লগইন করুন
তাবূক যুদ্ধে মুনাফিকদের অবস্থান ছিল খুবই জঘন্য। যাতে মুসলিম বাহিনী মদীনা থেকে বের না হয় এবং রোমকদের হামলার পথ সুগম হয়, সেজন্য তাদের চেষ্টার অন্ত ছিল না। সেকারণ তাদের ও দুর্বল ঈমানদারদের লক্ষ্য করে সূরা তওবা ৩৮ থেকে ১১০ পর্যন্ত পরপর ৭২টি আয়াত নাযিল হয়। তাতে মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি পায় ও মুনাফিকদের বিষয়ে তারা অধিক সজাগ হয়।
মুনাফিকরা নিজেরা তো দান করেনি। উপরন্তু এই দানকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছিল (তওবা ৯/৭৯)। তাদের ঠাট্টা যেন এরূপ ছিল যে, বিশ্বশক্তি রোমক বাহিনীকে এরা দু’চারটি খেজুর দিয়ে পরাস্ত করতে চায়। কিংবা দু’চারটা খেজুর দিয়েই এরা রোম সাম্রাজ্য জয়ের দিবা স্বপ্ন দেখছে।
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের নেতৃত্বে মুনাফিকরা নানা অজুহাতে জিহাদ থেকে পিছিয়ে থাকে। উপরন্তু তারা গোপনে মুমিনদের বলতে থাকে যে, মুহাম্মাদ ও তার সাথীরা কেউ আর মদীনায় ফিরতে পারবেনা। রোম সম্রাট ওদের বন্দী করে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দিবেন। তারা বলে,لاَ تَنْفِرُوا فِي الْحَرِّ ‘তোমরা এই গরমে বের হয়োনা’ (তওবা ৯/৮১)। তাদের প্ররোচনায় কেউ কেউ গিয়ে মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে জিহাদে না যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে’ (তওবা ৯/৪৩)। এ সময় মদীনার বেদুঈনদের মুনাফেকী ও অবাধ্যতা ছিল খুবই বেশী’ (তওবা ৯/৯৭)।[1] মদীনার শহর এলাকা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী বস্তী এলাকাতেও মুনাফেকী ছড়িয়ে পড়ে। যাদেরকে রাসূল (ছাঃ) জানতেন না। কিন্তু আল্লাহ জানতেন’ (তওবা ৯/১০১)। আল্লাহ পাক এসব মুনাফিকদের ওযর কবুল করতে এবং তাদের কথা বিশ্বাস করতে রাসূল (ছাঃ)-কে নিষেধ করেন’ (তওবা ৯/৯৪)। এমনকি কুরআন তাদেরকে ‘অপবিত্র’ (رِجْسٌ) বলে আখ্যায়িত করে’ (তওবা ৯/৯৫)।
এভাবে মুমিন ও মুনাফিকদের মধ্যে আমলে ও আচরণে বিভক্তি রেখা সৃষ্টি হয়। ক্বোবায় মুনাফিকদের তৈরী ‘মসজিদে যেরারে’ রাসূল (ছাঃ)-কে ছালাত আদায়ে নিষেধ করা হয়’ (তওবা ৯/১০৭-০৮)। তাবূক যুদ্ধ থেকে ফিরে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-এর জানাযায় শরীক হওয়ার পর থেকে সকল মুনাফিকের জানাযায় শরীক হওয়ার ব্যাপারে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়’ (তওবা ৯/৮৪)। তাবূক যুদ্ধে মুনাফিকদের বৃহদাংশ যোগদান করেনি। দু’চার জন যারা গিয়েছিল, তারা গিয়েছিল স্রেফ ষড়যন্ত্র করার জন্য। এমনকি ফেরার পথে তাদের মধ্যে ১২ জন রাসূল (ছাঃ)-কে এক পাহাড়ী সরু পথে হত্যার চেষ্টা করে (আল-বিদায়াহ ৫/১৯)।
তাছাড়া ঐ সময় ছিল ফল পাকার মৌসুম। যে কারণে মদীনা থেকে বের হওয়া তখন ছিল বড়ই কষ্টকর বিষয়।
মদীনার এই সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে আল্লাহপাক আয়াত নাযিল করে বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ فَلاَ يَقْرَبُوا الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ بَعْدَ عَامِهِمْ هَذَا وَإِنْ خِفْتُمْ عَيْلَةً فَسَوْفَ يُغْنِيكُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ إِنْ شَاءَ إِنَّ اللهَ عَلِيمٌ حَكِيمٌ ‘হে মুমিনগণ! মুশরিকগণ (শিরকী আক্বীদার কারণে) নাপাক বৈ কিছুই নয়। অতএব তারা যেন এ বছরের পর মাসজিদুল হারামের নিকটবর্তী না হয়। (ব্যবসা-বাণিজ্য তাদের হাতে থাকার কারণে) তোমরা যদি দারিদ্রে্যর ভয় কর, তবে সত্বর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তোমাদেরকে অভাবমুক্ত করে দিবেন যদি তিনি চান। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/২৮)। যারা অজুহাত দিয়ে পিছিয়ে থাকার অনুমতি চেয়েছিল, তাদের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,لَوْ كَانَ عَرَضًا قَرِيبًا وَسَفَرًا قَاصِدًا لَاتَّبَعُوكَ وَلَكِنْ بَعُدَتْ عَلَيْهِمُ الشُّقَّةُ وَسَيَحْلِفُونَ بِاللهِ لَوِ اسْتَطَعْنَا لَخَرَجْنَا مَعَكُمْ يُهْلِكُونَ أَنْفُسَهُمْ وَاللهُ يَعْلَمُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ ‘যদি গণীমত নিকটবর্তী হ’ত এবং সফর কাছাকাছি হ’ত, তাহ’লে ওরা অবশ্যই তোমার অনুগামী হ’ত। কিন্তু তাদের নিকট (শাম পর্যন্ত) সফরটাই দীর্ঘ মনে হয়েছে। তাই সত্বর ওরা আল্লাহর নামে শপথ করে বলবে, সাধ্যে কুলালে অবশ্যই আমরা তোমাদের সাথে বের হ’তাম। এভাবে (শপথ করে) তারা নিজেরা নিজেদের ধ্বংস করে। অথচ আল্লাহ জানেন যে ওরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী’ (তওবা ৯/৪২)। অতঃপর দৃঢ় বিশ্বাসী মুমিনদের প্রতি আহবান জানিয়ে আল্লাহ বলেন,انْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالاً وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ ‘তোমরা বেরিয়ে পড় অল্প সংখ্যায় হও বা অধিক সংখ্যায় হও এবং জিহাদ কর আল্লাহর পথে তোমাদের মাল দ্বারা ও জান দ্বারা। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জানতে’ (তওবা ৯/৪১)। আল্লাহর এই আহবানে সাড়া দিয়ে ঈমানদারগণ দলে দলে জিহাদের উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর চারপাশে জমা হয়ে যায়। মুজাহিদ বলেন, আয়াতগুলি সবই তাবূক যুদ্ধের ঘটনায় নাযিল হয়েছিল’ (সীরাহ ছহীহাহ ২/৫২৮)।