লগইন করুন
(১) ধাত্রীমাতা হালীমা সা‘দিয়াহ বলেন, ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় আমার বুকের দুধ শুকিয়ে গিয়েছিল। বাহন মাদী গাধাটির অবস্থাও ছিল করুণ। কেননা এ সময় আরব ভূমিতে দুর্ভিক্ষের বছর চলছিল। ফলে বেশী অর্থ পাবে না বলে ইয়াতীম মুহাম্মাদকে কেউ নিতে চাচ্ছিল না। অবশেষে আমি তাকে নিতে সম্মত হ’লাম। অতঃপর যখন তাকে বুকে রাখলাম, তখন সে এবং আমার গর্ভজাত সন্তান দু’জনে পেট ভরে আমার বুকের দুধ খেয়ে ঘুমিয়ে গেল। ওদিকে উটনীর পালান দুধে ভরে উঠল। যার দুধ আমরা সবাই তৃপ্তির সাথে পান করলাম। তখন আমার স্বামী হারেছ বললেন, ‘হালীমা! আল্লাহর কসম! তুমি এক মহা ভাগ্যবান সন্তান লাভ করেছ’। তারপর বাড়ীতে ফিরে আসার সময় দেখা গেল যে, আমাদের সেই দুর্বল মাদী গাধাটি এত তেযী হয়ে গেছে যে, কাফেলার সবাইকে পিছনে ফেলে সে এগিয়ে যাচ্ছে। যা দেখে সবাই বিস্মিত হয়ে গেল।
(২) বাড়ীতে ফিরে এসে দেখা গেল আমাদের রাখাল যে চারণভূমিতে পশুপাল নিয়ে যেত অন্যান্য রাখালরাও সেখানে তাদের পশুপাল নিয়ে যেত। কিন্তু তাদের পশুগুলো ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফিরত। অথচ আমাদের পশুপাল তৃপ্ত অবস্থায় এবং পালানে দুধভর্তি অবস্থায় বাড়ী ফিরত। এভাবে আমরা প্রতিটি ব্যাপারেই বরকত লক্ষ্য করলাম এবং আমাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এল।[1]
(৩) কা‘বা চত্বরের যে নির্দিষ্ট স্থানটিতে দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব বসতেন, সেখানে তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে কেউ বসতো না। কিন্তু শিশু মুহাম্মাদ ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি এসে সরাসরি দাদার আসনেই বসে পড়তেন। তার চাচারা তাকে সেখান থেকে নামিয়ে দিতে চাইলে দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব তাকে নিজের কাছেই বসাতেন ও গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলতেন,دَعُوا ابْنِي فَوَاللهِ إنَّ لَهُ لَشَأْنًا ‘আমার এ বেটাকে ছেড়ে দাও। আল্লাহর কসম এর মধ্যে বিশেষ কিছু শুভ লক্ষণ আছে’।[2]
উল্লেখ্য যে, ভাতীজার প্রশংসায় পঠিত আবু তালিবের কবিতা,
وَأَبْيَضَ يُسْتَسْقَى الْغَمَامُ بِوَجْهِهِ + ثِمَالَ الْيَتَامَى عِصْمَةً لِلأَرَامِلِ
‘শুভ্র দর্শন (মুহাম্মাদ) যার চেহারার অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করা হয়ে থাকে। সে যে ইয়াতীমদের আশ্রয়স্থল ও বিধবাদের রক্ষক’ যা তিনি পাঠ করেছিলেন মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নবুঅত লাভের পর কুরাইশদের চরম হুমকির সময়। এর মাধ্যমে তিনি মক্কার নেতাদেরকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন এবং বলতে চেয়েছিলেন যে, কোন অবস্থাতেই তিনি মুহাম্মাদকে তাদের দাবী মতে তাদের হাতে ছেড়ে দিবেন না। ইবনু হিশাম বলেন, উক্ত প্রসঙ্গে আবু তালিব ৮০ লাইনের যে দীর্ঘ কবিতা পাঠ করেন, তা আমার নিকটে বিশুদ্ধভাবে এসেছে। তবে কোন কোন বিদ্বান এর অধিকাংশ কবিতা সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন’ (ইবনু হিশাম ১/২৭২-৮০)।
এক্ষণে শিশুকালে তাঁকে নিয়ে চাচা কা‘বাগৃহে গিয়ে তাঁর অসীলায় এই দো‘আ করেছিলেন বলে ত্বাবাক্বাতে ইবনে সা‘দ, বায়হাক্বী দালায়েলুন নবুঅত প্রভৃতি গ্রন্থে যে বর্ণনা এসেছে তার সনদ ‘যঈফ’ (মা শা-‘আ ১৪-১৫ পৃঃ)। বরং মদীনাতে গিয়ে অনাবৃষ্টির সময় লোকদের দাবীর প্রেক্ষিতে জুম‘আর খুৎবায় মিম্বরে দাঁড়িয়ে রাসূল (ছাঃ) বৃষ্টি প্রার্থনা করেছেন এবং সে বৃষ্টিতে মদীনা সিক্ত হয়েছে।[3] রাসূল (ছাঃ)-এর বৃষ্টি প্রার্থনার সময় আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) আবু ত্বালিবের পঠিত উপরোক্ত কবিতার লাইনটি পাঠ করতেন’।[4] ইবনু কাছীর (রহঃ) আবু ত্বালিবের পঠিত দীর্ঘ কবিতাকে বহুবিশ্রুত সাব‘আ মু‘আল্লাক্বার কবিতাসমূহের চাইতে অধিক উত্তম ও সারগর্ভ বলে মত প্রকাশ করেছেন’।[5] জনৈক বেদুঈন ব্যক্তির আবেদনক্রমে রাসূল (ছাঃ) মিম্বরে উঠে আল্লাহর নিকট বৃষ্টি প্রার্থনা করে বলেন, اللَّهُمَّ اسْقِنَا ‘হে আল্লাহ! আমাদের প্রতি বৃষ্টি বর্ষণ কর’। উক্ত হাদীছে এ কথাও রয়েছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, لَوْ كَانَ أَبُو طَالِبٍ حَيًّا لَقَرَّتْ عَيْنَاهُ ‘যদি আজ আবু ত্বালিব বেঁচে থাকতেন, তাহ’লে তার দু’চক্ষু শীতল হয়ে যেত’। অতঃপর তিনি বলেন, কে আমাদেরকে তাঁর সেই কথাগুলি শুনাবে? তখন আলী (রাঃ) দাঁড়িয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সম্ভবতঃ আপনি তাঁর কবিতার সেই কথা বলছেন। যেখানে তিনি বলেছেন, وَأَبْيَضَ يُسْتَسْقَى الْغَمَامُ بِوَجْهِهِ (বায়হাক্বী, দালায়েল হা/২৩৮)। ইবনু হাজার বলেন, وَإِنْ كَانَ فِيهِ ضَعْفٌ لَكِنَّهُ يَصْلُحُ لِلْمُتَابَعَةِ আনাস (রাঃ) বর্ণিত উক্ত হাদীছটির মধ্যে কিছু দুর্বলতা থাকলেও এটিকে সহযোগী হিসাবে গ্রহণ করা যায়’।[6]
উক্ত দীর্ঘ কবিতা সম্পর্কে সীরাতে ইবনে হিশামের ভাষ্যকার আব্দুর রহমান সুহায়লী (মৃ. ৫৮১ হি.) বলেন, আবু তালেব স্বীয় পিতা আব্দুল মুত্ত্বালিবের সময়ে এটা দেখেছেন যে, অনাবৃষ্টিতে কাতর মক্কাবাসীদের জন্য বৃষ্টি প্রার্থনার উদ্দেশ্যে তিনি নারী-পুরুষ সবাইকে নিয়ে কা‘বাগৃহে জমা হন এবং আল্লাহর নিকট বৃষ্টি প্রার্থনা করেন। এ সময় শিশু মুহাম্মাদ তাঁর পাশে ছিল এবং তিনি তাকে কাঁধে তুলে নেন। অতঃপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষিত হয় (ইবনু হিশাম ১/২৮১, টীকা-২)। তবে উক্ত প্রার্থনায় আব্দুল মুত্ত্বালিব উপস্থিত নারী-পুরুষ সকলের দোহাই দিয়েছেন। অতএব উক্ত ঘটনায় মুহাম্মাদের পৃথক বৈশিষ্ট্য প্রমাণিত হয় না।
[2]. ইবনু হিশাম ১/১৬৮; আল-বিদায়াহ ২/২৮১; বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ (ছিন্ন সূত্র) হওয়ায় ‘যঈফ’ (মা শা-‘আ ১০ পৃঃ)। তবে শিশুদের এমন আচরণ এবং তা দেখে মুরববীদের এমন শুভ আশাবাদ ব্যক্ত করার মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই।
[3]. বুখারী, ফাৎহসহ হা/১০২১, ১০২৯; ইবনু হিশাম ১/২৮০ পৃঃ।
[4]. বুখারী, ফাৎহসহ হা/১০০৮, ১০০৯ ‘ইস্তিসক্বা’ অনুচ্ছেদ, ২/৫৭৬ পৃঃ; বায়হাক্বী, দালায়েল হা/২৩৮।
[5]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/৫৭; (قلت: هَذِهِ قَصِيْدَةٌ عَظِيْمَةٌ بَلِيْغَةٌ جِدَّا لاَ يَسْتَطِيْعُ يَقُولَهَا إِلَّا مَنْ نُسِبَتْ إِلَيْهِ، وَهِيَ أَفْحَلُ مِنَ الْمُعَلَّقَاتِ السَّبْعِ، وَأَبْلَغُ فِي تَأْدِيَةِ الْمَعْنَى فيها جَمِيعًا) أَنْ
[6]. ফাৎহুল বারী হা/১০০৮-এর আলোচনা দ্রঃ; মা শা-‘আ ১১-১৫ পৃঃ।