ব্যাংকের সুদ কি হালাল সূচি ও বিবরন শাইখ মুশ্তাক আহমাদ কারীমী
অর্থসংস্থানের বিভিন্ন দিক থেকে ব্যাংকের প্রকারভেদ

বর্তমান বিশ্বে কয়েক প্রকারেরই ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে কিছু ব্যাংক বিশেষ বিশেষ বিভাগে অর্থসংস্থানের কাজ করে থাকে। আর অপর কিছু ব্যাংক সাধারণভাবে অর্থসংস্থানের কাজ করে। এভাবে ব্যাংকসমূহ নিম্নোক্ত প্রকারে বিভক্তঃ-

১- কৃষি উন্নয়নমূলক ব্যাংক (AGRICULTURAL BANK)। এ ব্যাংক কৃষিকার্যের সকল ক্ষেত্রে ঋণ সরবরাহ করে থাকে।

২- শিল্পোন্নয়নমূলক ব্যাংক (INDUSTRIAL BANK)। এর কাজ হল বিভিন্ন শিল্পকর্মের উন্নতিকল্পে ঋণ সরবরাহ করা।

৩- প্রগতিমূলক ব্যাংক (DEVELOMENT BANK)। এ ব্যাংক যে কোনও প্রগতি ও উন্নয়মূলক কাজে ঋণ সরবরাহ করে থাকে।

৪- সমবায় ব্যাংক (CO-OPERATIVE BANK)। এই ব্যাংক পরস্পর সহযোগিতার ভিত্তিতে কায়েম করা হয়। এর কর্মপরিধি কেবল সদস্যদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। যারা এর সদস্য হয় কেবল তাদেরই অর্থ ডিপোজিট থাকে এবং তাদেরকেই ঋণ প্রদান করা হয়ে থাকে।

৫- বিনিয়োগমূলক ব্যাংক (INVESTMENT BANK)। এ ব্যাংকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ডিপোজিট রাখা হয়। সাধারণ কারেন্ট একাউন্ট বা সেভিং একাউন্ট এতে থাকে না; কেবলমাত্র ফিক্সড্ ডিপোজিট থাকে। আর ঋণও নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য প্রদান করা হয়। এর চাইতে কম মেয়াদের জন্য ঋণ দেওয়া হয় না।

উপরোল্লেখিত সকল প্রকার ব্যাংকের কর্ম-পরিধি সীমাবদ্ধ হয়।

৬- বাণিজ্যিক ব্যাংক (COMMERCIAL BANK) । এ ব্যাংক সাধারণ অর্থসংস্থানের কাজ করে থাকে এবং কোন বিশেষ ক্ষেত্র ও বিভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয় না।

৭- রিজার্ভ ব্যাংক (RESERVE BANK)। এটি দেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান; সকল প্রকার বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ এরই তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত। দেশের অর্থ-ব্যবস্থায় এর বড় ভূমিকা থাকে। এই ব্যাংকের বিভিন্ন ফাংশন নিম্নরূপঃ-

ক- এটি হল সরকারী ব্যংক। সরকারের অর্থ এতে জমা রাখা হয়। তবে এ অর্থের উপর সরকারকে সূদ দেওয়া হয় না। প্রয়োজনের সময় সরকারকে ঋণও দিতে থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যাংক মামূলী হারে সূদ গ্রহণ করে থাকে।

খ- রিজার্ভ ব্যাংক সরকারের অর্থনৈতিক পলিসীতে উপদেষ্টার কাজও করে।

গ- রিজার্ভ ব্যাংক জাতীয় মুদ্রা গচ্ছিত রাখে, পুঞ্জীভূত করে এবং প্রয়োজন মত তা জারীও করে।

ঘ- রিজার্ভ ব্যাংকের প্রধান ভূমিকা হল দুটি; প্রথমতঃ সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের এ তত্ত্বাবধান করে এবং উক্ত ব্যাংকগুলোর নিয়ম-শৃঙ্খলা বহাল রাখে; যাতে করে সেগুলো থেকে আর্থিক মুনাফা অর্জন হয় আর লোকসানের সকল দরজা বন্ধ থাকে।

দ্বিতীয়তঃ এই যে, এই ব্যাংক দেশের মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। রাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে এমন পদ্ধতি অবলম্বন করে, যাতে সেই স্ফীতি হরাস পেতে শুরু করে দেয়। আবার মুদ্রার মান অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার পরিস্থিতিতেও এমন উপায় অবলম্বন করে যাতে তা কমতে বাধ্য হয়।

এই মুদ্রার মান হরাস বৃদ্ধির কয়েকটি পদ্ধতি হতে পারে ঃ-

ক- রিজার্ভ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে যে হারে সূদের উপর ঋণ প্রদান করে, সে হারকে ‘ব্যাংক রেট’ বলে। ব্যাংক রেটও মুদ্রাস্ফীতির ক্ষেত্রে প্রভাবশীল হয়। আর তা এইভাবে হয় যে, যখন রিজার্ভ ব্যাংক সূদের হার বেশী করবে, তখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও অতিরিক্ত সূদের ভিত্তিতে ঋণ নেবে। সে জন্য এ ব্যাংকগুলোও ঋণগ্রহীতা জনসাধারণকে অতিরিক্ত সূদের উপরই ঋণ দেবে। যার পরিণাম এই দাঁড়াবে যে, জনসাধারণ ঋণ কম নিতে শুরু করবে। আর যখন লোকেরা ঋণ কম নেবে তখন ব্যাংকের অর্থবৃদ্ধিও কম হবে এবং মুদ্রার আবর্তনও কম হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে রিজার্ভ ব্যাংক সূদের হার কম করলে বাণিজ্যিক ব্যাংকও তার সুদের হার কমিয়ে দেবে। যার ফলে লোকেরা ঋণও বেশী নেবে এবং অর্থ বৃদ্ধিও বেশী হয়ে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।

খ- সরকারের যখন অর্থের প্রয়োজন হয়, তখন তা অর্জন করার নিমিত্তে বিভিন্ন ঋণের দস্তাবিজ জারী করে; যাকে সরকারী তমসুক বলা হয়।

বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ থেকে অর্থ সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে রিজার্ভ ব্যাংক একটি বিল জারী করে; যাকে ইংরাজীতে TREASURY BILL বলে। একটি বিলের লিখিত মূল্য (FACE VALUE) এক শত টাকা হয়। এই বিল সাধারণতঃ ছয় মাসের জন্য জারী করা হয়; তা নিলামের মাধ্যমে বিক্রয় করা হয়, আর কেবল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোই তার প্রাথমিক ক্রেতা হয়ে থাকে।

নিলাম এই পদ্ধতিতে করা হয় যে, রিজার্ভ ব্যাংক ঘোষণা করে দেয় যে, ‘এত টাকা বা দৃষ্টান্তস্বরূপ একশ’ কোটি টাকার ট্রেজারী বিল জারী করা হচ্ছে। প্রত্যেক ব্যাংক তখন বলে, ‘আমি এত মূল্যে একটি বিল ক্রয় করতে চাই।’ আজকাল এর রেট সাধারণতঃ ১৩ অথবা ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার বিল সাধারণতঃ ৮৬ বা ৮৭ টাকায় বিক্রয় হয়। এবারে যে ব্যাংক এই বিল ৮৬ টাকায় ক্রয় করবে সে ছয় মাস পরে তার পুরাপুরি ১০০ টাকা ওসুল করে নেবে। আর ১৪ টাকা তার সূদ অথবা লাভ হবে।

যখন মুদ্রার মান বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হয়, তখন রিজার্ভ ব্যাংক ট্রেজারী বিল স্বল্প মূল্যে বিক্রয় করার প্রবণতা প্রকাশ করে। যার ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংক নিজের পুঁজির বিনিময়ে বিল খরীদ করতে শুরু করে। এভাবে সকল ব্যাংকেরই অর্থ রিজার্ভ ব্যাংকে ফেরৎ আসতে আরম্ভ করে। আর ব্যাংকগুলোতে পুঁজি কম হয়ে যায়। ফলে ঋণ সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে অর্থ-বৃদ্ধির কাজও কমে যায়। ঠিক এর বিপরীত, যদি মুদ্রাস্ফীতি আনার প্রয়োজন হয়, তাহলে রিজার্ভ ব্যাংক ট্রেজারী বিল অতিরিক্ত মূল্যে ক্রয় করার জন্য খোলা বাজারে এসে যায়। লোকেরা তখন নিজেদের বিল বিক্রয় করে রিজার্ভ ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে নেয়। আর এভাবে মুদ্রার পরিমাণ বেড়ে মান কমে যায় এবং মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।

গ- নোট ছেপেও রিজার্ভ ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতির উপর প্রভাবশীল হয়।[1]

৮- আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (INTERNATIONAL MONETARY FUND)t- এ ফান্ড স্থাপিত হয় ১৯৪৮ সালে। যেভাবে একই দেশের কয়েকটি ব্যাংকের একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক (রিজার্ভ ব্যাংক) থাকে, ঠিক সেভাবেই কয়েকটি দেশের রিজার্ভ ব্যাংকের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হল এই সংস্থা (I.M.F)। এটা যেন দুনিয়ার জন্য একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক; যে সত্বর আদায়যোগ্য স্বল্পমেয়াদী ঋণ সকল দেশকে সরবরাহ করে থাকে। কখনো কোন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মজবুত হলেও সাময়িকভাবে কোন ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য নগদ অর্থ তার নিকট নাও থাকতে পারে। এই মুহূর্তে উক্ত সংস্থা এ দেশকে ঋণ সরবরাহ করে থাকে।

উক্ত সংস্থায় প্রত্যেক দেশের জন্য একটা নির্দিষ্ট কোটা (QUOTA) থাকে। ঐ দেশের বাণিজ্যকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে তুলনা করে দেখার পর এই কোটা নির্ধারিত করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয়েছে ১০০ কোটি ডলারের এবং কোন এক দেশের বাণিজ্য হল পাঁচ কোটি ডলারের। তাহলে এই দেশ পাঁচ শতাংশ কোটা অর্জন করতে পারবে।

প্রত্যেক দেশই তার কোটার ২৫ শতাংশ অর্থ আকারে এবং ৭৫ শতাংশ দেশীয় মুদ্রা আকারে ঐ সংস্থায় জমা করে। এইরূপে I.M.F এর নিকট সকল দেশের মুদ্রা জমা হয়ে যায়। I.M.F এ ফান্ড জমা করার পর প্রত্যেক দেশই সেখান থেকে ঋণ নেওয়ার অধিকার লাভ করে। যাকে ইংরাজীতে DRAWING RIGHTS বলে। আবার এই DRAWING RIGHTS এর ভিত্তিতে যে ঋণ পাওয়া যায় তা কয়েক অংশে ভাগ করে নেওয়া হয়। এক একটা ভাগকে বলা হয় TRANCHE । প্রথম ট্রান্চ এ ঋণের ২৫ শতাংশ হয়ে থাকে যা বিনা শর্তে পাওয়া যায় এবং তাতে সূদও কম লাগে। কিন্তু এর পরের ট্রান্চগুলোতে শর্তাবলী এবং বাধ্য-বাধকতাও বেশী, আর এই তুলনায় সূদের অংকও বেড়ে যেতে থাকে।

৯- আন্তর্জাতিক ব্যাংক (INTERNATIONAL BANK FOR RECONSTRUCTION AND DEVELOPMENT)t-

এই ব্যাংকের সংক্ষিপ্ত নাম হল বিশ্বব্যাংক (WORLD BANK) এবং বর্তমানে উক্ত নামেই পরিচিত ও প্রসিদ্ধ। এই ব্যাংক এবং ‘আই এম এফ’ এর মাঝে পার্থক্য এই যে, ‘আই এম এফ’ স্বল্প-মেয়াদী ঋণ প্রদান করে; যার মেয়াদ বড়জোর তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক দীর্ঘমেয়াদী ঋণদান করে থাকে; যার মেয়াদ পনের থেকে ত্রিশ বছর হয়। প্রতিষ্ঠা লাভের পর শুরুর দিকে এই ব্যাংক বিভিন্ন কর্ম-প্রকল্প (PROJECTS) বাস্তবায়নার্থে ঋণ দিয়েছিল। যেমন, সেতুনির্মাণ, রাজপথ নির্মাণ প্রভৃতি। অতঃপর ১৯৬০ সালের পর থেকে সাধারণ ঋণ দিতেও আরম্ভ করল। বর্তমানে এই ব্যাংক পলিসি-নির্মাতা ঋণও দান করে থাকে; অর্থাৎ এই বলে যে, যদি তুমি তোমার দেশের পলিসি (শাসন-প্রণালী বা কূটনীতি) এরূপ বানাও, তাহলে তোমাকে এত ঋণ দেওয়া হবে।

[1] (ইসলাম আওর জাদীদ মাঈশাত ও তিজারাত দ্রষ্টব্য।)