লগইন করুন
এভাবে আমরা বুঝতে পারছি যে, প্রথম হিজরী শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই হাদীস লিখে মুখস্থ করা হতো। মুহাদ্দিসগণ লিখিত পান্ডুলিপি দেখে হাদীস বর্ণনা করতেন, নিরীক্ষা করতেন, বিশুদ্ধতা যাচাই করতেন এবং প্রত্যেকেই তাঁর শ্রুত হাদীস লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে তাঁরা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে লিখিত পুস্তকের রেফারেন্স প্রদান না করে শুধুমাত্র ‘মৌখিক বর্ণনা’র উপর কেন নির্ভর করতেন। তাঁরা কেন (حدثنا، أخبرنا), অর্থাৎ ‘আমাকে বলেছেন’, ‘আমাকে সংবাদ দিয়েছেন’ ইত্যাদি বলতেন? তাঁরা কেন বললেন না, অমুক পুস্তকে এ কথাটি লিখিত আছে... ইত্যাদি?
প্রকৃত বিষয় হলো, সাহাবীগণের যুগ থেকেই ‘পুস্তক’-এর চেয়ে ‘ব্যক্তি’র গুরুত্ব বেশি দেয়া হয়েছে। পান্ডুলিপি-নির্ভরতা ও এতদসংক্রান্ত ভুলভ্রান্তির সম্ভাবনা দূর করার জন্য মুহাদ্দিসগণ পান্ডুলিপির পাশাপাশি বর্ণিত হাদীসটি বর্ণনাকারী উস্তাদ থেকে স্বকর্ণে শ্রবণের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন। এজন্য হাদীস শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে গ্রন্থের বা পান্ডুলিপির রেফারেন্স প্রদানের নিয়ম ছিল না। বরং বর্ণনাকারী শিক্ষকের নাম উল্লেখ করার নিয়ম ছিল। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় (حدثنا، أخبرنا) অর্থাৎ ‘আমাকে বলেছেন’ কথাটির অর্থ হলো আমি তাঁর পুস্তকটি তাঁর নিজের কাছে বা তাঁর অমুক ছাত্রের কাছে পড়ে স্বকর্ণে শুনে তা থেকে হাদীসটি উদ্ধৃত করছি। কেউ কেউ ‘আমি তাঁকে পড়তে শুনেছি’, বা ‘আমি পড়েছি’ এরূপ বললেও, সাধারণত ‘হাদ্দাসানা’ বা ‘আখবারানা’ বা ‘আমাদেরকে বলেছেন’ বলেই তাঁরা এক বাক্যে বিষয়টি উপস্থাপন করতেন।
এ থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, উপরে উল্লিখিত মুয়াত্তা গ্রন্থের সনদটির অর্থ এটাই নয় যে, মালিক আবুয যিনাদ থেকে শুধুমাত্র মৌখিক বর্ণনা শুনেছেন এবং তিনি আ’রাজ থেকে মৌখিক বর্ণনা শুনেছেন এবং তিনি আবূ হুরাইরা থেকে মৌখিক বর্ণনা শুনেছেন। বরং এখানে সনদ বলার উদ্দেশ্য হলো এ সনদের রাবীগণ প্রত্যেকে তাঁর উস্তাদের মুখ থেকে হাদীসটি শুনেছেন, লিখেছেন এবং লিখিত পান্ডুলিপি মৌখিক বর্ণনার সাথে মিলিয়ে নিয়েছেন।
তৃতীয় শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল বুখারী (২৫৬ হি) এ হাদীসটি মুয়াত্তা থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন:
حَدَّثَنَا عَبْدُاللَّهِ بْنُ مَسْلَمَةَ عَنْ مَالِكٍ عَنْ أَبِي الزِّنَادِ عَنِ الأَعْرَجِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ ذَكَرَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَقَالَ فِيهِ سَاعَةٌ لا يُوَافِقُهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ وَهُوَ قَائِمٌ يُصَلِّي يَسْأَلُ اللَّهَ تَعَالَى شَيْئًا إِلا أَعْطَاهُ إِيَّاهُ وَأَشَارَ بِيَدِهِ يُقَلِّلُهَا
আমাদেরকে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসলামা বলেছেন, মালিক থেকে আবুয যিনাদ থেকে, তিনি আ’রাজ থেকে, তিনি আবূ হুরাইরা থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শুক্রবারের কথা উল্লেখ করে বলেন: এ দিনের মধ্যে একটি সময় আছে কোনো মুসলিম যদি সে সময়ে দাঁড়িয়ে সালাতরত অবস্থায় আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করে তবে আল্লাহ তাকে তা প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাত দিয়ে ইঙ্গিত করেন যে, এ সুযোগটি স্বল্প সময়ের জন্য।’’[1]
এখানে ইমাম বুখারী মুয়াত্তা গ্রন্থের হাদীসটি হুবহু উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু তিনি এখানে মুয়াত্তা গ্রন্থের উদ্ধৃতি দেন নি। বরং তিনি ইমাম মালিকের একজন ছাত্র থেকে হাদীসটি শুনেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। বাহ্যত পাঠকের কাছে মনে হতে পারে যে, ইমাম বুখারী মূলত শ্রুতির উপর নির্ভর করেছেন। কিন্তু প্রকৃত বিষয় কখনোই তা নয়। ইমাম মালিকের কাছ থেকে শতাধিক ছাত্র মুয়াত্তা গ্রন্থটি পূর্ণরূপে শুনে ও লিখে নেন। তাঁদের বর্ণিত লিখিত মুয়াত্তা গ্রন্থ তৎকালীন বাজারে ‘ওয়ার্রাক’ বা ‘হস্তলিখিত পুস্তক’ ব্যবসাসীদের দোকানে পাওয়া যেত। ইমাম বুখারী যদি এইরূপ কোনো ‘পান্ডুলিপি’ কিনে তার বরাত দিয়ে হাদীসটি উল্লেখ করতেন তবে মুহাদ্দিসগণের বিচারে বুখারীর উদ্ধৃতিটি দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য বলে গণ্য হতো। কারণ পান্ডুলিপি নির্ভরতার মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের ভুলের সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য ইমাম মালিকের ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্থটি তাঁর মুখ থেকে আগাগোড়া শুনে ও পান্ডুলিপির সাথে মিলিয়ে বিশুদ্ধ পান্ডুলিপি বর্ণনা করতেন যে সকল মুহাদ্দিস ইমাম বুখারী তাঁদের কাছে যেয়ে মুয়াত্তা গ্রন্থটিত স্বকর্ণে শুনেছেন। ইমাম বুখারী তাঁর গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে মুয়াত্তা গ্রন্থের হাদীসগুলো উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু গ্রন্থের উদ্ধৃতি প্রদান করেন নি, বরং যাদের কাছে তিনি গ্রন্থটি পড়েছেন তাদের সূত্র প্রদান করেছেন। যেমন এখানে তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসলামার সূত্র উল্লেখ করেছেন। এখানে তাঁর কথার অর্থ: আমি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসলামার কাছে মুয়াত্তার এ হাদীসটি আমি স্বকর্ণে শুনেছি।
৩য় শতাব্দীর অন্যতম মুহাদ্দিস ইমাম মুসলিমও (২৬২হি) এ হাদীসটি মুয়াত্তা থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন:
حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ عَنْ مَالِكِ بْنِ أَنَسٍ عَنْ أَبِي الزِّنَادِ عَنِ الأَعْرَجِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ ذَكَرَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَقَالَ...
‘‘আমাদেরকে কুতাইবা ইবনু সাঈদ বলেন, মালিক থেকে, আবুয যিনাদ থেকে, তিনি আ’রাজ থেকে, তিনি আবূ হুরাইরা থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শুক্রবারের কথা উল্লেখ করে বলেন: ...’’[2]
এখানে ইমাম মুসলিমও একইভাবে পুস্তকের উদ্ধৃতি না দিয়ে পুস্তকটির বর্ণনাকারীর উদ্ধৃতি প্রদান করছেন।
৫ম শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইমাম বাইহাকী (৪৫৮ হি) তাঁর ‘আস-সুনানুল কুবরা’ নামক হাদীস গ্রন্থে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন:
أَخْبَرَنَا عَلِىُّ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ عَبْدَانَ أَخْبَرَنَا أَحْمَدُ بْنُ عُبَيْدٍ الصَّفَّارُ حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ الْقَاضِى حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ هُوَ الْقَعْنَبِىُّ عَنْ مَالِكٍ عَنْ أَبِى الزِّنَادِ عَنِ الأَعْرَجِ عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ ذَكَرَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَقَالَ...
‘‘আমাদেরকে আলী ইবনু আহমাদ ইবনু আবদান বলেন, আমাদেরকে আহমাদ ইবনু উবাইদ সাফ্ফার বলেন, আমাদেরকে ইসমাঈল কাযী বলেন, আমাদেরকে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসলামা কা’নাবী বলেন, তিনি মালিক থেকে, তিনি আবুয যিনাদ থেকে, তিনি আ’রাজ থেকে, তিনি আবূ হুরাইরা থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শুক্রবারের কথা উল্লেখ করে বলেন: ...।’’[3]
সনদটি দেখে কেউ ভাবতে পারেন যে, ৫ম শতাব্দী পর্যন্ত মুহাদ্দিসগণ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে শুধু মৌখিক বর্ণনার উপর নির্ভর করতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে গ্রন্থকার পর্যন্ত মাঝে ৮ জন বর্ণনাকারী! সকলেই শুধু মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির উপর নির্ভর করেছেন! কাজেই ভুলভ্রান্তির সম্ভাবনা খুবই বেশি!!
কিন্তু প্রকৃত অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইমাম বাইহাকীর এই সনদের অর্থ হলো: ইমাম মালিকের লেখা মুয়াত্তা গ্রন্থটি আমি আলী ইবনু আহমাদ ইবনু আবদান-এর নিকট পঠিত শুনেছি। তিনি তা আহমাদ ইবনু উবাইদ সাফ্ফার-এর কাছে পড়েছেন। তিনি পুস্তকটি ইসমাঈল কাযীর নিকট পাঠ করেছেন। তিনি পুস্তকটি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসলামা কা’নাবীর কাছে পাঠ করেছেন। তিনি মালিক থেকে....। এর দ্বারা তিনি প্রমাণ করলেন যে, তিনি মুয়াত্তা গ্রন্থটি বাজার থেকে ক্রয় করে নিজে পাঠ করে তার থেকে হাদীস সংগ্রহ করেন নি। বরং তিনি মুয়াত্তার পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে এমন একটি ব্যক্তির কাছে তা পাঠ করে শুনেছেন যিনি নিজে গ্রন্থটি বিশুদ্ধ পাঠের মাধ্যমে আয়ত্ত করেছেন... এভাবে শেষ পর্যন্ত। বাইহাকী এ হাদীসটি আরো অনেকগুলো সনদে উল্লেখ করেছেন। সকল সনদেই তিনি মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি মূলত বলেছেন যে, ইমাম মালিকের মুয়াত্তা গ্রন্থটি তিনি বিভিন্ন উস্তাদের কাছে বিভিন্ন সনদে বিশুদ্ধরূপে পড়ে শ্রবণ করেছেন।[4]
এভাবে আমরা দেখছি যে, লিখিত পান্ডুলিপির সাথে মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির সমন্বয়ের জন্য মুহাদ্দিসগণ পান্ডুলিপি বা পুস্তকের বরাত প্রদানের পরিবর্তে শ্রবণের বরাত প্রদানের নিয়ম প্রচলন করেন। তাঁদের এ পদ্ধতিটি ছিল অত্যন্ত সুক্ষ্ম ও বৈজ্ঞানিক। বর্তমান যুগে প্রচলিত গ্রন্থের নাম, পৃষ্ঠা সংখ্যা ইত্যাদি উল্লেখ করে ‘Reference’ বা তথ্যসূত্র দেয়ার চেয়ে এভাবে শিক্ষকের নাম উল্লেখ করে ‘Reference’ দেয়া অনেক নিরাপদ ও যৌক্তিক। তৎকালীন হস্তলিখিত গ্রন্থের যুগে শুধুমাত্র গ্রন্থের উদ্ধৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রন্থ পাঠে ভুলের সম্ভাবনা, গ্রন্থের মধ্যে অন্যের সংযোজনের সম্ভাবনা ও অনুলিপিকারের ভুলের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু গ্রন্থকারের মুখ থেকে গ্রন্থটি পঠিতরূপে গ্রহণ করলে এ সকল ভুল বা বিকৃতির সম্ভাবনা থাকে না।
ইহূদী-খৃস্টানগণ তাঁদের ধর্মগ্রন্থ লিখতেন পান্ডুলিপির উপর নির্ভর করে। এতে বিকৃতি সহজ হয়েছিল। ইহূদী-খৃস্টান পন্ডিতগণ একবাক্যে স্বীকার করেন যে, প্রচলিত বাইবেলের মধ্যে অনেক বিকৃতি বিদ্যমান, যেগুলোকে তাঁরা (erratum): ভুল এবং (Various readings): পাঠের ভিন্নতা বলে অভিহিত করেন।[5] পন্ডিত মিল প্রমাণ করেছেন যে, বাইবেলের মধ্যে এরূপ ত্রিশহাজার ভুল রয়েছে। আর পন্ডিত ক্রিসবাখ প্রমাণ করেছেন যে, বাইবেলের মধ্যে এরূপ একলক্ষ পঞ্চাশহাজার ভুল রয়েছে। আর শোলয-এর মতে এইরূপ বিকৃতি বাইবেলের মধ্যে এত বেশি যে তা গণনা করে শেষ করা যায় না।[6]
এ বিকৃতি ও ভুলের প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে পেরেছিলেন মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির বিষয়ে গুরুত্বারোপের মাধ্যমে।
আমরা আরো দেখছি যে, হাদীস তৃতীয় শতাব্দীতে বা পরবর্তী কালে সংকলিত হয়েছে মনে করাও ভুল। মূলত প্রথম শতাব্দী থেকেই হাদীস সংকলন করা হয়েছে। পরবর্তী সংকলকগণ তাঁদের গ্রন্থে পূর্ববর্তী সংকলকদের সংকলিত পুস্তকগুলো সংকলিত করেছেন। তবে মুহাদ্দিসগণ কখনোই হাদীস বর্ণনার তথ্যসূত্র হিসাবে পান্ডুলিপির উল্লেখ করেন নি। বরং পান্ডুলিপির পাশাপাশি মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির উপরে তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
[2] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৫৮৩।ু
[3] বাইহাকী, আহমাদ ইবনুল হুসাইন (৪৫৮হি.), আস-সুনানুল কুবরা ৩/২৪৯।
[4] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/২৪৯।
[5] T. H. Horne, An Introduction to The Critical Study And Knowledge of The Holy Scriptures 2/325. ; রাহমাতুল্লাহ কিরানবী, ইযহারুল হক ২/৫৪২।
[6] রাহমাতুল্লাহ কিরানবী, ইযহারুল হক্ক ২/৫৪২।