লগইন করুন
অনেকেই মনে করে থাকেন, গুনাহ্ করতেই থাকবো। আর সকাল-বিকাল ‘‘সুব্হানাল্লাহি ওয়া বিহাম্দিহী’’ ১০০ বার বলে দেবো। তখন সকল গুনাহ্ মাফ হয়ে যাবে অথবা এক বার হজ্জ করে ফেলবো তা হলে পূর্বের সকল গুনাহ্ মাফ হয়ে যাবে।
তাদেরকে আমরা জিজ্ঞাসা করবো, আপনি শুধু আল্লাহ্ তা‘আলার রহমত ও দয়ার আয়াত এবং এ সংক্রান্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীসগুলোই দেখছেন। কুর‘আন ও হাদীসে কি আল্লাহ্ তা‘আলার শাস্তির কোন উল্লেখ নেই? সুতরাং আপনি তাঁর শাস্তির ভয় না পেয়ে শুধু রহমতের আশা করছেন কেন?
কেউ কেউ মনে করেন যে, মানুষ গুনাহ্ করতে বাধ্য। সুতরাং গুনাহ্ করায় মানুষের কোন দোষ নেই। আমরা বলবো: মানুষ যদি গুনাহ্ করতেই বাধ্য হয় তা হলে আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুর‘আন ও হাদীসে গুনাহ্’র শাস্তির কথা উল্লেখ করলেনই বা কেন? আল্লাহ্ তা‘আলা কি (নাঊযু বিল্লাহ্) এতো বড় যালিম যে, কাউকে কোন কাজ করতে বাধ্য করবেন। আবার তাকে সে জন্য শাস্তিও দিবেন।
আপনি দয়া করে বাস্তবে একটুখানি পরীক্ষা করে দেখবেন কি? আপনার অন্তরে যখন কোন গুনাহ্’র ইচ্ছে জন্মে তখন আপনি উক্ত গুনাহ্ করার জন্য একটুও সামনে অগ্রসর হবেন না। তখন আপনি দেখবেন, কে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে কাজটি করিয়ে নেয়।
আপনি কি দেখছেন না যে, দুনিয়াতে এমনও কিছু লোক রয়েছেন যাঁরা গুনাহ্ না করেও শান্তিতে জীবন যাপন করছেন। সুতরাং আপনি একাই গুনাহ্ করতে বাধ্য হবেন কেন?
কেউ কেউ মনে করেন, গুনাহ্ করলে তো ঈমানের কোন ক্ষতি হয় না। কারণ, আমল ঈমানের কোন অংশ নয়। সুতরাং গুনাহ্ করতে কি? কারণ, জান্নাত তো একদিন না একদিন মিলবেই। তাদেরকে আমরা বলবো: আমল ঈমানের কোন অংশ না হয়ে থাকলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানের শাখাসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে আমলের কথা কেনই বা উল্লেখ করলেন এবং আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুর‘আন ও হাদীসে বান্দাহ্’র আমলের কারণেই ঈমান বাড়বে বলে অনেকগুলো প্রমাণ উল্লেখই বা করলেন কেন?
কেউ কেউ মনে করে থাকেন, আমরা যতই গুনাহ্ করি না কেন আমরা তো পীর-ফকির ও বুযুর্গদেরকে খুবই ভালোবাসি। সুতরাং তাদের ভালোবাসা আমাদেরকে বেড়া পার করিয়ে দিবে এবং তাদের উসিলায় দো‘আ করলে কাজ হয়ে যাবে। আমরা বলবো: সাহাবারা কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ভালোবাসতেন না? সুতরাং তাঁরা কেন এ আশায় গুনাহ্ করতে থাকেননি। তাদের জ্ঞান-বুদ্ধির কোন অভাব ছিলো কি?
কেউ কেউ মনে করে থাকেন, আমার বংশে অনেক আলিম ও বুযুর্গ রয়েছেন। সুতরাং তাঁরা আমাদেরকে সঙ্গে না নিয়ে জান্নাতে যাবেন না। আমরা বলবো: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবাদের সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনরা এ আশায় কেন গুনাহ্ করতে থাকেননি। তাদের জ্ঞান-বুদ্ধির কোন অভাব ছিলো কি?
কেউ কেউ মনে করেন, আল্লাহ্ তা‘আলার এমন কি প্রয়োজন রয়েছে যে, আমাকে শাস্তি দিবেন। সুতরাং তিনি দয়া করেই সে দিন আমাকে জান্নাত দিয়ে দিবেন। আমরা বলবো: কাউকে জান্নাত দেয়ারও আল্লাহ্ তা‘আলার কোন প্রয়োজন নেই। সুতরাং তিনি তাঁর সাথে মারাত্মক দোষ করা সত্ত্বেও কাউকে জান্নাত দিবেন কেন?
কেউ কেউ মনে করেন, আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আন মাজীদের সূরাহ যুহার ৫ নং আয়াতে বলেছেন: তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ততক্ষণ পর্যন্ত দিবেন যতক্ষণ না তিনি রাজি হন। সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো রাজি হবেন না আমাদেরকে জাহান্নামে ছেড়ে জান্নাতে যেতে। আমরা বলবো: আল্লাহ্ তা‘আলা যখন যালিম ও ফাসিকদেরকে শাস্তি দিতে রাজি তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন সে ব্যাপারে রাজি হবেন না? তিনি কি আল্লাহ্ তা‘আলার একান্ত বন্ধু নন? তিনি কি তখন আল্লাহ্ তা‘আলার পছন্দের বিরুদ্ধাচরণ করবেন?
কেউ কেউ মনে করেন, আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আনের সূরাহ যুমারের ৫৩ নং আয়াতে বলেছেন: তিনি সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দিবেন। সুতরাং গুনাহ্ করতে কি? আল্লাহ্ তা‘আলা তো সকল গুনাহ্ ক্ষমাই করে দিবেন। আমরা বলবো: আল্লাহ্ তা‘আলা কি কুর‘আন মাজীদের সূরাহ নিসা’র ৪৮ নং আয়াতে বলেননি যে, তিনি শির্ক ক্ষমা করবেন না। এ ছাড়া অন্য গুনাহ্ ক্ষমা করতেও পারেন ইচ্ছে করলে। সুতরাং সকল প্রকারের গুনাহ্ ক্ষমা করার ব্যাপারটি একান্ত তাওবা ও আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছার উপরই নির্ভরশীল।
কেউ কেউ বলে থাকেন, আল্লাহ্ তা‘আলা সূরাহ ইন্ফিত্বারের ৬ নং আয়াতে মানুষকে উযর শিক্ষা দিয়েছেন যে, মানুষ আল্লাহ্ তা‘আলার দয়ার কারণেই ধোকা খাচ্ছে বা খাবে। সুতরাং আমরা সবাই কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা‘আলার সামনে তাঁরই শেখানো উক্ত উযরই পেশ করবো। আমরা বলবো: আপনার উক্ত ধারণা একেবারেই মূর্খতা বশত। বরং মানুষ ধোকা খাবে বা খাচ্ছে শয়তান, কুপ্রবৃত্তি ও মূর্খতার কারণে; আল্লাহ্ তা‘আলার দয়ার নয়। কারণ, কেউ অত্যন্ত দয়াশীল হলে তাঁর সাথে ভালো ব্যবহারই করা উচিৎ। খারাপ ব্যবহার নয়।
কেউ কেউ বলে থাকেন, আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আন মাজীদের সূরাহ লাইলের ১৫ ও ১৬ নং আয়াতে বলেছেন যে, জাহান্নামে দগ্ধ হবে সেই ব্যক্তি যে নিতান্ত হতভাগ্য। যে (আল্লাহ্, রাসূল ও কুর‘আন এর প্রতি) মিথ্যারোপ করে এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর আমরা তো এমন নই। সুতরাং আমরা জান্নাতেই যাবো যত গুনাহ্ই করি না কেন। আমরা বলবো: আল্লাহ্ তা‘আলা এরপরই ১৭ নং আয়াতে বলেছেন: উক্ত লেলিহান জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে পরম সংযমী তথা চরম আল্লাহ্ভীরুরাই। সুতরাং গুনাহ্গাররা সাধারণত জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে না। কারণ, তারা পরম সংযমী তথা চরম আল্লাহ্ভীরু নয়।
কেউ কেউ বলে থাকেন, আল্লাহ্ তা‘আলা সূরাহ বাক্বারাহ্’র ২৪ নং আয়াতে বলেন: জাহান্নাম প্রস্ত্তত করা হয়েছে কাফিরদের জন্য। সুতরাং আমরা তো মুসলিম। আমাদের জন্য তো জাহান্নাম নয়। আমরা বলবো: আল্লাহ্ তা‘আলা সূরাহ আ’লি ইমরানের ১৩৩ নং আয়াতে বলেছেন: জান্নাত তৈরি করা হয়েছে আল্লাহ্ভীরুদের জন্য। সুতরাং পাপীরা তো খুব সহজেই সেখানে ঢুকতে পারবে না। কারণ, তারা তো আল্লাহ্ভীরু নয়।
কেউ কেউ মনে করেন, গুনাহ্ করতেই থাকবো। এক বছরের গুনাহ্ মাফের জন্য একটি আশুরার রোযাই যথেষ্ট। আরো বাড়তি সাওয়াব বা স্পেশাল দয়ার জন্য তো আরাফার রোযাই যথেষ্ট। সুতরাং তাও রেখে দেবো। অতঃপর জান্নাতে যাওয়ার জন্য আর কিছুই করতে হবে না। আমরা বলবো: রামাযানের রোযা এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামায তো ফরয। আর এগুলো কবীরা গুনাহ্ থেকে বাঁচার শর্তে সগীরা গুনাহ্গুলো শুধু ক্ষমা করতে পারে। সুতরাং উক্ত নফল রোযা কি এর চাইতেও আরো মর্যাদাশীল যে, সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দিবে।
কেউ কেউ বলে থাকেন: আল্লাহ্ তা‘আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি তাঁর বান্দাহ্’র ধারণা অনুযায়ীই তার সাথে ব্যবহার করে থাকেন। সুতরাং আমরা তাঁর সম্পর্কে এ ধারণা করি যে, আমরা যতই গুনাহ্ করি না কেন তিনি আমাদের সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দিবেন। সুতরাং গুনাহ্ করতে কি? আমরা বলবো: কেউ কারোর উপর তাঁর সাথে তার ব্যবহারের ধরন অনুযায়ীই ধারণা করে থাকে। যদি সে উক্ত ব্যক্তির সাথে সর্বদা ভালো ব্যবহার করে থাকে তখন সে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর সম্পর্কে এমন ধারণা করতে পারে যে, তিনি তার সাথে ভালো ব্যবহার করবেন। আর যদি সে তাঁর সাথে সর্বদাই দুর্ব্যবহার করে থাকে তা হলে সে কখনোই তাঁর ব্যাপারে এমন ধারণা করবে না যে, তিনি তার সাথে ভালো ব্যবহার করবেন।
এ কারণেই হাসান বসরী (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন:
إِنَّ الْـمُؤْمِنَ أَحْسَنَ الظَّنَّ بِرَبِّهِ فَأَحْسَنَ الْعَمَلَ، وَإِنَّ الْفَاجِرَ أَسَآءَ الظَّنَّ بِرَبِّهِ فَأَسَآءَ الْعَمَلَ.
‘‘নিশ্চয়ই মু’মিন ব্যক্তি নিজ প্রভু সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখে বলেই সর্বদা সে ভালো আমল করে। আর পাপী ব্যক্তি নিজ প্রভু সম্পর্কে খারাপ ধারণা করে বলেই সে সর্বদা খারাপ আমল করে’’।
বান্দাহ্ তো আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কে এমন ধারণা করবে যে, সে ভালো আমল করলে আল্লাহ্ তা‘আলা তা বিনষ্ট করে দিবেন না। বরং তিনি তা কবুল করে নিবেন এবং তিনি তাকে দয়া করে জান্নাত দিয়ে দিবেন। তার উপর একটুখানিও যুলুম করবেন না।
একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) এর নিকট ছয় অথবা সাতটি দিনার রেখে তাঁকে তা গরিবদের মাঝে বন্টন করতে বললেন। কিন্তু তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসুখের কারণে তা করতে ভুলে গেলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্থ হয়ে তাঁকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তা জানালেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন সে দিনারগুলো হাতে রেখে বললেন:
مَا ظَنُّ مُحَمَّدٍ بِرَبِّهِ لَوْ لَقِيَ اللهَ وَهَذِهِ عِنْدَهُ.
‘‘মুহাম্মাদের নিজ প্রভু সম্পর্কে কি ধারণা হতে পারে যদি সে আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে সাক্ষাৎ করে অথচ তার নিকট এ দিনারগুলো রয়েছে’’।
(আহমাদ্ ৬/৮৬, ১৮২; ইব্নু হিববান ৬৮৬ ’হুমায়দী, হাদীস ২৮৩ ইব্নু সা’দ ২/২৩৮)
কেউ কেউ বলতে পারেন যে, আল্লাহ্ তা‘আলার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেও তাঁর রহমতের আশা করা যেতে পারে। কারণ, তাঁর রহমত অপার ও অপরিসীম। আমরা বলবো: আপনার কথা ঠিকই। কিন্তু তারই সাথে সাথে আপনাকে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা কখনো অপাত্রে দয়া করবেন না। কারণ, তিনি হিকমতওয়ালা এবং অত্যন্ত পরাক্রমশীল। যে দয়ার উপযুক্ত তাকেই দয়া করবেন। আর যে শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত তাকে তিনি অবশ্যই শাস্তি দিবেন। বরং সে ব্যক্তিই আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কে সুধারণা রাখতে পারে যে তাওবা করেছে, নিজ কৃতকর্মের উপর লজ্জিত হয়েছে, বাকি জীবন ভালো কাজে খরচ করবে বলে আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে ওয়াদা করেছে।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«إِنَّ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَالَّذِيْنَ هَاجَرُوْا وَجَاهَدُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ، أُوْلٰٓئِكَ يَرْجُوْنَ رَحْمَةَ اللهِ».
‘‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং যারা আল্লাহ্’র পথে জিহাদ ও হিজরত করেছে একমাত্র তারাই আল্লাহ্’র রহমতের আশা করতে পারে’’।
(বাক্বারাহ্ : ২১৮)
এ কথা সবারই মনে রাখতে হবে যে, একটি হচ্ছে আশা। আরেকটি হচ্ছে দুরাশা। কেউ কোন বস্ত্তর যৌক্তিক আশা করলে তাকে তিনটি কাজ করতে হয়। যা নিম্নরূপ:
ক. যে বস্ত্তর সে আশা করছে সে বস্ত্তটিকে খুব ভালোবাসতে হবে।
খ. সে বস্ত্তটি কোনভাবে হাত
ছাড়া হয়ে যায় কি না সে আশঙ্কা সদা সর্বদা মনে রেখে সে ব্যাপারে তাকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে।
গ. যথাসাধ্য উক্ত বস্ত্তটি হাসিলের প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে।
এর কোন একটি কারোর মধ্যে পাওয়া না গেলে তার আশা দুরাশা বৈ আর কি?
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَنْ خَافَ أَدْلَجَ، وَمَنْ أَدْلَجَ بَلَغَ الْـمَنْزِلَ، أَلَا إِنَّ سِلْعَةَ اللهِ غَالِيَةٌ ؛ أَلَا إِنَّ سِلْعَةَ اللهِ الْـجَنَّةُ.
‘‘যার সময়মত গন্তব্যে পৌঁছার ভয় রয়েছে সে অবশ্যই প্রথম রাত্রে যাত্রা শুরু করবে। আর যে প্রথম রাত্রেই যাত্রা শুরু করলো সে অবশ্যই মঞ্জিলে (গন্তব্যে) পৌঁছুবে। তোমরা মনে রাখবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলার পণ্য খুবই দামি। আর আল্লাহ্ তা‘আলার পণ্য হচ্ছে জান্নাত’’।
(তিরমিযী ২৪৫০; হা’কিম ৪/৩০৭; ‘আব্দুব্নু ’হুমাইদ্ ১৪৬০)
সাহাবাদের জীবনী পড়ে দেখলে খুব সহজেই এ কথা বুঝে আসবে যে, আমাদের আশা সত্যিই দুরাশা যা কখনোই পূরণ হবার নয়। তাঁদের আশার পাশাপাশি ছিলো আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি অত্যন্ত ভয়।
একদা আবূ বকর (রাঃ) নিজকে উদ্দেশ্য করে বলেন:
وَدِدْتُ أَنِّيْ شَعْرَةٌ فِيْ جَنْبِ عَبْدٍ مُّؤْمِنٍ.
‘‘হায়! আমি যদি মু’মিন বান্দাহ্’র পার্শ্ব দেশের একটি লোম হতাম’’। (আহমাদ/যুহ্দ, পৃষ্ঠা: ১০৮)
একদা তিনি নিজ জিহবাহ্ টেনে ধরে বলেন:
هَذَا الَّذِيْ أَوْرَدَنِيَ الْـمَوَارِدَ.
‘‘এটিই আমাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে’’। (আহমাদ/যুহ্দ, পৃষ্ঠা: ১০৯)
তিনি বেশি বেশি কাঁদতেন এবং সবাইকে বলতেন:
اِبْكُوْا ؛ فَإِنْ لَمْ تَبْكُوْا فَتَبَاكُوْا.
‘‘কাঁদো; কাঁদতে না পারলে কাঁদার ভান করো’’। (আহমাদ/যুহ্দ, পৃষ্ঠা: ১০৮)
একদা ’উমর (রাঃ) সূরাহ ত্বূর পড়তে পড়তে যখন নিম্নোক্ত আয়াতে পৌঁছুলেন তখন কাঁদতে শুরু করলেন। এমনকি কাঁদতে কাঁদতে তিনি রুগ্ন হয়ে গেলেন এবং মানুষ তাঁর শুশ্রূষা করতে আসলো। আয়াতটি নিম্নরূপ:
«إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ لَوَاقِعٌ».
‘‘নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালকের শাস্তি অবশ্যম্ভাবী’’। (ত্বূর : ৭)
বেশি কান্নার কারণে তাঁর চেহারায় কালো দু’টি দাগ পড়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর সময় তিনি তাঁর ছেলেকে বললেন: আমার গন্ডদেশকে জমিনের সাথে লাগিয়ে দাও। তাতে হয়তো আল্লাহ্ তা‘আলা আমার উপর দয়া করবেন। আহ্! আল্লাহ্ তা‘আলা যদি আমাকে ক্ষমা না করেন। অতঃপর তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
একদা ‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আববাস্ (রা.) তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন: আপনার মাধ্যমেই দুনিয়ার অনেকগুলো শহর আবাদ হয়েছে এবং অনেকগুলো এলাকা বিজয় হয়েছে। আরো আরো। তখন তিনি বললেন: আমি শুধু জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাই। না চাই কোন গুনাহ্ না চাই কোন পুণ্য।
’উস্মান (রাঃ) যে কোন কবরের পাশে দাঁড়িয়েই কেঁদে ফেলতেন। এমন কি তাঁর সমস্ত দাড়ি কান্নার পানিতে ভিজে যেতো। তিনি বলতেন: আমাকে যদি জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে রাখা হয় এবং তখন আমি জানি না যে, আমাকে কোন দিকে যেতে বলা হবে। তখন আমি আমার গন্তব্য জানার আগেই চাবো ছাই হয়ে যেতে।
‘আলী (রাঃ) সর্বদা দু’টি বস্ত্তকে ভয় করতেন। দীর্ঘ আশা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ। কারণ, দীর্ঘ আশা আখিরাতকে ভুলিয়ে দেয় এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষকে সত্য গ্রহণ থেকে দূরে রাখে।
তিনি আরো বলেন: দুনিয়া চলে যাচ্ছে, আখিরাত এগিয়ে আসছে এবং প্রত্যেকটিরই অনুগামী রয়েছে। সুতরাং তোমরা আখিরাতের অনুগামী হও। দুনিয়ার অনুগামী হয়ো না। কারণ, এখন কাজের সময়। হিসাব নেই। আর আখিরাতে হিসাব রয়েছে। কোন কাজ নেই।
আবুদ্দারদা’ (রাঃ) বলেন: আমি আখিরাতে যে ব্যাপারে ভয় পাচ্ছি তা হচ্ছে, আমাকে বলা হবে: হে আবুদ্দারদা’! তুমি অনেক কিছু জেনেছো। তবে সে মতে কতটুকু আমল করেছো?
তিনি আরো বলেন: মৃত্যুর পর তোমাদের কি হবে তা যদি তোমরা এখন জানতে পারতে তা হলে তোমরা খাদ্য-পানীয় গ্রহণ করতে পারতে না। এমনকি নিজ ঘরেও অবস্থান করতে পারতে না। বরং তোমরা খালি ময়দানে নেমে পড়তে, ভয়ে বুকে থাপড়াতে এবং শুধু কাঁদতেই থাকতে। তিনি আপসোস করে বলেন: আহ্! আমি যদি গাছ হতাম মানুষ আমাকে কেটে কাজে লাগাতো।
বেশি বেশি কান্না করার কারণে আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আববাসের উভয় চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে যায়।
আবূ যর (রাঃ) বলতেন: আহ্! আমি যদি গাছ হতাম মানুষ আমাকে কেটে কাজে লাগাতো। আহ্! আমি যদি জন্মই না নিতাম। একদা কেউ তাঁকে খরচ বাবত কিছু দিতে চাইলে তিনি বললেন: আমার নিকট একটি ছাগল আছে যার দুধ আমি পান করি। কয়েকটি গাধা আছে যার উপর চড়ে আমি এদিক ওদিক যেতে পারি। একটি আযাদ করা গোলাম আছে যে আমার খিদমত আঞ্জাম দেয় এবং গায়ে দেয়ার মতো একটি বাড়তি আলখাল্লাও রয়েছে। আমি এগুলোর ব্যাপারেই হিসাব-কিতাবের ভয় পাচ্ছি। আর বেশির আমার কোন প্রয়োজন নেই।
আবূ ’উবাইদাহ্ (রাঃ) বলেন: আহ্! আমি যদি একটি ভেড়া হতাম। আমার পরিবারবর্গ আমাকে যবেহ্ করে খেয়ে ফেলতো।
ইব্নু আবী মুলাইকাহ্ (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: আমি ত্রিশ জন সাহাবাকে এমন পেলাম যে, তাঁরা নিজের ব্যাপারে মুনাফিকির ভয় পেতো।
কেউ কেউ আল্লাহ্ তা‘আলার অবাধ্য হওয়ার পরও শান্তিতে জীবন যাপন করছে বিধায় এমন মনে করে থাকেন যে, যখন আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে এখানে শান্তিতে রাখছেন তখন তিনি পরকালেও আমাকে শান্তিতে রাখবেন। সুতরাং পরকাল নিয়ে চিন্তা করার এমন কি রয়েছে? মূলতঃ উক্ত চিন্তা-চেতনা একেবারেই ভুল।
’উক্ববাহ্ বিন্ ‘আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إِذَا رَأَيْتَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يُعْطِيْ الْعَبْدَ مِنَ الدُّنْيَا عَلَى مَعَاصِيْهِ مَا يُحِبُّ، فَإِنَّمَا هُوَ اسْتِدْرَاجٌ، ثُمَّ تَلَا قَوْلَهُ عَزَّ وَجَلَّ: «فَلَمَّا نَسُوْا مَا ذُكِّرُوْا بِهٰفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ أَبْوَابَ كُلِّ شَيْءٍ حَتّٰى إِذَا فَرِحُوْا بِمَآ أُوْتُوْآ أَخَذْنٰهُمْ بَغْتَةً فَإِذَا هُمْ مُّبْلِسُوْنَ».
‘‘তুমি যখন দেখবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা কোন বান্দাহ্কে তাঁর অবাধ্যতা সত্ত্বেও পার্থিব সম্পদ হতে সে যা চায় তাই দিচ্ছেন তা হলে এ কথা মনে করতে হবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে ঢিল দিচ্ছেন। তিনি দেখছেন যে, সে এভাবে কতদূর যেতে পারে। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করেন যার মর্মার্থ এই যে, আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: অতঃপর যখন তারা সকল নসীহত (অবহেলা বশত) ভুলে গেলো তখন আমি তাদের জন্য (রহমত ও নি’য়ামতের) সকল দরোজা খুলে দিলাম। পরিশেষে যখন তারা সেগুলো নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠলো তখন আমি হঠাৎ তাদেরকে পাকড়াও করলাম। তখন তারা একেবারেই নিরাশ হয়ে পড়লো’’। (আন্‘আম : ৪৪) (আহমাদ্ ৪/১৪৫; ত্বাবারানী/কাবীর ৯১৩)
আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন:
«فَأَمَّا الْإِنْسَانُ إِذَا مَا ابْتَلَاهُ رَبُّهُ فَأَكْرَمَهُ وَنَعَّمَهُ، فَيَقُوْلُ رَبِّيْ أَكْرَمَنِ، وَأَمَّا إِذَا مَا ابْتَلَاهُ فَقَدَرَ عَلَيْهِ رِزْقَهُ، فَيَقُوْلُ رَبِّيْ أَهَانَنِ، كَلَّا».
‘‘মানুষ তো এমন যে, যখন তাকে পরীক্ষামূলক সম্মান ও সুখ-সম্পদ দেয়া হয় তখন সে বলে: আমার প্রভু আমাকে সম্মান করেছেন। আর যদি তাকে পরীক্ষামূলক রিযিকের সঙ্কটে ফেলা হয় তখন সে বলে: আমার প্রভু আমাকে অসম্মান করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: না, কখনো ব্যাপারটি এমন নয়’’। (ফজর : ১৫-১৭)
কেউ কেউ মনে করেন, দুনিয়া নগদ আর আখিরাত বাকি। সুতরাং নগদ ছেড়ে বাকির চিন্তা করতে যাবো কেন? আমরা বলবো: বাকি থেকে নগদ ভালো তখন যখন নগদ ও বাকি লাভের দিক দিয়ে সমান। কিন্তু যখন বাকি নগদ চাইতে অনেক অনেক গুণ ভালো প্রমাণিত হয় তখন সত্যিকারার্থে নগদ চাইতে বাকিই বেশি ভালো। আর এ কথা সকল মু’মিন ব্যক্তি জানে যে, আখিরাত দুনিয়ার চাইতে অনেক অনেকগুণ ভালো এবং চিরস্থায়ী। সুতরাং আখিরাতের উপর দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেয়া বোকামি বৈ কি?
মুস্তাউরিদ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
وَاللهِ مَا الدُّنْيَا فِيْ الْآخِرَةِ إِلاَّ مِثْلُ مَا يَجْعَلُ أَحَدُكُمْ إِصْبَعَهُ هَذِهِ فِيْ الْيَمِّ فَلْيَنْظُرْ بِمَ تَرْجِعُ ؟!
‘‘আল্লাহ্’র কসম! আখিরাতের তুলনায় দুনিয়া এমন যে, কেউ তার (তর্জনী) অঙ্গুলি সাগরে রাখলো। অতঃপর সে অঙ্গুলির সাথে যে পানিটুকু উঠে আসলো তার তুলনা যেমন পুরো সাগরের সাথে’’।
(মুসলিম ২৮৫৮; তিরমিযী ২৩২৩ আহমাদ্ ১/২২৯, ২৩০; ইব্নু মাজাহ্ ৪১৮৩)
এ যদি হয় দুনিয়ার তুলনা আখিরাতের সাথে তা হলে এক জন মানব জীবনের তুলনা আখিরাতের সাথে কতটুকু হবে তা বলার অপেক্ষাই রাখে না।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, দুনিয়া হচ্ছে নিশ্চিত আর আখিরাত হচ্ছে অনিশ্চিত। সুতরাং নিশ্চিত রেখে অনিশ্চিতের পেছনে পড়বো কেন? আমরা বলবো: আপনি কি সত্যিই আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী, না কি নন? আপনি যদি আখিরাতকে সত্যিই বিশ্বাস করে থাকেন তা হলে এ জাতীয় কথাই আপনার মুখ থেকে বেরুতে পারে না। আর যদি আপনি আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী না হয়েই থাকেন তা হলে আপনার ঈমানকে প্রথমে শুদ্ধ করে নিন। অতঃপর জান্নাত অথবা জাহান্নামের কথা ভাবুন।