লগইন করুন
কখনো অযথা কথা বলা যাবে না। অন্তরে কথা বলার ইচ্ছা জাগলেই চিন্তা করতে হবে, এতে কোন ফায়দা আছে কি না? যদি তাতে কোন ধরনের ফায়দা না থাকে তা হলে সে কথা কখনো বলবে না। আর যদি তাতে কোন ধরনের ফায়দা থেকে থাকে তাহলে দেখবে, এর চাইতে আরো লাভজনক কোন কথা আছে কি না? যদি থেকে থাকে তাহলে তাই বলবে। অন্যটা নয়।
কারোর মনোভাব সরাসরি বুঝা অসম্ভব। তবে কথার মাধ্যমেই তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে বুঝে নিতে হয়।
ইয়াহ্য়া বিন্ মু‘আয (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: অন্তর হচ্ছে ডেগের ন্যায়। তাতে যা রয়েছে অথবা দেয়া হয়েছে তাই রন্ধন হতে থাকবে। বাড়তি কিছু নয়। আর মুখ হচ্ছে চামচের ন্যায়। যখন কেউ কথা বলে তখন সে তার মনোভাবই ব্যক্ত করে। অন্য কিছু নয়। যেভাবে আপনি কোন পাত্রে রাখা খাদ্যের স্বাদ জিহবা দিয়ে অনুভব করতে পারেন ঠিক তেমনিভাবে কারোর মনোভাব আপনি তার কথার মাধ্যমেই টের পাবেন।
মন আপনার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নিয়ন্ত্রক ঠিকই। তবে সে আপনার কোন না কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সহযোগিতা ছাড়া যে কোন কাজ সম্পাদন করতে পারে না। সুতরাং আপনার মন যদি আপনাকে কোন খারাপ কথা বলতে বলে তখন আপনি আপনার জিহবার মাধ্যমে তার কোন সহযোগিতা করবেন না। তখন সে নিজ কাজে ব্যর্থ হবে নিশ্চয়ই এবং আপনিও গুনাহ্ কিংবা তার অঘটন থেকে রেহাই পাবেন।
এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
لَا يَسْتَقِيْمُ إِيْمَانُ عَبْدٍ حَتَّى يَسْتَقِيْمَ قَلْبُهُ، وَلَا يَسْتَقِيْمُ قَلْبُهُ حَتَّى يَسْتَقِيْمَ لِسَانُهُ.
‘‘কোন বান্দাহ্’র ঈমান ঠিক হয় না যতক্ষণ না তার অন্তর ঠিক হয়। তেমনিভাবে কোন বান্দাহ্’র অন্তর ঠিক হয় না যতক্ষণ না তার মুখ ঠিক হয়’’। (আহমাদ ৩/১৯৮)
সাধারণত মন মুখ ও লজ্জাস্থানের মাধ্যমেই বেশি অঘটন ঘটায় তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো কোন্ জিনিস সাধারণত: মানুষকে বেশির ভাগ জাহান্নামের সম্মুখীন করে তখন তিনি বলেন:
الْفَمُ وَالْفَرْجُ.
‘‘মুখ ও লজ্জাস্থান’’। (তিরমিযী ২০০৪; ইব্নু মাজাহ্ ৪৩২২; আহমাদ ২/২৯১, ৩৯২, ৪৪২; হা’কিম ৪/৩২৪; ইব্নু হিববান ৪৭৬ বুখারী/আদাবুল্ মুফ্রাদ, হাদীস ২৯২ বায়হাক্বী/শু‘আবুল্ ঈমান, হাদীস ৪৫৭০)
একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু‘আয বিন্ জাবাল্ (রাঃ) কে জান্নাতে যাওয়া ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার সহযোগী আমল বলে দেয়ার পর আরো কিছু ভালো আমলের কথা বলেন। এমনকি তিনি সকল ভালো কাজের মূল, কান্ড ও চূড়া সম্পর্কে বলার পর বলেন:
أَلَا أُخْبِرُكَ بِمِلَاكِ ذَلِكَ كُلِّهِ؟! قُلْتُ: بَلَى يَا نَبِيَّ اللهِ! فَأَخَذَ بِلِسَانِهِ، قَالَ: كُفَّ عَلَيْكَ هَذَا، فَقُلْتُ: يَا نَبِيَّ اللهِ! وَإِنَّا لَمُؤَاخَذُوْنَ بِمَا نَتَكَلَّمُ بِهِ؟! فَقَالَ: ثَكِلَتْكَ أُمُّكَ يَا مُعَاذُ! وَهَلْ يَكُبُّ النَّاسَ فِيْ النَّارِ عَلَى وُجُوْهِهِمْ أَوْ عَلَى مَنَاخِرِهِمْ إِلاَّ حَصَائِدُ أَلْسِنَتِهِمْ.
‘‘আমি কি তোমাকে এমন বস্ত্ত সম্পর্কে বলবো যার উপর এ সবই নির্ভরশীল? আমি বললাম: হে আল্লাহ্’র নবী! আপনি দয়া করে তা বলুন। অতঃপর তিনি নিজ জিহবা ধরে বললেন: এটাকে তুমি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করবে। তখন আমি বললাম: হে আল্লাহ্’র নবী! আমাদেরকে কথার জন্যও কি পাকড়াও করা হবে? তিনি বললেন: তোমার কল্যাণ হোক! হে মু‘আয! একমাত্র কথার কারণেই বিশেষভাবে সে দিন মানুষকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’’। (তিরমিযী ২৬১৬; ইব্নু মাজাহ্ ৪০৪৪; আহমাদ ৫/২৩১, ২৩৭ ‘আব্দু বিন্ ’হুমাইদ্/মুন্তাখাব্, ১১২ ‘আব্দুর্ রায্যাক্ব, হাদীস ২০৩০৩ বায়হাক্বী/শু‘আবুল্ ঈমান, হাদীস ৪৬০৭)
অনেক সময় একটিমাত্র কথাই মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত এমনকি তার সকল নেক আমল ধ্বংস করে দেয়।
জুন্দাব্ বিন্ ‘আব্দুল্লাহ্ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
قَالَ رَجُلٌ: وَاللهِ لَا يَغْفِرُ اللهُ لِفُلَانٍ، فَقَالَ اللهُ تَعَالَى: مَنْ ذَا الَّذِيْ يَتَأَلَّى عَلَيَّ أَنْ لَا أَغْفِرَ لِفُلَانٍ، فَإِنِّيْ قَدْ غَفَرْتُ لِفُلَانٍ وَأَحْبَطْتُ عَمَلَكَ.
‘‘জনৈক ব্যক্তি বললো: আল্লাহ্’র কসম, আল্লাহ্ তা‘আলা ওকে ক্ষমা করবেন না। তখন আল্লাহ্ তা‘আলা বললেন: কে সে? যে আমার উপর কসম খেয়ে বলে যে, আমি ওমুককে ক্ষমা করবো না। অতএব আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর উপর শপথকারীকে উদ্দেশ্য করে বললেন: আমি ওকেই ক্ষমা করে দিলাম এবং তোমার সকল নেক আমল ধ্বংস করে দিলাম’’।
(মুসলিম ২৬২১)
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) উক্ত হাদীস বর্ণনা করার পর বলেন:
وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لَتَكَلَّمَ بِكَلِمَةٍ أَوْبَقَتْ دُنْيَاهُ وَاٰخِرَتَهُ.
‘‘সে সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার জীবন! লোকটি এমন কথাই বলেছে যা তার দুনিয়া ও আখিরাত সবই ধ্বংস করে দিয়েছে’’।
(আবূ দাউদ্, হাদীস ৪৯০১)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন:
إِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مَا يَتَبَيَّنُ مَا فِيْهَا يَهْوِيْ بِهَا فِيْ النَّارِ أَبْعَدَ مَا بَيْنَ الْـمَشْرِقِ وَالْـمَغْرِبِ.
‘‘বান্দাহ্ কখনো কখনো যাচবিচার ছাড়াই এমন কথা বলে ফেলে যার দরুন সে জাহান্নামে এতদূর পর্যন্ত নিক্ষিপ্ত হয় যতদূর দুনিয়ার পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের মাঝের ব্যবধান’’। (বুখারী ৬৪৭৭; মুসলিম ২৯৮৮)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন:
وَإِنَّ أَحَدَكُمْ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ سَخَطِ اللهِ، مَا يَظُنُّ أَنْ تَبْلُغَ مَا بَلَغَتْ، فَيَكْتُبُ اللهُ عَلَيْهِ بِهَا سَخَطَهُ إِلَى يَوْمِ يَلْقَاهُ.
‘‘তোমাদের কেউ কখনো এমন কথা বলে ফেলে যাতে আল্লাহ্ তা‘আলা তার উপর অসন্তুষ্ট হন। সে কখনো ভাবতেই পারেনি কথাটি এমন এক মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছুবে; অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা উক্ত কথার দরুনই কিয়ামত পর্যন্ত তার উপর তাঁর অসন্তুষ্টি অবধারিত করে ফেলেন’’।
(তিরমিযী ২৩১৯; ইব্নু মাজাহ্ ৪০৪০; আহমাদ ৩/৪৬৯; হা’কিম ১/৪৪-৪৬; ইব্নু হিববান ২৮০; মা’লিক ২/৯৮৫)
উক্ত জটিলতার কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ উম্মতকে সর্বদা ভালো কথা বলা অথবা চুপ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন:
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ.
‘‘যার আল্লাহ্ তা‘আলা ও পরকালের উপর বিশ্বাস রয়েছে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে’’।
(বুখারী ৬০১৮, ৬০১৯ মুসলিম,হাদীস ৪৭, ৪৮; ইব্নু মাজাহ্ ৪০৪২)
সাল্ফে সালি’হীনগণ আজকের দিনটা ঠান্ডা কিংবা গরম এ কথা বলতেও অত্যন্ত সঙ্কোচ বোধ করতেন। এমনকি তাঁদের জনৈককে স্বপ্নে দেখার পর তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: আমাকে এখনো এ কথার জন্য আটকে রাখা হয়েছে যে, আমি একদা বলেছিলাম: আজ বৃষ্টির কতই না প্রয়োজন ছিলো! অতএব আমাকে বলা হলো: তুমি এটা কিভাবে বুঝলে যে, আজ বৃষ্টির খুবই প্রয়োজন ছিলো। বরং আমিই আমার বান্দাহ্’র কল্যাণ সম্পর্কে অধিক পরিজ্ঞাত।
অতএব জানা গেলো, জিহবার কাজ খুবই সহজ। কিন্তু তার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ।
সবার জানা উচিৎ যে, আমাদের প্রতিটি কথাই লিপিবদ্ধ হচ্ছে। তা যতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হোক না কেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلاَّ لَدَيْهِ رَقِيْبٌ عَتِيْدٌ»
‘‘মানুষ যাই বলুক না কেন তা লিপিবদ্ধ করার জন্য দু’ জন অতন্দ্র প্রহরী (ফিরিশ্তা) তার সাথেই রয়েছে’’। (ক্বা’ফ: ১৮)
মানুষ তার জিহবা সংক্রান্ত দু’টি সমস্যায় সর্বদা ভুগতে থাকে। একটি কথার সমস্যা। আর অপরটি চুপ থাকার সমস্যা। কারণ, অকথ্য উক্তিকারী গুনাহ্গার বক্তা শয়তান। আর সত্য কথা বলা থেকে বিরত ব্যক্তি গুনাহ্গার বোবা শয়তান।