লগইন করুন
১. কুরায়েশ তরুণদের অপকৌশল(مكيدة شباب قريش) : বুদাইল, উরওয়া ও হুলাইস-এর রিপোর্ট কাছাকাছি প্রায় একই রূপ হওয়ায় এবং সকলে রাসূল (ছাঃ)-এর দেওয়া প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করায় কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ আপোষ করার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। কিন্তু তরুণরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা নিজেরা গোপনে পৃথকভাবে এক কৌশল প্রস্ত্তত করে যে, রাতের অন্ধকারে তারা মুসলিম শিবিরে অতর্কিতে প্রবেশ করে এমন হৈ চৈ লাগিয়ে দেবে, যাতে উভয়পক্ষে যুদ্ধ বেধে যায় । পরিকল্পনা মোতাবেক ৭০ কিংবা ৮০ জন যুবক ‘তানঈম’ পাহাড় থেকে নেমে সোজা মুসলিম শিবিরে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রহরীদের নেতা মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর হাতে সবাই গ্রেফতার হয়ে যায়। পরে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সন্ধির প্রতি আগ্রহের কারণে(رَغْبَةً فيِ الصُّلْح) সবাইকে ক্ষমা করেন ও মুক্ত করে দেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,وَهُوَ الَّذِي كَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنْكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ عَنْهُمْ بِبَطْنِ مَكَّةَ مِنْ بَعْدِ أَنْ أَظْفَرَكُمْ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرًا ‘তিনিই মক্কা শহরে তাদের হাত তোমাদের থেকে এবং তোমাদের হাত তাদের থেকে নিবৃত্ত করেছেন তাদের উপর তোমাদের বিজয়ী করার পর। বস্ত্ততঃ তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ সবই দেখেন’ (ফাৎহ ৪৮/২৪)।
২. আপোষ চেষ্টায় মক্কায় প্রতিনিধি প্রেরণ(إرسال المندوب إلى مكة للمصالحة) : অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কুরায়েশদের নিকটে এমন একজন দূত প্রেরণের চিন্তা করলেন, যিনি তাদের নিকটে গিয়ে বর্তমান সফরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জোরালোভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেন এবং অহেতুক যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পারেন। এজন্য তিনি প্রথমে খারাশ বিন উমাইয়া আল-খুযাঈকে পাঠান। কিন্তু কুরায়েশরা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। যদি না বেদুঈনরা বাধা দিত (আহমাদ হা/১৮৯৩০)। অতঃপর ওমর (রাঃ)-কে নির্বাচন করলেন। কিন্তু তিনি বললেন যে, মক্কায় বনু ‘আদী গোত্রের একজন লোকও নেই যে আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে যদি আমি আক্রান্ত হই’। তাছাড়া আমার প্রতি তাদের আক্রোশ আপনি জানেন। তার চাইতে আপনি এমন একজনকে পাঠান, যিনি আমার চাইতে তাদের নিকট অধিক সম্মানিত। আপনি ওছমানকে প্রেরণ করুন। কেননা সেখানে তার গোত্রীয় লোকজন রয়েছে। তিনি আপনার বার্তা তাদের নিকটে ভালভাবে পৌঁছাতে পারবেন’।
অতঃপর রাসূল (ছাঃ) ওছমানকে ডাকলেন এবং তাকে কুরায়েশ নেতাদের কাছে পাঠালেন এই বলে যে,أَنَّا لَمْ نَأْتِ لِقِتَالٍ وَإِنَّمَا جِئْنَا عُمَّارًا ‘আমরা লড়াই করতে আসিনি বরং আমরা এসেছি ওমরাহকারী হিসাবে’। তিনি তাদেরকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দিতে বললেন। এছাড়াও মক্কার গোপন মুমিন নর-নারীদের কাছে সত্বর বিজয়ের সুসংবাদ শুনাতে বললেন এবং বলতে বললেন যে, আললাহ শীঘ্র তাঁর দ্বীনকে মক্কায় বিজয়ী করবেন। তখন আর কাউকে তার ঈমান লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন হবে না’।
আদেশ পাওয়ার পর ওছমান (রাঃ) মক্কাভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। বালদাহ (بَلْدَح) নামক স্থানে পৌঁছলে কুরায়েশদের কিছু লোক তাঁকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছেন? জবাবে তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে অমুক অমুক কাজে পাঠিয়েছেন। তারা বলল,قَدْ سَمِعْنَا مَا تَقُولُ ‘আমরা শুনেছি যা আপনি বলবেন’। এ সময় আবান বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ এসে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে নিজ ঘোড়ায় বসিয়ে নিলেন। অতঃপর মক্কায় উপস্থিত হয়ে ওছমান (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ মোতাবেক নেতৃবৃন্দের কাছে বার্তা পৌঁছে দিলেন ও তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। বার্তা পৌঁছানোর কাজ শেষ হ’লে নেতারা তাঁকে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করার অনুরোধ জানালেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পূর্বে তিনি তাওয়াফ করতে অস্বীকার করলেন।[1]
৩. ওছমান হত্যার ধারণা ও বায়‘আতুর রিযওয়ান(ظن قتل عثمان وبيعة الرضوان) :
মক্কায় কাজ মিটাতে বেশ দেরী হয়ে যায়। তাতে মুসলমানরা ধারণা করেন যে, মক্কাবাসীরা ওছমানকে হত্যা করেছে। তখন রাসূল (ছাঃ) ‘সামুরাহ’ বৃক্ষের(شَجَرَةُ السَّمُرَةِ) নীচে সবাইকে বায়‘আতের জন্য আহবান করলেন। যেখানে সবাই ওছমান হত্যার প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত ফিরে যাবে না বলে আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন। ইতিহাসে এটাই বায়‘আতুর রিযওয়ান(بَيْعَةُ الرِّضْوَانِ) বলে পরিচিত। এদিন বায়‘আত করার জন্য প্রথমে এগিয়ে আসেন আবু সিনান আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহাব আল-আসাদী’ (মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৩১৭৫)। অতঃপর সকলে বায়‘আত করেন একজন ব্যতীত। যার নাম জাদ বিন ক্বায়েস আনছারী(جَدُّ بنُ قَيْسٍ)। সে মুনাফিক ছিল। এদিন বায়‘আতকারীদের উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَنْتُمُ الْيَوْمَ خَيْرُ أَهْلِ الأَرْضِ ‘আজ তোমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ’ (বুখারী হা/৪১৫৪)। বায়‘আত শেষ হওয়ার পরপরই ওছমান (রাঃ) ফিরে আসেন।
বায়‘আতের বিবরণ দিতে গিয়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন,فَلَوْ كَانَ أَحَدٌ أَعَزَّ بِبَطْنِ مَكَّةَ مِنْ عُثْمَانَ لَبَعَثَهُ مَكَانَهُ ‘যদি মক্কার জনপদে ওছমানের চাইতে উত্তম কেউ থাকতেন, তাহ’লে রাসূল (ছাঃ) তাকেই কুরায়েশদের নিকট পাঠাতেন’। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) ওছমানকে মক্কায় পাঠান। তিনি চলে যাওয়ার পর বায়‘আতুর রিযওয়ান অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাঁর ডান হাত দেখিয়ে বলেন,هَذِهِ يَدُ عُثْمَانَ ‘এটি ওছমানের হাত’। অতঃপর সেটি দিয়ে অন্য হাতে মারেন এবং বলেন,هَذِهِ لِعُثْمَانَ ‘এটি ওছমানের জন্য’ (বুখারী হা/৩৬৯৮)। এরপর যথারীতি বায়‘আত অনুষ্ঠিত হয়।
উল্লেখ্য যে, বায়‘আত অনুষ্ঠান শেষে ‘ওছমান ফিরে এলেন। অতঃপর তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করলেন’(جاءَ عثمانُ فبايعَهُ) বলে যে কথা মুবারকপুরী লিখেছেন (আর-রাহীক্ব ৩৪১-৪২ পৃঃ), তা দলীল বিহীন এবং এটি কোন জীবনীকার লেখেননি। বরং বাস্তব কথা এই যে, ওছমানের পক্ষে রাসূল (ছাঃ) নিজেই স্বীয় ডান হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ও তার উপরেই বায়‘আত নিয়েছিলেন। অতএব পুনরায় এসে তাঁর বায়‘আত গ্রহণের কোন প্রয়োজন ছিল না। তবে নিঃসন্দেহে এই বায়‘আতের ফযীলতে তিনি অংশীদার ছিলেন। তাছাড়া ওছমানের নিজ হাতে বায়‘আত করার চাইতে তাঁর পক্ষে রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করা নিঃসন্দেহে অধিক উত্তম ছিল।
উক্ত বিষয়ে জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, এদিন আমরা চৌদ্দশ’ ব্যক্তি ছিলাম। আমরা সবাই বায়‘আত করেছিলাম। কেবল জাদ বিন ক্বায়েস আনছারী বায়‘আত করেনি। সে তার উটের পেটের নীচে লুকিয়ে ছিল। তিনি বলেন, আমরা মৃত্যুর উপরে বায়‘আত করিনি। বরং বায়‘আত করেছিলাম যেন আমরা পালিয়ে না যাই। এ সময় ওমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাত ধরে রেখেছিলেন’।[2]
মা‘ক্বিল বিন ইয়াসার (রাঃ) বলেন, ‘আমি গাছের ডাল উঁচু করে ধরে রেখেছিলাম’ (মুসলিম হা/১৮৫৮)। এদিন দক্ষ তীরন্দায সালামাহ ইবনুল আকওয়া‘ শুরুতে, মাঝে এবং শেষে মোট তিনবার বায়‘আত করেন’।[3] সালামাহ বলেন, এদিন আমরা মৃত্যুর উপরে বায়‘আত করি’ (মুসলিম হা/১৮৬০)। নাফে‘কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘তাঁরা মৃত্যুর উপর বায়‘আত করেননি। বরং ছবরের উপর বায়‘আত করেছিলেন’ (বুখারী হা/২৯৫৮)। এ বিষয়ে হাফেয ইবনু হাজার বলেন, মৃত্যুর উপরে বায়‘আতের অর্থ হ’ল, মৃত্যু হয়ে গেলেও যেন পালিয়ে না যাই। এটা নয় যে, অবশ্যই মৃত্যুবরণ করতে হবে। ছবরের অর্থ হ’ল, দৃঢ় থাকা এবং পালিয়ে না যাওয়া। তাতে বন্দীত্ব বা মৃত্যু যেটাই আসুক না কেন’।[4]
উপরের হাদীছগুলি সহ অন্য কোন ছহীহ হাদীছে বায়‘আতুর রিযওয়ান-এর কারণ কি ছিল সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। যদিও বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থে ওছমান হত্যার খবর শোনার পরে রাসূল (ছাঃ) সবার নিকট থেকে এই বায়‘আত গ্রহণ করেন বলে বর্ণিত হয়েছে। যা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়।[5] বরং শত্রুপক্ষের সম্ভাব্য হামলার বিরুদ্ধে আল্লাহর নামে দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণের জন্য রাসূল (ছাঃ) মুসলমানদের কাছ থেকে এই বায়‘আত নিয়েছিলেন। বস্ত্ততঃ ওছমান (রাঃ) প্রদত্ত প্রস্তাবনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও জবাব প্রদানের জন্য কুরায়েশ নেতাদের শলা-পরামর্শ কিছুটা দীর্ঘায়িত হয়। এতে তাঁর প্রত্যাবর্তন বিলম্বিত হয়। এভাবে যখন বায়‘আত সম্পন্ন হয়ে গেল, তখন ওছমান (রাঃ) এসে হাযির হন। এ ঘটনাই বায়‘আতুর রিযওয়ান(بَيْعَةُ الرِّضْوَانِ) বা সন্তুষ্টির বায়‘আত নামে খ্যাত। কেননা আল্লাহ পাক মুসলমানদের এই স্বতঃস্ফূর্ত বায়‘আত গ্রহণে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
ফযীলত(فضيلة البيعة) : এই বায়‘আতে আল্লাহ খুশী হয়ে সাথে সাথে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন-لَقَدْ رَضِيَ اللهُ عَنِ الْمُؤْمِنِيْنَ إِذْ يُبَايِعُوْنَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِيْ قُلُوْبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِيْنَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحاً قَرِيْباً ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন মুমিনদের উপরে যখন তারা বায়‘আত করছিল তোমার নিকটে বৃক্ষের নীচে। আল্লাহ অবগত ছিলেন যা তাদের অন্তরে ছিল। অতঃপর তিনি তাদের উপরে বিশেষ প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয় পুরস্কার দিলেন’ (ফাৎহ ৪৮/১৮)। এছাড়াও আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِيْنَ يُبَايِعُوْنَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُوْنَ اللهَ يَدُ اللهِ فَوْقَ أَيْدِيْهِمْ فَمَن نَّكَثَ فَإِنَّمَا يَنْكُثُ عَلَى نَفْسِهِ وَمَنْ أَوْفَى بِمَا عَاهَدَ عَلَيْهُ اللهَ فَسَيُؤْتِيْهِ أَجْراً عَظِيْماً ‘নিশ্চয়ই যারা তোমার নিকটে বায়‘আত করেছে, তারা তো আল্লাহর নিকটেই বায়‘আত করেছে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে। অতঃপর যে ব্যক্তি বায়‘আত ভঙ্গ করে, সে তার নিজের ক্ষতির জন্যই সেটা করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে, সত্বর আল্লাহ তাকে মহা পুরস্কারে ভূষিত করবেন’ (ফাৎহ ৪৮/১০)।
এই বায়‘আতের পরকালীন গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ يَدْخُلُ النَّارَ إِنْ شَاءَ اللهُ مِنْ أَصْحَابِ الشَّجَرَةِ أَحَدٌ الَّذِينَ بَايَعُوا تَحْتَهَا ‘আল্লাহ চাহেন তো বৃক্ষতলে বায়‘আতকারীদের কোন ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে না’ (মুসলিম হা/২৪৯৬)। তিনি বলেন,كُلُّكُمْ مَغْفُورٌ لَهُ إِلاَّ صَاحِبَ الْجَمَلِ الأَحْمَرِ ‘তোমরা প্রত্যেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত লাল উটওয়ালা ব্যতীত’ (মুসলিম হা/২৭৮০ (১২)। ইমাম নববী বলেন, কাযী আয়ায বলেন, ‘লাল উটওয়ালা’ বলে জাদ বিন ক্বায়েস মুনাফিককে বুঝানো হয়েছে (শরহ মুসলিম)। ফলে এই বায়‘আতে অংশগ্রহণকারীগণের অবস্থা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ন্যায় হয়ে গেছে। তাঁরা সবাই হ’লেন স্ব স্ব জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত (ফালিল্লাহিল হাম্দ)।
উল্লেখ্য যে, নাফে‘ বলেন, ওমর (রাঃ)-এর কাছে খবর পৌছলো এই মর্মে যে, লোকেরা ঐ গাছের নিকট গিয়ে ছালাত আদায় করছে। তখন তিনি তাদেরকে খুবই ধমকালেন এবং গাছটি কেটে ফেলার নির্দেশ দিলেন’।[6] ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, যখন আমরা পরের বছর পুনরায় গেলাম (ক্বাযা ওমরাহ আদায়ের জন্য), তখন আমাদের দু’জন ব্যক্তিও গাছের নীচে জমা হয়নি। যেখানে আমরা বায়‘আত করেছিলাম। আর এটি ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত’ (বুখারী, ফৎহুল বারী হা/২৯৫৮-এর ব্যাখ্যা)। এর অর্থ, গাছটির অবস্থান গোপন থাকায় মানুষ সেখানে কোনরূপ পূজা করার সুযোগ পায়নি। যাতে তারা ঐ গাছটিকে কোনরূপ উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে বলে বিশ্বাসী না হয়’ (ঐ)।
৪. আবু জান্দালের আগমন(قدوم أبى جندل) : সন্ধিপত্র লেখার কাজ চলছে এরি মধ্যে সোহায়েল-পুত্র আবু জান্দাল(أَبُو جَنْدَل) শিকল পরা অবস্থায় পা হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে এসে মুসলিম শিবিরে ঢুকে পড়ল। তাকে দেখে সোহায়েল বলে ওঠেন, এই আবু জান্দালই হ’ল প্রথম ব্যক্তি যে বিষয়ে আমরা চুক্তি করেছি যে, আপনি তাকে ফেরৎ দিবেন। (কেননা সে অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই পালিয়ে আপনার দলে চলে এসেছে)। রাসূল (ছাঃ) বললেন, এখনও তো চুক্তি লিখন কাজ শেষ হয়নি? সোহায়েল বললেন, আল্লাহর কসম! তাহ’লে চুক্তির ব্যাপারে আমি আর কোন কথাই বলব না’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, অন্ততঃ আমার খাতিরে তুমি ওকে ছেড়ে দাও’। সোহায়েল বললেন, আপনার খাতিরেও আমি তাকে ছাড়ব না। রাসূল (ছাঃ) বললেন,بَلَى فَافْعَلْ ‘হ্যাঁ এটুকু তুমি কর’। তিনি বললেন,مَا أَنَا بِفَاعِلٍ ‘না আমি তা করব না’। অতঃপর সোহায়েল আবু জান্দালের মুখে চপেটাঘাত করে তার গলার কাপড় ধরে টানতে টানতে মুশরিকদের নিকটে নিয়ে চললেন। আবু জান্দাল তখন অসহায়ভাবে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগল ‘হে মুসলিমগণ! আমি কি মুশরিকদের কাছে ফিরে যাব? ওরা আমাকে দ্বীনের ব্যাপারে ফিৎনায় নিক্ষেপ করবে’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,يَا أَبَا جَنْدَلٍ، اصْبِرْ وَاحْتَسِبْ ‘হে আবু জান্দাল! ধৈর্য ধর এবং ছওয়াবের আশা কর। আল্লাহ তোমার ও তোমার সাথী দুর্বলদের জন্য মুক্তির পথ খুলে দেবেন। আমরা কুরায়েশদের সঙ্গে সন্ধি করেছি। তারা ও আমরা পরস্পরে আল্লাহর নামে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। যা আমরা ভঙ্গ করতে পারি না’।[7]
৫. মুহাজির মহিলাদের ফেরৎ দানে অস্বীকৃতি(إنكار رد النساء المهاجرات) : এই সময় মক্কা হ’তে বেশ কিছু মুমিন মহিলা আগমন করলেন, যারা মদীনায় হিজরত করতে চান। তাদের অভিভাবকগণ তাদের ফেরৎ নিতে এলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ফেরৎ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, সন্ধিচুক্তিতে পুরুষ মুহাজিরের কথা বলা আছে, মহিলাদের কথা নেই। কেননা চুক্তির ভাষ্য হ’ল এই যে,وَعَلَى أَنَّهُ لاَ يَأْتِيْكَ مِنَّا رَجُلٌ وَإِنْ كَانَ عَلَى دِيْنِكَ إِلاَّ رَدَدْتَهُ إِلَيْنَا ‘আমাদের মধ্যকার কোন পুরুষ(رَجُلٌُ) যদি আপনার নিকটে আসে, সে আপনার দ্বীনের উপরে হ’লেও তাকে আপনি ফেরৎ দিবেন’ (বুখারী হা/২৭৩২)। এখানে মহিলাদের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। একই সময়ে ঐ ধরণের মহিলা মুহাজিরদের সম্পর্কে সূরা মুমতাহিনা ১০ আয়াতটি নাযিল হয়। যাতে বলা হয় যে, এইসব মুহাজির মহিলাগণকে পরীক্ষা করো। পরীক্ষায় সত্যিকারের মুমিন প্রমাণিত হ’লে তাদেরকে কাফেরদের নিকটে ফেরৎ দিয়ো না। কেননা কাফেরগণ তাদের জন্য হালাল নয়। অতঃপর ঐসব মহিলাদেরকে যথাযথভাবে মোহর দানের মাধ্যমে মুমিনদের সাথে বিবাহের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তাদের কাছ থেকে বায়‘আত গ্রহণের আদেশ দেওয়া হয় (মুমতাহিনা ৬০/১২)। উক্ত আয়াত নাযিলের ফলে হযরত ওমর (রাঃ) মক্কায় তাঁর দু’জন মুশরিক স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেন। যারা পরে একজন মু‘আবিয়ার সাথে, অন্যজন আবু জাহম বিন হুযায়ফাহ অথবা তার পরে ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার সাথে বিবাহিতা হন।[8]
৬. ওমরাহ থেকে হালাল হ’লেন সবাই(يتحللون جميعا من العمرة) : চুক্তি সম্পাদনের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবাইকে হালাল হওয়ার জন্য স্ব স্ব পশু কুরবানী করতে বললেন। তিনি পরপর তিনবার একথা বললেন। কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। তখন রাসূল (ছাঃ) উম্মে সালামাহর কাছে গিয়ে বিষয়টি বললেন। তিনি পরামর্শ দিলেন যে, আপনি এটা চাইলে ‘সোজা বেরিয়ে যান ও কাউকে কিছু না বলে নিজের উটটি নহর করুন। অতঃপর নাপিত ডেকে নিজের মাথা মুন্ডন করুন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাই করলেন। তখন সবাই উঠে দাঁড়ালো ও স্ব স্ব কুরবানী সম্পন্ন করল। অতঃপর কেউ মাথা মুন্ডন করল, কেউ চুল ছাঁটলো’ (বুখারী হা/২৭৩২)। সবাই এত দুঃখিত ছিল যে, যেন পরস্পরকে হত্যা করবে। সেই সময় তাঁরা প্রতি সাত জনে একটি গরু অথবা একটি উট নহর করেন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আবু জাহলের হৃষ্টপুষ্ট নামকরা উটটি নহর করেন (যা বদরযুদ্ধে গণীমত হিসাবে হস্তগত হয়েছিল), যার নাকে রূপার নোলক ছিল। উদ্দেশ্য, যাতে মক্কার মুশরিকরা মনোকষ্টে ভোগে। এই সময় রাসূল (ছাঃ) মাথা মুন্ডনকারীদের জন্য তিনবার ও চুল ছাঁটাইকারীদের জন্য একবার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এই সফরে এহরাম অবস্থায় অসুখ বা কষ্টের কারণে মাথা মুন্ডনকারীর জন্য ফিদইয়ার বিধান নাযিল হয়। যা কা‘ব বিন উজরাহর(كَعْبُ بنُ عُجْرَةَ) মাথায় প্রচন্ড উকুনের কারণে নাযিল হয়েছিল। হজ্জ ও ওমরাহর কোন ওয়াজিব তরক করলে ‘ফিদইয়া’ ওয়াজিব হয়। এজন্য একটি বকরী কুরবানী দিবে অথবা ৬ জন মিসকীনকে তিন ছা‘ খাদ্য দিবে অথবা তিনটি ছিয়াম পালন করবে’।[9]
৭. সন্ধির ব্যাপারে মুসলমানদের বিষণ্ণতা ও রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ওমর (রাঃ)-এর বিতর্ক (غم المسلمين من الصلح ومكالمة عمر مع الرسول صـ) : হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তির দু’টি বিষয় মুসলিম কাফেলার অন্তরে দারুণভাবে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, যা তাদের হৃদয়কে দুঃখে ও বেদনায় ভারাক্রান্ত করে ফেলেছিল। (ক) রওয়ানা হবার সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছিলেন যে, আমরা বায়তুল্লাহ গমন করব ও তাওয়াফ করব। অথচ এখন তিনি তা না করেই ফিরে যাচ্ছেন। (খ) তিনি আল্লাহর রাসূল এবং তিনি সত্যের উপরে আছেন। উপরন্তু আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার ওয়াদা দিয়েছেন। তাহ’লে কুরায়েশদের চাপে তিনি কেন ওমরাহ না করেই ফিরে যাওয়ার মত হীন শর্তে সন্ধি করলেন।
বলা বাহুল্য উসায়েদ বিন হুযায়ের, সা‘দ বিন উবাদাহ, সাহল বিন হুনাইফ এবং অন্যান্য সকলের অনুভূতির মুখপাত্র স্বরূপ ওমর ফারূক (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে উপস্থিত হয়ে নিম্নোক্ত বাদানুবাদ করেন। ওমর বলেন, হে আল্লাহর রাসূল!أَلَسْنَا عَلَى الْحَقِّ وَهُم عَلَى الْبَاطِلِ ‘আমরা কি হক-এর উপরে নই? এবং তারা বাতিলের উপরে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। ওমর বললেন,أَلَيْسَ قَتْلاَنَا فِي الْجَنَّةِ وَقَتْلاَهُمْ فِي النَّارِ؟ ‘আমাদের নিহতেরা কি জান্নাতে নয়? এবং তাদের নিহতেরা জাহান্নামে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। ওমর বললেন, তাহ’লে কেন আমরা দ্বীনের ব্যাপারে ছাড় দেব এবং ফিরে যাব? অথচ আল্লাহ পাক এখনো আমাদের ও তাদের মাঝে কোনরূপ ফায়ছালা করেননি? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন,يَا ابْنَ الْخَطَّابِ، إِنِّى رَسُولُ اللهِ، وَلَنْ يُضَيِّعَنِى اللهُ أَبَدًا ‘হে ইবনুল খাত্ত্বাব! আমি আল্লাহর রাসূল। কখনোই আল্লাহ আমাকে ধ্বংস করবেন না’।[10] অন্য বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন,إِنِّي رَسُولُ اللهِ، وَلَسْتُ أَعْصِي رَبِّي، وَهُوَ نَاصِرِيْ ‘আমি আল্লাহর রাসূল। আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করি না। তিনিই আমার সাহায্যকারী’। তখন ওমর বললেন,أَوَ لَيْسَ كُنْتَ تُحَدِّثُنَا أَنَّا سَنَأْتِي الْبَيْتَ، فَنَطُوفُ بِهِ؟ ‘আপনি কি আমাদের বলেননি যে, সত্বর আমরা আল্লাহর ঘরে গমন করব ও তাওয়াফ করব’? জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তবে আমি কি তোমাকে বলেছিলাম যে, আমরা এবছরই সেটা করব’? ওমর বললেন, না’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,فَإِنَّكَ تَأْتِيْهِ، فَتَطُوفُ بِهِ ‘তাহ’লে অবশ্যই তুমি আল্লাহর ঘরে আসবে ও তাওয়াফ করবে’।[11]
অতঃপর ওমর (রাঃ) রাগতঃভাবে বেরিয়ে আবুবকর (রাঃ)-এর কাছে গেলেন ও একইরূপ অভিযোগ করলেন। তিনিও তাকে রাসূল (ছাঃ)-এর ন্যায় জবাব দিলেন এবং বললেন,إِنَّهُ رَسُولُ اللهِ، وَلَنْ يُضَيِّعَهُ اللهُ أَبَدًا ‘নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহর রাসূল এবং কখনোই আল্লাহ তাঁকে ধ্বংস করবেন না’।[12] তিনি আরও বলেন,أَيُّهَا الرَّجُلُ إِنَّهُ رَسُولُ اللهِ، وَلَيْسَ يَعْصِي رَبَّهُ، وَهُوَ نَاصِرُهُ، فَاسْتَمْسِكْ بِغَرْزِهِ، حَتَّى تَمُوتَ، فَوَاللهِ إِنَّهُ عَلَى الْحَقِّ ‘হে ব্যক্তি! নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহর রাসূল। তিনি তাঁর প্রতিপালকের অবাধ্যতা করেন না। তিনিই তাঁকে সাহায্যকারী। অতএব তুমি আমৃত্যু তাঁর রাস্তা দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে থাক। আল্লাহর কসম! তিনি অবশ্যই হক-এর উপরে আছেন’ (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৮৭২, সনদ ছহীহ)। এর মাধ্যমে আবুবকর (রাঃ)-এর ঈমানী দৃঢ়তা ও অবিচল আনুগত্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।
৮. ‘ফাৎহুম মুবীন’ (فَتْحٌ مُّبِينٌ) :
ফেরার পথে মক্কা থেকে মদীনার পথে ৪২ মাইল (৬৪ কি. মি.) দূরে কোরাউল গামীম(كُرَاعُ الْغَمِيمِ) পৌঁছলে সূরা ফাৎহ-এর প্রথম দিকের আয়াতগুলি নাযিল হয় (ফাৎহুল বারী হা/৪১৫২-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)। যেখানে বলা হয়,إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُبِينًا- لِيَغْفِرَ لَكَ اللهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ وَيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكَ وَيَهْدِيَكَ صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا- وَيَنْصُرَكَ اللهُ نَصْرًا عَزِيزًا ‘আমরা তোমাকে স্পষ্ট বিজয় দান করেছি’। ‘যাতে আল্লাহ তোমার অতীত ও ভবিষ্যৎ ত্রুটিসমূহ ক্ষমা করে দেন এবং তোমার প্রতি তাঁর নে‘মত পূর্ণ করেন ও তোমাকে সরল পথে পরিচালিত করেন’। ‘আর তোমাকে দান করেন বলিষ্ঠ সাহায্য’ (ফাৎহ ৪৮/১-৩)। রাসূল (ছাঃ) ওমরের কাছে লোক পাঠিয়ে আয়াতটি শুনিয়ে দিলেন। তখন ওমর এসে বললেন,يَا رَسُوْلَ اللهِ، أَوَ فَتْحٌ هُوَ؟ ‘হে আল্লাহর রাসূল! এটা কি বিজয় হ’ল’? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি খুশী হ’লেন ও ফিরে গেলেন’ (মুসলিম হা/১৭৮৫ (৯৪)।
ওমর (রাঃ) তার ঐদিনের বাড়াবাড়ির কারণে দারুণভাবে লজ্জিত হন। তিনি বলেন,
مَا زِلْتُ أَصُومُ وَأَتَصَدَّقُ وَأُصَلِّى وَأَعْتِقُ مِنَ الَّذِى صَنَعْتُ مَخَافَةَ كَلاَمِى الَّذِى تَكَلَّمْتُ بِهِ يَوْمَئِذٍ حَتَّى رَجَوْتُ أَنْ يَكُونَ خَيْراً
‘আমি এজন্য অনেক সৎকর্ম করেছি। সর্বদা ছাদাক্বা করেছি, ছিয়াম রেখেছি, নফল ছালাত আদায় করেছি, দাস-দাসী মুক্ত করেছি- শুধু ঐদিন ঐকথাগুলি বলার গোনাহর ভয়ে। এখন আমি মঙ্গলের আশা করছি’ (আহমাদ হা/১৮৯৩০)।
এভাবে ৪৫২ কিঃ মিঃ দূর থেকে ইহরাম বেঁধে এসে মাত্র ২২ কিঃ মিঃ দূরে থাকতে ফিরে যেতে হ’ল। অথচ কা‘বাগৃহ এমন একটি স্থান যেখানে পিতৃহন্তা আশ্রয় নিলেও তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়। কিন্তু আড়াই হাযার বছর থেকে চলে আসা এই রেওয়াজ রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর সাথী মুসলমানদের জন্য ভঙ্গ করা হ’ল এবং তাঁদেরকে কা‘বাগৃহ যেয়ারতে বাধা দেওয়া হ’ল। শান্তির বৃহত্তর স্বার্থে রাসূল (ছাঃ) তা মেনে নিলেন। যদিও সাথীরা প্রায় সবাই তাতে নারায ছিলেন। এর মধ্যে নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও তার প্রতি কর্মীদের অটুট আনুগত্যের অনন্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
৯. চুক্তির প্রতিক্রিয়া(رجعية الهدنة) :
চুক্তি শেষে রাসূল (ছাঃ) যখন মদীনায় ফিরে আসেন, তখন আবু বাছীর নামে কুরায়েশের একজন ব্যক্তি মুসলিম হয়ে মদীনায় আসেন। তখন কুরায়েশরা তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য দু’জন লোক পাঠায়। তারা এসে এই চুক্তির দোহাই দিয়ে তাকে ফেরৎ চায়। তখন রাসূল (ছাঃ) আবু বাছীরকে তাদের হাতে অর্পণ করেন। অতঃপর তারা তাকে নিয়ে বের হয়ে যায় এবং যুল হুলায়ফাতে অবতরণ করে খেজুর খেতে থাকে। এমন সময় আবু বাছীর তাদের একজনকে বললেন, আল্লাহর কসম! তোমার তরবারীটা কতই না সুন্দর! তাতে লোকটি খুশী হয়ে তরবারী টান দিয়ে বের করে বলল, অবশ্যই আল্লাহর কসম এটি খুবই সুন্দর। আমি এটি বার বার পরীক্ষা করেছি। আবু বাছীর বললেন, আমাকে দাও তো আমি একটু দেখি। তখন সে তাকে তরবারীটি দিল। হাতে পেয়েই আবু বাছীর তাকে হত্যা করে ফেলল। এ দৃশ্য দেখে দ্বিতীয় জন ভয়ে দৌড় দিয়ে মদীনায় পৌঁছে গেল এবং মসজিদে প্রবেশ করল। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-কে বলল, আল্লাহর কসম আমার সাথী নিহত হয়েছে। এমন সময় আবু বাছীর পিছে পিছে এসে বলল, হে আল্লাহর নবী! আপনি অবশ্যই আপনার চুক্তি পালন করেছেন। আপনি আমাকে তাদের নিকটে ফেরৎ দিয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ আমাকে তাদের থেকে নাজাত দিয়েছেন। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,وَيْلُ أُمِّهِ مِسْعَرَ حَرْبٍ، لَوْ كَانَ لَهُ أَحَدٌ ‘দুর্ভোগ তার মায়ের জন্য! সে যুদ্ধের অগ্নি উদ্দীপক। যদি আজ তাকে সাহায্য করার কেউ থাকত!’।[13] এখানে বাক্যের প্রথম অংশটি বিস্ময়সূচক। অর্থাৎ তার মা কত বড়ই না বীর সন্তানের জন্মদাত্রী। বাক্যের শেষাংশে তার অভিভাবকদের প্রতি শ্লেষ ব্যক্ত হয়েছে। হায়! যদি তারা তার ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করার ব্যাপারে তাকে সাহায্য করত!
একথার মাধ্যমে আবু বাছীর যখন বুঝলেন যে, তাকে ফেরৎ দেওয়া হবে, তখন তিনি শামের সায়ফুল বাহরের দিকে চলে গেলেন। ওদিকে মক্কা থেকে আবু জান্দাল এসে তার সাথে মিলিত হলেন। এমনিভাবে কুরায়েশ থেকে যখনই কোন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করতেন, তখনই তিনি বের হয়ে এসে আবু বাছীরের সাথে ‘ঈছ’ নামক স্থানে মিলিত হতেন। ফলে সেখানে একটি বড় দল গড়ে ওঠে। যখনই তাদের সামনে কোন কুরায়েশ কাফেলা আসত, তখনই তার উপরে তারা হামলা করত। পরবর্তীতে রাসূল (ছাঃ)-এর জামাতা আবুল ‘আছ বিন রবী‘-এর ব্যবসায়ী কাফেলা তাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। তখন তার বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর বক্তব্য জানতে পেরে তারা উক্ত কাফেলার সবকিছু ছেড়ে দেয় (যাদুল মা‘আদ ৩/২৬৩-৬৪)।
[2]. মুসলিম হা/১৮৫৬ (৬৯); বুখারী হা/৪১৫৪; মিশকাত হা/৬২১৯।
[3]. মুসলিম হা/১৮০৭; ইবনু হিশাম ২/৩১৫-১৬।
[4]. ফাৎহুল বারী হা/২৯৫৭-৫৮-এর আলোচনা দ্রঃ।
[5]. আর-রাহীক্ব ৩৪১ পৃঃ, (ঐ, তা‘লীক্ব ১৬৪ পৃঃ)।
প্রসিদ্ধ আছে যে, ওছমান হত্যার গুজবই ছিল এর একমাত্র কারণ। তিনি নিহত হয়েছেন, এ খবর পৌঁছার পর রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ نَبْرَحُ حَتَّى نُنَاجِزَ الْقَوْمَ ‘আমরা যাব না যতক্ষণ না ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করব’ (ইবনু হিশাম ২/৩১৫; তারীখ ত্বাবারী ২/৬৩২; আল-বিদায়াহ ৪/১৬৭; আর-রাহীক্ব ৩৪১ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১৭৭ পৃঃ)। অন্য আর একটি কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, কুরায়েশ প্রতিনিধি সুহায়েল বিন ‘আমর ও অন্যদের সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর সন্ধি আলোচনার এক পর্যায়ে দু’পক্ষের কোন একজন ব্যক্তি অপর পক্ষের উদ্দেশ্যে তীর ছুঁড়ে মারেন। তখন উভয় পক্ষে গোলমাল ও হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। এমতাবস্থায় মুসলিম পক্ষ সুহায়েল বিন ‘আমরসহ মক্কার প্রতিনিধি দলকে এবং অন্যদিকে মক্কার নেতারা ওছমানকে আটকিয়ে রাখে। তখন রাসূল (ছাঃ) মুসলমানদেরকে বায়‘আতের আহবান জানান’ (বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত হা/১৪৬৭)। হাদীছটি ‘যঈফ’ (আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ১৬৪ পৃঃ; মা শা-‘আ ১৭৬-৭৮ পৃঃ)।
[6]. ত্বাবাক্বাত ইবনু সা‘দ, সনদ ছহীহ; ফাৎহুল বারী হা/৪১৬৫-এর আলোচনা।
[7]. আহমাদ হা/১৮৯৩০, সনদ হাসান; ইবনু হিশাম ২/৩১৮।
[8]. বুখারী হা/২৭৩৩; ফাৎহুল বারী হা/৫২৮৬-এর আলোচনা।
[9]. বুখারী হা/১৮১৫; মুসলিম হা/১২০১; মিশকাত হা/২৬৮৮। দ্রঃ লেখক প্রণীত ‘হজ্জ ও ওমরাহ’ বই (৪র্থ সংস্করণ, ২০১৩ খৃ.) ৩৮-৩৯ পৃঃ।
[10]. বুখারী হা/৩১৮২; মুসলিম হা/১৭৮৫ (৯৪)।
[11]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৮৭২, হাদীছ ছহীহ।
[12]. বুখারী হা/৩১৮২; মুসলিম হা/১৭৮৫ (৯৪)।
[13]. যাদুল মা‘আদ ৩/২৬৩-৬৪; বুখারী হা/২৭৩১; মিশকাত হা/৪০৪২।