লগইন করুন
১. জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইম (রাঃ) বলেন, আরাফার দিন বিদায় হজ্জের ভাষণে সমবেত জনগণের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
أَيُّهَا النَّاسُ، فَإِنِّى وَاللهِ لاَ أَدْرِى لَعَلِّى لاَ أَلْقَاكُمْ بَعْدَ يَوْمِى هَذَا بِمَكَانِى هَذَا، فَرَحِمَ اللهُ مَنْ سَمِعَ مَقَالَتِى الْيَوْمَ فَوَعَاهَا، فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ وَلاَ فِقْهَ لَهُ، وَلَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ، وَاعْلَمُوا أَنَّ أَمْوَالَكُمْ وَدِمَاءَكُمْ حَرَامٌ عَلَيْكُمْ كَحُرْمَةِ هَذَا الْيَوْمِ فِى هَذَا الشَّهْرِ فِى هَذَا الْبَلَدِ، وَاعْلَمُوا أَنَّ الْقُلُوبَ لاَ تَغِلُّ عَلَى ثَلاَثٍ: إِخْلاَصِ الْعَمَلِ للهِ، وَمُنَاصَحَةِ أُولِى الأَمْرِ، وَعَلَى لُزُومِ جَمَاعَةِ الْمُسْلِمِينَ، فَإِنَّ دَعْوَتَهُمْ تُحِيطُ مِنْ وَرَائِهِمْ- رواه الدارمىُّ-
(১) ‘হে জনগণ! আল্লাহর কসম, আমি জানিনা আজকের পরে আর কোনদিন তোমাদের সঙ্গে এই স্থানে মিলিত হ’তে পারব কি-না। অতএব আল্লাহ রহম করুন ঐ ব্যক্তির উপরে যে ব্যক্তি আজকে আমার কথা শুনবে ও তা স্মরণ রাখবে। কেননা অনেক জ্ঞানের বাহক নিজে জ্ঞানী নয় (সে অন্যের নিকট জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায়) এবং অনেক জ্ঞানের বাহক তার চাইতে অধিকতর জ্ঞানীর নিকটে জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায়। (২) জেনে রেখ, নিশ্চয়ই তোমাদের মাল-সম্পদ ও তোমাদের রক্ত তোমাদের পরস্পরের উপরে হারাম, যেমন আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহর তোমাদের জন্য হারাম’ (অর্থাৎ এর সম্মান বিনষ্ট করা হারাম)। (৩) জেনে রেখ, তিনটি বিষয়ে মুমিনের অন্তর খিয়ানত করে না : (ক) আল্লাহর উদ্দেশ্যে এখলাছের সাথে কাজ করা। (খ) শাসকদের জন্য কল্যাণ কামনা করা এবং (গ) মুসলমানদের জামা‘আতকে অাঁকড়ে ধরা। কেননা তাদের দো‘আ তাদেরকে পিছন থেকে (শয়তানের প্রতারণা হ’তে) রক্ষা করে’ (দারেমী হা/২২৭, সনদ ছহীহ)। অর্থাৎ মুমিন যতক্ষণ উক্ত তিনটি স্বভাবের উপরে দৃঢ় থাকবে, ততক্ষণ তার অন্তরে খিয়ানত বা বিদ্বেষ প্রবেশ করবে না। যা তাকে ইলম প্রচারের কাজে বাধা দেয়। আর তিনিই হবেন কামেল মুমিন’ (মির‘আত হা/২২৯-এর ব্যাখ্যা)।
ছাহেবে মিরক্বাত বলেন,لُزُومِ جَمَاعَةِ الْمُسْلِمِينَ অর্থ আক্বীদা ও সৎকর্মে সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং জুম‘আ, জামা‘আত ও অন্যান্য বিষয়ে সকলে অংশগ্রহণ করা।فَإِنَّ دَعْوَتَهُمْ تُحِيطُ مِنْ وَرَائِهِمْ অর্থ তাদের দো‘আ তাদেরকে শয়তানী প্রতারণা এবং পথভ্রষ্টতা হ’তে পিছন থেকে তাদের রক্ষা করে। এর মধ্যে ধমকি রয়েছে, যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে বেরিয়ে যাবে, সে ব্যক্তি জামা‘আতের বরকত ও মানুষের দো‘আ থেকে বঞ্চিত হবে। এছাড়াও এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করা অধিক উত্তম বিচ্ছিন্ন থাকার চাইতে’। কোন কোন বর্ণনায়مَنْ وَرَائَهُمْ এসেছে। অর্থাৎ তাদের পিছনে যারা আছে, তারা তাকে রক্ষা করে। ত্বীবী বলেন, এর দ্বারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতকে বুঝানো হয়েছে। যাদের দো‘আ তাদের পরবর্তী বংশধরগণকেও পথভ্রষ্টতা হ’তে রক্ষা করে’ (মিরক্বাত, শরহ মিশকাত হা/২২৮-এর ব্যাখ্যা)।
২. জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের দিন সূর্য ঢলে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ক্বাছওয়া (الْقَصْوَاءُ) উটনীর পিঠে সওয়ার হয়ে বাত্বনুল ওয়াদীতে আরাফাহ ময়দানে আসেন। অতঃপর লোকদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন,
أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ حَرَامٌ عَلَيْكُمْ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا، فِيْ شَهْرِكُمْ هَذَا، فِيْ بَلَدِكُمْ هَذَا- أَلاَ كُلُّ شَىْءٍ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ تَحْتَ قَدَمَىَّ مَوْضُوْعٌ وَدِمَاءُ الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوْعَةٌ وَإِنَّ أَوَّلَ دَمٍ أَضَعُ مِنْ دِمَائِنَا دَمُ ابْنِ رَبِيعَةَ بْنِ الْحَارِثِ كَانَ مُسْتَرْضِعًا فِى بَنِى سَعْدٍ فَقَتَلَتْهُ هُذَيْلٌ- وَرِبَا الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوْعٌ وَأَوَّلُ رِبًا أَضَعُ رِبَانَا رِبَا عَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَإِنَّهُ مَوْضُوْعٌ كُلُّهُ- فَاتَّقُوا اللهَ فِى النِّسَاءِ فَإِنَّكُمْ أَخَذْتُمُوْهُنَّ بِأَمَانِ اللهِ وَاسْتَحْلَلْتُمْ فُرُوْجَهُنَّ بِكَلِمَةِ اللهِ وَلَكُمْ عَلَيْهِنَّ أَنْ لاَّ يُوْطِئْنَ فُرُشَكُمْ أَحَدًا تَكْرَهُوْنَهُ. فَإِنْ فَعَلْنَ ذَلِكَ فَاضْرِبُوْهُنَّ ضَرْبًا غَيْرَ مُبَرِّحٍ وَلَهُنَّ عَلَيْكُمْ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ- وَقَدْ تَرَكْتُ فِيْكُمْ مَا لَنْ تَضِلُّوْا بَعْدَهُ إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ كِتَابَ اللهِ، وَأَنْتُمْ تُسْأَلُوْنَ عَنِّىْ فَمَا أَنْتُمْ قَائِلُوْنَ- قَالُوْا نَشْهَدُ أَنَّكَ قَدْ بَلَّغْتَ وَأَدَّيْتَ وَنَصَحْتَ. فَقَالَ بِإِصْبَعِهِ السَّبَّابَةِ يَرْفَعُهَا إِلىَ السَّمَاءِ وَيَنْكُتُهَا إِلَى النَّاسِ، اللهُمَّ اشْهَدْ، اللهُمَّ اشْهَدْ- ثَلاَثَ مَرَّاتٍ- رواه مسلم-
‘হে জনগণ! নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত ও মাল-সম্পদ তোমাদের পরস্পরের উপরে হারাম, যেমন আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহর তোমাদের জন্য হারাম’ (অর্থাৎ এর সম্মান বিনষ্ট করা হারাম)। (৪) ‘শুনে রাখ, জাহেলী যুগের সকল কিছু আমার পায়ের তলে পিষ্ট হ’ল। জাহেলী যুগের সকল রক্তের দাবী পরিত্যক্ত হ’ল। আমাদের রক্ত সমূহের প্রথম যে রক্তের দাবী আমি পরিত্যাগ করছি, তা হ’ল রাবী‘আহ ইবনুল হারেছ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব-এর শিশু পুত্রের রক্ত। যে তখন বনু সা‘দ[1] গোত্রে দুগ্ধ পান করছিল, আর হোযাইল গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করেছিল’। (৫) ‘জাহেলী যুগের সকল সূদ পরিত্যক্ত হ’ল। আমাদের সূদ সমূহের প্রথম যে সূদ আমি শেষ করে দিচ্ছি সেটি হ’ল (আমার চাচা) আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের পাওনা সূদ। যার সবটুকুই বাতিল করা হ’ল। (৬) ‘তোমরা নারীদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসাবে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর কালেমার মাধ্যমে তাদেরকে হালাল করেছ। তাদের উপরে তোমাদের প্রাপ্য হক হ’ল এই যে, তারা তোমাদের বিছানা এমন কাউকে মাড়াতে দেবে না, যাদেরকে তোমরা অপছন্দ কর। যদি তারা সেটা করে, তবে তোমরা তাদের প্রহার করবে যা গুরুতর হবে না। আর তোমাদের উপরে তাদের প্রাপ্য হক হ’ল উত্তমরূপে খাদ্য ও পরিধেয় প্রদান করা’। (৭) ‘আর জেনে রাখ, আমি তোমাদের মাঝে ছেড়ে যাচ্ছি এমন এক বস্ত্ত, যা মযবুতভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। সেটি হ’ল আল্লাহর কিতাব’। (৮) ‘আর তোমরা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। তখন তোমরা কি বলবে? লোকেরা বলল, আমরা সাক্ষ্য দিব যে, আপনি সবকিছু পৌঁছে দিয়েছেন, (রিসালাতের আমানত) আদায় করেছেন এবং উপদেশ দিয়েছেন’। অতঃপর তিনি শাহাদাত অঙ্গুলী আসমানের দিকে উঁচু করে অতঃপর সমবেত জনমন্ডলীর দিকে নীচু করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক’ (তিনবার)।[2]
৩. ফাযালাহ বিন ওবায়েদ (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِالْمُؤْمِنِ؟ مَنْ أَمِنَهُ النَّاسُ عَلَى أَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَالْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ النَّاسُ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ وَالْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ فِى طَاعَةِ اللهِ وَالْمُهَاجِرُ مَنْ هَجَرَ الْخَطَايَا وَالذُّنُوبَ
(৯) ‘আমি কি তোমাদেরকে মুমিন সম্পর্কে খবর দিব না? সে ঐ ব্যক্তি যার হাত থেকে অন্যদের মাল ও জান নিরাপদ থাকে। আর মুসলিম সেই, যার যবান ও হাত থেকে অন্যেরা নিরাপদ থাকে। আর মুজাহিদ সেই, যে আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সর্বাত্মকভাবে নিয়োজিত করে এবং মুহাজির সেই, যে সকল প্রকার অন্যায় ও পাপকর্ম সমূহ পরিত্যাগ করে’।[3]
উক্ত কথাটি আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর (রাঃ)-এর বর্ণনায় অন্যভাবে এসেছে,الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ، وَالْمُهَاجِرُ مَنْ هَجَرَ مَا نَهَى اللهُ عَنْهُ ‘মুসলিম সেই, যার যবান ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে এবং মুহাজির সেই, যে আল্লাহর নিষেধ সমূহ পরিত্যাগ করে’।[4]
৪. আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, আরাফাতের ময়দানে উটনীর পিঠে সওয়ার অবস্থায় প্রদত্ত ভাষণে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
أَلاَ وَإِنِّى فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ وَأُكَاثِرُ بِكُمُ الأُمَمَ فَلاَ تُسَوِّدُوا وَجْهِى أَلاَ وَإِنِّى مُسْتَنْقِذٌ أُنَاسًا وَمُسْتَنْقَذٌ مِنِّى أُنَاسٌ فَأَقُولُ يَا رَبِّ أُصَيْحَابِى. فَيَقُولُ إِنَّكَ لاَ تَدْرِى مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ-
(১০) ‘মনে রেখ! আমি তোমাদের সকলের আগেই হাউয কাউছারে পৌঁছে যাব। আর আমি অন্য সকল উম্মতের মধ্যে তোমাদের আধিক্য নিয়ে গর্ব করব। অতএব তোমরা আমার চেহারাকে কালেমালিপ্ত করো না। (১১) মনে রেখ! আমি অনেককে সেদিন মুক্ত করব এবং অনেকে সেদিন আমার থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। তখন আমি বলব, ‘হে আমার প্রতিপালক! এরা তো আমার সাথী। তিনি বলবেন, তুমি জানো না তোমার পরে এরা (ইসলামের মধ্যে) কত বিদ‘আত সৃষ্টি করেছিল’ (ইবনু মাজাহ হা/৩০৫৭)।
সাহল বিন সা‘দ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, এ জওয়াব পাওয়ার পর রাসূল (ছাঃ) বলবেন,سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِى ‘দূর হও দূর হও! যে ব্যক্তি আমার পরে আমার দ্বীনকে পরিবর্তন করেছ’।[5]
৫. মিখনাফ বিন সুলায়েম (রাঃ) বলেন,
كُنَّا وُقُوفًا مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم بِعَرَفَاتٍ فَسَمِعْتُهُ يَقُولُ : يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِى كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَةً وَعَتِيرَةً- رواه الترمذى وأبو داؤد وابن ماجه-
(১২) ‘আমরা আরাফাতের ময়দানে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে দাঁড়িয়েছিলাম। অতঃপর আমি তাঁকে বলতে শুনলাম যে, হে জনগণ! নিশ্চয় প্রত্যেক পরিবারের উপর প্রতি বছর একটি করে কুরবানী ও ‘আতীরাহ’।[6]
৬. সুলায়মান বিন আমর ইবনুল আহওয়াছ তার পিতা হ’তে বর্ণনা করেন যে, এদিন রাসূল (ছাঃ) আরও বলেন,
أَىُّ يَوْمٍ هَذَا؟ قَالُوا يَوْمُ الْحَجِّ الأَكْبَرِ. قَالَ: فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ بَيْنَكُمْ حَرَامٌ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِى بَلَدِكُمْ هَذَا، أَلاَ لاَ يَجْنِى جَانٍ إِلاَّ عَلَى نَفْسِهِ لاَ يَجْنِى وَالِدٌ عَلَى وَلَدِهِ وَلاَ مَوْلُوْدٌ عَلَى وَالِدِهِ- أَلاَ وَإِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ أَيِسَ مِنْ أَنْ يُعْبَدَ فِى بِلاَدِكُمْ هَذِهِ أَبَدًا وَلَكِنْ سَتَكُونُ لَهُ طَاعَةٌ فِيمَا تَحْتَقِرُونَ مِنْ أَعْمَالِكُمْ فَسَيَرْضَى بِهِ-
(১৩) ‘আজকে কোন দিন? লোকেরা বলল, হাজ্জে আকবারের দিন। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত, সম্পদ ও (১৪) সম্মান পরস্পরের জন্য হারাম। যেমন এই দিন ও এই শহর তোমাদের জন্য হারাম। ‘মনে রেখ, অপরাধের শাস্তি অপরাধী ব্যতীত অন্যের উপরে বর্তাবে না। পিতার অপরাধের শাস্তি পুত্রের উপর এবং পুত্রের অপরাধের শাস্তি পিতার উপর বর্তাবে না’। (১৫) ‘মনে রেখ, শয়তান তোমাদের এই শহরে পূজা পাওয়া থেকে (অর্থাৎ তোমাদের কাফের হওয়া থেকে) চিরদিনের মত নিরাশ হয়ে গেছে। তবে যেসব কাজগুলিকে তোমরা তুচ্ছ মনে কর, সেসব কাজে তার আনুগত্য করা হবে, আর তাতেই সে খুশী থাকবে’।[7] যেমন মিথ্যা, প্রতারণা, আপোষে ঝগড়া-মারামারি ইত্যাদি। যা পরবর্তীদের মধ্যে ঘটেছিল (মির‘আত)। জাবের (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছেوَلَكِنْ فِى التَّحْرِيشِ بَيْنَهُمْ ‘কিন্তু শয়তানী প্ররোচনা বাকী থাকবে’।[8] (১৬) একই রাবী কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে, أَلاَ إِنَّ الْمُسْلِمَ أَخُو الْمُسْلِمِ فَلَيْسَ يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ مِنْ أَخِيهِ شَىْءٌ إِلاَّ مَا أَحَلَّ مِنْ نَفْسِهِ ‘মনে রেখ! এক মুসলিম আরেক মুসলিমের ভাই। অতএব কোন মুসলমানের জন্য তার ভাই-এর কোন বস্ত্ত হালাল নয় কেবল অতটুকু ব্যতীত যতটুকু সে তার জন্য হালাল করে’ (তিরমিযী হা/৩০৮৭)। ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে,لاَ يَحِلُّ لاِمْرِئٍ مِنْ مَالِ أَخِيهِ إِلاَّ مَا أَعْطَاهُ مِنْ طِيبِ نَفْسٍ وَلاَ تَظْلِمُوا ‘কোন ব্যক্তির মাল তার ভাই-এর জন্য হালাল নয়। যতক্ষণ না সে তাকে খুশী মনে তা দেয়। আর তোমরা যুলুম করো না...।[9] এদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সওয়ারীর পিঠে বসে একটি খুৎবা দিয়েছিলেন, দু’টি খুৎবা নয়। এতে প্রমাণিত হয় যে, মুসফিরের জন্য জুম‘আর ছালাত অপরিহার্য নয় (যাদুল মা‘আদ ২/২১৬)।
আরাফাতের ভাষণে উপরে বর্ণিত ৬টি হাদীছের মধ্যে আমরা ১৬টি বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর বক্তব্য পেয়েছি। যার প্রতিটিই ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
উল্লেখ্য যে, আরাফাতের ময়দানে রাসূল (ছাঃ)-এর উক্ত ভাষণ উচ্চকণ্ঠে জনগণকে শুনিয়েছিলেন রাবী‘আহ বিন উমাইয়া বিন খালাফ’।[10] আল্লাহর কি অপূর্ব মহিমা! মক্কায় হযরত বেলালের উপরে লোমহর্ষক নির্যাতনকারী, রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী ১৪ নেতার অন্যতম নিকৃষ্টতম নেতা ও বদর যুদ্ধে নিহত উমাইয়া বিন খালাফের ছেলে রাবী‘আহ আজ রাসূল (ছাঃ)-এর দেহরক্ষী ছাহাবী ও তাঁর বিদায়ী ভাষণ প্রচারকারী। সুবহা-নাল্লা-হি ওয়া বিহামদিহী, সুবহা-নাল্লা-হিল ‘আযীম।
[2]. মুসলিম হা/১২১৮ (১৪৭) ‘বিদায় হজ্জ’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/২৫৫৫ ‘মানাসিক’ অধ্যায়; ইবনু মাজাহ হা/৩০৭৪।
[3]. আহমাদ হা/২৪০০৪; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৮৬২; ছহীহাহ হা/৫৪৯।
[4]. বুখারী হা/১০; মিশকাত হা/৬।
[5]. বুখারী হা/৬৫৮৩-৮৪; মুসলিম হা/২২৯৭ (৩২); মিশকাত হা/৫৫৭১।
অতএব জন্মনিরোধ করে উম্মতের সংখ্যা কমানো এবং ধর্মের নামে ও রাজনীতির নামে ইসলামের মধ্যে নতুন কিছু সৃষ্টি বা আমদানী করা নিষিদ্ধ।
[6]. তিরমিযী হা/১৫১৮; আবুদাঊদ হা/২৭৮৮; ইবনু মাজাহ হা/৩১২৫; মিশকাত হা/১৪৭৮, সনদ ‘হাসান’।
‘আতীরাহ’ অর্থ ঐ পশু যা রজব মাসে যবহ করা হয়। যা ইসলামের প্রথম যুগে চালু ছিল এবং পরে রহিত করা হয় (মির‘আত হা/১৪৯২-এর ব্যাখ্যা)। অত্র হাদীছে প্রমাণিত হয় যে, মুক্বীম অবস্থায় পরিবার পিছু একটি করে কুরবানী দেওয়া আবশ্যক। তাছাড়া আল্লাহ বলেন, আমরা ইসমাঈলের কুরবানীর বিনিময়ে একটি মহান কুরবানী পেশ করলাম’। আর সেটিকে আমরা পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’ (ছাফফাত ৩৭/১০৭-০৮)। আর সেটি ছিল একটি দুম্বা। রাসূল (ছাঃ) মদীনাতে মুক্বীম অবস্থায় নিজ পরিবারের পক্ষ থেকে নিয়মিতভাবে একটি বা দু’টি দুম্বা কুরবানী করেছেন’ (বুখারী হা/৫৫৫৮; মুসলিম হা/১৯৬৬; মিশকাত হা/১৪৫৩-৫৪)। আয়েশা (রাঃ) বলেন, হজ্জের সফরে তিনি পরিবারের পক্ষ থেকে একটি গরু কুরবানী দিয়েছে (আবুদাঊদ হা/১৭৫০)। আনাস (রাঃ) বলেন, হজ্জের সফরে রাসূল (ছাঃ) দাঁড়ানো অবস্থায় ৭টি উট নহর করেন এবং মদীনাতে ঈদুল আযহার দিন দু’টি শিংওয়ালা সুঠামদেহী দুম্বা যবহ করেছেন’ (বুখারী হা/১৭১২)। মুসাফির অবস্থায় সাত জনে মিলে একটি গরু বা উট কুরবানীর বিধান রয়েছে। হোদায়বিয়া ও হজ্জের সফরে এবং অন্যান্য সফরে ছাহাবীগণ এভাবেই কুরবানী করেছেন’ (মুসলিম হা/১৩১৮ (৩৫০-৫১); আবুদাঊদ হা/২৮০৯; তিরমিযী হা/৯০৪-০৫; ইবনু মাজাহ হা/৩১৩১; মিশকাত হা/১৪৬৯)। উক্ত হাদীছটি আবুদাঊদে ও মিশকাতে সংক্ষিপ্তভাবে এসেছে,الْبَقَرَةُ عَنْ سَبْعَةٍ وَالْجَزُورُ عَنْ سَبْعَةٍ ‘গরু ও উট সাত জনের পক্ষ হ’তে’ (আবুদাঊদ হা/২৮০৮; মিশকাত হা/১৪৫৮ ‘কুরবানী’ অনুচ্ছেদ)। সেখান থেকেই সম্ভবতঃ সাত ব্যক্তি কিংবা সাত বা একাধিক পরিবার মিলে একটি গরু কুরবানী দেওয়ার প্রথা চালু হয়েছে। যা সুন্নাত সম্মত নয়। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : লেখক প্রণীত ‘মাসায়েলে কুরবানী’ বই)।
[7]. তিরমিযী হা/২১৫৯; ইবনু মাজাহ হা/৩০৫৫, হাদীছ ছহীহ; মিরক্বাত শারহ মিশকাত হা/২৬৭০।
আরাফার দিনকে ‘হজ্জে আকবার’ বলা হয় এবং শুধু ওমরাকে ‘হজ্জে আছগার’ বলা হয়। তবে প্রসিদ্ধ মতে আরাফা ও জুম‘আর দিন একত্রিত হওয়াকে ‘হজ্জে আকবার’ বলা হয় (মিরক্বাত হা/২৬৭০-এর আলোচনা)। এর জন্য ৭০টি হজ্জের সমান নেকী পাওয়া যায় বলে যে হাদীছ প্রচলিত আছে, তা ভিত্তিহীন ও জাল (যঈফাহ হা/২০৭, ১১৯৩, ৩১৪৪)।
[8]. মুসলিম হা/২৮১২; মিশকাত হা/৭২।
[9]. বায়হাক্বী হা/১১৩০৪; ইরওয়া হা/১৪৫৯-এর আলোচনা ১/২৮১, সনদ হাসান।
[10]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/২৯২৭, সনদ হাসান; ইবনু হিশাম ২/৬০৫।