার জন্য কোনভাবেই উপযোগী নয় তা হলে সে কাফির। এ ব্যাপারে সকল মুসলিমের ঐকমত্য রয়েছে। কারণ, সে আল্লাহ্ তা‘আলার বিধানকে অস্বীকার করেছে যা নিশ্চিত কুফরি।
খ. যে বিচারক বিশ্বাস করে যে, মানব রচিত বিধানই বর্তমান যুগে বিচার কার্য পরিচালনার জন্য অত্যন্ত উপযোগী; আল্লাহ্ তা‘আলার বিধান নয়, চাই তা সর্ব বিষয়েই হোক অথবা শুধুমাত্র নব উদ্ভাবিত বিষয়াবলীতে, তা হলে সেও কাফির। এ ব্যাপারেও সকল মুসলিমের ঐকমত্য রয়েছে। কারণ, সে মানব রচিত বিধানকে আল্লাহ্ তা’লার বিধানের উপর প্রাধান্য দিয়েছে, যা কুফরি।
গ. যে বিচারক বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ্ তা‘আলার বিধান যেমন বর্তমান যুগে বিচার কার্য পরিচালনার জন্য উপযোগী তেমনিভাবে মানব রচিত বিধানও, তা হলে সেও কাফির। কারণ, সে সৃষ্টিকে স্রষ্টার সমপর্যায়ে দাঁড় করিয়েছে যা শির্ক তথা কুফরিও বটে।
ঘ. যে বিচারক বিশ্বাস করে যে, বর্তমান যুগে আল্লাহ্ তা‘আলার বিধানের আলোকে যেভাবে বিচার কার্য পরিচালনা করা সম্ভব তেমনিভাবে মানব রচিত যে কোন বিধানের আলোকেও বিচার কার্য পরিচালনা করা সম্ভব তা হলে সেও কাফির। যদিও সে এ কথা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ্ তা‘আলার বিধানই সর্বোত্তম। কারণ, সে নিশ্চিত হারাম বস্ত্তকে হালাল মনে করছে। যা কুফরিরই অন্তর্গত।
ঙ. যে বিচারক মনে করে যে, বর্তমান যুগের শরীয়ত বিরোধী আদালতসমূহই মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল; ইসলামী শরীয়ত নয় তা হলে সেও কাফির। কারণ, সেও নিশ্চিত হারাম বস্ত্তকে হালাল মনে করছে। যা কুফরিরই অন্তর্গত।
চ. যে গ্রাম্য মোড়ল মনে করে যে, তার এ অভিজ্ঞতালব্ধ বিচারই মানুষের সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় তা হলে সেও কাফির। কারণ, সেও নিশ্চিত হারাম বস্ত্তকে হালাল মনে করছে। যা কুফরিরই অন্তর্গত।
ছ. যে বিচারক মনে করে যে, আল্লাহ্ তা‘আলার বিধানই বিচারের ক্ষেত্রে একমাত্র গ্রহণযোগ্য বিধান; অন্য কোন মানব রচিত বিধান নয়। এর পরও সে মানব রচিত কোন বিধানের আলোকে বিচার কার্য পরিচালনা করে যাচ্ছে এবং সে এও মনে করছে যে, আমার এ কর্ম নীতি কখনোই ঠিক হতে পারে না তা হলে সে সত্যিই বড় পাপী। কারণ, সে নিজ স্বার্থ বা প্রবৃত্তি পূজারী। তবে সে কাফির নয়।
মানব রচিত আইন গ্রহণকারীদেরও কয়েকটি পর্যায় রয়েছে যা নিম্নরূপ:
ক. যে বিচারপ্রার্থী এ কথা জানে যে, তার প্রশাসক বা বিচারক আল্লাহ্ তা‘আলার বিধান অনুযায়ী বিচার করছে না। তবুও সে তার প্রশাসক বা বিচারকেরই অনুসরণ করছে এবং এও মনে করছে যে, তার প্রশাসক বা বিচারকের বিচার কার্যই সঠিক। তারা যা হালাল বলে তাই হালাল এবং তারা যা হারাম বলে তাই হারাম তা হলে সে কাফির। কারণ, সে তার প্রশাসক বা বিচারককে তার প্রভু বানিয়ে নিয়েছে যা শির্ক তথা কুফরিও বটে।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«اِتَّخَذُوْا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِ وَالْـمَسِيْحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوْا إِلاَّ لِيَعْبُدُوْا إِلَهًا وَّاحِدًا، لَا إِلَهَ إِلاَّ هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُوْنَ»
‘‘তারা আল্লাহ্ তা‘আলাকে ছেড়ে নিজেদের আলিম, ধর্ম যাজক ও মার্ইয়ামের পুত্র মাসীহ্ (ঈসা) (আঃ) কে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে। অথচ তাদেরকে শুধু এতটুকুই আদেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলারই ইবাদাত করবে। তিনি ব্যতীত সত্যিকার কোন মা’বূদ নেই। তিনি তাদের শির্ক হতে একেবারেই পূতপবিত্র’’। (তাওবাহ্: ৩১)
‘আদি’ বিন্ হাতিম (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
أَتَيْتُ النَّبِيَّ وَفِيْ عُنُقِيْ صَلِيْبٌ مِنْ ذَهَبٍ فَقَالَ : يَا عَدِيُّ! اِطْرَحْ عَنْكَ هَذَا الْوَثَنَ، وَسَمِعْتُهُ يَقْرَأُ فِيْ سُوْرَةِ بَرَاءَةٍ:
«اِتَّخَذُوْا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِ»
قَالَ: أَمَا إِنَّهُمْ لَمْ يَكُوْنُوْا يَعْبُدُوْنَهُمْ وَلَكِنَّهُمْ كَانُوْا إِذَا أَحَلُّوْا لَـهُمْ شَيْئًا اِسْتَحَلُّوْهُ وَإِذَا حَرَّمُوْا عَلَيْهِمْ شَيْئًا حَرَّمُوْهُ.
‘‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে গলায় স্বর্ণের ক্রুশ ঝুলিয়ে উপস্থিত হলে তিনি আমাকে ডেকে বলেন: হে ‘আদি’! এ মূর্তিটি (ক্রুশ) গলা থেকে ফেলে দাও। তখন আমি তাঁকে উক্ত আয়াতটি পড়তে শুনেছি। ‘আদি’ বলেন: মূলতঃ খ্রিষ্টানরা কখনো তাদের আলিমদের উপাসনা করতো না। তবে তারা হালাল ও হারামের ব্যাপারে বিনা প্রমাণে আলিমদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতো। আর এটিই হচ্ছে আলিমদেরকে প্রভু মানার অর্থ তথা আনুগত্যের শির্ক’’। (তিরমিযী ৩০৯৫)
উক্ত বিধান আলিম ও ধর্ম যাজকদের ব্যাপারে যেমন প্রযোজ্য তেমনিভাবে বিচারক ও প্রশাসকদের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।
খ. যে বিচারপ্রার্থী মনে করে যে, আল্লাহ্ তা‘আলার বিচারই সঠিক। তার বিচারকের বিচার সঠিক নয়। আল্লাহ্ তা‘আলা যাই হালাল বলেন তাই হালাল আর তিনি যাই হারাম বলেন তাই হারাম। তবুও সে তার বিচারকের বিচারই গ্রহণ করছে তার কোন স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে তা হলে সে সত্যিই বড় পাপী। কারণ, সে স্বার্থ পূজারী। তবে সে কাফির নয়।
আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’উমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
عَلَى الْـمَرءِ الْـمُسْلِمِ السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ فِيْمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ إِلاَّ أَنْ يُّؤْمَرَ بِمَعْصِيَةٍ، فَإِنْ أَمَرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ.
‘‘প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তি তার উপরস্থের যে কোন কথা শুনতে ও তাঁর আনুগত্য করতে বাধ্য তা তার পছন্দসই হোক বা নাই হোক যতক্ষণ না তিনি তাকে কোন গুনাহ্’র আদেশ করেন। তবে যদি তিনি তাকে কোন গুনাহ্’র আদেশ করেন তখন তার জন্য উক্ত কথাটি শুনা ও মানা বৈধ নয়’’। (বুখারী ৭১৪৪; মুসলিম ১৮৩৯)
‘আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক আনসারী সাহাবীকে আমীর বানিয়ে একটি সেনাদল পাঠান এবং তাদেরকে তাদের আমীরের যাবতীয় কথা শুনতে ও তাঁর আনুগত্য করতে আদেশ করেন। পথিমধ্যে তারা উক্ত আমীরকে কোন এক ব্যাপারে রাগিয়ে তুললে তিনি তাদেরকে আদেশ করলেন যে, তোমরা আমার জন্য কিছু জ্বালানি কাঠ একত্রিত করো। তখন তারা তাই করলো। আমীর সাহেব তাদেরকে সেগুলোতে আগুন ধরাতে বললেও তারা তাই করলো। অতঃপর তিনি তাদেরকে বললেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি তোমাদেরকে আমার যাবতীয় কথা শুনতে ও আমার আনুগত্য করতে আদেশ করেননি? তারা সকলেই বললো: অবশ্যই। আমীর বললেন: তা হলে তোমরা আগুনে প্রবেশ করো। তখন তারা একে অপরের চেহারা চাওয়া-চাওয়ি শুরু করলো। তারা বললো: আমরা তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ছুটেই আসলাম আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে। এভাবেই কিছু সময় কেটে গেলো। ইতোমধ্যে তাঁর রাগ নেমে গেলো এবং আগুন নিভিয়ে দেয়া হলো। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ফিরে এসে তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন:
لَوْ دَخَلُوْهَا مَا خَرَجُوْا مِنْهَا، إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِيْ الْـمَعْرُوْفِ.
‘‘যদি তারা তাতে (আগুনে) প্রবেশ করতো তা হলে তারা আর সেখান থেকে বের হতে পারতো না। নিশ্চয়ই আনুগত্য হচ্ছে (কুর‘আন ও হাদীস সম্মত) সৎ কাজেই’’। (বুখারী ৭১৪৫; মুসলিম ১৮৪০)
গ. যে বিচারপ্রার্থী বাধ্য হয়েই শরীয়ত বিরোধী বিচার গ্রহণ করেছে; সন্তুষ্ট চিত্তে নয় তা হলে সে কাফিরও নয়। গুনাহ্গারও নয়।
উম্মে সালামাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
يُسْتَعْمَلُ عَلَيْكُمْ أُمَرَاءُ، فَتَعْرِفُوْنَ وَتُنْكِرُوْنَ، فَمَنْ كَرِهَ فَقَدْ بَرِئَ، وَمَنْ أَنْكَرَ فَقَدْ سَلِمَ، وَلَكِنْ مَنْ رَضِيَ وَتَابَعَ.
‘‘তোমাদের উপর এমন আমীর নিয়োগ করা হবে যাদের কিছু কর্মকান্ড হবে মেনে নেয়ার মতো আর কিছু মেনে নেয়ার মতো নয়। সুতরাং যা মেনে নেয়ার মতো নয় তা কেউ অপছন্দ করলে সে দায়মুক্ত হলো। আর যে তা মেনে নিলো না সে নির্ভেজাল থাকলো। আর যে তাতে তার সন্তুষ্টি প্রকাশ করলো এবং তার অনুসরণ করলো সেই হবে নিশ্চিত দোষী’’। (মুসলিম ১৮৫৪)