লগইন করুন
হিজরতকালে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইয়াছরিবে মূলতঃ দু’দল লোক বসবাস করত। একদল ছিল ইয়াছরিবের পৌত্তলিক মুশরিক সম্প্রদায়। যারা প্রধানতঃ আউস ও খাযরাজ দু’গোত্রে বিভক্ত ছিল। আউসদের নেতা ছিলেন সা‘দ বিন মু‘আয ও খাযরাজদের নেতা ছিলেন সা‘দ বিন ওবাদাহ। মুনাফিক সরদার আব্দুল্লাহ বিন উবাই ইবনে সুলূল ছিলেন খাযরাজ গোত্রভুক্ত। এরা ছিল বিশুদ্ধ আরবী ভাষী। রাসূল (ছাঃ)-এর দাদার মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জারও ছিল এই গোত্রভুক্ত।
দ্বিতীয় ছিল ইহূদী সম্প্রদায়। খ্রিষ্টানরা যাদেরকে ফিলিস্তীন ও সিরিয়া অঞ্চল থেকে উৎখাত করে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপর দখল কায়েম করেছিল। ইহূদীরা শেষনবীর আগমনের অপেক্ষায় এবং তাঁর নেতৃত্বে তাদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের আশায় ইয়াছরিবে হিজরত করে এসেছিল বহুদিন পূর্বে। এরা ছিল হিব্রুভাষী। কিন্তু পরে আরবীভাষী হয়। এদের প্রধান তিনটি গোত্র বনু ক্বায়নুক্বা‘, বনু নাযীর ও বনু কুরায়যা মদীনার উপকণ্ঠে তাদের তৈরী স্ব স্ব দুর্ভেদ্য দুর্গসমূহে বসবাস করত। দক্ষ ব্যবসায়ী ও সূদী কারবারী হওয়ার কারণে এরা ছিল সর্বাধিক সচ্ছল। চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও কূট কৌশলের মাধ্যমে এরা আউস ও খাযরাজের মধ্যে সর্বদা যুদ্ধাবস্থা জিইয়ে রাখতো এবং ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’ নীতির মাধ্যমে উভয় গোত্রের উপরে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতো। এই সূক্ষ্ম পলিসির কারণে তাদের বনু ক্বায়নুক্বা‘ গোষ্ঠী খাযরাজদের মিত্র ছিল এবং বনু নাযীর ও বনু কুরায়যা গোষ্ঠী আউসদের মিত্র ছিল। আসলে তারা উভয়েরই শত্রু ছিল। তাদেরকে তারা সূদী কারবার ও অস্ত্র ব্যবসার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করত। তারা এভাবে আরবদের শোষণ করত। এজন্য তাদের মূর্খতার প্রতি তাচ্ছিল্য করে তারা বলত, لَيْسَ عَلَيْنَا فِي الأُمِّيِّيْنَ سَبِيْلٌ ‘মূর্খদের ব্যাপারে আমাদের কোন দায়িত্ব নেই’ (আলে ইমরান ৩/৭৫)। অর্থাৎ মূর্খদের সম্পদ হরণ করায় ও তাদের অধিকার নষ্ট করায় আমাদের কোন পাপ নেই। সেই সময় ইয়াছরিবে পৌত্তলিক ও ইহূদীদের বাইরে কিছু সংখ্যক খ্রিষ্টানও বসবাস করত। যারা ইহূদীদের ন্যায় ইয়াছরিবে হিজরত করে এসেছিল শেষনবীর আগমন প্রত্যাশায়।
বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তিগুলি গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের শ্লোগানের আড়ালে উন্নয়নশীল ও বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে তাদের শোষণ-নির্যাতন, সূদী কারবার ও অস্ত্র ব্যবসা পূর্বের ন্যায় বজায় রেখে চলেছে। মুসলমানদের সম্পদ হরণ করায় ও তাদের অধিকার বিনষ্ট করায় কোন পাপ নেই বলে আজও তাদের আচরণে প্রমাণ পাওয়া যায়। ভূগর্ভের তৈল লুট করার জন্য তারা ভূপৃষ্ঠের মানুষের রক্ত পান করছে গোগ্রাসে। কিন্তু এই রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারদের রক্ত নেশা মিটছে না মোটেই। এজন্যেই এরা ‘মাগযূব’ (অভিশপ্ত) ও ‘যোওয়াল্লীন’ (পথভ্রষ্ট) বলে কুরআনে অভিহিত হয়েছে।[1]
ইহূদীরা ভেবেছিল, শেষনবী হযরত ইসহাকের বংশে হবেন এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে তিনি খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের প্রতি অত্যাচারের প্রতিশোধ নেবেন। তারা ইয়াছরিবের লোকদের হুমকি দিত এই বলে যে, سَيَخْرُجُ نَبِىُّ آخِرِ الزَّمَانِ فَنَتَّبِعُهُ وَنَقْتُلُكُمْ مَعَهُ قَتْلَ عَادٍ وَإِرَمَ ‘আখেরী যামানার নবী সত্বর আগমন করবেন। আমরা তাঁর অনুসারী হব এবং তোমাদের হত্যা করব (বিগত ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি) ‘আদ ও ইরামের ন্যায়’।[2] কিন্তু হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে শেষনবীর আগমন ঘটায় এবং তিনি হযরত মূসা ও ঈসা (আঃ) উভয়ের সত্যায়ন করায় ইহূদীরা তাঁর শত্রু হয়ে যায়।
পক্ষান্তরে তৃতীয় দল খ্রিষ্টানরা ভেবেছিল যে, শেষনবী এসে তাদের লালিত বিশ্বাস অনুযায়ী কথিত ত্রিত্ববাদ, ঈসার পুত্রত্ববাদ, প্রায়শ্চিত্ববাদ, সন্ন্যাসবাদ ও পোপের ঐশী নেতৃত্ববাদ সমর্থন করবেন। কিন্তু এসবের বিপরীত হওয়ায় তারাও রাসূল (ছাঃ)-এর বিরোধী হয়ে গেল। উল্লেখ্য যে, ইহূদী ও নাছারা কারু মধ্যে তাদের ধর্ম প্রচারের ব্যাপারে কোনরূপ সংগ্রামী চেতনা ছিল না। ধর্মের প্রতিপাদ্য তাদের মধ্যে যা লক্ষ্য করা যেত, সেটা ছিল কেবল জাদু-টোনা, ঝাড়-ফুঁক, শুভাশুভ লক্ষণ নির্ধারণ ও অনুরূপ কিছু ক্রিয়া-কর্ম। এ সকল কাজের জন্যই তারা নিজেদেরকে জ্ঞানী-গুণী এবং আধ্যাত্মিক গুরু ও নেতা মনে করত।
চতুর্থ আরেকটি উপদল গড়ে উঠেছিল খাযরাজ গোত্রের আব্দুল্লাহ বিন উবাই ইবনে সুলূলের নেতৃত্বে। বু‘আছ যুদ্ধের পর আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্র মিলে তাকে নেতা নির্বাচিত করে। এজন্য তারা বহু মূল্যবান রাজমুকুট তৈরী করে এবং এই প্রথমবারের মত উভয় গোত্র একত্রিত হয়ে তাকে রাজ আসনে বসাতে যাচ্ছিল। এমনি সময়ে রাসূল (ছাঃ)-এর আগমন ঘটে এবং উভয় গোত্র তাকে ছেড়ে রাসূল (ছাঃ)-কে নেতারূপে বরণ করে। এতে আব্দুল্লাহ ও তার অনুসারীরা মনে মনে ক্ষুব্ধ হয় এবং তাদের সকল ক্ষোভ গিয়ে পড়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে। কিন্তু অবস্থা অনুকূল না দেখে তারা চুপ থাকে এবং বছর দেড়েক পরে বদর যুদ্ধের পর হতাশ হয়ে অবশেষে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইসলাম কবুলের ঘোষণা দেয়। তবে আদি বাসিন্দা আউস ও খাযরাজদের অনেকে পূর্বেই ইসলাম কবুল করায় এবং তারাই রাসূল (ছাঃ)-কে ও মুহাজিরগণকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আশ্রয় দেওয়ায় অন্যেরা সবাই চুপ থাকে এবং ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় রাসূল (ছাঃ)-এর নেতৃত্ব মেনে নেয়।
উপরোক্ত চারটি দল তথা (১) পৌত্তলিক আউস ও খাযরাজ (২) ইহূদী। বনু ক্বায়নুক্বা, বনু নাযীর ও বনু কুরায়যা। (৩) নাছারা। যারা প্রধানতঃ নাবিত্ব বাজার(سوق النبط) এলাকায় বসবাস করত। তবে সমাজে তাদের তেমন কোন প্রভাব ছিল না। (৪) খাযরাজ গোত্রের আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের গ্রুপ। যারা গোপন ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে সর্বদা তৎপর ছিল।
এতদ্ব্যতীত (৫) মুহাজির মুসলমানদের নানাবিধ সমস্যা মুকাবিলা করা রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য বলতে গেলে জ্বলন্ত সমস্যা ছিল। তবে মুহাজিরদের সমস্যা আনছাররাই মিটিয়ে দিত। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের পরস্পরে ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়েছিলেন। মক্কা থেকে কোন মুহাজির এলেই তারা তাকে সাদরে বরণ করে নিত। ফলে মুহাজিরগণের সমস্যা ছিল পজেটিভ। কিন্তু বিরুদ্ধবাদীদের সমস্যা ছিল নেগেটিভ। যা সর্বদা রাসূল (ছাঃ)-কে চিন্তাগ্রস্ত করে রাখতো।
উপরোক্ত সমস্যাবলীর সাথে যোগ হয়েছিল আরেকটি কঠিন সমস্যা। সেটা ছিল (৬) মক্কার মুশরিকদের অপতৎপরতা। তারা মুহাজিরদের ফেলে আসা বাড়ী-ঘর ও ধন-সম্পত্তি জবরদখল করে নিল। তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বন্দী ও নির্যাতন করতে লাগল। অধিকন্তু তাদের ধর্মীয় ও ব্যবসায়িক নেতৃত্বের প্রভাব খাটিয়ে আরব উপদ্বীপের অন্যান্য ব্যবসায়ী ও সাধারণ লোকদের উস্কানি দিতে লাগল, যাতে মদীনায় খাদ্য-শস্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ তারা বন্ধ করে দেয়। ফলে মদীনায় পণ্য আমদানী হ্রাস পেতে থাকল। যা মক্কার মুশরিকদের সাথে মদীনার মুসলমানদের মধ্যে ক্রমে যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরী করে ফেলল।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৪২৯; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ১৪৬, সনদ হাসান।