লগইন করুন
ইয়ামন থেকে মক্কায় হিজরতকারী এই পরিবার মক্কার বনু মাখযূমের সাথে চুক্তিবদ্ধ মিত্র (حَلِيفٌ) ছিল। পরিবার প্রধান ইয়াসির বিন মালিক এবং তার স্ত্রী সুমাইয়া ও পুত্র ‘আম্মার সকলে মুসলমান হন। ফলে তাদের উপরে যে ধরনের অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল, ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। বনু মাখযূম নেতা আবু জাহলের নির্দেশে তাদেরকে খোলা ময়দানে নিয়ে উত্তপ্ত বালুকার উপরে শুইয়ে রেখে প্রতিদিন নানাভাবে নির্যাতন করা হ’ত। একদিন চলার পথে তাদের শাস্তির দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, صَبْرًا آلَ يَاسِر فَإِنَّ مَوْعِدَكُمُ الْجَنَّةُ ‘ধৈর্য ধর হে ইয়াসির পরিবার! তোমাদের ঠিকানা হ’ল জান্নাত’। অবশেষে ইয়াসিরকে কঠিন নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়।[1]
অতঃপর পাষাণ হৃদয় আবু জাহল নিজ হাতে ইয়াসিরের বৃদ্ধা স্ত্রী সুমাইয়ার গুপ্তাঙ্গে বর্শা বিদ্ধ করে তাকে হত্যা করে। তিনিই ছিলেন ইসলামে প্রথম মহিলা শহীদ।[2] অতঃপর তাদের পুত্র ‘আম্মারের উপরে শুরু হয় নির্যাতনের পালা। তাকেও বেলালের ন্যায় কঠিন নির্যাতন করা হয় যতক্ষণ না সে রাসূল (ছাঃ)-কে গালি দিতে রাযী হয়। অবশেষে বাধ্য হয়ে তিনি তাদের কথা মেনে নেন। পরে মুক্তি পেয়েই তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন كََيْفَ تَجِدُ قَلْبَكَ؟ ‘ঐ সময় তোমার অন্তর কিরূপ ছিল’? তিনি বললেন,مُطْمَئِنًّا بِالْإِيْمَانِ ‘ঈমানের উপর অবিচল’। রাসূল (ছাঃ) বললেন إِنْ عَادُوا فَعُدْ ‘যদি ওরা আবার বলতে বলে, তাহ’লে তুমি আবার বল’। তখন নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়,[3] مَنْ كَفَرَ بِاللهِ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلاَّ مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَلَكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِنَ اللهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ ‘ঈমান আনার পরে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কুফরী করে, তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর ক্রোধ এবং কঠিন শাস্তি। কিন্তু যাকে বাধ্য করা হয়, অথচ তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে (তার কোন চিন্তা নেই)’ (নাহল ১৬/১০৬)। ইবনু কাছীর বলেন, সকল বিদ্বান এ বিষয়ে একমত যে, কুফরীতে বাধ্য করা হ’লে বাধ্যকারীর কথামত কাজ করা জায়েয (ইবনু কাছীর)। একমাত্র বেলাল ছিলেন, যিনি তাদের কথা মত কাজ করতেন না, বরং কেবলি বলতেন আহাদ, আহাদ।
পরে হযরত আবুবকর (রাঃ) ‘আম্মার বিন ইয়াসিরকে তার মনিবের কাছ থেকে খরীদ করে মুক্ত করে দেন। ‘আম্মার ঐ সময় আবুবকর (রাঃ)-এর প্রশংসায় যে কবিতা বলেন, তার শুরু ছিল নিম্নরূপ :
جَزَى اللهُ خَيْرًا عَنْ بَلاَلٍ وَصَحْبِهِ + عَتِيْقًا وَأَخْزَى فَاكِهًا وَأَبَا جَهْلِ
‘আল্লাহ উত্তম পুরস্কার দান করুন আবুবকর (রাঃ)-কে বেলাল ও তার সাথীদের পক্ষ হতে এবং লাঞ্ছিত করুন আবু ফাকীহাহ (উমাইয়া বিন খালাফ) ও আবু জাহলকে’।[4]
‘আম্মার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতেন, যে ব্যক্তি ‘আম্মারের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে আল্লাহ তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন’। খালিদ বিন অলীদ (রাঃ) বলেন, এই হাদীছ শোনার পর থেকে আমি সর্বদা তাকে ভালোবাসতাম’।[5] আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ভন্ডনবীদের বিরুদ্ধে ইয়ামামাহর যুদ্ধে তার কান বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওমর (রাঃ) তাকে কূফার গবর্ণর নিযুক্ত করেন। রাসূল (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে,تَقْتُلُهُ الْفِئَةُ الْبَاغِيَةُ ‘তাকে বিদ্রোহী দল হত্যা করবে’ (বুখারী হা/৪৪৭)। ৩৭ হিজরীতে ছিফফীনের যুদ্ধে তিনি আলী (রাঃ)-এর পক্ষে যোগদান করেন এবং শহীদ হন। এসময় তাঁর বয়স ছিল ৯৩ বছর। আলী (রাঃ) তাঁকে গোসল ও কাফন না দিয়েই দাফন করেন।[6]
[2]. আল-ইছাবাহ, সুমাইয়া, ক্রমিক ১১৩৩৬।
[3]. হাকেম হা/৩৩৬২, ২/৩৫৭ পৃঃ সনদ ছহীহ; কুরতুবী হা/৩৯৫৫; বায়হাক্বী হা/১৭৩৫০, ৮/২০৮-০৯ পৃঃ; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা নাহল ১০৬ আয়াত।
[4]. আবু নু‘আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ১/১৪৮; তানতাভী, তাফসীর সূরা লায়েল ১৯-২০ আয়াত, ১৩/২০৪ পৃঃ।
[5]. হাকেম হা/৫৬৭৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৩৮৬।
[6]. আল-ইছাবাহ, ‘আম্মার ক্রমিক ৫৭০৮; আল-ইস্তী‘আব ক্রমিক ১৮৬৩।