লগইন করুন
এরপর মুতাহয় দু’ দলের মধ্যে মুখোমুখী সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল। এক পক্ষে অত্যন্ত সাধারণ অস্ত্র সম্ভার সজ্জিত মাত্র তিন হাজার মুসলিম সৈন্য, অন্যপক্ষে উন্নত সমর সাজে সজ্জিত দু’ লক্ষ সৈন্য। এ যুদ্ধ ছিল সৈন্য সংখ্যা এবং সাজ-সরঞ্জামের দিক থেকে এক অকল্পনীয় অসম যুদ্ধ। সমগ্র পৃথিবী বিস্ময়াভিভূত হয়ে লক্ষ্য করছিল এর গতি প্রকৃতি। কিন্তু যখন ঈমানের বসন্তকালীন হাওয়া প্রবাহিত হয় তখন ঠিক সে রকম বিস্ময়কর ঘটনাবলী প্রকাশ হয়ে যায়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরম প্রিয় যায়দ বিন হারিসাহ (রাঃ) সর্ব প্রথম পতাকা গ্রহণ করেন এবং এমন উদ্দীপনা ও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন যে, ইসলামী বাজপক্ষীদের ছাড়া অন্য কোথাও আর এর নজীর পাওয়া যায় না। অমিত বিক্রমে তিনি যুদ্ধ করতে থাকেন এবং যুদ্ধ করতে থাকেন। কিন্তু তাঁর যুদ্ধোন্মাদনার এক পর্যায়ে শত্রুপক্ষের বর্শা বিদ্ধ হয়ে শাহাদতের পেয়ালায় অমৃত পান করে ভূমিতে লুটিয়ে পড়লেন।
এরপর পালা ছিল জা’ফার (রাঃ)-এর। অনতিবিলম্বে তিনি পতাকা উঠিয়ে নিলেন এবং পূর্ণ উদ্যমে যুদ্ধ আরম্ভ করে দিলেন। যুদ্ধ যখন পূর্ণ মাত্রায় পৌঁছল তখন তিনি তাঁর লাল-কালো ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ দিয়ে নীচে নেমে পড়লেন। ঘোড়ার পাসমূহ কর্তন করে দিলেন এবং আঘাতের পর আঘাত হেনে বাধা দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে শত্রুর আঘাতে তাঁর দক্ষিণ হাতটি কর্তিত হয়ে পড়ল। এরপর বাম হাত দ্বারা পতাকা ধারণ পূর্বক তাকে উর্ধ্বে উত্তোলিত অবস্থায় রাখার জন্য অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। এক পর্যায়ে তাঁর বাম হাতও কর্তিত হল। অতঃপর তিনি তাঁর উভয় হাতের অবশিষ্টাংশ দ্বারা বুকের সঙ্গে পতাকা জড়িয়ে ধরে যতক্ষণ না শাহাদতের পেয়ালা পান করলেন ততক্ষণ পতাকা সমুন্নত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেন।
বলা হয়েছে যে, একজন রোমীয় তাঁকে এমন ভাবে তরবারী দ্বারা আঘাত করেছিল যে, তাতে তাঁর দেহ দ্বিখন্ডিত হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা তাঁই দু’ হাতের বিনিময়ে জান্নাতে দু’টি হাত প্রদান করেছেন যার ফলে তিনি যেখানে খুশী সেখানে উড়ে বেড়াতে পারছেন। এ জন্য তাঁকে জা’ফার ত্বাইয়ার এবং ‘যুল জানাহাইন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর উপাধিসহ নাম হয়েছে জা’ফার তাইয়ার যুল জানাহাইন বা দু’ পাখা বিশিষ্ট উড়ন্ত জা’ফার (ত্বাইয়ার অর্থ উড়ন্ত এবং যুল জানাহাইন অর্থ দু’ বাহু বিশিষ্ট)।
ইমাম বুখারী (রঃ) নাফি‘র বরাতে ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, মুতাহ যুদ্ধের দিন জা’ফার (রাঃ)-এর শাহাদতের পর তাঁর শরীরে বর্শা ও তরবারীর ৫০টি আঘাত গণনা করেছিলাম। এসবের মধ্যে একটি আঘাতও পিছন দিক থেকে লাগেনি।[1]
অন্য এক সূত্রের ভিত্তিতে ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আমি সে যুদ্ধে মুসলিমগণের সঙ্গে ছিলাম। জা’ফার বিন আবূ ত্বালীবের খোঁজ করতে গিয়ে আমরা তাঁকে শাহাদতপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণের মধ্যে পেলাম। আমরা তাঁর দেহে বর্শা এবং তীরের নব্বইটিরও অধিক আঘাতের চিহ্ন প্রত্যক্ষ করলাম।[2]
নাফে‘ হতে ইবনে উমার (রাঃ)-এর বর্ণনায় আরও অতিরিক্ত এ কথাগুলো আছে যে, ‘এই আঘাতের চিহ্নগুলো আমরা তাঁর শরীরের সামনের দিকে পেলাম।’’[3]
এভাবে অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করার পর জা’ফার (রাঃ) শাহাদত বরণ করেন। অতঃপর আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ) পতাকা ধারণ করে নিজের ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে সম্মুখ পানে অগ্রসর হতে থাকলেন এবং তাঁর সঙ্গে মোকাবেলা করার জন্য আহবান জানিয়ে নীচের কবিতার চরণগুলো আবৃত্তি করতে থাকলেন,
أقسمت يا نفس لتنزلنه كارهة أو لتطـاوعنه
إن أجلب الناس وشدوا الرنه مالي أراك تكرهين الجنه
অর্থ : ‘হে আত্মা! আমি শপথ করছি যে, তুমি অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বীতায় অবতরণ করবে, ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় হোক যদি লোকেরা যুদ্ধরত থাকে এবং বর্শা পরিচালনা করতে থাকে তাহলে আমি তোমাকে জান্নাত হতে কেন পশ্চাদপসরণ করতে দেখছি।
এরপর তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীতায় অবতরণ করেন। এমতাবস্থায় তাঁর চাচাত ভাই মাংস যুক্ত একটি হাড় নিয়ে আসেন এবং বলেন, এ দ্বারা আপন পৃষ্ঠদেশ শক্ত করে নাও। কারণ এ দিবসে তোমাকে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। তিনি হাড়টি নিয়ে একবার কামড়ালেন তারপর তা ফেলে দিয়ে তরবারী ধরলেন এবং সম্মুখে অগ্রসর হয়ে যুদ্ধ করতে করতে শাহাদত বরণ করলেন।
[2] ঐ অধ্যায় ২য় খন্ড ৬১১ পৃঃ।
[3] ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৫১২ পৃঃ। বাহ্যত দুই হাদীসে সংখ্যার পার্থক্য পরিদৃষ্ট হচ্ছে, সামঞ্জস্য বিধান হেতু বলা হয়েছে যে, তীরের আঘাত হিসেবে ধরার কারণে সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে দ্র: ফাতহুল বারী)।