লগইন করুন
তিনি ছিলেন আরবের এক অভিজাত বংশদ্ভূত একজন প্রখ্যাত কবি। তিনি কাফির ছিলেন এবং নাবী কারীম (ﷺ)-এ নামে কুৎসা রটনা করতেন। এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন ত্বায়িফ যুদ্ধ হতে ফিরে আসেন (৮ম হিজরী) তখন কা‘বের নিকট তার ভাই বুজাইর বিন যুহাইর এ মর্মে পত্র লিখেন যে, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কার এমন কয়েক ব্যক্তিকে হত্যা করেছেন যারা তাঁর নামে কুৎসা রটনা করত এবং তাঁকে কষ্ট দিত। কুরাইশদের ছোটখাটো কবিগণের মধ্যে যার যে দিকে সুযোগ সুবিধা হয়েছে সে সেদিকে পলায়ন করেছে। অতএব, যদি তুমি প্রাণে রক্ষা পেতে চাও তাহলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে গিয়ে হাজির হয়ে যাও। কারণ, নাবী কারীম (ﷺ)-এর দরবারে গিয়ে কেউ তওবার সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন। তাকে হত্যা করেন না। যদি এ কথার উপর তুমি আস্থাশীল না হও তাহলে যেখানে খুশী গিয়ে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করতে পার।’’
এরপর দু’ ভাইয়ের মধ্যে পত্রালাপ চলতে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে কা’বের নিকট পৃথিবীর পরিসর সংকীর্ণ মনে হতে থাকে। এমনকি তার নিকট নিজের জীবনের ফুল নিক্ষিপ্ত হতে দেখা গেল- এ কারণে অবশেষে সে মদীনায় আগমন করল এবং জুহাইনা গোত্রের এক ব্যক্তির মেহমান হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করল। অতঃপর তার সঙ্গে ফজরের সালাত আদায় করল। ফজরের সালাত হতে ফারেগ হওয়া মাত্রই জুহাইনা গোত্রের লোকটি তাঁকে ইঙ্গিত করলে তিনি উঠে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট উপবিষ্ট হলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে চিনতেন না। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! কা‘ব বিন জুহাইর তওবা করে মুসলিম হয়েছেন এবং আপনার নিকট ক্ষমা ও আশ্রয় প্রার্থনা করছেন। আমি যদি তাঁকে আপনার খিদমতে হাজির করি তাহলে আপনি কি তাঁকে আশ্রয় প্রদান করবেন?
নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‘হ্যাঁ’
অতঃপর তিনিই বললেন, ‘আমি হচ্ছি কা‘ব বিন জুহাইর’। এ কথা শুনে একজন আনসারী সাহাবী তাকে হত্যা করার জন্য লাফ দিয়ে ওঠেন এবং তাঁর গ্রীবা কর্তন করার জন্য অনুমতি চান। নাবী কারীম (ﷺ) বললেন,
(دَعْهُ عَنْكَ، فَإِنَّهُ قَدْ جَاءَ تَائِباً نَازِعاً عَمَّا كَانَ عَلَيْهِ)
‘ক্ষান্ত হও, এ ব্যক্তি তাওবা করেছে, এবং তাওবা করার কারণে সমস্ত দোষত্রুটি থেকে সে মুক্তি লাভ করেছে।’
এ সময়েই কা‘ব বিন জুহাইর তাঁর একটি প্রসিদ্ধ কবিতা পাঠ করে নাবী কারীম (ﷺ)-কে শোনাল যার প্রথম পংক্তিটি এখানে লিপিবদ্ধ করা হল,
بانت سعاد فقلبي اليوم مَتْبُول ** مُتَيَّمٌ إثْرَهَا، لم يُفْدَ، مَكْبُول
অর্থ : ‘সু’আদ চলে গেছে, বিরহ ব্যথায় আমার অন্তর বিদীর্ণ, আমি বন্দী শৃঙ্খলাবদ্ধ আমার মুক্তিপণ দেয়া হয়নি।
এ কবিতাতেই কা‘ব রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রশংসাসহ তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে নিম্নোক্ত লাইনগুলো আবৃত্তি করেন,
نبئت أن رسول الله أوعدني ** والعفو عند رسول الله مأمول
مهلا هداك الذي أعطاك نافلة الـ ** قرآن فيها مواعيظ وتفصيل
لا تأخذن بأقوال الوشاة ولم ** أذنب، ولو كثرت فيَّ الأقاويل
لقد أقوم مقاما ما لو يقوم به ** أرى وأسمع ما لو يسمع الفيل
لظل يرعد إلا أن يكون له ** من الرسول بإذن الله تنويل
حتى وضعت يميني ما أنازعه ** في كف ذي نقمات قيله القيل
فلهو أخوف عندي إذ أكلمه ** وقيل: إنك منسوب ومسئول
من ضيغم بضراء الأرض مخدرة ** في بطن عثر غيل دونه غيل
إن الرسول لنور يستضاء به ** مهند من سيوف الله مسلول
অর্থ : আমি সংবাদ পেয়েছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে ধমক দিয়েছেন, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট ক্ষমার আশা করা হয়। আপনি অপেক্ষা করুন। যে আল্লাহ আপনাকে হিদায়াতপূর্ণ কুরআন দিয়েছেন, তিনি আপনাকে হিদায়াতের কাজে সাফল্য দান করুন। (নিন্দুকদের কথায়, কান দিবেন না) যদিও আমার সম্পর্কে অনেক কথাই বলা হয়েছে, কিন্তু আমি কোন অপরাধ করিনি। আমি এমন এক জায়গায় দন্ডায়মান আছি, আমি সেই কথাই শুনেছি এবং দেখেছি যে হাতীও যদি সেখানে দাঁড়ায় এবং সেই কথাগুলো শুনে তাহলে কম্পিত হবে। এ অবস্থা ব্যতীত যে তার উপর আল্লাহর অনুমতিতে রাসূল (ﷺ)-এর মেহেরবানী হয়। এমন কি আমি নিজ হাত কোন দ্বিধা ছাড়াই এমন এক সম্মানিত ব্যক্তির হাতে রেখেছি যাঁর প্রতিশোধ নেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে এবং যার কথাই আসল কথা যখন আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলছি। এমতাবস্থায় আমাকে বলা যে, ‘তুমি এ কথা বলেছ এবং তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। তা তো আমার নিকট সে সিংহের চাইতেও ভয়ানক যার থাকার স্থান এমন এক উপত্যকায় অবস্থিত যা অত্যন্ত কঠিন এবং ধ্বংসাত্মক যার পূর্বেও ধ্বংস হয়ে থাকে। নিশ্চয়ই রাসূল আলোকস্বরূপ, তাঁর দ্বারা অন্ধকার দূর হয়। কোষমুক্ত হিন্দুস্থানী ধারালো তলোয়ার।
এরপর কা‘ব বিন জুহাইর কুরাইশ মুহাজিরগণের প্রশংসা করেন। কারণ, কা'বের আগমনে তাদের কোন ব্যক্তি ভাল উক্তি ছাড়া কোন মন্তব্য করে নি এবং কোন গতিভঙ্গীও পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু তাদের প্রশংসা কালে আনসারদের প্রতি তিনি কটাক্ষ করেন। কারণ তাঁদের একজন তার গ্রীবা কর্তনের অনুমতি চেয়েছিল। কাজেই তিনি বললেন,
يمشون مَشْي الجمال الزُّهْرِ يعصمهم ** ضَرْبٌ إذا عَرَّد السُّودُ التَّنَابِيل
অর্থ : ওরা (কুরাইশগণ) সুশ্রী উটের ন্যায় হেলে দুলে চলেন। অসিযুদ্ধ তাদের রক্ষা করে যখন কদাকার কুৎসিত লোকেরা রাস্তা ছেড়ে পলায়ন করে।
কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর যখন তাঁর ঈমান দৃঢ় হয় তখন আনসারদের প্রশংসাসূচক একটি কবিতা আবৃত্তি করেন এবং তাঁদের ব্যাপারে তাঁর যে ত্রুটি হয়েছিল তার তিনি সংস্কার করে নেন। এ কবিতাটি নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হল :
من سره كَرَمُ الحــياة فلا يَزَلْ ** في مِقْنَبٍ من صالحي الأنصار
ورثوا المكارم كابراً عن كـابر ** إن الخـيار هـم بنـو الأخيار
অর্থ : ভদ্রোচিত জীবন যাপন যার পছন্দনীয় হয় তিনি সর্বদাই সৎ সাহায্যকারীদের দলভুক্ত হয়ে থাকেন। তার ভাল স্বভাবগুলো পিতা এবং পূর্বের পিতৃপুরুষগণের নিকট হতে প্রাপ্ত হয়েছে। প্রকৃতই ভাল লোক ভাল লোকেরই সন্তান হয়।