কোন ভুল থাকলে সেটি রিপোর্ট করার জন্য অনুগ্রহ করে লগইন করুন।
লগইন করুন
লগইন করুন
হজ সফরে সহজ গাইড হজ মুহাম্মাদ মোশফিকুর রহমান
১০ যিলহজ: মুযদালিফার রাত
- এ রাতের মূল কাজ হলো মুযদালিফায় গমন করে মাগরিব ও এশার সালাত একসাথে পরপর কসর করে আদায় করা ও মুযদালিফায় ঘুমিয়ে রাত্রি যাপন করা এবং ফজরের সালাতের পর মিনা তথা জামরাতুল আকা‘বাহ’য় কংকর নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে গমন করা।
- মুযদালিফায় অবস্থান সাদামাটা জীবন যাপন, গৃহহীনতা ও অভাবের প্রতীক। মুযদালিফা এলাকা হারামের সীমার ভিতরে অবস্থিত। আরাফার সীমানা শেষ হলেই মুযদালিফা শুরু হয় না। আরাফা থেকে ৬ কি.মি. অতিক্রম করার পর আসে মুযদালিফা। মুযদালিফার পর কিছু অংশ ওয়াদি আল-মুহাসসির উপত্যকা এলাকা তারপর মিনা সীমানা শুরু। বর্তমানে মিনায় জায়গা সংকুলান না হওয়ায় মুযদালিফার একাংশ মিনা হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
- আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেন, ‘‘তোমরা যখন আরাফার ময়দান থেকে ফিরে আসবে তখন মাশআরুল হারামের (মুযদালিফায়) কাছে এসে আল্লাহকে স্মরণ করবে, যেমনি করে আল্লাহ তোমাদের পথ বলে দিয়েছেন, তেমনি করে তাঁকে স্মরণ করবে, নিশ্চয় তোমরা পথভ্রষ্টদের দলে শামিল ছিলে”।[1]
- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় অবস্থানের ফযীলত সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা এ দিনে তোমাদের ওপর অনুকম্পা করেছেন, অতঃপর তিনি গুনাহগারদেরকে সৎকাজকারীদের কাছে সোপর্দ করেছেন। আর সৎকাজকারীরা যা চেয়েছে তা তিনি দিয়েছেন”।[2]
- আরাফার ময়দানে সূর্যাস্তের পর মাগরিবের সালাত না পড়েই মুযদালিফার উদ্দেশ্যে আরাফা ত্যাগ করুন। সূর্যাস্তের পূর্বে আরাফা ত্যাগ করবেন না, করলেই দম দিতে হবে। ধীরে-সুস্থে শান্ত ভাবে যাত্রা শুরু করুন, বাসে আগে উঠার জন্য ধাক্কাধাক্কি করবেন না। রাস্তায় যেতে যেতে তালবিয়াহ পাঠ অব্যাহত রাখুন। আরাফা থেকে সকল বাস প্রায় একই সময়ে মুযদালিফার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। তাই রাস্তায় প্রচুর যানজটের সৃষ্টি হয়। তাই মুযদালিফায় বাসে যাওয়ার চেয়ে ছোট গ্রুপ করে পায়ে হেঁটে যাওয়াই ভালো, কারণ এতে আপনি খুব দ্রুতই মুযদালিফায় পৌঁছাতে পারবেন। সবসময় দলবদ্ধ হয়ে থাকার চেষ্টা করুন। এখানে দলছাড়া ও হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। মুযদালিফায় পায়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য আলাদা একমুখী রাস্তা আছে, এ রাস্তায় কোনো গাড়ি চলাচল করে না। তবে রাস্তা চেনা না থাকলে ও হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলে বাসে যাওয়াই উত্তম।
- মুযদালিফা সীমানার ভিতরে প্রবেশের পর বাস কোনো একটি সুবিধাজনক ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াবে। মুযদালিফায় যখনই পৌছাবেন তখন প্রথম কাজ হলো মাগরিব ও এশার সালাত কসর করে পরপর আদায় করা। যদি একত্রে জামা‘আত করে পড়েন তবে প্রথমে একবার আযান ও তারপর এক ইকামাতের পর মাগরিবের তিন রাকাত ফরয সালাত এবং তার পরপরই ইকামাত দিয়ে এশার দুই রাকাত ফরয সালাত আদায় করবেন। এ দুই সালাতের মাঝখানে অন্য কোনো সালাত বা তাসবিহ পড়বেন না, শুধু এশার ফরয সালাতের পর বিতর সালাত পড়বেন।[3]
- মুযদালিফায় পৌছার পর যদি এশার সালাতের ওয়াক্ত না হয় তবে অপেক্ষা করতে হবে। আবার আপনি যদি প্রচণ্ড যানজটের কারণে মধ্যরাতের আগে মুযদালিফায় পৌঁছতে না পারেন, তাহলে পথিমধ্যে কোথাও যাত্রাবিরতি করে মাগরিব ও এশার সালাত পড়ে নিবেন।
- সালাত আদায়ের পর আর কোনো কাজ নেই। এবার আপনি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় সুবহে সাদিক পর্যন্ত শুয়ে ঘুমিয়ে আরাম করেছেন। যেহেতু ১০ যিলহজ হাজীদের অনেক পরিশ্রম করতে হবে তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফার রাতে বিশ্রাম করেছেন।
- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফা থেকে মিনা যাওয়ার সময় সাতটি কংকর নিয়েছিলেন তা স্পষ্ট। অবশ্য মুযদালিফা থেকে কংকর নেওয়ায় কোনো সমস্যা নেই তবে উচিত হবে এটাকে জরুরী মনে না করা ও মুযদালিফার কংকরের বিশেষ গুণ আছে এমন ধারণা পোষণ না করা। পরবর্তীতে মিনা থেকে বা হারামের সীমানার ভিতরে যে কোনো স্থান থেকে কংকর সংগ্রহ করতে পারেন।
- আপনি ইচ্ছা করলে এখান থেকে জামরায় পরবর্তী তিন দিন কংকর নিক্ষেপের জন্য (২১ ৩=৬৩) কংকর সংগ্রহ করতে পারেন। সব কংকরই এখান থেকে নেওয়া বিধান মনে করা যাবে না, কারণ মিনা থেকেও কংকর সংগ্রহের সময় ও সুযোগ পাওয়া যায়। তবে মিনার চেয়ে মুযদালিফায় কংকর সহজলভ্য বেশি।
- কংকর নিক্ষেপের জন্য সংগৃহিত পাথরের আকার চনা বুটের দানা বা শিমের বিচির মতো হবে। বেশি বড় আকারের কংকর নেওয়া মাকরূহ। কংকর মুছার বা ধোয়ার কোনো নিয়ম হাদীসে কোথাও নেই। কিছু অতিরিক্ত কংকর নিবেন কারণ অনেক সময় কংকর হাত থেকে পড়ে হারিয়ে যায়। কংকরগুলো একটি ছোট ব্যাগ অথবা প্লাস্টিকের বোতলে সংরক্ষণ করে রাখুন। আবার আপনি যদি মুযদালিফা বা মিনা থেকে কংকর সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন তাহলে অন্য কারো কাছ থেকেও কংকর নিতে পারেন। এতে কোনো সমস্যা নেই। এভাবে সবাই এতো কংকর এখান থেকে নিলে একদিন মুযদালিফার সব কংকর হয়তো শেষ হয়ে যেতে পারে বলে আপনার মনে যদি ধারণা জাগে তবে আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই, ইনশা-আল্লাহ এমনটি হবে না কখনো!
- মুযদালিফা ও মিনার মধ্যবর্তী একটি জায়গার নাম ওয়াদী মুহাসসার। এটা মুযদালিফার অংশ নয়। তাই এখানে অবস্থান করা যাবে না। এ মুহাসসার এলাকায় আবরাহা রাজার হাতির বাহিনীকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি কংকর নিক্ষেপ করে নাস্তানাবুদ করেছিল। ইতোপূর্বে এ কথাটি বলা হয়েছিল যে, বর্তমানে মুযদালিফার একাংশ মিনা হিসাবে ব্যবহার করা হয় হজযাত্রী সংকুলান না হওয়ার কারণে। তাই ঐ জায়গাটুকু মিনা হিসাবে ব্যবহৃত হলেও যেহেতু মৌলিক অর্থে মিনায় পরিনত হয় নি, তাই ঐ অংশে তাবুতে রাত্রিযাপন করলে মুযদালিফার রাত্রিযাপন হয়ে যাবে। ওয়াদী মুহাসসারেও এখন অবশ্য তাবু বিছিয়ে মিনা হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
- মুযদালিফার সীমানার ভিতর এ রাত্রি যাপন করা ওয়াজিব।
- বৃদ্ধ ও দূর্বল পুরুষ-নারী, শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তিগণ ওজর বা কারণ সাপেক্ষে মধ্যরাতের চাঁদ ডুবে যাওয়ার পর মুযদালিফা ত্যাগ করে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে পারেন। অসুস্থ্য ও দুর্বলদের সাহায্যার্থে তাদের সাথে অভিভাবকরাও যেতে পারবেন। ওজর ছাড়া মুযদালিফা ত্যাগ করে মিনায় যাওয়া ঠিক হবে না। চলে গেলে দম দিতে হবে।[4]
- মুযদালিফায় সুবহে সাদিকে ঘুম থেকে উঠে একটু আগেভাগে আউয়াল ওয়াক্তেই ফজরের সালাত আদায় করে নিবেন। ফজরের সময় দুই রাকাত সুন্নাত ও দুই রাকাত ফরয সালাত আদায় করবেন। এবার মুযদালিফায় উকুফ করবেন, দো‘আ-যিকর করবেন ঠিক যেমন আল্লাহ করতে বলেছেন সূরা আল-বাকারা: ২:১৯৮ এবং সূরা-আল আ‘রাফ, ৭:২০৫ আয়াতে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় ‘কুযাহ’ পাহাড়ের পাদদেশে উকুফ করেছেন। এ স্থানটি বর্তমানে আল মাশার-আল হারাম মসজিদের সন্মুখভাগে অবস্থিত। এ মসজিদটি মুযদালিফার ৫নং রোডের পাশে অবস্থিত এবং ১২ হাজার মুসল্লী ধারন ক্ষমতা রাখে। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আমি এখানে উকুফ (অবস্থান) করলাম তবে মুযদালিফার পুরোটাই উকুফের স্থান”।[5]
- এবার কিবলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে দুই হাত উঠিয়ে দো‘আ-যিকির, তাসবিহ করতে থাকুন, আল্লাহর প্রশংসা করুন: ‘‘আলহামদুলিল্লাহ’’- ‘‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য’’।
- তাকবীরের মাধ্যমে আল্লাহর মহত্ব ঘোষণা করুন: ‘‘আল্লাহু আকবার’’- ‘‘আল্লাহ মহান’’।
- কালেমা পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর একত্ববাদ ঘোষণা করুন: ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ -‘‘আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনো ইলাহ নেই’’।
এই দো‘আ-যিকিরগুলো বারবার পাঠ করতে থাকুন এবং যতক্ষণ না পূর্ব আকাশ ফর্সা হওয়া দৃশ্যমান হয় ততক্ষণ এ দো‘আগুলো পাঠ করতে থাকুন, আপনার পছন্দ মতো অন্য দো‘আও পাঠ করতে পারেন। অতঃপর সূর্যোদয়ের আগেই মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন।[6]
[1] সূরা আল-বাকারা: ২:১৯৮
[2] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩০২৩
[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২২৫৬; সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৫৬০
[4] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৫৬৪
[5] সহীহ মুসলিম (২/৮৯৩)
[6] আবু দাউদ
[2] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩০২৩
[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২২৫৬; সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৫৬০
[4] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৫৬৪
[5] সহীহ মুসলিম (২/৮৯৩)
[6] আবু দাউদ