লগইন করুন
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ جَهَّزَ جَيْشَ الْعُسْرَةِ فَلَهُ الْجَنَّةُ ‘যে ব্যক্তি জায়শুল উসরাহর প্রস্ত্ততিতে দান করবে, তার জন্য জান্নাত’ (বুখারী হা/২৭৭৮)। উক্ত হাদীছ শোনার পর মুসলমানদের মধ্যে দানের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
(১) ওমর (রাঃ) বলেন, (তাবূক যুদ্ধের সময়) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবাইকে ছাদাক্বার নির্দেশ দিলেন। তখন আমার নিকটে পর্যাপ্ত সম্পদ ছিল। আমি মনে মনে বললাম, দানের প্রতিযোগিতায় আজ আমি আবুবকরের উপরে জিতে যাব। তিনি বলেন, অতঃপর আমি আমার সমস্ত মালের অর্ধেক নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর খিদমতে হাযির হ’লাম। তিনি বললেন, পরিবারের জন্য কি পরিমাণ রেখে এসেছ? আমি বললাম, অনুরূপ পরিমাণ। এ সময় (২) আবুবকর (রাঃ) তাঁর সমস্ত মাল-সম্পদ নিয়ে হাযির হ’লেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, হে আবুবকর! তোমার পরিবারের জন্য কি পরিমাণ রেখে এসেছ? তিনি বললেন,أَبْقَيْتُ لَهُمُ اللهَ وَرَسُولَهُ ‘তাদের জন্য আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি’। ওমর বলেন, তখন আমি মনে মনে বললাম, আর আমি কখনোই তাঁর উপরে জিততে পারব না’।[1] এতে বুঝা যায় যে, দু’জনের মধ্যে ওমর (রাঃ) প্রথম ছাদাক্বা নিয়ে আসেন।
(৩) ওছমান গণী (রাঃ) ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে আসেন। স্বর্ণমুদ্রাগুলি যখন রাসূল (ছাঃ)-এর কোলের উপরে তিনি ঢেলে দেন, তখন রাসূল (ছাঃ) সেগুলি উল্টে-পাল্টে বলতে থাকেন,مَا ضَرَّ ابْنَ عَفَّانَ مَا عَمِلَ بَعْدَ الْيَوْمِ، يُرَدِّدُهَا مِرَاراً ‘আজকের দিনের পর কোন আমলই ইবনু ‘আফফানের (অর্থাৎ ওছমানের) কোন ক্ষতিসাধন করবে না’। কথাটি তিনি কয়েকবার বলেন’।[2] এই বিপুল দানের জন্য তাঁকেمُجْهِزُ جَيْشِ الْعُسْرَةِ অর্থাৎ ‘তাবূক যুদ্ধের রসদ যোগানদাতা’ বলা হয়।[3]
(৪) আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব বহু মাল-সামান নিয়ে আসেন। (৫) এতদ্ব্যতীত ত্বালহা, সা‘দ বিন ওবাদাহ, মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ প্রমুখ প্রচুর মাল-সম্পদ দান করেন। এভাবে এক মুদ, দুই মুদ করে কম-বেশী দানের স্রোত চলতে থাকে। মহিলাগণ তাদের গলার হার, হাতের চুড়ি, পায়ের অলংকার, কানের রিং, আংটি ইত্যাদি যার যা গহনা ও অলংকার ছিল, সবই রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে পাঠিয়ে দেন। কেউ সামান্যতম কৃপণতা করেননি (সীরাহ হালাবিইয়াহ ৩/১০০; আর-রাহীক্ব ৪৩৩ পৃঃ)। আছেম বিন ‘আদী ১০০ অসাক্ব অর্থাৎ হিজাযী ছা‘ হিসাবে প্রায় ১৪,৩৫৯ কেজি খেজুর জমা দেন (ইবনু হিশাম ২/৫৫১)। এ সময় উমাইরাহ বিনতে সুহায়েল বিন রাফে‘ দুই ছা‘ খেজুর, আবু খায়ছামা আনছারী এক ছা‘ এবং আবু ‘আক্বীল হাছহাছ অথবা হাবহাব আনছারী (রাঃ) অর্ধ ছা‘ বা অর্ধ থলি (نِصْفُ صُبْرَةٍ) খেজুর নিয়ে আসেন’ (কুরতুবী)। আবু ‘আক্বীল বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি সারা রাত দুই ছা‘ খেজুরের বিনিময়ে অন্যের ক্ষেতে পানি সেচেছি। সেখান থেকে এক ছা‘ পরিবারের জন্য রেখে এসেছি এবং এক ছা‘ এখানে এনেছি’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ১০২৬০)। তখন রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ দিলেন তার ঐ খেজুরগুলি ছাদাক্বার স্তূপের উপর ছড়িয়ে দিতে। অতঃপর তার জন্য দো‘আ করলেন, بَارَكَ اللهُ فِيمَا أَعْطَيْتَ وَفِيمَا أَمْسَكْتَ ‘আল্লাহ তাতে বরকত দিন যা তুমি দান করেছ এবং যা তুমি (পরিবারের জন্য) রেখে দিয়েছ’। তখন কিছু লোক এতে হাসাহাসি করে বলল, নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এসব দান থেকে অমুখাপেক্ষী’ (ত্বাবারী হা/১৭০১২; কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা তওবা ৭৯ আয়াত, সনদ যঈফ)।
সবশেষে আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ (রাঃ) এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ছাদাক্বা দানকারী আর কেউ বাকী আছে কি? রাসূল (ছাঃ) বললেন, না। তখন তিনি তার মোট সম্পদের অর্ধেক ৪০০০ দিরহাম বা ১০০ উক্বিয়া স্বর্ণমুদ্রা দান করেন। এ সময় ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব বলেন, তুমি কি পাগল? তিনি বললেন, আমি পাগল নই। অতঃপর বলেন, আমার মোট ৮০০০ দিরহামের মাল রয়েছে। তন্মধ্যে ৪০০০ দিরহাম রেখেছি আমার পরিবারের জন্য এবং বাকী ৪০০০ দিরহাম আমি আমার প্রতিপালককে ঋণ দিলাম। তখন রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে বললেন,بَارَكَ اللهُ فِيمَا أَعْطَيْتَ وَفِيمَا أَمْسَكْتَ ‘আল্লাহ তাতে বরকত দিন যা তুমি দান করেছ এবং যা তুমি রেখে দিয়েছ’। এ সময় এক ছা‘ বা অর্ধ ছা‘ করে যারা দান করেন, সকলের উদ্দেশ্যে তিনি একই দো‘আ করেন। তখন মুনাফিকরা বলল, আল্লাহর কসম! এটি স্রেফ ‘রিয়া’ ও শ্রুতি মাত্র। কেননা আল্লাহ এসব দান থেকে অমুখাপেক্ষী’ (ত্বাবারী হা/১৭০০৪, ১৭০১৭; ইবনু কাছীর, তাফসীর তওবা ৭৯ আয়াত, সনদ যঈফ)।
আবু মাসঊদ আনছারী (রাঃ) বলেন, আমাদেরকে ছাদাক্বার আদেশ দেওয়া হ’ল। তখন আমরা সবাই তা বহন করে নিয়ে গেলাম। এ সময় আবু ‘আক্বীল অর্ধ ছা‘ ছাদাক্বা নিয়ে এলেন। অন্য একজন তার চাইতে কিছু বেশী নিয়ে এল। তখন মুনাফিকরা বলল, নিশ্চয় আল্লাহ এইসব ছাদাক্বা থেকে অমুখাপেক্ষী। তারা বলল, এরা এগুলি করছে লোক দেখানোর জন্য। তখন সূরা তওবা ৭৯ আয়াতটি নাযিল হয়’ (বুখারী হা/৪৬৬৮)।[4]
উক্ত আয়াতে আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ يَلْمِزُونَ الْمُطَّوِّعِينَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ فِي الصَّدَقَاتِ وَالَّذِينَ لاَ يَجِدُونَ إِلاَّ جُهْدَهُمْ فَيَسْخَرُونَ مِنْهُمْ سَخِرَ اللهُ مِنْهُمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ‘যারা স্বেচ্ছায় ছাদাক্বা দানকারী মুমিনদের প্রতি বিদ্রূপ করে এবং যাদের স্বীয় পরিশ্রমলব্ধ বস্ত্ত ছাড়া কিছুই নেই তাদেরকে উপহাস করে, আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত করেন এবং তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (তওবা ৯/৭৯)।
[2]. আহমাদ হা/২০৬৪৯; তিরমিযী হা/৩৭০১; মিশকাত হা/৬০৬৪। তিরমিযীর বর্ণনায় এসেছে, مَرَّتَيْنِ (দুই বার)।
এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, তিনি স্বর্ণমুদ্রা ছাড়াও ৯০০ উট, গদি ও পালানসহ ১০০ ঘোড়া (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১৩৬; আর-রাহীক্ব ৪৩৩ পৃঃ) এবং ২০০ উক্বিয়া রৌপ্য মুদ্রা দান করেন (আর-রাহীক্ব ৪৩৩ পৃঃ)। তবে এগুলির সনদ দুর্বলতা থেকে মুক্ত নয় (সীরাহ ছহীহাহ ২/৫২৫)।
[3]. মুহাম্মাদ বিন ওমর আল-হাযরামী ওরফে বাহরাক্ব (মৃ. ৯৩০ হি.), হাদায়েকুল আনওয়ার ওয়া মাত্বালি‘উল আসরার ফী সীরাতিন নবীইল মুখতার (জেদ্দা : দারুল মানহাজ, ১ম সংস্করণ ১৪১৯ হি.) ৩৭২ পৃঃ।
[4]. এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, আবু খায়ছামা মালেক বিন ক্বায়েস আনছারী, যিনি তাবূক যুদ্ধের তহবিলে এক ছা‘ খেজুর দান করেন এবং মুনাফিকরা সেজন্য তাকে বিদ্রুপ করে, রাসূল (ছাঃ)-এর কাফেলা তাবূকের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি নিজ বাড়ীতে প্রবেশ করেন। সেখানে গিয়ে তার দু’জন স্ত্রীকে তার জন্য ঠান্ডা পানি ও খাদ্য সমূহ প্রস্ত্ততরত অবস্থায় দেখতে পান। এসব দেখে তিনি বলে ওঠেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এখন প্রচন্ড দাবদাহের মধ্যে রাস্তা চলছেন। আর আবু খায়ছামা শীতল ছায়ার নীচে উপাদেয় খাদ্য ও সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে তার মাল-সম্পদের মধ্যে অবস্থান করছে? এটা কখনই ইনছাফ নয়। অতঃপর তিনি স্ত্রীদের উদ্দেশ্যে বললেন, আমি কখনই তোমাদের কারু কক্ষে প্রবেশ করব না, যতক্ষণ না আমি রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে মিলিত হব। অতএব তোমরা আমার জন্য পাথেয় প্রস্ত্তত করে দাও। অতঃপর তিনি তার বাহনে উঠে রওয়ানা হ’লেন। পথিমধ্যে উমায়ের বিন ওয়াহাব আল-জুমাহীর সঙ্গে দেখা হ’লে তিনি বলেন, আমার কিছু পাপ রয়েছে। অতএব তুমি আমাকে পিছনে ফেলে যেয়োনা, যতক্ষণ না আমি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে পৌঁছে যাই। অতঃপর তিনি আগে আগে চললেন। অবশেষে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছাকাছি দূরত্বে পৌঁছে গেলে লোকেরা বলল, একজন সওয়ারী এগিয়ে আসছে। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ওটি আবু খায়ছামা। লোকেরা বলল, আল্লাহর কসম! সে আবু খায়ছামা। অতঃপর তিনি সওয়ারী থেকে নেমে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে সালাম করলেন এবং তার বিষয়টি বর্ণনা করলেন। তখন রাসূল (ছাঃ) তার কল্যাণের জন্য দো‘আ করলেন’ (ইবনু হিশাম ২/৫২০-২১; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬৪)।
ঘটনাটি ইবনু ইসহাক বিনা সনদে বর্ণনা করেছেন। এটি ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১৮৭০)।