লগইন করুন
সামান্য ব্যবধানে জীবনের দু’জন শ্রেষ্ঠ সহযোগীকে হারিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিদারুণভাবে মর্মাহত ও বেদনাহত হন। জীবন থাকলে মৃত্যু আসবেই। এটাই প্রাণীজগতের চিরন্তন নিয়ম। নিকটজনেরা এতে ব্যথিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। রহমাতুল্লিল ‘আলামীন হিসাবে দয়াশীল নবীর জন্য এটা ছিল আরও বেশী বেদনাময়। কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে, এ কারণে এ বছরকে ‘দুঃখের বছর’ (عَامُ الْحُزْنِ) হিসাবে অভিহিত করতে হবে।[1] রাসূল (ছাঃ) বা ছাহাবায়ে কেরাম কখনো এরূপ নামকরণ করেননি। এমনকি সীরাতে ইবনে ইসহাক, ইবনু হিশাম বা পরবর্তী কোন সীরাত গ্রন্থে এ নামের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, এর একমাত্র উৎস আমি খুঁজে পেয়েছি ক্বাসত্বালানীর আল-মাওয়াহেবুল লাদুন্নিয়াহ কিতাবের মধ্যে। যেখান থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন শায়খ সা‘আতী (الساعاتى) আহমাদ আব্দুর রহমান আল-বান্না (১৮৮৫-১৯৫৮ খৃঃ)। যিনি মিসরের ইখওয়ানুল মুসলেমীন-এর প্রতিষ্ঠাতা শায়খ হাসানুল বান্না (১৯০৬-১৯৪৯ খৃঃ)-এর পিতা ছিলেন। তিনি স্বীয় কিতাব ফাৎহুর রববানী (২০/২২৬)-এর মধ্যে বলেন, وَكَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يُسَمَّى ذَلِكَ الْعَامَ عَامَ الْحُزْنِ، كَذَا فِى الْمَوَاهِبِ اللَّدُنِّيَةِ ‘আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উক্ত বছরকে ‘দুঃখের বছর’ হিসাবে অভিহিত করতেন। যেমন মাওয়াহেবুল লাদুন্নিয়াহ-তে বর্ণিত হয়েছে’। অথচ ক্বাসত্বালানী সেখানে সূত্র হিসাবে উল্লেখ করেছেন, فيما ذكره صاعد ‘ছা‘এদ যেমন বর্ণনা করেছেন’। আলবানী বলেন, ছা‘এদ একজন অপরিচিত ব্যক্তি। যাকে কেউ চেনে না এবং কেউ তাকে বিশ্বস্ত বলেননি’। আর ক্বাসত্বালানীর কথায় বুঝা যায় যে, তিনি এটাকে ‘সংযুক্তি’ (تعليق) হিসাবে এনেছেন কোনরূপ সনদ ছাড়াই। অতএব এটি ‘মু‘যাল’ পর্যায়ের দুর্বলতম বর্ণনা। যা বিশুদ্ধ নয়’।[2]
উল্লেখ্য যে, আহমাদ বিন মুহাম্মাদ আল-ক্বাসত্বালানী (৮৫১-৯২৩ হি.) ছিলেন একাধারে ছহীহ বুখারীর ভাষ্যকার ও রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনীকার। এতদ্ব্যতীত সীরাহ হালাবিইয়াহ-তে সনদ বিহীনভাবে বলা হয়েছে যে, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উক্ত বছরকে ‘দুঃখের বছর’ হিসাবে অভিহিত করতেন’ (সীরাহ হালাবিইয়াহ ৩/৫২১)। জীবনীকার মুহাম্মাদ আল-গাযালী (মৃ. ১৪১৬ হি.) একই শিরোনাম করেছেন (ফিক্বহুস সীরাহ ১৩১ পৃঃ)।
আমরা মনে করি যে, রাসূল (ছাঃ)-এর পুরা জীবনী সামনে রাখলে তার মধ্যে বদর বিজয় ও মক্কা বিজয়সহ অন্যান্য বিজয়ের আনন্দগুলি বাদ দিলে সেখানে বরং দুঃখের পাল্লাই ভারি হবে। এমনকি ব্যক্তি জীবনে ৪ কন্যা ও ৩ পুত্র সন্তানের জনক হওয়া সত্ত্বেও কেবল ফাতেমা ব্যতীত ৬ সন্তানই তাঁর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেছেন। পিতা হিসাবে এটি তাঁর জীবনে কম দুঃখের ছিল না।
অতঃপর দাওয়াতী জীবনে তিনি ও তাঁর সাথী ছাহাবীগণ দ্বীনের জন্য যে অবর্ণনীয় নির্যাতন ও দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন, ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। বিশেষ করে তায়েফে নির্যাতনের ঘটনাকে তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে কষ্টদায়ক ও মর্মান্তিক ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন’।[3] অতঃপর মাদানী জীবনে তৃতীয় হিজরীতে ওহোদ যুদ্ধে তাঁর নিজের দাঁত ভাঙ্গা ও চাচা হামযাসহ ৭০ জন প্রাণপ্রিয় সাথীকে হারানো, চতুর্থ হিজরীর ছফর মাসে রাজী‘ কূয়ার নিকটে ১০ জন ছাহাবী ও তার কয়েকদিন পরে মাঊনা কূয়ার নিকটে ৭০ জন শ্রেষ্ঠ ক্বারী ছাহাবীকে বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে হত্যা করার মর্মান্তিক ঘটনা। যেজন্য তিনি মাসব্যাপী পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে ঐসব বিশ্বাসঘাতক শত্রুদের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করেন।[4] যে ঘটনাগুলির ফলে মাত্র ছ’মাসের কম সময়ের মধ্যে প্রায় ১৫০ জন ছাহাবী শহীদ হয়ে যান। তাদের হারানোর বেদনায় ব্যথিত হয়ে তিনি কিন্তু কখনো দুঃখের বছর কিংবা শোকের মাস বা শোকের দিবস ইত্যাদি পালন করেননি। যেমনভাবে বর্তমান যুগে করা হয়ে থাকে।
বস্ত্ততঃ কোন বছরই একচেটিয়া দুঃখের বা আনন্দের নয়। বরং প্রতিটি মুহূর্তেই আনন্দ ও বেদনার আগমন-নির্গমন ঘটে থাকে আল্লাহর হুকুমে। তিনি বলেন, فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا- إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْراً. ‘নিশ্চয়ই প্রত্যেক কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে’। ‘নিশ্চয়ই প্রত্যেক কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে’ (ইনশিরাহ ৯৪/৫-৬)। তাই কোন একটি সময়, দিন, মাস বা বছরকে আনন্দের বা দুঃখের বছর বলে অভিহিত করা আল্লাহর চিরন্তন বিধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের শামিল। রাসূল (ছাঃ) বলেন, قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ يُؤْذِينِى ابْنُ آدَمَ، يَسُبُّ الدَّهْرَ وَأَنَا الدَّهْرُ، بِيَدِى الأَمْرُ، أُقَلِّبُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ ‘আল্লাহ বলেন, আদম সন্তান আমাকে কষ্ট দেয়। সে যামানাকে গালি দেয়। অথচ ‘আমিই যামানা’। আমার হাতেই সকল ক্ষমতা। আমিই রাত্রি ও দিবসের আবর্তন-বিবর্তন ঘটাই’।[5]
অতএব ভাল-মন্দ ও দুঃখ-আনন্দ নিয়ে জীবন। যা আল্লাহর অমোঘ বিধান। বান্দাকে তা মেনে নিয়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকতে হবে। একারণেই ইসলামে কোন দিবস পালনের বিধান নেই। কেবল আনন্দের দিন হিসাবে নির্ধারিত হয়েছে জুম‘আ, ঈদায়েন, হজ্জ ও আইয়ামে তাশরীক্বের তিনদিন সহ গড়ে সাত দিন। যা হজ্জে আগমনকারী ব্যতীত অন্যদের জন্য ছয় দিন। প্রতিটি আনন্দের দিনই ইবাদতের পবিত্রতার সাথে সম্পৃক্ত। সেখানে আনন্দের নামে কোনরূপ অনর্থক আমোদ-ফুর্তি ও অনুষ্ঠানসর্বস্ব পার্থিবতার কোন সুযোগ নেই।
অতএব চাচা আবু ত্বালিব ও স্ত্রী খাদীজা (রাঃ)-এর স্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে ১০ম নববী বর্ষকে ‘দুঃখের বছর’ (عَامُ الْحُزْنِ) বলে অভিহিত করা ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী। তাই এরূপ আখ্যায়িত করা হ’তে বিরত থাকা আবশ্যক।
[2]. আলবানী, দিফা‘ ‘আনিল হাদীছ ওয়াস-সীরাহ ১৮ পৃঃ; মা শা-‘আ ৬৭-৬৯ পৃঃ।
[3]. বুখারী হা/৩২৩১; মুসলিম হা/১৭৯৫।
[4]. বুখারী হা/৪০৯৬; মুসলিম হা/৬৭৭; আবুদাঊদ হা/১৪৪৩; মিশকাত/১২৮৯-৯০।
[5]. বুখারী হা/৪৮২৬; মুসলিম হা/২২৪৬; মিশকাত হা/২১ ‘ঈমান’ অধ্যায়।