ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম ঈমান শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ)
প্রশ্ন: (২০) কিছু কিছু মানুষ আল্লাহর কাছে দো‘আ করে থাকে; কিন্তু দো‘আ কবূল হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, “তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব”। তাহলে মানুষ কীভাবে আল্লাহর কাছে দো‘আ করলে তা কবূল হবে?

উত্তর: বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা। দরূদ ও সালাম পেশ করছি আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার এবং সকল সাহাবীর ওপর। মুসলিম ভাইদের জন্য আল্লাহর কাছে আকীদা ও আমলের ক্ষেত্রে সঠিক পথের তাওফীক প্রার্থনা করছি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَقَالَ رَبُّكُمُ ٱدۡعُونِيٓ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَسۡتَكۡبِرُونَ عَنۡ عِبَادَتِي سَيَدۡخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ ٦٠﴾ [غافر: ٦٠]

“তোমাদের রব বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। যারা আমার ইবাদাতে অহংকার করে তারা সত্বরই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে”। [সূরা গাফির, আয়াত: ৬০]

প্রশ্নকারী বলেছেন যে, তিনি আল্লাহর কাছে দো‘আ করে থাকেন। অথচ আল্লাহ তার দো‘আ কবূল করেন না। ফলে তার কাছে এ অবস্থা কঠিন বলে মনে হয়। বিশেষ করে আল্লাহ তো ওয়াদা করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে দো‘আ করে, আল্লাহ তার দো‘আ কবূল করেন। আল্লাহ কখনই ওয়াদা খেলাফ করেন না। উক্ত প্রশ্নের জবাবে আমরা বলব যে, দো‘আ কবূলের জন্য কতিপয় শর্ত রয়েছে। তা সর্ববস্থায় দো‘আর ক্ষেত্রে বর্তমান থাকতে হবে।

প্রথম শর্ত: একাগ্রচিত্তে আল্লাহর কাছে দো‘আ করা। অন্তরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে, এ বিশ্বাসের সাথে আল্লাহর কাছে দো‘আ করা যে, আল্লাহ কবূল করতে সক্ষম। দো‘আ করার সময় এ আশা রাখবে যে, আল্লাহ তা কবূল করবেন।

দ্বিতীয় শর্ত: দো‘আ করার সময় এ কথা অনুভব করবে যে, দো‘আ কবূলের দিকে সে খুবই মুখাপেক্ষী। শুধু তাই নয় বরং এ কথাও অনুভব করবে যে, একমাত্র আল্লাহই বিপদগ্রস্থ ফরিয়াদকারীর ফরিয়াদ শ্রবণ করেন এবং তিনিই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। যদি এ কথা অনুভব করে যে, সে আল্লাহর দিকে মুখাপেক্ষী নয় এবং আল্লাহর কাছে তার কোনো প্রয়োজনও নেই; বরং দো‘আ করাটা যেন একটা অভ্যাসমাত্র তাহলে এ ধরণের দো‘আ কবূল না হওয়ারই উপযোগী।

তৃতীয় শর্ত: হারাম খাওয়া থেকে দূরে থাকবে। কারণ, বান্দা এবং তার দো‘আ কবূল হওয়ার মধ্যে হারাম রুযী প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে। সহীহ হাদীসে প্রমাণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللَّهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا وَإِنَّ اللَّهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ فَقَالَ ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلرُّسُلُ كُلُواْ مِنَ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَٱعۡمَلُواْ صَٰلِحًاۖ إِنِّي بِمَا تَعۡمَلُونَ عَلِيمٞ ٥١﴾ [المؤمنون: ٥١] وَقَالَ ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُلُواْ مِن طَيِّبَٰتِ مَا رَزَقۡنَٰكُمۡ﴾ [البقرة: ١٧٢] ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ»

“নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ পবিত্র তিনি পবিত্র ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করেন না। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলদের প্রতি যা নির্দেশ দিয়েছেন, মুমিনদের প্রতিও তাই নির্দেশ দিয়েছেন।” তিনি বলেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلرُّسُلُ كُلُواْ مِنَ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَٱعۡمَلُواْ صَٰلِحًاۖ إِنِّي بِمَا تَعۡمَلُونَ عَلِيمٞ ٥١﴾ [المؤمنون: ٥١]

“হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার্য গ্রহণ কর এবং সৎ কর্ম কর।” [সুরা আল-মুমিনূন, আযাত: ৫১] আল্লাহ বলেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُلُواْ مِن طَيِّبَٰتِ مَا رَزَقۡنَٰكُمۡ﴾ [البقرة: ١٧٢]

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু সামগ্রী থেকে আহার গ্রহণ কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসেবে দান করেছি।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭২]

অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফর করে এলায়িত কেশ ও ধুলামিশ্রিত পোশাক নিয়ে অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে ডাকতে থাকে হে, রব! হে রব!! অথচ সে ব্যক্তির পানাহার সামগ্রী হারাম উপার্জনের, পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম পয়সায় সংগৃহীত, এমতাবস্থায় কি করে তার দো‘আ কবূল হতে পারে?”[1]

দো‘আ কবূলের সকল মাধ্যম অবলম্বন করা সত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ লোকের দো‘আ কবূল হওয়াকে অসম্ভব মনে করলেন। দো‘আ কবূলের কারণগুলো নিম্নরূপঃ

১) আকাশের দিকে হাত উত্তোলন করা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা আকাশে ‘আরশের উপরে। আল্লাহর দিকে হাত উঠানো দো‘আ কবূলের অন্যতম কারণ। হাদীসে এসেছে,

«إِنَّ اللَّهَ حَيِيٌّ كَرِيمٌ يَسْتَحْيِي إِذَا رَفَعَ الرَّجُلُ إِلَيْهِ يَدَيْهِ أَنْ يَرُدَّهُمَا صِفْرًا»

“নিশ্চয় আল্লাহ অত্যন্ত লজ্জাশীল ও সম্মানী। বান্দা যখন তাঁর দিকে দু’হাত উঠিয়ে দো‘আ করে, তখন তিনি হাত দু’টিকে খালি অবস্থায় ফেরত দিতে লজ্জা বোধ করেন।”[2]

২) এ লোকটি আল্লাহর একটি নাম (رب) ‘পালনকর্তা’ উচ্চারণ করে করে দো‘আ করেছে। এ নামের উসীলা গ্রহণ করা দো‘আ কবূলের অন্যতম কারণ। কেননা রব অর্থ রব, সমস্ত মাখলুকাতের সৃষ্টিকারী ও পরিচালনাকারী। তাঁর হাতেই আকাশ-জমিনের চাবি-কাঠি। এ জন্যই আপনি কুরআন মজীদের অধিকাংশ দো‘আতেই দেখতে পাবেন, ‘রব’ বা রব শব্দটি উল্লেখ হয়েছে। আল্লাহ বলেন,

﴿ رَّبَّنَآ إِنَّنَا سَمِعۡنَا مُنَادِيٗا يُنَادِي لِلۡإِيمَٰنِ أَنۡ ءَامِنُواْ بِرَبِّكُمۡ فَ‍َٔامَنَّاۚ رَبَّنَا فَٱغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرۡ عَنَّا سَيِّ‍َٔاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ ٱلۡأَبۡرَارِ ١٩٣ رَبَّنَا وَءَاتِنَا مَا وَعَدتَّنَا عَلَىٰ رُسُلِكَ وَلَا تُخۡزِنَا يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِۖ إِنَّكَ لَا تُخۡلِفُ ٱلۡمِيعَادَ ١٩٤ فَٱسۡتَجَابَ لَهُمۡ رَبُّهُمۡ أَنِّي لَآ أُضِيعُ عَمَلَ عَٰمِلٖ مِّنكُم مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰۖ بَعۡضُكُم مِّنۢ بَعۡضٖۖ١٩٥ ﴾ [ال عمران: ١٩٣، ١٩٥]

“হে আমাদের রব! আমরা নিশ্চিতরূপে শুনেছি একজন আহ্বানকারীকে ঈমানের প্রতি আহ্বান করতে যে, তোমাদের রবর প্রতি ঈমান আন। তাই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের রব! অতঃপর আমাদের সকল গুনাহ মাফ কর এবং আমাদের সকল দোষত্রুটি দূর করে দাও, আর আমাদের মৃত্যু দাও নেক লোকদের সাথে। হে আমাদের রব! আমাদেরকে দাও, যা তুমি ওয়াদা করেছ তোমার রাসূলগণের মাধ্যমে এবং কিয়ামতের দিন তুমি আমাদিগকে অপমানিত করো না। নিশ্চয় তুমি ওয়াদা খেলাফ করো না। অতঃপর তাদের রব তাদের দো‘আ এ বলে কবূল করে নিলেন যে, আমি তোমাদের কোনো পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না, সে পুরুষ হোক বা নারী লোক হোক। তোমরা সকল নারী-পুরুষই সমান।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯৩-১৯৫] সুতরাং আল্লাহর এ নামের (রব) মাধ্যমে উসীলা দেওয়া দো‘আ কবূলের অন্যতম কারণ।

৩) এ লোকটি মুসাফির ছিল। সফর করাকে অধিকাংশ সময় দো‘আ কবূলের কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। কেননা সফর অবস্থায় মানুষ আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। স্বদেশে অবস্থানকারীর চেয়ে মুসাফির আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি অধিক মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। মুসাফির এলোমেলো কেশ বিশিষ্ট ও ময়লাযুক্ত কাপড় পরিধানকারী হয়। কোনো গুরুত্বই দিচ্ছে না। আল্লাহর কাছে দো‘আ করা ব্যতীত তার অন্য কোনো উপায় নেই। সফরে থেকে এলোকেশ বিশিষ্ট হয়ে ও ময়লাযুক্ত পোশাক পরিহিত অবস্থায় দো‘আ করা দো‘আ কবূলের পক্ষে খুবই সহায়ক। হাদীসে আছে, আল্লাহ তা‘আলা আরাফার দিন বিকাল বেলা দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং আরাফাতে অবস্থানকারীদেরকে নিয়ে ফিরিশতাদের সাথে গর্ব করে বলেন, “প্রতিটি অঞ্চল হতে তারা আমার কাছে এসেছে, ধুলা-মলিন পোষাক নিয়ে এবং এলোকেশ বিশিষ্ট অবস্থায়।[3]

যাই হোক দো‘আ কবূলের উপরোক্ত কারণগুলো থাকা সত্বেও কোনো কাজ হলো না। কারণ, একটাই তার খাদ্য-পানীয় ছিল হারাম, পোষাক ছিল হারাম এবং হারাম খেয়ে তার দেহ গঠিত হয়েছে। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কি ভাবে তার দো‘আ কবূল করা হবে? দো‘আ কবূলের এ শর্তগুলো পাওয়া না গেলে দো‘আ কবূলের কোনই সম্ভাবনা নেই। শর্তগুলো বর্তমান থাকার পরও যদি দো‘আ কবূল না হয়, তাহলে বুঝতে হবে কি কারণে দো‘আ কবূল হয় নি, তা আল্লাহই ভালো জানেন। দো‘আকারী এ বিষয়ে জানার কোনো সুযোগ নেই। দো‘আ কবূলের সকল শর্ত বর্তমান থাকার পরও দো‘আ কবূল না হলে হতে পারে আল্লাহ তার ওপর থেকে দো‘আ কবূলের চেয়ে বড় কোনো মুসীবত দূর করবেন অথবা এও হতে পারে যে, কিয়ামতের দিনের জন্য তার দো‘আকে সঞ্চয় করে রাখবেন এবং সেদিন তাকে অধিক পরিমাণে বিনিময় দান করবেন। কেননা ব্যক্তি দো‘আ কবূলের সকল শর্ত বাস্তবায়ন করে আল্লাহর কাছে দো‘আ করার পরও দো‘আ কবূল করা হয় নি এবং তার উপর থেকে বড় কোনো মুসিবতও দূর করা হয় নি। দো‘আ কবূলের সকল শর্ত পূরণ করে দো‘আ করেছে। কিন্তু দ্বিগুণ পুরস্কার দেওয়ার জন্য তার দো‘আ কবূল করা হয় নি। দো‘আ করার কারণে এবং অন্য একটি পুরস্কার মুসীবত দূর না করার কারণে। সুতরাং তার জন্য দো‘আ কবূলের চেয়ে মহান জিনিস তার জন্য কিয়ামতের দিন সঞ্চয় করে রাখা হবে।

মানুষের উচিৎ হলো দো‘আর ফলাফলের জন্য তাড়াহুড়া না করা। কেননা তাড়াহুড়া করা দো‘আ কবূল না হওয়ার অন্যতম কারণ। হাদীসে এসেছে,

«يُسْتَجَابُ لِأَحَدِكُمْ مَا لَمْ يَعْجَلْ قَالُوْا كَيْفَ يَعْجَلُ يَا رَسُولُ اللَّهِ؟ قَالَ يَقُولُ دَعَوْتُ ودَعَوْتُ وَ دَعَوْتُ فَلَمْ يُسْتَجَبْ لِى»

“তোমাদের কেউ দো‘আয় তাড়াহুড়া না করলে তার দো‘আ কবূল হয়ে থাকে। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, কীভাবে তাড়াহুড়া করা হয়ে থাকে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বান্দা বলে থাকে কত দো‘আ করলাম, কত দো‘আ করলাম, কত দো‘আ করলাম, কিন্তু কবূল তো হচ্ছে না।”[4] তাই কারও জন্য দো‘আতে তাড়াহুড়া এবং দো‘আ করতে করতে ক্লান্তি বোধ করে দো‘আ করা ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়; বরং বেশি বেশি দো‘আ করা উচিৎ। কারণ, দো‘আ একটি ইবাদাত। দীনী ভাই! ছোট-বড় এবং কঠিন-সহজ সকল বিষয়ে আপনাকে বেশি বেশি দো‘আ করার উপদেশ দিচ্ছি। আল্লাহ সবাইকে তাওফীক দিন।

>
[1] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুয যাকাত।

[2] তিরমিযী, অধ্যায়: কিতাবুদ দাওয়াত।

[3] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল হজ।

[4] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: কিতাবুদ দাওয়াত।