লগইন করুন
ইবনু ইসহাক বলেন, খায়বর যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে রবীউল আউয়াল থেকে শাওয়াল পর্যন্ত (৬ মাস) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় অবস্থান করেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি কয়েকটি ছোট ছোট সেনাদল বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেন। অতঃপর গত বছরে কৃত হুদায়বিয়া সন্ধির শর্তানুযায়ী তিনি এ বছর যুলক্বা‘দাহ মাসে ওমরাহ করার জন্য প্রস্ত্ততি নেন (ইবনু হিশাম ২/৩৭০)। গত বছরে যারা হোদায়বিয়ায় হাযির ছিলেন, তাদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন তারা ছাড়াও অন্যান্যগণ মিলে মোট দু’হাযার ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে বের হন। মহিলা ও শিশুরা ছিল এই সংখ্যার বাইরে। মূসা বিন উক্ববাহ ইমাম যুহরী থেকে বর্ণনা করেন যে, মুশরিকদের চুক্তিভঙ্গের আশংকায় যুদ্ধে পারদর্শী লোকদের এবং যুদ্ধাস্ত্র সমূহ সঙ্গে নেওয়া হয় এবং তাদেরকে হারামের বাহিরে রেখে দেওয়া হয়। এ কথা জানতে পেরে কুরায়েশরা ভয় পেয়ে যায়। তখন তাদের পক্ষ থেকে গত বছরে হোদায়বিয়ার সন্ধিকালে অন্যতম আলোচক মিকরায বিন হাফছ রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলে তিনি বলেন, তিনি শর্তের উপরেই দৃঢ় আছেন এবং কোষবদ্ধ তরবারী ব্যতীত তারা মক্কায় প্রবেশ করেননি।[1]
এই ওমরাহ চারটি নামে পরিচিত। যথা- ওমরাতুল ক্বাযা(عُمْرَةُ الْقَضَاءِ; হুদায়বিয়ার ওমরাহর ক্বাযা হিসাবে), ওমরাতুল ক্বাযিইয়াহ(عُمْرَةُ الْقَضِيَّةِ; হোদায়বিয়াহর ফায়ছালার প্রেক্ষিতে), ওমরাতুল ক্বিছাছ(عُمْرَةُ الْقِصَاصِ; হোদায়বিয়ার ওমরাহর বদলা হিসাবে), ওমরাতুছ ছুলহ(عُمْرَةُ الصُّلْحِ; হোদায়বিয়া সন্ধির ওমরাহ)।[2]
ইবনু হিশাম বলেন, ‘উওয়াইফ বিন আযবাত্ব আদ-দীলী(عُوَيْفُ بنُ الْأَضبَطِ الدِّيلِيُّ) কে মদীনার প্রশাসক নিযুক্ত করে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।[3] সঙ্গে নেন কুরবানীর জন্য ৬০টি উট। অতঃপর যুল-হুলায়ফা পৌঁছে ওমরাহর জন্য এহরাম বাঁধলেন এবং সকলে উঁচু স্বরে ‘লাববায়েক’ ধ্বনির মাধ্যমে তালবিয়াহ পাঠ করলেন। অতঃপর দীর্ঘ সফর শেষে মক্কা থেকে ৮ মাইল দূরে ইয়া’জাজ (يَأْجَجُ) নামক স্থানে পৌঁছে বর্ম, ঢাল, বর্শা, তীর প্রভৃতি যুদ্ধাস্ত্র সমূহ আওস বিন খাওলা আনছারীর(أَوْسُ بن خَوْلَى الأَنْصَارِيُّ) নেতৃত্বে দু’শো লোককে এগুলির তত্ত্বাবধানে সেখানে রেখে দেওয়া হ’ল। বাকীরা মুসাফিরের অস্ত্র ও কোষবদ্ধ তরবারিসহ মক্কায় গমন করেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় উষ্ট্রী ক্বাছওয়া (الْقَصْوَاءُ) এর পিঠে সওয়ার ছিলেন। মুসলমানগণ স্ব স্ব তরবারি কাঁধে ঝুলিয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে মাঝে রেখে ‘লাববায়েক’ ধ্বনি দিতে দিতে ‘হাজূন’ মুখী টিলার পথ ধরে মক্কায় প্রবেশ করেন।[4]
মুশরিকরা সব বেরিয়ে মক্কার উত্তর পার্শ্বে ‘কু‘আইক্বি‘আন’ (القُعَيْقِعَان) পাহাড়ের উপর জমা হয়ে মুসলমানদের আগমন দেখতে থাকে এবং বলাবলি করতে থাকে যে, ইয়াছরিবের জ্বর(قَدْ وَهَنَتْهُمْ حُمَّى يَثْرِبَ) এদের দুর্বল করে দিয়েছে’। একথা জানতে পেরে রাসূল (ছাঃ) সবাইকে নির্দেশ দিলেন যেন ত্বাওয়াফের সময় প্রথম তিন ত্বাওয়াফ দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করে, যাকে ‘রমল’ (الرَمَل) বলা হয়। তবে রুকনে ইয়ামানী ও হাজারে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে স্বাভাবিক ভাবে চলবে। এ নির্দেশ তিনি এজন্য দেন, যাতে মুশরিকরা মুসলমানদের শক্তি-ক্ষমতা দেখতে পায়’।[5] একই উদ্দেশ্যে তিনি তাদের ইযত্বেবার (الاِضْطِبَاع) নির্দেশ দেন (আহমাদ হা/৩১৭)। যার অর্থ হ’ল ডান কাঁধ খোলা রেখে বগলের নীচ দিয়ে চাদর বাম কাঁধের উপরে রাখা। যাতে ব্যক্তিকে সদা প্রস্ত্তত দেখা যায়। মুশরিকরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে দেখতে থাকে। এরি মধ্যে তিনি ‘লাববায়েক’ ধ্বনি দিতে দিতে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন এবং স্বীয় মাথা বাঁকা লাঠি দ্বারা হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করেন। অতঃপর ত্বাওয়াফ করেন ও মুসলমানেরাও ত্বাওয়াফ করে (আর-রাহীক্ব ৩৮৫ পৃঃ)।
আনাস (রাঃ) বলেন, ত্বাওয়াফের সময় আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাঃ) যুদ্ধছন্দে কবিতা বলে রাসূল (ছাঃ)-এর আগে আগে চলতে থাকেন। এতে হযরত ওমর (রাঃ) তাকে বলেন,يَا ابْنَ رَوَاحَةَ بَيْنَ يَدَىْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَفِى حَرَمِ اللهِ تَقُولُ الشِّعْرَ؟ ‘হে ইবনে রাওয়াহা! রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে ও আল্লাহর হারামের মধ্যে তুমি কবিতা পাঠ করছ’? তখন রাসূল (ছাঃ) ওমরকে বললেন,خَلِّ عَنْهُ يَا عُمَرُ فَلَهِىَ أَسْرَعُ فِيهِمْ مِنْ نَضْحِ النَّبْلِ ‘ওকে ছাড় ওমর! এটা ওদের প্রতি তীর নিক্ষেপের চাইতেও দ্রুত কার্যকর’। কবিতাটি ছিল নিম্নরূপ:
خَلُّوا بَنِي الْكُفَّارِ عَنْ سَبِيلِهِ + الْيَوْمَ نَضْرِبُكُمْ عَلَى تَنْزِيلِهِ
ضَرْبًا يُزِيلُ الْهَامَ عَنْ مَقِيلِهِ + وَيُذْهِلُ الْخَلِيلَ عَنْ خَلِيلِهِ
‘হে কাফির সন্তানেরা! তোমরা আল্লাহর পথ থেকে সরে যাও। আজ আমরা তোমাদের মারব আল্লাহর কুরআনের উপরে’। (২) ‘এমন মার, যা খুলিকে মাথা থেকে বিচ্ছিন্ন করবে এবং বন্ধুকে বন্ধু থেকে ভুলিয়ে দেবে’।[6]
মুসলমানদের এই দ্রুতগতির ত্বাওয়াফ ও সাহসী কার্যক্রম দেখে মুশরিকদের ধারণা পাল্টে গেল এবং তারা বলতে লাগল যে, তোমাদের ধারণা ছিল ভুল।هَؤُلاَءِ أَجْلَدُ مِنْ كَذَا وَكَذَا ‘ওরা তো দেখছি অমুক অমুকের চাইতে বেশী শক্তিশালী’ (মুসলিম হা/১২৬৬)।
ত্বাওয়াফ শেষে তাঁরা সাঈ করেন এবং এ সময় মারওয়ার নিকটে তাদের কুরবানীর পশুগুলি দাঁড়ানো ছিল। সাঈ শেষে রাসূল (ছাঃ) সেখানে গিয়ে বললেন,هَذَا الْمَنْحَرُ، وَكُلُّ فِجَاجِ مَكَّةَ مَنْحَرٌ ‘এটাই হ’ল কুরবানীর স্থান এবং মক্কার সকল অলি-গলি হ’ল কুরবানীর স্থল’ (আবুদাঊদ হা/২৩২৪)। অতঃপর তিনি সেখানে উটগুলি নহর করেন এবং মাথা মুন্ডন করেন। মুসলমানেরাও তাই করেন।
এভাবে হালাল হওয়ার পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) একদল ছাহাবীকে মক্কা থেকে আট মাইল দূরে ইয়া’জাজ পাঠিয়ে দেন। তারা সেখানে গিয়ে অস্ত্র-শস্ত্র পাহারায় থাকেন এবং অন্যদের ওমরাহর জন্য পাঠিয়ে দেন (যাদুল মা‘আদ ৩/৩২৮)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কায় তিনদিন অবস্থান করেন। চতুর্থ দিন সকালে মুশরিক নেতারা এসে আলী (রাঃ)-কে বলেন, সন্ধিচুক্তি অনুযায়ী তিনদিনের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। এবার তোমাদের নেতাকে যেতে বল।[7] তখন রাসূল (ছাঃ) মক্কা থেকে ৬ কি.মি. উত্তরে তান‘ঈম-এর নিকটবর্তী ‘সারিফ’ (السَرِف) নামক স্থানে অবতরণ করেন। অতঃপর সেখানে চাচা আববাস-এর ব্যবস্থাপনায় মায়মূনাহ বিনতুল হারেছ-এর সাথে বিবাহ হয় ও সেখানে বাসর যাপন করেন’ (বুখারী হা/৪২৫৮)।
মক্কা থেকে বেরিয়ে আসার সময় সাইয়েদুশ শুহাদা হযরত হামযা (রাঃ)-এর শিশুকন্যা আমাতুল্লাহ হে চাচা হে চাচা(يَا عَمِّ يَا عَمِّ) বলতে বলতে ছুটে আসে। আলী (রাঃ) তাকে কোলে তুলে নেন। এরপর আলী, জা‘ফর ও যায়েদ বিন হারেছাহর মধ্যে বিতর্ক হয়। কেননা সবাই তাকে নিতে চান। তখন রাসূল (ছাঃ) জা‘ফরের অনুকূলে ফায়ছালা দেন। কেননা জা‘ফরের স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস(أَسمَاء بنت عُمَيْس) ছিলেন মেয়েটির আপন খালা। এ সময় রাসূল (ছাঃ) বলেন,الْخَالَةُ بِمَنْزِلَةِ الأُمِّ ‘খালা হ’লেন মায়ের স্থলাভিষিক্ত’।[8] হামযা-কন্যার পাঁচটি নাম এসেছে। যথাক্রমে ‘উমারাহ, ফাতেমা, উমামাহ, আমাতুল্লাহ ও সালমা। তন্মধ্যে প্রথম নামটিই অধিক প্রসিদ্ধ’।[9]
উল্লেখ্য যে, ‘উমরাতুল ক্বাযা আদায়ের মাধ্যমেই সূরা ফাৎহ ২৭ আয়াত-এর ভবিষ্যদ্বাণী কার্যকর হয়। যেখানে আল্লাহ বলেন,لَقَدْ صَدَقَ اللهُ رَسُولَهُ الرُّؤْيَا بِالْحَقِّ لَتَدْخُلُنَّ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ إِنْ شَاءَ اللهُ آمِنِينَ مُحَلِّقِينَ رُؤُوسَكُمْ وَمُقَصِّرِينَ لاَ تَخَافُونَ فَعَلِمَ مَا لَمْ تَعْلَمُوا فَجَعَلَ مِنْ دُونِ ذَلِكَ فَتْحًا قَرِيبًا ‘আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সত্য স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আল্লাহ চাহেন তো তোমরা অবশ্যই মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে মস্তক মুন্ডিত অবস্থায় এবং কেশ কর্তিত অবস্থায়। এমনভাবে যে, তোমরা কাউকে ভয় করবে না। অতঃপর তিনি জানেন, যা তোমরা জানো না। অতঃপর তিনি দিবেন তোমাদেরকে একটি নিকটবর্তী বিজয়’।[10] অর্থাৎ হোদায়বিয়ার সন্ধি। যার ফলে পরবর্তী বছর নিরাপদে ক্বাযা ওমরাহ আদায়ের সুযোগ হয়।
[2]. ফাৎহুল বারী ‘ক্বাযা ওমরাহ’ অনুচ্ছেদ; সীরাহ হালাবিইয়াহ ২/৭৭৯; শারহুল মাওয়াহেব ৩/৩১১।
[3]. ইবনু হিশাম ২/৩৭০; মুবারকপুরী এখানে আবু রুহুম ‘উওয়াইফ আল-গিফারী লিখেছেন (আর-রাহীক্ব ৩৮৪ পৃঃ)। কিন্তু তাঁর প্রদত্ত সূত্রগুলিতে ঐ নাম পাওয়া যায়নি।
[4]. আর-রাহীক্ব ৩৮৪ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/৩২৭।
[5]. মুসলিম হা/১২৬৬; বুখারী হা/৪২৫৬।
[6]. তিরমিযী হা/২৮৪৭ ‘শিষ্টাচার ও অনুমতি প্রার্থনা’ অধ্যায়, ‘কবিতা আবৃত্তি’ অনুচ্ছেদ; নাসাঈ হা/২৮৭৩।
[7]. বুখারী হা/৪২৫১; মিশকাত হা/৪০৪৯।
[8]. বুখারী হা/২৬৯৯; আহমাদ হা/৯৩১; ছহীহাহ হা/১১৮২।
[9]. ফাৎহুল বারী হা/৪২৫১-এর আলোচনা।
আসমা বিনতে ‘উমায়েস (রাঃ) স্বামী জা‘ফর বিন আবু ত্বালেব (রাঃ)-এর সাথে হাবশায় হিজরত করেন। অতঃপর মুতার যুদ্ধে জা‘ফর শহীদ হ’লে আবুবকর (রাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন। তাঁর গর্ভে মুহাম্মাদ বিন আবুবকরের জন্ম হয়। আবুবকর (রাঃ) মৃত্যুর সময় আসমাকে অছিয়ত করে যান তাঁকে গোসল দেওয়ার জন্য। পরে তিনি আলী (রাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন’ (আল-ইছাবাহ, আসমা ক্রমিক ১০৮০৩)। হযরত আলী (রাঃ)-এর শাহাদাতের পরেও তিনি বেঁচেছিলেন (সিয়ারু আ‘লাম ক্রমিক ৫১, ২/২৮৭)। তিনি উম্মুল মুমিনীন যয়নব বিনতে খুযায়মাহ ও মায়মূনা বিনতুল হারেছ (রাঃ)-এর সহোদর বোন ছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, তিনি ৬০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
[10]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ফাৎহ ২৭ আয়াত; সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৬৫।