লগইন করুন
ইতোপূর্বে আমি উল্লেখ করেছি যে, ইসলাম এবং মুসলিমগণের নামে ‘ইহুদীগণ জ্বলে পুড়ে’ যেতে থাকে। কিন্তু যেহেতু তারা ছিল ভীরু ও কারপুরুষ এবং যুদ্ধের ময়দানে পেরে ওঠার ক্ষমতা তাদের ছিল না, সেহেতু তারা শঠতা ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করত। যুদ্ধের পরিবর্তে তারা ষড়যন্ত্র ও হীন কূটকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে নানাভাবে দুঃখ-কষ্ট দেয়ার কাজে লিপ্ত থাকত। অবশ্য বনু ক্বায়নুক্বার দেশত্যাগ এবং কা‘ব বিন আশরাফির হত্যার ঘটনা সংঘটিত হওয়ার ফলে তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে এবং তাদের চক্রান্তমূলক কাজকর্মে কিছুটা ভাটা পড়ে যায়। কিন্তু উহুদের যুদ্ধের পর তাদের পূর্বের আচরণ ধারায় আবার তারা ফিরে আসে, অর্থাৎ চক্রান্তমূলক ক্রিয়াকর্ম পুনরায় শুরু করে দেয়। তারা প্রকাশ্যে শত্রুতা আরম্ভ করে, অঙ্গীকার ভঙ্গ এবং মদীনার মুনাফিক্ব ও মক্কার মুশরিকদের সাহায্য করতে থাকে।[1]
সব কিছু অবগত হওয়া সত্ত্বেও নাবী কারীম (ﷺ) অত্যন্ত ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে চলতে থাকেন। কিন্তু রাযী ও মউনার বেদনাদায়ক ঘটনাবলীর মাধ্যমে তারা সীমাহীন ঔদ্ধত্য ও বাড়াবাড়ির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে নাবী কারীম (ﷺ)-কে খতম করার এমন এক কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করে যা নিম্নে উল্লেখিত হল :
কয়েকজন সাহাবা (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইহুদীদের নিকট গমন করে বনু কিলাব গোত্রের সেই দু’ ব্যক্তির শোনিতপাতের খেসারত সম্পর্কে কথোপকথন করছিলেন ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী ভুলক্রমে যাদের হত্যা করেছিলেন। তাদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির কারণে এ ব্যাপারে সহায়তা করা ছিল আশু কর্তব্য।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন তাদের সঙ্গে কথোপকথনরত ছিলেন তারা বলল, ‘আবুল কাশেম! আমরা আপনার কথা মতোই কাজ করব। আপনি এখানে অবস্থান করুন, আমরা আপনার প্রয়োজন পূরণ করছি।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের এক বাড়ির দেয়ালের সঙ্গে গা লাগিয়ে বসে পড়লেন এবং তাদের ওয়াদা পূরণের অপেক্ষায় রইলেন। নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে ছিলেন আবূ বাকর (রাঃ), উমার (রাঃ), আলী (রাঃ) এবং আরও কয়েকজন সাহাবা কেরামের (রাঃ) একটি দল।
এদিকে ইহুদীগণ গোপনে একত্রিত হলে শয়তান তাদের পেয়ে বসল এবং তাদের ভাগ্য লিখনে যে দুভার্গ্যের প্রসঙ্গটি লিপিবিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল সে তাকে আরও সুশোভন করে উপস্থাপন করল। এ প্রেক্ষিতে তারা নাবী কারীম (ﷺ)-কে হত্যার এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পরস্পর বলাবলি করল, ‘কে এমন আছে যে, এই চাকীটা নিয়ে দেয়ালের উপর উঠে যাবে, অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ)-এর মাথার উপর তা নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করবে?’
দুর্ভাগা ইহুদী ‘আমর বিন জাহহাশ বলল, ‘আমি’।
তাদের মধ্যে থেকে সালাম বিন মুশকিম বলল, ‘তোমরা এমন কর না, কারণ আল্লাহর কসম! তোমরা যা করতে চাচ্ছ সে সম্পর্কে তাঁকে অবগত করিয়ে দেয়া হবে। অধিকন্তু, আমাদের এবং তাঁদের মধ্য যে অঙ্গীকারনামা রয়েছে, এ কাজ হবে তারও বিপরীত।’
কিন্তু তারা তার কথায় কর্ণপাত না করে তাদের চক্রান্তমূলক কর্মকান্ড বাস্তবায়নের ব্যাপারে অটল রইল। এদিকে মহান রাববুল আলামীনের পক্ষ থেকে জিবরাঈল (আঃ) আগমন করে নাবী কারীম (ﷺ)-কে ইহুদী চক্রান্তের ব্যাপারটি অবগত করিয়ে দিলেন। তিনি সেখান থেকে দ্রুত গাত্রোত্থান করে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যান। পরে সাহাবাবৃন্দ এসে তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি সেখান থেকে চলে এলেন, অথচ আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইহুদী চক্রান্তের বিষয়টি তখন তাঁদের নিকট ব্যক্ত করলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘ইহুদীগণ এক ভয়ংকর চক্রান্ত করেছিল যা আল্লাহ তা‘আলা আমাকে অবগত করেছেন।’
মদীনা প্রত্যাবর্তনের পর পরই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাৎক্ষণিকভাবে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাকে বনু নাযীরের নিকট এ নির্দেশসহ প্রেরণ করেন যে, তারা যেন অবিলম্বে মদীনা থেকে বেরিয়ে অন্যত্র চলে যায়। মুসলিমগণের সঙ্গে তারা আর বসবাস করতে পারবে না। মদীনা পরিত্যাগ করে যাওয়ার জন্য তাদের দশ দিন সময় দেয়া হল। এ নির্ধারিত সময়ের পরে তাদের মধ্য থেকে যাকে মদীনায় পাওয়া যাবে তার গ্রীবা কর্তন করা হবে। এ নির্দেশ প্রাপ্তির পর মদীনা পরিত্যাগ করে যাওয়া ছাড়া ইহুদীদের আর কোন গত্যন্তর রইল না।
নাবী কারীম (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে নির্দেশ প্রাপ্তির পর মদীনা পরিত্যাগের জন্য তারা প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। কিন্তুমুনাফিক্ব নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই উল্লেখিত সময়ের মধ্যেই মদীনা ত্যাগ না করে আপন আপন স্থানে দৃঢ়তার সঙ্গে অবস্থান করতে থাকার জন্য পরামর্শ দেয়। সে বলে যে, তার নিকট দুই হাজার সাহসী সৈন্য রয়েছে, যারা তাদের দূর্গাভ্যন্তরে থেকে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে তৈরি থাকবে। অধিকন্তু, যদি তাদের দেশ থেকে বের করে দেয়া হয় তাহলে তাদের সঙ্গে তারাও দেশত্যাগ করবে, যদি তাদের যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয় তারা তাদের সাহায্য করবে এবং তাদের কোন ব্যাপারেই তারা কারো নিকট মাথা নত করবে না। তাছাড়া বনু কুরাইযাহ এবং বনু গাত্বাফান যারা তোমাদের ‘হালীফ’ (সহযোগী) তারাও তাদের সাহায্য করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(لَئِنْ أُخْرِجْتُمْ لَنَخْرُجَنَّ مَعَكُمْ وَلَا نُطِيْعُ فِيْكُمْ أَحَدًا أَبَدًا وَإِن قُوْتِلْتُمْ لَنَنصُرَنَّكُمْ) [الحشر:11]
‘তোমরা যদি বহিস্কৃত হও, তাহলে অবশ্য অবশ্যই আমরাও তোমাদের সাথে বেরিয়ে যাব, আর তোমাদের ব্যাপারে আমরা কক্ষনো কারো কথা মেনে নেব না। আর যদি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়, তাহলে আমরা অবশ্য অবশ্যই তোমাদেরকে সাহায্য করব।’ [আল-হাশর (৫৯) : ১১]
আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব পাওয়ার পর ইহুদীদের মনোবল বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে মদীনা পরিত্যাগ না করে বরং মুসলিমগণকে মোকাবেলা করবে। তাদের নেতা হুওয়াই বিন আখতাবের বিশ্বাস ছিল যে, মুনাফিক্ব নেতা যা বলেছে তা সে পূরণ করবে। এ কারণে প্রত্যুত্তরে সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলে পাঠাল যে তারা কিছুতেই তাদের ঘরবাড়ি পরিত্যাগ করে যাবে না। তিনি যা করতে চান তা করতে পারেন।
এতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, মুসলিমগণের জন্যে এ পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর। কারণ, ইতিহাসের সংকটপূর্ণ অধ্যায়ে শত্রুদের সঙ্গে মোকাবেলা করার ব্যাপারটি তেমন আশা কিংবা উৎসাহব্যঞ্জক ছিল না। এর পরিণতি যে অত্যন্ত ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তা অস্বীকার করা যায় না। তখন সমগ্র আরব জাহান ছিল মুসলিমগণের বিরুদ্ধে এবং মুসলিমগণের দুটি প্রচারক দলকে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয়েছিল। তাছাড়া বনু নাযীরের ইহুদীগণ এতই শক্তিশালী ছিল যে, তাদের হাত হতে অস্ত্রশস্ত্র নামানো মোটেই সহজ সাধ্য ছিল না। অধিকন্তু তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ব্যাপারটিও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আশঙ্কামুক্ত ছিল না। কিন্তু ‘বীরে মাউনার’ বেদনাদায়ক ঘটনার পূর্বে ও পরে পরিস্থিতি যে ভাবে মোড় নিয়েছিল যার ফলশ্রুতি ছিল অঙ্গীকার ভঙ্গ ও মুসলিমগণকে নির্মমভাবে হত্যা এবং যা মুসলিমগণের মনে এ সকল অপরাধ সম্পর্কে অভূতপূর্ব এক সচেতনতা ও চৈতন্যের উন্মেষ ঘটিয়েছিল, তার ফলে মুসলিমগণের মনে প্রতিশোধ গ্রহণের অনুভূতি এবং ইচ্ছা ও হয়েছিল তীব্র।
এ কারণে তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, যেহেতু বনু নাযীর নাবী কারীম (ﷺ)-কে হত্যার এক ঘৃণ্য চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল সেহেতু যে কোন মূল্যে যুদ্ধ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তাতে ফলাফল যাই হোক না কেন।
এমনি এক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে নাবী কারীম (ﷺ) যখন হুওয়াই বিন আখতাবের নিকট থেকে তার নির্দেশনার প্রত্যুত্তর প্রাপ্ত হলেন তখন তিনি এবং তাঁর উপস্থিত সাহাবীগণ (রাঃ) আল্লাহ আকবার ধ্বনিতে ফেটে পড়লেন। তৎক্ষণাৎ শুরু হয়ে গেলে যুদ্ধ প্রস্তুতি। আব্দুল্লাহ বিন উম্মু মাকতুমের উপর মদীনার প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পণের পর বনু নাযীর অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেলেন মুসলিম বাহিনী। পতাকা ছিল আলী বিন আবূ ত্বালীবের হাতে। বনু নাযীর এলাকায় পৌঁছে মুসলিম বাহিনী তাদের দূর্গ অবরোধ করেন।
এদিকে বনু নাযীর দূর্গ অভ্যন্তরে অবস্থান গ্রহণ করে দূর্গ প্রাচীর থেকে তীর এবং প্রস্তর নিক্ষেপ করতে থাকে। যেহেতু খেজুর বাগানগুলো তাদের ঢাল বা যুদ্ধাবরণ হিসেবে বিদ্যমান ছিল সেহেতু সেগুলোকে কেটে ফেলার কিংবা পুড়িয়ে ফেলার জন্য নাবী কারীম (ﷺ) নির্দেশ প্রদান করেন। পরে এর প্রতি ইঙ্গিত করে হাসসান (রাঃ) বলেছেন,
وهان عَلٰى سَرَاةِ بني لُؤي ** حـريـق بالبُوَيْرَةِ مسـتطيـر
অর্থ: বনু লুওয়াইদের নেতাদের জন্য এটা অতি সাধারণ কথা ছিল যে, বুওয়াইরাতে অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হবে (বনু নাযীরের খেজুরের বাগানের নাম ছিল বুওয়াইরা) এর প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন,
(مَا قَطَعْتُمْ مِّن لِّيْنَةٍ أَوْ تَرَكْتُمُوْهَا قَائِمَةً عَلٰى أُصُوْلِهَا فَبِإِذْنِ اللهِ) [الحشر: 5]
‘তোমরা খেজুরের যে গাছগুলো কেটেছ আর যেগুলোকে তাদের মূলকান্ডের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়েছ, তা আল্লাহর অনুমতিক্রমেই (করেছ)।’ [আল-হাশর (৫৯) : ৫]
যাহোক, যখন তাদের অবরোধ করা হল তখন বনু কুরাইযাহ তাদের থেকে পৃথক রইল। আব্দুল্লাহ বিন উবাইও প্রতিশ্রুতি পালন করল না। তাছাড়া, তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ গাত্বাফান গোত্রও সাহায্যার্থে এগিয়ে এল না। মোট কথা, তাদের এ সংকট কালে কেউই তাদের কোনভাবেই সাহায্য করল না। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ ঘটনার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে আয়াত নাযিল করেন,
(كَمَثَلِ الشَّيْطَانِ إِذْ قَالَ لِلْإِنسَانِ اكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّيْ بَرِيءٌ مِّنْكَ) [الحشر: 16]
‘(তাদের মিত্ররা তাদেরকে প্রতারিত করেছে) শয়ত্বানের মত। মানুষকে সে বলে- ‘কুফুরী কর’। অতঃপর মানুষ যখন কুফুরী করে তখন শয়ত্বান বলে- ‘তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’ [আল-হাশর (৫৯) : ১৬]
অবরোধ বেশী দীর্ঘদিন হয় নি, অবরোধ অব্যাহত ছিল ছয় রাত্রি মতান্তরে পনের রাত্রি। এর মধ্যেই আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দেন। যার ফলে তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে এবং তারা অস্ত্র সংবরণ করতে সম্মত হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট তারা প্রস্তাব করে যে মদীনা পরিত্যাগ করে তারা অন্যত্র চলে যেতে প্রস্তুত রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করে এ নির্দেশ প্রদান করেন যে, অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া অন্যান্য যে সব দ্রব্য তারা উটের পিঠে বোঝাই করে নিয়ে যেতে পারবে তা নিয়ে যাবে। পরিবার পরিজনও তাদের সঙ্গে যেতে পারবে।
এ স্বীকৃতির পর বনু নাযীর অস্ত্র সমর্পণ করে। অতঃপর গৃহাদির জানালা দরজাগুলো যাতে উটের পিঠে বোঝাই করে নিয়ে যেতে পারে এ উদ্দেশ্যে নিজ হাতে নিজ নিজ ঘরবাড়িগুলো ধ্বংস করে ফেলে। এদের কোন কোন লোককে ছাদের কড়া এবং দেয়ালের খুঁটি নিয়ে যেতেও দেখা যায়। অতঃপর শিশু ও মহিলাদের উটের পিঠে সওয়ার করিয়ে ছয়শত উটের উপর সব কিছু বোঝাই করে নিয়ে রওয়ানা হয়ে যায়। অধিক সংখ্যক ইহুদী এবং তাদের প্রধানগণ যেমন হুয়াই বিন আখতাব এবং সালাম বিন আবিল হুক্বাইক্ব খায়বার অভিমুখে যায়। এক দল যায় সিরিয়া অভিমুখে। শুধু ইয়ামিন বিন ‘আমর এবং আবূ সাঈদ বিন ওয়াহাব ইসলাম গ্রহণ করে। কাজেই, তাদের মালামালের উপর হাত দেয়া হয় নি।
আরোপিত শর্তাদির পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বনু নাযীরের অস্ত্রশস্ত্র, জমিজমা ও বাড়িঘর নিজ অধিকারভুক্ত করে নেন। অস্ত্রশস্ত্র মধ্যে ছিল ৫০টি লৌহ বর্ম, ৫০টি হেলমেট এবং ৩৪০টি তরবারী।
বনু নাযীরের ঘরবাড়ি জমিজমা ও বাগ বাগিচার উপর একমাত্র নাবী কারীম (ﷺ)-এর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে তাঁর এতটুকু স্বাধীনতা ছিল যে, ইচ্ছা করলে তিনি সব নিজ অধিকারে রেখে দিতে পারেন, কিংবা যাকে ইচ্ছা দিয়েও দিতে পারেন। ফলে তিনি যুদ্ধ লব্ধ অর্থ সম্পদের ন্যায় এ সবের এক পঞ্চমাংশ বাহির করেন নি। কারণ আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ‘ফাই’ (ফাও) সম্পদের ন্যায় সে সব সম্পদ দান করেছিলেন। উট, ঘোড়া কিংবা তরবারী ব্যবহার করে তা জয় করা হয় নি। কাজেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ বিশেষ অধিকার বলে পূর্বে হিজরতকারীগণের মধ্যে সেই সম্পদ বন্টন করে দেন। তবে অভাবগ্রস্ত থাকার কারণে আনসারী সাহাবী আবূ দুজানাহ (রাঃ) এবং সাহল বিন হুনাইফ (রাঃ)-কে কিছু অংশ প্রদান করেন। অধিকন্তু, একটি ছোট অংশ নিজের জন্য সংরক্ষণ করেন যদ্দ্বারা নিজ পবিত্র বিবিগণের পূর্ণ এক বছরের ব্যয় করতেন। অবশিষ্টাংশ যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং অস্ত্র সংগ্রহের কাজে ব্যয় করেন।
বনু নাযীর যুদ্ধ ৪র্থ হিজরীর রবিউল আওয়াল মোতাবেক ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে সংঘটিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ তা‘আলা পুরো সূরাহ হাশর অবতীর্ণ করেন। এতে ইহুদীগণের দেশান্তর পর্বটি চিত্রায়ন করে মুনাফিক্বগণের শঠতাপূর্ণ ক্রিয়াকর্মের পর্দা উন্মোচিত হয়েছে এবং লব্ধ সম্পদের হুকুমসমূহ উল্লেখ প্রসঙ্গে মুহাজির ও আনসারগণের প্রশংসা করা হয়েছে। অধিকন্তু, এও বলা হয়েছে যে, যুদ্ধের প্রয়োজনে শত্রুদের বৃক্ষ কর্তন কিংবা তাতে অগ্নি সংযোগ করে তা জ্বালিয়ে দেয়া যেতে পারে। এরূপ করাকে ভূপৃষ্টে বিপর্যয় সৃষ্টি করা বলা চলে না। অতঃপর ঈমানদারদের জন্য তাকওয়ার অপরিহার্যতা এবং পরকাল প্রস্তুতির জন্য বিশেষভাবে তাগিদ দেয়া হয়েছে। উল্লেখিত বিষয়াদি বর্ণনার পর আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় হামদ ও সানা বর্ণনার পর নিজ নাম ও গুণাবলীর মাধ্যমে সূরাহটি সমাপ্ত করেন।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূরাহ হাশর সম্পর্কে বলতেন, এ সূরাহটিকে সূরাহ বনী নাযীর বল।[2]
ইবনু ইসহাক্ব এবং অধিকাংশ সীরাত রচয়িতাদের বর্ণনামতে এটাই হচ্ছে বনু নাযার যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত সার।
অন্যপক্ষে আবূ দাউদ, আব্দুর রাজ্জাক এবং অন্যান্য সীরাত রচয়িতাগণ এ যুদ্ধের চিত্র অন্যভাবে বর্ণনা করেছেন তা হলো-
বদর যুদ্ধের পর কাফির মুরাইশগণ ইহুদীদের নিকট এ মর্মে একখানা পত্র লেখে যে, আপনারা হলেন সুদক্ষ তীরন্দায ও সুরক্ষিত দুর্গের অধিবাসী। আপনারা আমাদের কুরাইশ ভাইদের সাথে হয়তো যুদ্ধ করবেন নয়তো আমরা যা করবার তা করে বসবো। আর এতে আমাদের ও আপনাদের সম্রান্ত মহিলাদের মধ্যে কোন বাধা থাকবেন অর্থাৎ তাদের ইযযত লুণ্ঠন করা হবে। কুরাইশদের এ পত্র পাওয়ার সাথে সাথে বনু রাযী’র গোত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট দূত পাঠিয়ে খবর দেয় যে, আপনি আপনার ত্রিশজন সাৰ্থীসহ আমাদের কাছে আগমন করুন এবং আমরাও আমাদের ত্রিশজন পণ্ডিতকে প্রেরণ করবো। এরপর আমরা অমুক স্থানে একত্রিত হবো। এতে তারা আমাদের এবং আপনাদের মাঝে ফায়সালাকারী হবে। তারা আপনার কথা শ্রবণ করবে। অতঃপর যদি আমাদের পণ্ডিতগণ আপনার কথাকে সত্যায়ন করে এবং আপনার প্রতি ঈমান আনে তবে আমরা সকলেই আপনার প্রতি ঈমান আনবো। এ কথা মোতাবেক নাবী (ﷺ) তাঁর ত্রিশজন সাহাবা (রাঃ)-কে নিয়ে বের হলেন। অন্যদিকে ইহুদীদেরও ত্রিশজন পণ্ডিত বের হলো। এমতাবস্থায় তারা কোন এক উন্মুক্ত প্রাস্তরে একত্রিত হবেন, তখন কতক ইহুদী পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো যে, তোমরা কিভাবে তাদের মোকাবালায় পেরে উঠবে অথচ তার সাথে ত্রিশজন জানবাজ সাহাবা (রাঃ) রয়েছেন? যারা সকলেই মুহাম্মাদের মৃত্যুর পূর্বে নিজেদের মৃত্যুকে পছন্দ করে। সুতরাং তোমরা মুহাম্মাদের নিকট এ বলে খরব পাঠাও যে, আমরাই কিভাবে বুঝবো বা তারাই বা কিভাবে বুঝবে অথচ তারা ত্রিশজন লোক। অর্থাৎ এসাথে বেশিসংখ্যক লোক হলো বিষয় বুঝতে কষ্টকর হবে। তাই আপনার সাখীদের থেকে কেবল তিনজনকে সাথে নিয়ে আসেন এবং আমাদেরও তিন পণ্ডিত গিয়ে আপনার সাথে কথাবার্তা বলবে। তারা আপনার উপর ঈমান নিয়ে আসলে আমরা সকলে আপনার প্রতি ঈমান নিয়ে আসবো এবং আপনাকে সত্য নাবী বলে বিশ্বাস করবো। এ কথামতো নাবী (ﷺ) তিনজন সাহাবা (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে রওয়ানা হলেন এবং ইহুদীরা খানাযিয নামক স্থানে মিলিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে অকস্যাৎ আক্রমণ করে নিঃশেষ করে দেওয়ার চক্রান্ত করতে লাগল। এ সংবাদ অবগত হয়ে বনু নাযীরের এক ইহুদী শুভাকাঙ্ক্ষী মহিলা তার ভাইকে খবর প্রেরণ করে। সে ছিল একজন মুসলিম আনসার। ঐ মহিলা তাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে বনু নাযীরের দূরভীসন্ধামূলক চক্রান্ত সম্পর্কে অবগত করে। অতঃপর তার ভাই দ্রুতগতিতে আগমন করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বনু নাযীরের লোকেদের কাছে পৌছার পূর্বেই তাঁকে ইহুদী চক্রান্ত সম্পর্কে সংবাদ দেওয়ার ফলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পথিমধ্যে হতে ফিরে যান। পরদিন সকালেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সৈন্যবাহিনী নিয়ে বনু নাযীরকে অবরোধ করে। তিনি তাদেরকে এ নির্দেশ দেন যে, তোমরা আমাদের সাথে কোন প্রকার অন্যায় আচরণ না করার মর্মে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে সন্ধি সম্পাদন ব্যতীত নিরাপদে বসবাস করতে পারবে না। কিন্তু তারা তা অস্বীকার করে। ফলে তিনি মুসলমানদের নিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধ করেন। পরদিন সকালে তিনি (ড°) বনু নায়ীরকে ছেড়ে দিয়ে বাহিনীসহ বনু কুরাইযাহর উপর আক্রমন করেন এবং তাদেরকেও একই আহবান জানান। তারা এতে রাযি হয়ে যায়। ফলে তিনি পরদিন সকালে সেখান হতে ফিরে এসে আবার বনু নাযীরকে আক্রমন করেন। শেষ পর্যন্ত তারা অস্ত্র ব্যতীত উটের পিঠে যা বহন করে নিয়ে যাওয়া যাবে তা নিয়ে যাওয়ান অনুমতি সাপেক্ষে আত্মসমর্পণ করে। অতঃপর বনু নায়ীর উটের পিঠে তাদের মালসীমানা, ঘর-বাড়ি, দরজা-জানালা ইত্যাদি চাপিয়ে বহন করে নিয়ে যায়। তারা বের হয়ে যাওয়ার সময় নিজ হাতে তাদের বাড়িঘরকে ধ্বংশ করে দেয়। তারা সিরিয়া অভিমুখে চলে যায় এবং তাদের কোন কাফেলা এই প্রথম সিরিয়া গমন করে।
[2] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ১৯০-১৯২ পৃঃ। যাদুল মা’আদ ২য় খন্ড ৭১ ও ১১০ পৃ: এবং সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৭৪-৫৭৫ পৃঃ।