লগইন করুন
উত্তর: যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য এবং দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর রাসূলের প্রতি। হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুরাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর হাদীছটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে। আর তা হচ্ছে, মুসলিমদের দলে দলে বিভক্ত হওয়া আদৌ বৈধ নয়; বরং তাদেরকে একটিমাত্র ইমারতের অধীনে এবং সেই ইমারতের খলীফার তত্ত্বাবধায়নে একক জামা‘আত হয়ে থাকতে হবে। কিন্তু যদি কখনও এমন হয় যে, মুসলিমরা দলমত নির্বিশেষে একক খলীফার বায়‘আত করে একক জামা‘আত হয়ে থাকতে পারছে না, তাহলে সেক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর অনুসরণ প্রিয় কোনো মুসলিমের নির্দিষ্ট কোনো একটি দলে যোগদান করা বৈধ নয়। বিশেষ করে যখন প্রত্যেকটি দল নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উল্লসিত থাকবে আর দাবী করবে যে, তার একজন নির্দিষ্ট আমীর রয়েছে এবং ঐ আমীরের দলে দলভুক্ত সবাইকে তাঁর কাছে বায়‘আত করতে হবে। আর যখন এই বায়‘আতকে ‘বায়‘আতে কুবরা’ বা সর্ববৃহৎ বায়‘আত গণ্য করা হবে, তখন বিষয়টি আরো মারাত্মক আকার ধারণ করবে। মনে রাখতে হবে, ‘বায়‘আতে কুবরা’ সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র একক খলীফা ছাড়া অন্য কারো জন্য বৈধ নয়। বিষয়টি তখন আরো মারাত্মক আকার ধারণ করে, যখন প্রত্যেকটি জামা‘আতের একজন করে বায়‘আত গ্রহণকারী আমীর থাকেন এবং তার অনুসারীরা উক্ত বায়‘আতের শর্তাবলী এমনভাবে মেনে চলে যে, তাদের কারো জন্য অন্য কারো মতামত গ্রহণের বৈধতা থাকে না। আমি অন্য কোনো আমীরের কথা বললাম না, কারণ আমীর কথাটি বললে অন্তত: নামের ক্ষেত্রে হলেও আমরা যেন তাদের সাথে ঐক্যমত পোষণ করলাম। সেজন্য আমি আমীর না বলে অন্য কোনো ব্যক্তি বা আলেমের কথা বললাম। অর্থাৎ তাদের দলভুক্ত নয় এমন কোনো ব্যক্তি বা আলেমের সাথে দলীল-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাদের জন্য তাঁর মতামত গ্রহণের সুযোগ থাকে না। অতএব, দলগুলির অবস্থা যদি এরূপ হয়, তাহলে সেগুলোতে যোগদান করা কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয়; বরং তাকে একাকী থাকতে হবে। তবে তার মানে এই নয় যে, তার যেসব ভাই পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ্র অনুসরণে আগ্রহী, সে তাদের থেকে দূরে থাকবে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَكُونُواْ مَعَ ٱلصَّٰدِقِينَ ١١٩ ﴾ [التوبة: ١١٩]
‘আর তোমরা সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (তাওবাহ ১১৯)। অর্থাৎ সত্যবাদী যেই হোক না কেন এবং যেখানেই হোক না কেন তাদের সাথে থাক। সেকারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু–এর হাদীছে দলাদলির প্রত্যেকটি দলকে পরিত্যাগের নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও উম্মতে মুহাম্মাদীকে নিম্নোক্ত হাদীছে সুসংবাদ প্রদান করেছেন, তিনি বলেছেন, ‘ক্বিয়ামত পর্যন্ত একটি জনগোষ্ঠী হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে; তাদের বিরোধীরা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না’। উল্লেখ্য যে, উক্ত হাদীছ এবং হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু–এর হাদীছে স্ববিরোধী কোনো বক্তব্য নেই। কেননা হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু–এর হাদীছে একদিকে যেমন দলাদলি করতে নিষেধ করা হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি কুরআন ও সুন্নাহ্র অনুসারী সত্যবাদী মুমিনদের সাথে থাকতে বলা হয়েছে এবং তাদেরকে একক কোনো ব্যক্তির অন্ধ অনুসরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে এই একক ব্যক্তি যদি দলমত নির্বিশেষে গোটা মুসলিম উম্মাহ কর্তৃক বায়‘আতকৃত ইমাম হন, তাহলে তাঁর অনুসরণ করা যরূরী। মনে রাখতে হবে, মুসলিম উম্মাহ যদি একই সময়ে একাধিক ব্যক্তির হাতে বায়‘আত করে, তাহলে বিষয়টি অত্যন্ত ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। আমার ধারণা মতে, দলাদলি সৃষ্টিকারীরা যদি ভয়াবহ সেই বিষয়টি জানত, তাহলে দলাদলি থেকে পশ্চাদ্ধাবন করত এবং হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু–এর হাদীছের বক্তব্য অনুযায়ী তারা কাউকে তাদের ‘আমীর’ হিসাবে গ্রহণ করত না। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘একই সময়ে দু’জন খলীফার বায়‘আত সংঘটিত হলে শেষের জনকে তোমরা হত্যা কর’। অতএব, গোটা মুসলিম উম্মাহকে পরিচালনার জন্য একক খলীফা তৈরী পর্যন্ত তাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে এবং অপেক্ষার এই সময়ে তাদের জন্য কোনক্রমেই ভিন্ন ভিন্ন দলের ভিন্ন ভিন্ন আমীর বা দলপ্রধান নির্ধারণ ও তাঁর হাতে বায়‘আত বৈধ হবে না। কারণ এই বায়‘আত মুসলিমদের বিভক্তি ও দলাদলিকে আরো বৃদ্ধি করবে। আমি বিভক্তি সৃষ্টির কথা না বলে বিভক্তি বৃদ্ধির কথা বললাম একারণে যে, দুঃখজনক হলেও সত্য মুসলিমরা ইতোমধ্যে দলে দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। এই বিভক্তির পরে প্রত্যেকটি দল যদি তাদের আলাদা আলাদা দলীয় প্রধান নির্ধারণ করে, তাহলে এই নেতৃত্ব উম্মতের মধ্যে বিভক্তি আরো বহুগুণে বৃদ্ধি করবে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَلَا تَنَٰزَعُواْ فَتَفۡشَلُواْ وَتَذۡهَبَ رِيحُكُمۡۖ ﴾ [الانفال: ٤٦]
‘তোমরা পরস্পরে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়ো না। অন্যথায়, তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের শক্তি বিনষ্ট হবে’ (আল-আনফাল ৪৬)। তবে মুসলিম উম্মাহ্র প্রত্যেককে তার সাধ্যানুযায়ী সর্বজন স্বীকৃত একক খলীফা তৈরীর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আর এটিই হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীছটির অর্থ। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার কাঁধে বায়‘আত না থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, তার জাহেলী মৃত্যু হবে’। দলাদলি সৃষ্টিকারীদের মধ্যে বহু সংখ্যক মানুষ এই হাদীছটি ভুল বুঝে থাকে। তারা মনে করে, প্রত্যেকটি মুসলিমের কাঁধে কারো না কারো বায়‘আত অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু হাদীছটির মর্মার্থ তা নয়; বরং এর অর্থ দু’টিঃ (১) গোটা মুসলিম উম্মাহ্র একক খলীফা থাকলে কোনো মুসলিমের জন্য তাঁর বায়‘আত পরিত্যাগ করে জামা‘আত থেকে পৃথক থাকা বৈধ নয়। আর এই বায়‘আত পরিত্যাগ করে কারো মৃত্যু হলে তার মৃত্যুকে জাহেলী মৃত্যু গণ্য করা হবে। (২) যদি মুসলিমদের মধ্যে এমন খলীফা না থাকে, তাহলে তাদেরকে অবশ্যই এমন খলীফা তৈরীর চেষ্টা করতে হবে, সবাই যার বায়‘আত করবে। এটিই হচ্ছে হাদীছের দ্বিতীয় অর্থ। হাদীছটির দ্বিতীয় এই অর্থকে কিছু ‘ফিক্বহী ক্বায়েদা’ সমর্থন করে। যেমন: مَا لَا يَتِمُّ الْوَاجِبُ إلَّا بِهِ فَهُوَ وَاجِبٌ ‘যা ছাড়া ওয়াজিব বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, সেটিও ওয়াজিব’। বুঝা গেল, মুসলিম উম্মাহ্র একক খলীফা থাকা ওয়াজিব। এই খলীফা না থাকলে তাঁকে তৈরীর চেষ্টা করাও ওয়াজিব। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ্র এমন ইমাম না থাকলে তাদের দলে দলে বিভক্ত হয়ে থাকা ঠিক নয়। কেননা এই দলাদলি তাদের বিভক্তিকে আরো বৃদ্ধি করবে। সেজন্য আমার মতে, যারা কোনো দল বা সংগঠনের দিকে মানুষকে দা‘ওয়াত দেয়, তাদের এই দা‘ওয়াতের উদ্দেশ্য যদি হয় সংগঠন বা দল গঠন, যেসব দলের মূলনীতি ও শর্তসমূহ অন্যান্য সংগঠনের অনেক মূলনীতি থেকে ভিন্ন, তাহলে এই হাদীছে তা থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সতর্ক করেছেন। তবে মুসলিমদেরকে দ্বীন শিক্ষা দিতে এবং তদ্নুযায়ী আমলের জন্য তাদেরকে সুসংগঠিতভাবে পরিচালনা করা যেতে পারে; বরং তা অপরিহার্য বিষয়। কেননা মুসলিম উম্মাহ্র একক খলীফা তৈরীর জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে মানুষকে আগে দ্বীনের জ্ঞানে জ্ঞানী করে তুলতে হবে। অন্যথায় চূড়ান্ত এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভবপর হবে না।([1])